শমীক লাহিড়ী
১
বেনিটো মুসোলিনি বা অ্যাডলফ হিটলারের সময় যদি সোশ্যাল মিডিয়া অথবা কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা থাকত তাহলে কি হতো! জার্মানির বিজয় গৌরব গাথা এবং ইহুদি অথবা কমিউনিস্ট বিদ্বেষ মানুষের মনের গভীরে ঢুকিয়ে দিতে কী ধরনের ‘রিল’ বানাতেন গোয়েরিং এবং গোয়েবেলস! মুসোলিনি কেমনভাবে কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তাকে (এআই) কাজে লাগাতেন তার অসত্য প্রচারের জন্য সেটা ভাবার বিষয়! তবে একথা নিঃসন্দেহে বলা যায়- আরএসএস-বিজেপি’র আইটি সেল অথবা আরএসএস-বিজেপি পোষিত সংবাদমাধ্যম এবিষয়ে হিটলার ও মুসোলিনির উপযুক্ত শিক্ষক হতে পারত।
১৯৩৩ সালে হিটলার যখন জার্মানির ক্ষমতায় এলেন, তখন তিনি একটা নতুন দপ্তর তৈরি করেছিলেন, যার নাম দিয়েছিলেন জনশিক্ষা ও প্রচার মন্ত্রক (Reich Ministry of Public Enlightenment and Propaganda)। তিনি জোসেফ গোয়েবলসকে এই দপ্তরের প্রধান করেছিলেন। গোয়েবলসের কাজ ছিল ছবি, গান, নাটক, সিনেমা, বই, রেডিয়ো আর খবরের কাগজের মাধ্যমে হিটলারের কথা আর দলের আদর্শকে মানুষের কাছে পৌঁছে দেওয়া। এই সবকটি প্রচারমাধ্যমকে এক জায়গায় এনে ভালোভাবে চালানো এবং সংস্কৃতি, শিক্ষা আর খবরের উপর কড়া নজর রাখার কাজ করত এই দপ্তর।
যারাই হিটলারের দলের বিরুদ্ধে কথা বলতেন, তাদের মুখ বন্ধ করার জন্য খুব কঠিন নিয়ম তৈরি করা হয়েছিল। শুরুতে গুপ্ত হত্যা, পরে ফায়ারিং স্কোয়াডের সামনে দাঁড় করিয়ে হত্যা করা হতো। কিন্তু গুলি করে মারার খরচ অনেক বেশি, তাই কম খরচে হত্যার জন্য হিটলার গ্যাস চেম্বারের ব্যবস্থা করেছিলেন। আইজি ফারবেন (IG Farben) নামে একটি জার্মান রাসায়নিক ও ওষুধ প্রস্তুতকারক জোটের অংশ ছিল এরা। এই আইজি ফারবেন জোটের একটি শাখা ডেগেশ-এর (Deutsche Gesellschaft für Schädlingsbekämpfung mbH) তৈরি গ্যাস ব্যবহার করা হতো ‘গ্যাস চেম্বারে’। বেয়ার কোম্পানিও আইজি ফারবেনের অংশ হিসেবে সেই গ্যাস উৎপাদনে পরোক্ষভাবে জড়িত ছিল। টেসচ্ অ্যান্ড স্টাবেনো (Tesch und Stabenow) কোম্পানিও এই কাজ করত। এই গ্যাসটির বাণিজ্যিক নাম ছিল জাইক্লোন বি (Zyklon B)। এটি মূলত হাইড্রোজেন সায়ানাইড ভিত্তিক একটি কীটনাশক ছিল, যা নাৎসি কনসেনট্রেশন ক্যাম্পগুলোতে মানুষ হত্যার জন্য ব্যবহার করা হতো। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সময় আইজি ফারবেন নাৎসি জার্মানির একটি গুরুত্বপূর্ণ অংশ ছিল এবং কনসেনট্রেশন ক্যাম্পগুলোতে বন্দি শ্রমিকদের বিনা পারিশ্রমিকে কাজ করানো, বন্দিদের দেহে নিষ্ঠুর পরীক্ষা চালানো সহ যুদ্ধ সামগ্রী উৎপাদনে তাদের গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা ছিল। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পর এই গ্যাস সরবরাহের সাথে জড়িত থাকার অভিযোগে টেসচ্ ও স্টাবেনো’র দু’জন পরিচালককে ব্রিটিশ সামরিক আদালতে ফাঁসির আদেশ দেওয়া হয়েছিল। ডেগেশের পরিচালককে প্রথমে কারাদণ্ড দেওয়া হলেও পরবর্তীতে তিনি মুক্তি পেয়ে পান।
সে সময়ে বিজেপি-র আইটি সেল থাকলে এত কাঠখড় পোড়াতে হতো হিটলারকে? এত চমক-ধমক-হত্যা কিছুরই দরকার পড়ত না ছবি, গান, নাটক, সিনেমা, বই, রেডিয়ো, খবরের কাগজওয়ালাদের বাগে আনতে। মোদি’র আদানি-আম্বানি’র মতো হিটলারেরও অনেক করপোরেট বন্ধু ছিল, যাদের অর্থে তিনি, তার দল ও নাৎসিদের এত বাড়বাড়ন্ত ছিল। কয়েকজন বিক্রি হলেও কিন্তু সব সংবাদ মাধ্যম, চলচ্চিত্রকার, লেখক, শিল্পী, বৈজ্ঞানিক সেই সময়ে বিক্রি হননি। অনেকেই অবিক্রিত ছিলেন। কিন্তু মোদি’র কপাল চওড়া। দেশের প্রায় সব মূল সংবাদ মাধ্যম আদানি, আম্বানি বা মোদি ঘনিষ্ঠ করপোরেটের হাতে বিক্রিত এবং তাই বিকৃত খবর পরিবেশন করে দেশের মানুষের ঘরের মধ্যেই তার মাথার চেম্বারে ঢুকে পড়ছে এরা। গ্যাস চেম্বারে আজকের যুগে আর কাউকে ঢোকাতে হয় না।
পাড়ায় পাড়ায় ব্ল্যাক শার্ট, ব্রাউন শার্টের গুপ্তচরদের পাঠিয়ে মানুষের মনের খবর জানতে হতো নাৎসিদের ইতালি বা জার্মানিতে। যদি মোদি’র মতো জুখেরবার্গ মার্কা একজন কাউকে জোগাড় করতে পারতেন হিটলার বা মুসোলিনি, তাহলে খরচা করে এত গুপ্তচর পোষার দরকারই পড়ত না। ‘মারীচ সংবাদ’ নাটকে বিপ্লব কেতন চক্রবর্তীর গলায় একটা অসাধারণ গান ছিল —
‘নিশীথ রাতে প্রিয়ার কাছে
কোন কথাটি কও,
ঘুমের মাঝে স্বপ্নরাজ্যে
কোথায় তুমি যাও।
মাটিতে পা আছে কিংবা
শূন্যেতে রও ভাসিয়া।
সব জানতে পারবে
সিয়ার কাছে –
সিয়া সিয়া সিয়া’ (CIA)।
এখন বিজেপি আইটি সেল আর ওদের পোষা সংবাদমাধ্যমের মালিকরা বলেন — সব জানতে পারবে/ ফেসবুকের কাছে, তার কাছেই যাও।
২
পহেলগামে ২২ এপ্রিল নৃশংস বর্বরোচিতভাবে নিরস্ত্র ২৬ জনকে ধর্ম জিজ্ঞাসা করে হত্যা করল পাক মদতপুষ্ট সন্ত্রাসবাদীরা। স্বজন হারানোর চোখের জলের জলেই প্রতিশোধের আগুন জ্বলেছিল ১৪০ কোটি ভারতবাসীর। জম্মু-কাশ্মীর থেকে কন্যাকুমারিকা জাতি-ধর্ম-বর্ণ-ভাষা-লিঙ্গ নির্বিশেষে মানুষ চেয়েছিল সন্ত্রাসবাদীদের খতম করুক সরকার। সব মানুষ দেখতে চেয়েছিল লড়াইটা হোক সন্ত্রাসবাদ আর তার মদতদাতাদের বিরুদ্ধে। উড়িয়ে দেওয়া হোক ওদের সব ঘাঁটি, তা সে সীমান্তের এপারেই হোক বা ওপারেই। ভারতবাসীর জীবনে অনেক যন্ত্রণা আছে — কাজ নেই, শিক্ষা নেই, চাষির ফসলের দাম নেই, মজুরি বাড়ে না কিন্তু জিনিসের দাম বাড়তেই থাকে। কিন্তু সব যন্ত্রণা বুকে চেপে রেখেই দেশের মানুষ পহেলগামের নিরীহ নিরপরাধ মানুষের রক্তস্রোতের বিহিত দেখতে চেয়েছিল। তাই দেশের সব রাজনৈতিক দল এককাট্টা হয়ে সরকারকে সন্ত্রাসবাদ বিরোধী যে কোনো পদক্ষেপ গ্রহণের জন্য দু’হাত তুলে সমর্থন জানিয়েছিল উদার চিত্তে।
কিন্তু আরএসএস-বিজেপি-হিন্দুত্ববাদীদের মাথায় তখন ঘুরছে, এই সুযোগে মুসলিম বিদ্বেষ তুঙ্গে তুলে, হিন্দুত্ববাদের বিভাজনের রাজনীতিকে চ্যাম্পিয়ন করার প্যাঁচ-পয়জার। সন্ত্রাসবাদীদের বিরুদ্ধে নয়, মুসলমান বিদ্বেষ ছড়াতে উঠেপড়ে লেগে গেল বিজেপি’র আইটি সেল আর এদের পোঁ ধরা করপোরেট সংবাদমাধ্যম। শুরু হয়ে গেল অর্ধসত্য-অসত্যের মিশ্রণে তৈরি মনগড়া গল্প কাহিনির খিচুড়ি। দেশের মানুষ যখন এককাট্টা হয়ে দেখতে চাইছে, প্রধানমন্ত্রী সম্পূর্ণ মনোনিবেশ করুন একাজে নিজের সরকারকে নিয়ে, সব রাজনৈতিক দলকে নিয়ে, দেশের সব মানুষকে নিয়ে, তখন তিনি সর্বদল বৈঠকে না এসে চলে গেলেন বিহারে দলের নির্বাচনী প্রচারে, বিদ্বেষ-বিভাজনের বিষ ঢালতে। সরকারের কাজ দেশের সংকটে সব মানুষকে ঐক্যবদ্ধ করা, নাকি, দেশের অভ্যন্তরে মানুষকে বিভক্ত করে, দেশকে দুর্বল করা? সেদিনই বোঝা গিয়েছিল কী চায় আরএসএস-বিজেপি।
এবার তোলা হলো যুদ্ধ জিগির। সেনাবাহিনী, বিদেশমন্ত্রক কিন্তু সতর্ক। তাঁরা অর্জুনের পাখির চোখ দেখার মতো শুধুই খুঁজছে সন্ত্রাসবাদের ঘাঁটি, সীমানার এপারে বা ওপারে। অবশেষে ৭ মে ভারতের মানুষ সদ্য ঘুমভাঙা চোখে দেখল শুরু হয়ে গেছে সন্ত্রাসবাদীদের ঘাঁটি ধ্বংসের কাজ। ৭ মে দুপুর ১২টা ৩০ মিনিট। সংবাদমাধ্যমের সামনে এলেন লেফটেন্যান্ট জেনারেল রাজীব ঘাই, ডিরেক্টর জেনারেল অফ মিলিটারি অপারেশনস্ (DGMO)। সাথে ভারতীয় সেনাবাহিনীর সিগন্যাল কোরের কর্নেল সোফিয়া কুরেশি এবং বায়ুসেনার উইং কমান্ডার ব্যোমিকা সিং। সরকারের অবস্থান ব্যাখ্যা করার জন্য বিদেশসচিব বিক্রম মিসরিও ছিলেন। তাঁরা স্পষ্ট জানিয়ে দিলেন ২৬টি সন্ত্রাসবাদী ঘাঁটি, যা পাকিস্তানে ছিল ধ্বংস করা হয়েছে রাত ১টা ০৫ থেকে ১টা ৩০ মিনিটের মধ্যে, মাত্র ২৫ মিনিটে। ছোট্ট সাংবাদিক সম্মেলন, স্পষ্ট কথায় জানিয়ে দিলেন — চলবে এই কাজ, থামবে না। দুই নারী যাঁরা ধর্মে হিন্দু ও মুসলিম, কিন্তু তাঁদের পরিচয় একটাই সন্ত্রাসবাদের বিরুদ্ধে আপোষহীন দুই ভারতীয় সেনা।
কিন্তু মহা বিপদে পড়ে গেল আইটি সেল। মুসলিম বিদ্বেষের জিগির তোলার গোড়ায় বোম মেরে চলে গেলেন দুই ভারতীয় সেনা অফিসার ব্যোমিকা আর সোফিয়া। কী হবে! মাথায় হাত ভক্তকুলের। এগিয়ে এলো ভক্তদের ভরসা সেই পোষ্য সংবাদ মাধ্যম। সেনা যাই বলুক, যুদ্ধ হবে তো টিভি’র স্টুডিয়োতে আর পোষা কলমচি’র কলমে। লাগাও যুদ্ধ, নাগপুর বাহিনী লড়বে, গুলি মারো সেনাবাহিনীর। সেনা বাহিনী না হয় নাই বা দখল করল করাচি, টিভি’র খবরেই দখল করে ফেলো। লাহোরে ফেলো বোমা, স্টুডিয়োতে বসেই। এত পয়সা দিয়ে সফটওয়্যার কেনা হয়েছে, বানাও ভিডিয়ো। শরীরের সব অ্যাড্রিনালিন হরমোন ছোটাও মিসাইলের গতিতে। রাত বাড়লে কোনো টিভি’র দর্শক যাতে উত্তেজনার অভাবে ঘুমিয়ে না পড়েন, তাই তাজা রাখো তাঁদের মস্তিষ্কের সবকটা নিউরোট্রান্সমিটারকে। নামিয়ে ফেলো গোটা তিনেক পাকিস্তানি ফাইটার জেটকে, দরকারে স্টুডিয়ো’র মাথায় লাগাও গোটা কয়েক এস-৪০০ ক্ষেপণাস্ত্র। রাশিয়ার বানানো, তাতে কি! নাম দিয়ে দাও ‘সুদর্শন চক্র’, বেশ হিন্দু হিন্দু ব্যাপারটাও আসে এতে, আর, ৭ নম্বর লোক কল্যাণ মার্গ, নতুন দিল্লির বাংলোয় থাকা মোদিজিকে ‘শেষনাগ শয্যা’য় শুয়ে থাকা বিষ্ণুর অবতার বলে চালানোতেও কাজে লাগবে।
৩
গোদি মিডিয়ার যুদ্ধের কিছু বিবরণ
৮ মে রাতে ভয়ংকর উত্তেজিত স্প্যানিয়াল বুলের মতো কিছু টিভি’র সঞ্চালক ঘোষণা করে দিলেন, করাচি বন্দর ধ্বংস করে দিয়েছে আইএনএস বিক্রান্ত, সীমান্ত পেরিয়ে পাকিস্তানে ঢুকে পড়েছে ভারতের সেনা, ট্যাঙ্ক। একসঙ্গে লাহোর, ইসলামাবাদ সহ বিভিন্ন শহরে ভারত হামলা করেছে। পাকিস্তানের অর্ধেক প্রায় মাটিতে মিশে গেছে ইত্যাদি ইত্যাদি।
৯ মে, শুক্রবার প্রতিরক্ষা মন্ত্রক বিবৃতি প্রকাশ করে বলতে বাধ্য হয় সমস্ত সংবাদমাধ্যমকে, ‘যে কোনো প্রতিবেদনের ক্ষেত্রে সতর্ক, সংবেদনশীল এবং দায়িত্বশীল হওয়ার অনুরোধ করা হচ্ছে’।
আরএসএস-বিজেপি আইটি সেল এগিয়ে গেল কয়েকধাপ। ৮ মে রাত থেকেই শুরু হয়ে গেল ভুয়ো খবরের বন্যা। কোথাও ইজরায়েল-হামাস সংঘর্ষ, কোথাও রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধ, কোথাও বা রাশিয়ার পুরোনো কোনো অগ্নিকাণ্ডের দৃশ্যকে ভারত-পাক যুদ্ধের দৃশ্য বলে ছড়িয়ে দেওয়া হলো। আবার কোনো ভিডিয়ো ফুটেজ না পেয়ে, বিভিন্ন থ্রি-ডি ভিডিয়ো গেমের দৃশ্য তুলে সেগুলিকেই যুদ্ধের দৃশ্য বলে চালিয়ে দেওয়া হলো। কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তার সাহায্যে তৈরি করা হলো ‘ডিপ ফেক’ ভিডিয়ো। সোশ্যাল মিডিয়ায় ছড়িয়ে-পড়া এই সমস্ত ভিডিয়ো’র সত্যতা যাচাই না করে, ‘এক্সক্লুসিভ ফুটেজ’ বলে প্রচার শুরু করল করপোরেট মিডিয়া, সাথে সঞ্চালকের গগনবিদারি তীব্র চিৎকার, ডেসিবেলের মাপে যা রাফায়েলের আওয়াজকেও ছাপিয়ে গিয়েছিল।
আবারও প্রতিরক্ষা মন্ত্রকের পক্ষ থেকে ৯ মে বলা হলো, ‘‘বিভিন্ন মিডিয়া চ্যানেল, ডিজিটাল প্ল্যাটফর্ম এবং ব্যক্তিবিশেষকে বলা হচ্ছে, যুদ্ধ পরিস্থিতি কিংবা সেনার কার্যকলাপ নিয়ে তাৎক্ষণিক প্রতিবেদন থেকে বিরত থাকুন। এই ধরনের স্পর্শকাতর ভিডিয়ো বা তথ্য সংবাদমাধ্যমে প্রকাশ করে দিলে আমাদের সামরিক বাহিনীর কাজে বিঘ্ন ঘটবে এবং বহু মানুষের প্রাণ বিপন্ন হবে। তার ফলাফল কী হতে পারে তা অতীতে কার্গিল যুদ্ধ, ২৬/১১’র মুম্বাই হামলা কিংবা কান্দাহার বিমান হাইজ্যাকের ঘটনায় আমরা দেখেছি। কেবল টেলিভিশন নেটওয়ার্ক (সংশোধনী) নিয়মবিধি অনুযায়ী, শুধুমাত্র সরকারিভাবে দায়িত্বপ্রাপ্ত আধিকারিকরা এই ধরনের সেনা অভিযান নিয়ে বিবৃতি দিতে পারেন। সমস্ত সংবাদমাধ্যমকে যে কোনো খবরের ক্ষেত্রে সতর্ক, সংবেদনশীল এবং দায়িত্বশীল হওয়ার অনুরোধ করা হচ্ছে।’’
পাক সেনা প্রধানকে গ্রেপ্তার করে তাঁকে সরিয়ে দেওয়া হচ্ছে বলে ৮ মে রাত থেকে ‘জি নিউজ’, ‘এবিপি নিউজ’, ‘রিপাবলিক ভারত’ এবং তাদের বাংলা সংস্করণ সহ বিভিন্ন বিজেপি ঘনিষ্ঠ টিভি চ্যানেলে দাবি করা হলো। তারই সঙ্গে বালুচিস্তানের বিচ্ছিন্নতাবাদীরা পাক সেনার বিরুদ্ধে যুদ্ধ শুরু করে রাতের মধ্যেই কোয়েটা শহর দখল করে ফেলবে বলে খবরও দেয় গোদি মিডিয়া।
রাত ১১টা নাগাদ ভারতীয় নৌসেনা করাচি বন্দরে হামলা করেছে বলে বিভিন্ন ইংরেজি, হিন্দি ও আঞ্চলিক ভাষার খবরের চ্যানেলে দাবি করা হয়। এই মনগড়া তথ্যকে আরও বিশ্বাসযোগ্য করতে এ বছরের ফেব্রুয়ারি মাসে আমেরিকার ফিলাডেলফিয়া শহরের এক বিমান দুর্ঘটনার ছবি শেয়ার করে সংবাদ মাধ্যম ‘এবিপি আনন্দ’। ‘ভারতের হামলার পর করাচি বন্দরের দৃশ্য’ বলে সেটিকে দাবি করে এগিয়ে থাকা, এগিয়ে রাখা চ্যানেল। জম্মু কাশ্মীরের রাজৌরির সেনাঘাঁটিতে ৮ মে রাতে পাক সেনা আত্মঘাতী আক্রমণ করেছে বলে দাবি করে ‘আজতক নিউজে’র এক ‘জানেমানে’ সাংবাদিক।
কিন্তু ভক্তকুল, গোদি মিডিয়া, আইটি সেল-এর যৌথ বাহিনীর প্রযোজিত এসব মিথ্যাচার, লোকঠকানো কারবারের ঢোল ফেঁসে যায় ভোরের আলো ফোটার আগেই। পরের দিন সকালের মধ্যেই জানা যায়, এসব খবরের একটারও ন্যূনতম সত্যতা বা ভিত্তি নেই। বাংলায় কথা আছে, এককান কাটা রাস্তার একধার দিয়ে দিয়ে যায়, দু’কান কাটা যায় রাস্তার মাঝ বরাবর। এই ‘যৌথ প্রবঞ্চক বাহিনী’র নাক-কান দুই কাটা গেলেও উৎসাহে ভাটা পড়েনি।
গত মার্চে মুম্বাইয়ের ধারাভি বস্তিতে তেলের ট্যাঙ্ক বিস্ফোরণের ভিডিয়োকে পাকিস্তানের শিয়ালকোট শহরে ভারতের ক্ষেপণাস্ত্র হানার ফুটেজ বলে দাবি করা হয় এই জালিয়াতদের তরফে। শিয়ালকোটে ভারতের ক্ষেপণাস্ত্র হামলার আরও কয়েকটি ভিডিয়ো প্রচার করে গোদি মিডিয়া। তবে প্রায় সাথেসাথেই জানা যায়, এই ফুটেজ ২০২১-এ গাজায় ইজরায়েলের হামলার দৃশ্য।
এছাড়াও আরও বিভিন্ন হামলা ও প্রত্যাঘাতের অসংখ্য ভুয়ো ফুটেজ ৮-৯ মে, এই দু’দিন ধরে সোশ্যাল মিডিয়ায় ছড়ানো হয়েছে। ভারতে ধৃত পাক বায়ুসেনার পাইলটের একটি ভিডিয়ো ভাইরাল হয়। পরে জানা যায়, এটি ১৫ এপ্রিল, ২০২৫ পাক বায়ুসেনার অনুশীলন চলাকালীন বিমান দুর্ঘটনায় এক আহত পাইলটের ছবি ও ভিডিয়ো, সাম্প্রতিক ঘটনাবলির সঙ্গে যার কোনো সম্পর্ক নেই। আরেকটি ভিডিয়োকে ভাইরাল করা হয় যেখানে দেখা যাচ্ছে, পাক সেনার এক মুখপাত্র বলছেন, হামলা করতে আসা পাক বায়ুসেনার দুটি জেএফ-১৭ যুদ্ধবিমানকে ভারত গুলি করে নামিয়েছে। পরে জানা যায়, এটা এআই দিয়ে তৈরি একটি ‘ডিপ ফেক ভিডিয়ো’। ভারতের ‘এয়ার ডিফেন্স সিস্টেম’ পাক বায়ুসেনার এক এফ-১৬ যুদ্ধবিমানকে মাটিতে নামতে বাধ্য করেছে বলেও অনেক সংবাদমাধ্যমে দাবি করা হয়। তার একটি ভিডিয়ো ভাইরালও করা হয়। পরে জানা যায়, সেটি ‘আর্মা-থ্রি’ নামের একটি ভিডিয়ো গেমের দৃশ্য। পাকিস্তানের কোনো এফ-১৬ বিমান ধ্বংস করা হয়েছে, এমন দাবি আজ পর্যন্ত ভারতীয় সেনার তরফে করা হয়নি। এতে ক্ষিপ্ত হয়ে আরএসএস-বিজেপি বাহিনী এখন বিদেশ সচিব আর কর্নেল সোফিয়া কুরেশিকে সন্ত্রাসবাদী তকমা দিতে উঠেপড়ে লেগেছে।
কত উদাহরণ আর দেওয়া যায়! সমগ্র ভূপৃষ্ঠকে পাতা হিসাবে ব্যবহার করে, এভারেস্টের চূড়াকে কলম আর বঙ্গোপসাগরের সমগ্র জলরাশিকে কালি হিসাবে ব্যবহার করলেও, এ যুগের ফ্যাসিবাদী আরএসএস-বিজেপি-হিন্দুত্ববাদীদের এই মিথ্যাচারের ভগ্নাংশকেও তুলে ধরা যাবে না। হিটলার-মুসোলিনি কবর থেকেই বোধহয় বলছেন, ‘গোদি মিডিয়া তুস্সি গ্রেট হো’।
তবে ট্রাম্পের এক ধমকেই ৫৬ ইঞ্চির ছাতি তোবড়ানো অ্যালুমিনিয়ামের বাটি হয়ে গেছে!
ব্যবহৃত ছবিঃ সোশ্যাল মিডিয়া সুত্রে সংগৃহীত