দেশে ধর্মঘট হচ্ছেই...

সাধারণ ধর্মঘট হচ্ছেই। শ্রমমন্ত্রীকে স্পষ্ট ভাষায় জানিয়ে দিয়ে এলেন ট্রেড ইউনিয়ন নেতারা। বৃহস্পতিবার শ্রমমন্ত্রী সন্তোষ গাঙ্গোয়ার ডেকেছিলেন কেন্দ্রীয় ট্রেড ইউনিয়নগুলিকে। ধর্মঘট না করার জন্য আরজি জানালেও কোনও দাবিই মানতে চাননি তিনি। নিছক রুটিনমাফিক বৈঠক করেন। কেন্দ্রের মনোভাবে ক্ষুব্ধ শ্রমিক নেতারা বৈঠকেই মন্ত্রীকে জানান শ্রমজীবী মানুষের দাবিদাওয়া নিয়ে কেন্দ্রের মনোভাব শুধু গা-ছাড়াই নয়, মানুষের স্বার্থবিরোধী। শ্রমিক সংগঠনগুলি ন্যূনতম মজুরি, সকলের জন্য পেনশন, লেবার কোডের নামে শ্রমিকদের সুরক্ষা প্রত্যাহারের সিদ্ধান্ত বাতিল, সমকাজে সমমজুরি, ঠিকা শ্রমিকদের সুরক্ষা, রাষ্ট্রায়ত্ত ক্ষেত্রের বিলগ্নি বন্ধের যে দাবি তুলেছে তা নিয়ে কেন্দ্রের তরফে কোনও ইতিবাচক সাড়া পাওয়া যায়নি। সুতরাং ধর্মঘট হচ্ছেই।

বৃহস্পতিবার সিআইটিইউ নেতা তপন সেন বৈঠকের পরে বলেন, শ্রমমন্ত্রীর কোনও ক্ষমতাই নেই। প্রধানমন্ত্রীর মাথা ঘামানোর বিষয়ে তিনি কী করবেন? সংবেদনহীন একটা সরকার। আমরা ক্ষুব্ধ। কেন্দ্রকে জানিয়ে দিয়েছি ধর্মঘট হচ্ছেই।

এদিন বৈঠকের শুরুতে শ্রমমন্ত্রী বলেন, শ্রমিকদের কল্যাণে সরকার সব ব্যবস্থাই নিচ্ছে। শ্রম বিধি তার অঙ্গ। বৈঠকে উপস্থিত ট্রেড ইউনিয়ন নেতারা জোরের সঙ্গে মন্ত্রীর বিবৃতির প্রতিবাদ করেন। তাঁরা  বলেন, শ্রম বিধি শ্রমিকদের ওপরে দাসত্ব চাপিয়ে দেবার নকশা। এর কাছে শ্রমিক আন্দোলন আত্মসমর্পণ করবে না।

মন্ত্রীকে শ্রমিক নেতারা বলেন, ধারাবাহিক ভাবে শ্রমিক আন্দোলন যে বিষয়গুলি তুলে ধরছে তার একটি নিয়েও সরকারের কোনো প্রত্যুত্তর নেই। ২০১৫-র পরে ত্রিপাক্ষিক ভারতীয় শ্রম সম্মেলনও ডাকেনি সরকার। এই অবস্থায় ধর্মঘট হবেই। এদিন মন্ত্রীর সঙ্গে বৈঠকের পরে সিআইটিইউ, আইএনটিইউসি, এআইটিইউসি, এইচএমএস, এআইইউটিইউসি, টিইউসিসি, এআইসিসিটিইউ, ইউটিইউসি, এলপিএফ, সেওয়ার পক্ষ থেকে যৌথ বিবৃতিতে বলা হয়েছে, কৃষক সহ জনগণের অন্যান্য অংশের সমর্থন নিয়ে ধর্মঘট ব্যাপক চেহারা নিতে চলেছে।

সংশোধিত নাগরিকত্ব আইনের বিরুদ্ধে দেশব্যাপী বিক্ষোভ সাধারণ ধর্মঘটের প্রস্তুতিতে বাড়তি মাত্রা জুগিয়েছে, মনে করছেন এই ধর্মঘটের মূল আহ্বায়ক কেন্দ্রীয় ট্রেড ইউনিয়ন নেতারাও। মুখ্যত অর্থনৈতিক দাবিকে সামনে রেখে এই ধর্মঘট ডাকা হয়েছিল গত সেপ্টেম্বরে। রুটি রুজির জরুরি দাবির সঙ্গে তখনও ছিল বিভাজনের শক্তিকে রুখে দেবার আহ্বান। কিন্তু প্রথমে এনআরসি, পরে সংসদে সংশোধিত নাগরিকত্ব আইন পাশ হয়ে যাবার পরে জন-অসন্তোষকে নতুন মাত্রা দিয়েছে কোথাও স্বতঃস্ফূর্ত কোথাও সংগঠিত প্রতিবাদ। দুই স্রোত মিশে যাচ্ছে। স্বাধীন ভারতের বৃহত্তম ধর্মঘট হতে চলেছে ৮ জানুয়ারি।

তপন সেন বলেছেন, গত বছরের থেকেও অনেক বড় আকার নিতে চলেছে এই ধর্মঘট। বিশেষ করে সিএএ-এনআরসি নিয়ে কেন্দ্রের পদক্ষেপের পরে ধর্মঘটের প্রস্তুতিতে বাড়তি গতি সঞ্চারিত হয়েছে। এই গণবিক্ষোভ ধর্মঘটের পরিসর বাড়িয়ে দিয়েছে।

বিশেষ করে ট্রেড ইউনিয়নগুলি দীর্ঘদিন ধরেই কেন্দ্রের অর্থনৈতিক নীতির বিপজ্জনক ফলাফল হবে বলে আশঙ্কা প্রকাশ করছিল। গত বছরের দ্বিতীয়ার্ধ থেকে তা প্রকট সত্য হিসাবেই প্রমাণিত হয়েছে। অর্থনীতি মন্দার কবলে পড়েছে। আইএনটিইউসি সভাপতি জি সঞ্জীব রেড্ডি বলেছেন, আমরা যা বলছিলাম তা ২০১৯-এ সকলেই দেখতে পাচ্ছেন। মোদী সরকারের নীতিতে এক কোটির বেশি লোক গত বছরেই কাজ হারিয়েছেন। অর্থনীতির মন্দা চলছেই। রেড্ডির বক্তব্য, এই সরকারের নীতি প্রথম থেকেই শ্রমিক-বিরোধী। রাষ্ট্রায়ত্ত ক্ষেত্রের প্রতি এই সরকারের কোনও নজর নেই। তারা বেসরকারি হাতে সব কিছুকেই তুলে দিতে চাইছে। শ্রমজীবী মানুষের স্বার্থের দিকে তাকিয়েই এই ধর্মঘট ডাকা হয়েছে। সব রাজনৈতিক দলেরই উচিত এই ধর্মঘটকে সমর্থন করা।

ধর্মঘটের দাবি হিসাবে সামনে চলে এসেছে সংশোধিত নাগরিকত্ব আইন প্রত্যাহারও। ট্রেড ইউনিয়নগুলিও যৌথ বিবৃতিতে বলেছে, ‘বিজেপি সরকারের পদক্ষেপে দেশের মধ্যে বিভাজন তৈরি হতে পারে, ধর্ম-জাতি-ভাষা নির্বিশেষে জনমনে গভীর অসন্তোষ তৈরি হয়েছে। বর্তমান সঙ্কট থেকে দৃষ্টি ঘোরাতেও এই বিষয়কে ব্যবহার করা হচ্ছে। জনবিরোধী নীতির বিরুদ্ধে ঐক্যবদ্ধ প্রতিবাদকে বিভাজিত করার চেষ্টা চলছে।’ কিন্তু বিভাজনের শক্তির সঙ্গে রাস্তায় পাল্লা দিচ্ছে ঐক্যবদ্ধ প্রতিবাদ— মনে করছেন শ্রমিক নেতারা।

শ্রমিকশ্রেণির প্রতিবাদের সঙ্গে কেন্দ্রের অন্যান্য পদক্ষেপের সম্পর্ক গভীর বলেই মনে করছেন ট্রেড ইউনিয়ন নেতারা। সিআইটিইউ নেত্রী এআর সিন্ধু বলেছেন, আসামে এনআরসি বা কাশ্মীরকে অবরোধ করে রাখার ফলে সবচেয়ে বেশি ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছেন পরিযায়ী শ্রমিকরা। নাগরিকত্ব প্রমাণের জন্য নথি জোগাড়েও তাঁরাই সবচেয়ে বেশি সমস্যায় পড়বেন। দেশের এক জায়গা থেকে অন্য জায়গায় কাজ করতে যান, বারবার নথি জোগাড় করবেন কোথা থেকে? এই কারণেই শ্রমিক আন্দোলন সারা ভারতে এনআরসি’র বিরোধিতা করছে, সংশেধিত নাগরিকত্ব আইনের বিরোধিতা করছে।

আগেই কৃষক-খেতমজুর, মহিলা, ছাত্র-যুবকদের সংগঠনগুলি ধর্মঘটকে সমর্থন জানিয়েছিল। এখন সিএএ’র বিরুদ্ধে রাস্তায় নেমে পড়া বিভিন্ন সামাজিক সংগঠনও ধর্মঘটকে সমর্থনের কথা জানাচ্ছে। রুটি রুজি ও নাগরিকত্ব রক্ষার সংগ্রাম হিসাবে ধর্মঘট নতুন মাত্রা নিয়ে নিয়েছে।


শেয়ার করুন

উত্তর দিন