দেশ বদলের ডাকে ২৭ সেপ্টেম্বর সাধারণ ধর্মঘট... ইন্দ্রজিৎ ঘোষ।

১৩ সেপ্টেম্বর ২০২১, সোমবার

জনবিরোধী, কৃষক বিরোধী তিনটি কৃষি আইন প্রত্যাহারের দাবিতে আগামী ২৭ সেপ্টেম্বর ২০২১ দেশ জোড়া ভারত বন্ধের ডাক দিয়েছে সংযুক্ত কিষান মোর্চা। বিদ্যুৎ বিল প্রত্যাহার ও চারটি শ্রম কোড বাতিলের দাবিতে আগামী ২৭ সেপ্টেম্বর ধর্মঘট কে সমর্থন করেছেন কেন্দ্রীয় ট্রেড ইউনিয়ন ও শিল্পভিত্তিক ফেডারেশন সমূহ।



তিনটি কৃষি বিল প্রত্যাহারের দাবিতে দীর্ঘ নয় মাস ধরে আন্দোলন করছেন দেশের প্রায় ৩০০ টি কৃষক সংগঠন।
প্রধানমন্ত্রী বলেছিলেন কৃষকদের সঙ্গে সমস্যার সমাধান মাত্র একটি ফোনের দূরত্ব। কিন্তু ১১ বার বৈঠকের পরেও সমস্যার সমাধান হয়নি। আসলে কেন্দ্রীয় সরকার কর্পোরেটদের কাছে নিজেদের বিক্রি করেছে।


গত ২৫ ও ২৭ আগস্ট সংযুক্ত কিষান মোর্চার আহব্বানে কনভেনশন অনুষ্ঠিত হয়। ৩০০ টির বেশি কৃষক সংগঠন, ১৮ টি কেন্দ্রীয় ট্রেড ইউনিয়ন, শিল্পভিত্তিক ফেডারেশন, ছাত্র যুব মহিলা সংগঠন এই কনভেনশনে অংশগ্রহণ করেন।

এই কনভেনশন থেকেই দেশজুড়ে সরকারের বিরুদ্ধে গণ আন্দোলনের ডাক দেওয়া হয়। রাজ্যে রাজ্যে মহাপঞ্চায়েত অনুষ্ঠিত হচ্ছে। হরিয়ানা পাঞ্জাব উত্তর প্রদেশের সরকার এই মহা পঞ্চায়েত গুলির উপর ব্যাপক দমন-পীড়ন নামিয়ে আনছে।
গত ২৮ শে আগস্ট হরিয়ানার কার্নেলে ব্যাপক পুলিশি নির্যাতন ঘটে। পুলিশের লাঠির আঘাতে শহীদের মৃত্যু বরণ করেন কৃষক নেতা সুশীল কাজল। গত ৭ সেপ্টেম্বর হরিয়ানার কার্নেলের সচিবালয় ঘেরাও করেন কৃষকরা। কৃষকদের দাবি শহীদ সুশীল কাজলের পরিবারকে ২৫ লক্ষ টাকা ক্ষতিপূরণ দিতে হবে। সরকারি আধিকারিক যিনি ঘোষণা করেছিলেন লাঠি মেরে কৃষকদের মাথা ফাটিয়ে দিতে হবে তার বিরুদ্ধে খুনের মামলা করতে হবে।



গত ৫ সেপ্টেম্বর উত্তরপ্রদেশের মুজাফ্ফরনগরে যেখানে বিজেপি অনেক বার দাঙ্গা সংঘটিত করেছিল যেখানে কৃষকদের দীপ্ত ঘোষণা ধর্ম জাতের বিভেদ ভুলে রুটি রুজির স্বার্থে ঐক্যবদ্ধ লড়াই করতে হবে।
মুজাফ্ফরনগরের এই মহাপঞ্চায়েতের উপর ও ব্যাপক পুলিশের জুলুম শুরু হয়।


কিন্তু কিছুতেই আন্দোলনের তেজ কমছে না বরং বাড়ছে।
পুলিশের জুলুম আন্দোলন শুরুর দিন থেকেই ছিল। গত নভেম্বর মাস থেকে আন্দোলন শুরু সময় থেকে কৃষকদের রাজধানীর বুকে ঢুকতে না দেওয়ার ব্যাপক চেষ্টা করেছে। রাস্তায় বোল্ডার ফেলে কাঁটা লাগিয়ে ও কোনো লাভ হয়নি। গত ৮ ডিসেম্বর ২০২০ দেশ জোড়া সাধারণ ধর্মঘট হয়েছে। গত ২৬ জানুয়ারী প্রজাতন্ত্র দিবসের দিন লালকেল্লা তে ও বিক্ষোভের আঁচ পৌছায়।


অনেক দমন পিড়নের পর ও দিল্লির রাস্তা থেকে সরানো সম্ভব হয়নি।

রোদ ঝড় বৃষ্টি ঠান্ডা কিছুতেই আন্দোলনের মাত্রা কমেনি বরং বেড়েছে। টানা ১০ মাস ধরে রাস্তায় বসে আছেন আমাদের অন্নদাতারা।
কিন্তু কেন তাঁরা এতো বিদ্রোহী?? কি আছে এই আইনে??


কেন্দ্রীয় সরকার সংসদে গায়ের জোরে যে আইন গুলি পাস করিয়েছে তা কৃষকদের তো সর্বনাশ করবেই সঙ্গে দেশের সাধারণ মানুষের ও সর্বনাশ করবে।

কৃষি আইন প্রথমটি হল চুক্তি চাষ। এই আইনে অনেক ভালো কথা বলা থাকলেও আসলে এটা কর্পোরেটদের কাছে কৃষকদের বন্দী করা। জমি ও পরিশ্রম কৃষকের কর্পোরেট বীজ সার কীটনাশকসহ অন্যান্য বিষয় কর্পোরেটের। কি চাষ হবে তা ঠিক করবে কর্পোরেটরা। ফষল কিনবে কর্পোরেটরা ফষলের দাম ঠিক করবে কর্পোরেটরা।


নূন্যতম সহায়ক মূল্য থাকছে না। সরকার ফষল কেনার কোনো চেষ্টা করছে না। ফলে আগামীদিনে রেশন ব্যাবস্থা থাকবে না। সবটা কর্পোরেটদের হাতে ছেড়ে দেওয়া হবে। আমাদের রাজ্যের সরকার মুখে বিজেপির বিরোধীতা করলেও এই রাজ্যে লোকের অভাব বলে কৃষক সহায়তা কেন্দ্র বন্ধ রাখছে। ধান কিনছে না। ধানের নূন্যতম সহায়ক মূল্য যেখানে ২১০০ টাকা প্রতি কুইন্টাল যেখানে আমাদের রাজ্যে ১৩০০ টাকা কুইন্টালে ধান বেচতে বাধ্য হচ্ছে।



সবচাইতে বিপদজনক আইন হলো নিত্যপ্রয়োজনীয় জিনিসপত্র আইন থেকে কৃষিপন্য গুলি তুলে দেওয়া। মজুতদারি কালো বাজারী খতম করার পরিবর্তে মুজতদারি বাড়ানোর জন্য আইন করা হচ্ছে। তার ফল আমরা হাতে নাতে পেয়েছি। এই বছর তৈল বীজ বেশি উৎপাদন হওয়ার পর ও ভোজ্য তেলের দাম প্রায় ২০০ টা। অর্থনীতি বিশেষজ্ঞদের মতে মজুতদারি কালোবাজারির কারণেই এই ঘটনা।



এরসাথে কেন্দ্রীয় সরকারের বিদ্যুৎ বিল
যা কৃষক তো বটেই সাধারণ মানুষের মারাত্মক ক্ষতি করবে। কৃষকদের ভর্তুকি তুলে নেবে। সেচের খরচ বাড়বে। ফষল উৎপাদনের খরচ বাড়বে।
মোদী সরকার মুখে প্রচুর কথা বললেও আসলে দেশের মানুষের সর্বনাশ করছে।
কর্পোরেটদের মুনাফার স্বার্থে যেমন কৃষি আইন তেমন শ্রমিকদের সরাসরি শোষণের জন্য আইন আনছে। দেশের ১৮৬ টি শ্রমআইনে পরবর্তন করে মাত্র ৪ টি শ্রম কোড তৈরী করছে। যেখানে শ্রমিককে ৮ ঘন্টার পরিবর্তে ১২ ঘন্টা কাজ করানো যেতে পারে।
মজুরির থেকে ওভারটাইমের ভাতা, ছুটির ওয়েজ, ছুটি কালিন মজুরি বাদ দেওয়া হয়েছে।
কোনো কারখানা বা সংস্থায় ২০ জনের কম থাকলে বোনাস না দিলেও চলবে। সংস্থায় ২০ জনের কম থাকলে পি এফ না দিলেও চলবে।
নূন্যতম সামজিক সুরক্ষার বালাই থাকবে না। পি এফ, পেনশান, ই এস আই….

ইউনিয়ন করার অধিকার কেড়ে নেওয়া হবে। ইউনিয়ন এর রেজিষ্ট্রেশন করাতে গেলে মালিকের অনুমতি লাগবে। মানে আর রেজিষ্ট্রেশন করানোই সম্ভব হবে না। ৩০০ এর কম শ্রমিক থাকলে ইউনিয়ন করার অধিকার থাকবে না।

কোনো সংস্থায় ইউনিয়ন করতে গেলে আগে নূন্যতম ৭ জন শ্রমিক একত্রিত হলেই করতে পারত এই শ্রম কোডে নূন্যতম ১০০ জন অথবা মোট শ্রমিকদের ১০ % হতে হবে। এর ফলে অনেক সংস্থা আর ইউনিয়ন করা সম্ভব হবে না।

মহিলা শ্রমিকদের নাইট ডিউটি করানোর ক্ষেত্রে সুরক্ষার নির্দিষ্ট মানদণ্ড ছিল বর্তমানে তা তুলে নেওয়া হয়েছে।


পেশাগত সুরক্ষা ও স্বাস্থ্য এবং কাজের পরিবেশ সংক্রান্ত কোডে শ্রমিকদের নিরাপত্তা ও স্বাস্থ্যকর কর্মক্ষেত্র দেবার ক্ষেত্রে নির্দিষ্ট কিছু নেই।
আড়াইশো রকম সংখ্যা বিশিষ্ট প্রতিষ্ঠানের জন্য ওয়েলফেয়ার অফিসারের ব্যবস্থা নেই।
রাজ্য / কেন্দ্র শিল্প বিষয়ক ট্রাইব্যুনালে আলোচনা চলছে এমন সংস্থাতে স্ট্রাইক করা যাবে না। শিল্প সংক্রান্ত আলোচনা চলার ৭ দিনের মধ্যে স্ট্রাইক করা যাবে না। মূলত শ্রমিকদের ধর্মঘট করার অধিকারকে খর্ব করা হল।


করোনা ভাইরাস সংক্রমণের ভয়ে দেশ জুড়ে লকডাউন, মানুষের কাজ নেই খাবার নেই। সেই সময় মানুষের প্রয়োজনে সরকারের থাকার কথা কিন্তু সরকার তখন কর্পোরেটদের স্বার্থে দেশের সম্পদ বিক্রি করছে। দেশ বিক্রি করছে। আজ কয়লা, রেল ব্যাঙ্ক, বিমা, অডিনেন্স ফ্যাক্টরি সহ একাধিক রাষ্ট্রয়াত্ব ক্ষেত্র বেসরকারীকরণ করছে।
কেন্দ্রীয় সরকারের সাথে পাল্লা দিয়ে চলছে এই রাজ্যের সরকার। ডি পি এল এর জমি বিক্রি করছে, রাজ্যের ৪৬ টি রাষ্ট্রয়াত্ব ক্ষেত্র বিক্রির সিন্ধান্ত নিয়েছে রাজ্য সরকার। মুখে বিজেপির বিরোধীতা করলেও আসলে কেন্দ্রের সহযোগী হিসাবে কাজ করছে রাজ্যের সরকার।



মানুষ মারা নীতি।

এই মানুষ মারা নীতির প্রতিবাদে সারা দেশ গর্জে উঠেছে। রাজ্যে রাজ্যে চলছে মহাপঞ্চায়েত। করোনা সংক্রমণের সরকারের বিধিনিষেধের তোয়াক্কা না করেই রাস্তায় নামছে মানুষ। দমনপিরণ চলছে। শহীদ হচ্ছেন। তাতেও মানুষের আন্দোলন দমানোর ক্ষমতা নেই মোদী সরকারের।



মানুষের অধিকার নিয়ে লাগাতার লড়াই চলছে।
১৯৯৫ সালের পর থেকে ২২ টা দেশ জোড়া সাধারণ ধর্মঘট হয়েছে। প্রতিটি ধর্মঘটে অংশগ্রহণ বেড়েছে। গত ২৬ নভেম্বর ২০২০, কেন্দ্রীয় ট্রেড ইউনিয়ন ও ফেডারেশন গুলির ডাকে সাধারণ ধর্মঘটে প্রায় ২৫ কোটি মানুষের অংশগ্রহণ ছিল। যা পৃথিবীর ইতিহাসে সর্ববৃহৎ। তার ১৫ দিন পর ৮ ডিসেম্বর সংযুক্ত কৃষান মোর্চার ডাকে ও দেশ জোড়া সাধারণ ধর্মঘট হয়েছে।
লড়াই লাগাতার। এই লড়াইয়ের ধারাবাহিকতায়
আগামী ২৭ সেপ্টেম্বর ২০২১ দেশ জোড়া ভারত বন্ধের ডাক দিয়েছে সংযুক্ত কিষান মোর্চা। বিদ্যুৎ বিল প্রত্যাহার ও চারটি শ্রম কোড বাতিলের দাবিতে আগামী ২৭ সেপ্টেম্বর ধর্মঘট কে সমর্থন করেছেন কেন্দ্রীয় ট্রেড ইউনিয়ন ও শিল্পভিত্তিক ফেডারেশন সমূহ।


আসুন দেশ বাঁচানোর লড়াইতে আমরা সকলে সামিল হই। ২৭ সেপ্টেম্বর ধর্মঘট কে সফল করি।


শেয়ার করুন

উত্তর দিন