Site icon CPI(M)

Freedom Struggle And The Communists: Part V

5

সুজন চক্রবর্তী

দেশে যত রাজ্য, তত রাজ্য সরকার খুবই কম, মাত্র ৩টি রাজ্যে সিপিআই(এম) বা বামপন্থীদের দ্বারা পরিচালিত। খুবই কম সময়ের জন্য। স্বাধীনতার পর ৭৫ বছর অতিক্রান্ত। তার অর্ধেকের চেয়েও কম সময়ের জন্য বামশাসিত রাজ্য সরকার। কিন্তু এর মধ্যেও অনন্য। দায়বদ্ধতার মডেল। বিকল্প দৃষ্টিভঙ্গি যা বস্তুতপক্ষে স্বাধীনতার শপথ বা স্বপ্নকে পুষ্ট করে।

ক) মানব উন্নয়নে নানান সূচকে দেশের মধ্যে সবচেয়ে এগিয়ে থাকা রাজ্যগুলির মধ্যে অধিকাংশ ক্ষেত্রেই কেরালা, পশ্চিমবাংলা কিংবা ত্রিপুরার স্থান, এবং তা বাম আমলকে ঘিরেই।

খ) ১৯৫৭ সালে কেরলে কমরেড ই এম এস নাম্বুদ্রীপাদের নেতৃত্বাধীন সরকার। ছ’দিনের মাথায় অর্ডিন্যান্স জমিতে কৃষক উচ্ছেদের বিরুদ্ধে। ৫৭ সালেই করলের ‘এগ্রেরিয়ান রিলেশনস বিল’; জমির অধিকার, জমির উর্দ্ধসীমা কমানো সহ কৃষক স্বার্থের নানা বিষয়। একই দৃষ্টিতে ত্রিপুরার বাম সরকার। পশ্চিম বাংলার বেনামী জমি উদ্ধার, অপারেশন বর্গা সহ একগুচ্ছ প্রকল্প। বস্তুতপক্ষে ভারতীয় রাজনীতিতে কৃষকের জীবন জীবিকা সংক্রান্ত ইস্যুগুলিকে গুরুত্বের সাথে সামনে এনেছে বাম সরকারগুলি।

গ) ১৯৭৭ সালে পশ্চিম বাংলায় বাম সরকারের প্রথম সিদ্ধান্ত রাজনৈতিক বন্দী মুক্তি। উন্নত, গণতান্ত্রিক ভারধারার স্পষ্ট প্রকাশ। বিকল্প রাজনৈতিক চেতনাবোধেই বামপন্থীরা।

ঘ) বিকেন্দ্রীকরণ এবং গ্রাম-শহরের স্থানীয় স্বায়ত্ত শাসন। ক্ষমতার কেন্দ্রীকরণের পরিবের্ত ক্ষমতা ছড়িয়ে দেওয়া। গণতন্ত্রের বিস্তার। অর্থনৈতিক-সামাজিকভাবে পিছিয়ে থাকা অংশকে সামনের দিকে টেনে আনা। তাদের হাতে দায়িত্ব, অধিকার। মানুষের ক্ষমতায়ন। নারীর ক্ষমতায়ন। ১৯৭৮ এ পঞ্চায়েত স্তরে প্রথমে মনোনীত মহিলা প্রতিনিধি। তারপর নির্বাচিত। স্বায়ত্তশাসিত পরিচালন ব্যবস্থায় মহিলা, তপশিলীজাতি, আদিবাসী সংরক্ষন, জমির পাট্টা, মজুরী সহ নানা ক্ষেত্রে মহিলাদের অর্থনৈতিক এবং সামাজিক ক্ষমতায়ন। একটি দায়বদ্ধ মনোভাব।

ঙ) পিছিয়ে থাকা অংশের মানুষের অধিকার এবং সক্ষমতার বিকাশ। ত্রিপুরায় উপজাতি অংশের মানুষের জন্য বিশেষ উদ্যোগ। সম্পৃক্ততার বিশেষ পরিকল্পনা। স্বশাসিত ব্যাবস্থাপনার বিশেষ উদ্যোগ।

চ) রাজনৈতিক সংকীর্ণতার উর্দ্ধে উঠে প্রশাসনিক নিরপেক্ষ ভাবধারা প্রতিষ্ঠা করা। মানুষের প্রতি এবং গণতন্ত্রের প্রতি মর্যাদা বোধকে বিকশিত করা। সেই মনোভাবেই বিরোধী অথবা প্রতিপক্ষকে মর্যাদা দান। বিধানসভা থেকে পঞ্চায়েত প্রতিটি ক্ষেত্রেই বিরোধী দলকে প্রশাসনিক স্বচ্ছতার কাজে যুক্ত করা। বামশাসিত সরকারেই এসব উন্নত গণতান্ত্রিক বন্দোবস্ত। পঞ্চায়েত স্তরের বিরোধী নেতাকে  সংশ্লিষ্ট ক্ষেত্রে অর্থনৈতিক কমিটিতে যুক্ত করা এবং দুর্নীতি সংক্রান্ত অভিযোগ খতিয়ে দেখা ও প্রকৃত অর্থেই তদন্ত করার দায়িত্ব দেওয়া, এসব অনন্য এবং বিকল্প। যদিও বামশাসনের অবসানে এসব বন্দোবস্তকে বরবাদ করে পরবর্তী শাসকেরা।

ছ) প্রশাসন পরিচালনার ক্ষেত্রে দেশজুড়ে যখন দুর্নীতর রমরমা, বাম সরকারগুলি সেক্ষেত্রেও বিকল্প, সততা এবং স্বচ্ছতার ধারাবাহিক অনুশীলন। সারা দেশজুড়ে যখন রাজনীতিবিদ অথবা নির্বাচিত প্রতিনিধিদের অনৈতিকতা, দুর্নীতি, দুস্কৃতি অথবা দাঙ্গাকারীর নানা ছাপ স্পষ্ট, বামশাসিত ক্ষেত্রে তখনও এসব রোগ কার্যত ধরা ছোঁয়ার বাইরে। জাতীয় রাজনীতিতে স্বচ্ছতা ও দূর্ণীতিমুক্ত অবদান বামপন্থীদের।

জ) গ্রামস্তর পর্যন্ত সর্বনিম্ন অংশের মানুষকে পরিকল্পনা রচনায় যুক্ত করার বিকল্প বাম সরকারগুলির অনন্যতাকেই স্পষ্ট করে। এক্ষেত্রে কেরালা মডেল আন্তর্জাতিক স্তরেও যথেষ্ট প্রশংসিত। বাংলা ভাগ, উদ্বাস্তুস্রোত, কেন্দ্রীয় বঞ্চনা সহ নানান যন্ত্রণার শিকার হতে হয়েছে পশ্চিমবাংলাকে। বহু আক্রমণ অত্যাচার সত্ত্বেও দৃঢ় অবস্থানেই মানুষের পাশে থেকেছে বামপন্থীরা। গড়ে তুলেছে গ্রাম-শহর। গড়ে তুলেছে শিক্ষা স্বাস্থ্যের পরিকাঠামো। জীবন-জীবিকার নানান প্রকল্প, পিছিয়ে থাকা মানুষের জন্য বিশেষ পরিকল্পনা। গণতন্ত্র, ধর্মনিরপেক্ষতা, ঐক্য, মানুষের ক্ষমতায়ন – নানা বিষয় বলিষ্ঠ ভূমিকায় বিকল্পের সন্ধান দিয়েছে। গোটা দেশ তাকে মর্যাদার চোখে দেখেছে। বামবিকল্পকে ধ্বংস করার নানান প্রচেষ্টা ধারাবাহিকভাবেই চলছে বটে, কিন্তু তাতে স্বাধীনতা পরবর্তী আধুনিক ভারত গড়ে তোলার প্রক্রিয়ায় বামপন্থীদের অবদান এবং ভূমিকা ম্লান হতে পারে না।

নব্বই এর দশক, আক্রমণের নতুন মাত্রা

স্বাধীনতার পরবর্তী সময় থেকেই দেশের শাসকশ্রেণী আপোষের পথ ধরেছে। পার্টি কর্মসূচীর ৩.৯ ধারায় বলা হচ্ছে— ‘পঞ্চাশের দশক থেকে শাসকশ্রেণী ধণতান্ত্রিক বিকাশের যে পথ নিয়েছিল তা সঙ্কট জর্জরিত হতে বাধ্য ছিল। শেষ পর্যন্ত তা বদ্ধদশায় পোঁছেও যায়। ভূস্বামীদের সঙ্গে বৃহৎ বুর্জোয়াদের সমঝোতার ফলে কৃষকদের ক্রয়ক্ষমতা যথেষ্ট বাড়লো না, তারফলে অভ্যন্তরীন বাজার সম্প্রসারিত হলো না। শিল্পায়নে অর্থ যোগান এবং রাষ্ট্রের ব্যয় নির্বাহে বৈদেশিক এবং অভ্যন্তরীন ঋণের ওপর ক্রমবর্দ্ধমান নির্ভরশীলতা বৈদেশিক লেনদেনের ভারসাম্য এবং ফিসক্যাল ঘাটতি উভয় ক্ষেত্রেই গুরূতর সঙ্কট ডেকে আনলো।

এই প্রেক্ষাপটে নব্বইয়ের দশকে ঘটনাবলির বিবেচনা অত্যন্ত জরুরী। এইরকম সময়েই সোভিয়েতের বিপর্যয়। বাড়তি সুযোগ পেল সাম্রাজ্যবাদী শক্তি। ফিন্যান্স পুঁজির দাপাদাপি বাড়লো। বিশ্বায়ন এবং উদার অর্থনীতির নামে দেশের শিল্প বানিজ্য ক্ষেত্র ক্রমশ আক্রান্ত হলো। দেশীয় শিল্প এবং শ্রমের বাজারে সংকট বাড়লো। ঠিক এই সময়তেই ক্রমশ মাথাচাড়া দিচ্ছে সাম্প্রদায়িক শক্তি। বাবরি মসজিদ ধ্বংস হলো। সোভিয়েতের বিপর্যয়ের একইসাথে যেন সাম্রাজ্যবাদী আস্ফালন, উদার অর্থনীতির রমরমা এবং সাম্প্রদায়িক শক্তির মাথাচাড়া। যেন একটা স্পষ্ট যোগসূত্র। এই সময়েই শক্তি বৃদ্ধি হতে থাকলো বিজেপির। অর্থনৈতিক, রাজনৈতিক, সামাজিক প্রতিটি ক্ষেত্রেই অস্থিরতা বাড়তে থাকলো। মানুষের ঐক্য রচনার মধ্য দিয়ে এই সার্বিক বিপদের বিরুদ্ধে রুখে দাঁড়াতেই হবে। শ্রমজীবি মানুষের জীবন-জীবিকার লড়াইয়ের পথে বামপন্থীরা। মানুষের ব্যাপক ঐক্য জরুরী। বিপন্ন দেশ, রুখে দাঁড়াতেই হবে। সেই ব্যাপক ঐক্য প্রক্রিয়াকে ত্বরান্বিত করেই অগ্রসর হতে থাকলো দেশরক্ষার এ লড়াই। সাম্রাজ্যবাদ বিরোধী এবং দেশের গণতন্ত্র, ধর্মনিরপেক্ষতা রক্ষার লড়াই। সার্বভৌম, সাধারণতন্ত্রকে রক্ষার লড়াই। এই লড়াইতে সবচেয়ে দায়বদ্ধ ভূমিকা সন্দেহাতীতভাবেই বামপন্থীদের।

ইতিমধ্যে দেশীয় রাজনীতিতে বিজেপি একচেটিয়া পুঁজির বিশ্বস্ততা অর্জন করে চলেছে। সাম্প্রদায়িক শক্তি, মানুষকে বিভাজনের শক্তি। ক্রমশ মাথা চাড়া দিচ্ছে। একচেটিয়া পুঁজি, সামন্ততন্ত্র এবং সাম্রাজ্যবাদী শক্তির স্বার্থরক্ষা করেই বিপজ্জনক শক্তি বিজেপি। মানুষের সার্বিক ঐক্য আর লড়াই ক্রমশ জোরদার করা, এরকম সময়ে অনেক বেশী জরুরী।

শেয়ার করুন