ভারতের কমিউনিস্ট পার্টি গঠন – ঐতিহ্য ও উত্তরাধিকারঃমানবেশ চৌধুরি

১৭ অক্টোবর ২০২২, সোমবার

দ্বিতীয় পর্ব

এভাবে তো বাইরে থেকে সাহায্য করা শুরু হলো। কিন্তু দেশের মধ্যে কী হতে থাকলো!

কলকাতা, মুম্বাই, লাহোর, মাদ্রাজ শহরে – তাসখন্দে পার্টি গড়ে ওঠার আগে থেকেই, কয়েকজন যুব বিপ্লবী, কমিউনিস্ট আদর্শের প্রতি আকৃষ্ট হয়ে নিজ উদ্যোগেই কিছু কিছু কাজ শুরু করে দিয়েছিলেন। পার্টি গড়ে উঠবার পর নিজ নিজ ভাবে আলাদা করে কমিউনিস্ট ইন্টারন্যাশলানের সঙ্গে যোগাযোগ করলেন তাঁরা। ইন্টারন্যাশনাল আবার এই বিপ্লবীদের পরস্পরের মধ্যে সংযোগ করিয়ে দিল। সবাই একটা বোঝাপড়া করে কাজ করতে শুরু করলেন। পত্রিকাও প্রকাশ করতেন তাঁরা। ১৯১৯ সালেই কলকাতায় ‘নবযুগ’ নামে পত্রিকা প্রকাশ করা শুরু করেছিলেন মুজফফর আহমদ ও নজরুল ইসলাম। ইন্টারন্যাশনালের সঙ্গে সম্পর্ক তৈরি হলে, ১৯২২ সালে ধূমকেতু, ১৯২৫ সালে শ্রমিক প্রজা স্বারাজ দলের সাপ্তাহিক মূখপত্র ‘লাঙল’, ওই সালেই উর্দু পত্রিকা ‘মজদুর’– মূলত মুজফফর আহমদ, নজরুল ইসলাম, কুতুবুদ্দিন আহমদ প্রমুখ কমিউনিস্ট কর্মী ও দরদীদের দ্বারা প্রকাশিত হতে থাকে। ১৯২২ সালে এস, এ ডাঙ্গে বোম্বাই থেকে সাপ্তাহিক ‘স্যোসালিস্ট’ ও গোলাম হোসায়ন লাহোর থেকে ‘ইনকিলাব’ প্রকাশ করতে থাকেন।

মুজফফর আহমদ , নজরুল ইসলাম ও ফজলুল হক

উল্লিখিত সব কেন্দ্রগুলিতেই পার্টির অন্যবিধ সাংগঠনিক কিছু কিছু কাজ শুরু হয়ে গেল। কঠোর গোপনীয়তার মধ্যে এই কাজ চলতে থাকলো শুধু নয়, পার্টির বৃত্তের মধ্যে নতুন নতুন কর্মী আসতে শুরু করলেন।

গ্রেট ব্রিটেনের কমিউনিস্ট পার্টির সঙ্গেও যোগাযোগ হলো। তাঁদের কয়েকজন স্বশরীরে এসে সহযোগিতা করতে থাকলেন।

পার্টি ১৯৩০ সালে Draft Platform of Action of the Communist Party of India নামে দলিল রচনা করলো।

১৯৩৬ সালে লখনৌতে সারা ভারত কৃষক সভা, সারা ভারত ছাত্র ফেডারেশন, ফ্যাসিস্ত বিরোধী লেখক সংঘ গঠন করে মজুর–কিষান-ছাত্র–সংস্কৃতির আন্দোলনকে বেগবান করে তোলা হলো। ঐ দশকেই জাতিয়তাবাদী সশস্ত্র বিপ্লবীদের বিরাট অংশ জেলখানায় মার্কস বাদ লেনিনবাদ পড়ে কমিউনিস্ট পার্টিতে যোগ দেন। ঐ মতের কারামুক্ত বন্দিরাও পার্টিতে যোগ দিলেন। সব থেকে বেশি ও নেতৃত্বকারী কমরেডরা আসেন আন্দামান কারাগার থেকে। আগতরা নেতৃত্বে বৃত হন।

শহিদত্ব বরণ করেন কমিউনিস্টরা। কায়ূর বিপ্লবীদের কথা বিশেষ করে মনে পড়ছে।

ইতোমধ্যে দ্বিতীয় মহাযুদ্ধ শুরু হলো। এক পর্যায়ে আক্রান্ত হলো সোভিয়েত রাশিয়া। সোভিয়েতকে রক্ষা করতে হবে। কারণ, দানব মদমত্ত-জাতিয়তাবাদী হিটলার ও তার অক্ষশক্তি দ্বারা সে আক্রান্ত। সোভিয়েত শেষ হওয়া মানে মেহনতি ও গণতান্ত্রিক মানুষের সব অর্জন শেষ হয়ে যাওয়া। ভারতে কমিউনিস্টদের আবার তার সঙ্গে জাতীয় স্বাধীনতার সংগ্রামকে মেলাতে হবে। পরাধীন করে রেখেছে যে ব্রিটিশ শাসক, তারাই আবার মিত্রশক্তির অংশ হিসাবে সোভিয়েতের জোটে। পার্টির পক্ষে বেশ জটিল অবস্থা। কিন্তু বোঝাপড়া ঠিক রেখে, যোগ্য নেতৃত্ব -রাজনীতি সংগঠন ও আন্দোলন পরিচালনার ভার নিতে সক্ষমপর হলেন।

রাশিয়া, দ্বিতীয় মহাযুদ্ধ

১৯৪২ সালে গান্ধীজির ডাকা ভারতছাড়ো আন্দোলনে পরিস্থিতির বাধ্য বাধকতার জন্য, কমিউনিস্টদের অনেক চিন্তা করে কাজ করতে হতো। কিন্তু কৃষক সভার ইতিহাস পড়া থাকলে জানতে পারবেন, কত সহস্র লালঝাণ্ডার কৃষককর্মী ঐ লড়াইতে শামিল হয়েছিলেন। অনেক পুস্তক আছে। অরুণ শৌরীর কুৎসার জবাবে কমরেড এম বাসবপুন্নাইয়ার লেখা বইটি পাঠ করে নিতে পারেন।

যুদ্ধের সময় বিশেষ করে বাংলায় কালোবাজারি-মজুদদারি প্রতিরোধ, কলেরা, বসন্ত, ম্যালিরিয়ার মতো মারণ রোগ প্রতিরোধ, গণনট্য সংঘ –এর অনুষ্ঠান করার সঙ্গে সঙ্গে, উল্লিখিত ঐ জটিল পরিস্থিতিতে দুই ধরনের কাজ এক সঙ্গে চালিয়ে নিয়ে যাওয়া হতে থাকলো।

১৯৪৫ সালে যুদ্ধে অসীম কষ্ট আর মৃত্যুকে সহ্য করে সোভিয়েতের বিজয় ঘটলে, কমিউনিস্টরা ও তাদের অনুসারী প্রগতিবাদীরা উৎসাহিত হয়ে উঠলেন। স্বাধীনতার ক্রান্তি লগ্নে গণবিদ্রোহগুলি সবই কমিউনিস্ট পার্টির পরিচালনায় হতে লাগলো, যেমন, লালফৌজের বিজয়ে মিছিল, আই এন আই বন্দিদের বিচারের ও ক্যাপ্টেন রসিদ আলিকে দণ্ডদানের বিরুদ্ধে, নৌ বিদ্রোহে, ডাক-তার ধর্মঘটে, দাঙ্গা প্রতিরোধে, পুন্নাপ্রা-ভায়ালারের গণবিদ্রোহে, মণিপুরের কৃষক বিদ্রোহে, মহারাষ্ট্রের ওয়ারিলি আদিবাসী অভ্যুত্থানে, সুরমা ভ্যালির কৃষক আন্দোলনে, বাংলার তেভাগা লড়াইয়ে, ময়মনসিংহের হাজং বিদ্রোহে এবং সর্বোপরি তেলেঙ্গানার গণবিদ্রোহে – সবেতেই কমিউনিস্টদের উজ্জ্বল নেতৃত্ব।

এই পর্যন্ত আসতে গিয়ে কত ষড়যন্ত্র মামলা, কত হত্যাকাণ্ড, কত জীবনদান, কত কারাবাস, কত অন্তরীনের জীবন, কত আত্মগোপনের যন্ত্রণা সহ্য করতে হয়েছে কমিউনিস্টদের! এসব পড়লে মনে যুগপৎ বিষন্নতা ও গর্ববোধের দ্যোতনা সৃষ্টি হয়।

যেমন পেসোয়ার কোর্টে ১৯২৩ সালে পেসোয়ার কমিউনিস্ট ষড়যন্ত্র মামলা। পেসোয়ার আদালতে দফায় দফায় চারটি ষড়যন্ত্র মামলা ১৯২৭ সাল পর্যন্ত চললো।

১৯২৩ সালে পেসোয়ার কমিউনিস্ট ষড়যন্ত্র মামলা

১৯২৩ সালেই কলকাতায় কুতুবুদ্দিন আহমদের বাড়ি থেকে কমরেড মুজফফর আহমদকে আটক করে কয়েক মাস কারাবন্দি করে রাখা হলো।

১৯২৪ সালে মুজফফর আহমদ প্রমুখ চার জনের বিরুদ্ধে কানপুর কমিউনিস্ট ষড়যন্ত্র মামলা রুজু করা হয়। চলল দু’বছর ধরে।

তারপর তো ইতিহাস প্রসিদ্ধ মিরাট কমিউনিস্ট ষড়যন্ত্র মামলায়, ২৯শে মার্চ ১৯২৯ সালে, একই তারিখে, দিবাগত শেষ রাতে সারাভারত থেকে মোট ২৯ জনকে আটক করা হয়।

এর আগের ষড়যন্ত্র মামলা গুলোর সময় প্রচার পাওয়া যায় নি। কমিউনিস্টরা নিজেরা ছাড়া কে আর প্রচার করবে! তাই মিরাট মামলার বন্দিরা ঠিক করলেন, কোর্টের কাঠগড়াকে পার্টির নীতি আদর্শ ও কর্মসূচী প্রচারের মঞ্চ হিসাবে ব্যবহার করা হবে।

কারাবন্দি কমরেডের মধ্যে ১৮ জন সম্মিলিত বিবৃতি দেন। অনেকে একক বিবৃতিও দেন। তার মধ্যে কমরেড মুজফফর আহমদের বিবৃতিটি মহার্ঘ। চার বছর ধরে শুনানি চলে। এসব দেশের ও বিদেশের পত্রিকায় প্রকাশিত হতো। তাতে পার্টির প্রসার ঘটে আশ্চর্যজনক দ্রুততায় ভারতের বিভিন্ন রাজ্যে।

মুজফফর আহমদ, বাঙ্কিম মুখেরজী,পি শি যোশী, সোমনাথ লাহিড়ী...

মুজফফর আহমদকে যাবৎজীবন কারাদণ্ডে দণ্ডিত করা হয়। এলাহাবাদ হাইকোর্টে আপিল করলে তা তিন বছরে নেমে আসে। কিন্তু তিনি মুক্ত হলেও, তাঁকে অন্তরিণ করে রাখা হয় মেদিনীপুরের সুতাহাটায়।

আমরা দেখলাম, জন্মাবধি পার্টিকে মূলত গোপনেই কাজ করতে হয়। কিন্তু ১৯৩৬ সাল থেকে পার্টিকে খাতায় কলমেই নিষিদ্ধ ঘোষণা করা হয়। সেই নিষেধাজ্ঞা ওঠে ১৯৪২ সালের জুন মাসের মাঝা মাঝি সময়ে। আবার ১৯৪৮ সালে তিন বছরের জন্য পার্টি নিষিদ্ধ হলো। তখন দেশ স্বাধীন হয়েছে। শাসক শ্রেণির কত জ্বালা কমিউনিস্টদের নিয়ে!

সেই জ্বালা মেটানোর জন্য পার্টি নেতা-কর্মীদের ওপর তো দৈহিক ও অন্যবিধ আক্রমণ নেমে এসেছিলই। সে সবকে মূকাবিলা করেই এগোতে হয়েছে। অন্যদিকে পার্টিকে ডান ও বাঁ দিকে টেনে রাখার বিরুদ্ধে মতাদর্শিক লড়াই চালাতে হয়েছে, তাতেও জীবন দিতে হয়েছে, কারারুদ্ধ হয়ে থাকতে হয়েছে। সমাজতন্ত্রের দুই পরাশক্তি সোভিয়েত ইউনিয়ন ও চীনের মধ্যেকার বিরোধে, কারও লেজুড়বৃত্তি না করেও, সমাজতন্ত্রের পক্ষে দৃঢ়ভাবে দাঁড়িয়েছে পার্টি। আভ্যন্তরিণ ও বাইরের আক্রমণে সোভিয়েত রাশিয়া ও পূর্ব ইউরোপের দেশগুলো যখন ধ্বংস হয়ে গিয়েছে, তখন আমাদের এই মহান পার্টি মেহনতি জনতার লাল পতাকাকে ঊর্ধে তুলে ধরেছে। এককেন্দ্রিক বিশ্বে যখন লুটেরা সাম্রাজ্যবাদের দোসররা দেশ চালাচ্ছে, যখন দেশে কর্পোরেট-সাম্প্রদায়িকদের উৎকট দাপট চলছে, তখন বিহ্বল না হয়ে, পার্টি জবরদস্ত লড়াই দিয়ে চলেছে। বিপ্লবী কর্মসূচী অনুসারি পার্টির সাংগঠিনিক কাঠামোকে তৈরি করে নিয়েছে পার্টি। প্রতিনিয়ত তার মূল্যায়ন হচ্ছে। আমাদের মহান পথিকৃতদের পদরেখা ধরে চলছে কমিউনিস্টদের অভিযাত্রা। লক্ষ্য - মানুষের বাসযোগ্য এক ভারত নির্মাণ করা।

    ---------------------------------------------------------- 

মূল ঋণ– আমার জীবন ও ভারতের কমিউনিস্ট পার্ট– মুজফফর আহমদ


শেয়ার করুন

উত্তর দিন