দীপ্তজিৎ দাস
ফিদেল আলেজান্দ্রো কাস্ত্রো রুজ। এই দুনিয়ায় শোষিত মানুষের মুক্তির লড়াইয়ের ইতিহাসে এক অনির্বাণ প্রজ্জ্বলিত দীপশিখার নাম। সাম্প্রতিক অতীতে মার্কসবাদের অব্যর্থ প্রয়োগের এক ‘ট্যাকটিক্যাল জিনিয়াস’। হাভানা বিশ্ববিদ্যালয়ের স্কুল অফ ল'র মেধাবী ছাত্র ফিদেল স্কুলজীবনে ছিলেন এক দুর্দান্ত স্পোর্টসম্যান। বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়াকালীন তার রাজনৈতিক জীবনে হাতেখড়ি। পরবর্তীতে নিয়মিত বইচর্চা, সাধারণ মানুষের দুঃখের বীভৎস স্মৃতি, কিউবায় বাতিস্তা শাসনের দুঃসহ অভিজ্ঞতা ফিদেলকে মার্কসবাদে অনুরক্ত করে। ছাত্র আন্দোলন, শ্রমিক-কৃষকদের আন্দোলনের পাশাপাশি ডমিনিকা রিপাবলিক, কলম্বিয়ায় রাজনীতির অভিজ্ঞতা কাস্ত্রোকে রাজনীতিজ্ঞ হিসেবে পরিণত করে তোলে। তার নেতৃত্বে ঐতিহাসিক অভ্যুত্থানের মাধ্যমে স্বৈরাচারী বাতিস্তা সরকারের উৎখাত করে কিউবা দেশটির সমাজতন্ত্রের অভিমুখে যাত্রার রোমহর্ষক ইতিহাসের অনুরণন আজও ধ্বনিত হয় পৃথিবীর প্রতিটা প্রান্তে।
ক্ষমতায় আসীন হওয়ার পর থেকে ফিদেল মূলত জোড় দেন দ্বীপরাষ্ট্রে সমাজতন্ত্রকে স্থায়ী শক্ত ভিতের উপর দাঁড় করানোয়। বৈজ্ঞানিক সমাজতন্ত্রের পাঁচটি মূলভিত্তি হল সকলের জন্য খাদ্য, বস্ত্র, বাসস্থান, শিক্ষা, চিকিৎসার অধিকার। ফিদেলের চোখে শিক্ষা ও স্বাস্থ্য ব্যবস্থা হল বিপ্লবের স্থায়িত্বের পিলসুজ। তাই কমিউনিস্ট আদর্শ অনুযায়ী দেশ চালনায় সর্বাধিক গুরুত্ব দেওয়া হয় শিক্ষা ও চিকিৎসায়। প্রধানত ফিদেলের অভিভাবকত্বে কিউবা স্বাস্থ্য ও শিক্ষায় বিশেষ উৎকর্ষতা লাভ করে। ফিদেলের মৃত্যুর পর কানাডার প্রধানমন্ত্রী জাস্টিন ট্রুডো বলতে বাধ্য হন ‘মিস্টার কাস্ত্রো একজন কিংবদন্তী বিপ্লবী ও বক্তা’, তার আমলে দ্বীপরাষ্ট্রে স্বাস্থ্য ও শিক্ষায় চমকপ্রদ উন্নয়ন হয়।’
বিপ্লবের আগেও কিউবার সংবিধানে সকল শিশুর শিক্ষার অধিকার স্বীকৃত ছিল। প্রতিশ্রুতি ছিল বাজেটে শিক্ষাকে অগ্রাধিকার দেওয়ার। কিন্তু বাস্তবের সাথে তফাৎ ছিল বিস্তর।
ক্ষমতাসীন হওয়ার পর কাস্ত্রোর নেতৃত্বাধীন সরকার বাধ্যতামূলক করে সকলের শিক্ষার অধিকারকে। বাতিস্তা আমলের সেনা ছাউনির জায়গায় মাথা তোলে একের পর এক সরকারি স্কুল। সরকারি বাজেটে অগ্রাধিকার পায় শিক্ষাখাতে খরচ। জোর দেওয়া হয় টেকনিক্যাল কলেজ,মেডিক্যাল কলেজ তৈরীতে। ১৯৬১ সাল থেকে শুরু হয় সারা দেশব্যাপী শিক্ষা অভিযান। ১০-১৬ বছর বয়সী ছাত্রছাত্রীদের বিশেষ প্রশিক্ষণ দেওয়া হয়। তারাই সারা দেশজুড়ে প্রাপ্তবয়স্ক মানুষদের শিক্ষার আলোর হদিশ দেওয়ার মিশন শুরু করেন। এটাই মার্কসবাদ, লেনিনবাদের মূলগত শিক্ষা।
ফল মেলে হাতেনাতে। ১৯৫৩ সালে কিউবার ৬-১৪ বছরের শিশুদের মধ্যে সাক্ষরতার হার ছিল ৪৪%। ১৫-১৯ বছরের ছাত্রছাত্রীদের মধ্যে মাত্র ১২% ছিল পাঠরত।৫০ এর দশক জুড়ে কিউবার গড় সাক্ষরতার হার ছিল ২৩%। মার্কসবাদ নামক আশ্চর্য প্রদীপের সংস্পর্শে বদলে গেল চিত্রপট। সোভিয়েত ইউনিয়নের পতনের আগে অবধি কিউবায় শিক্ষাখাতে ব্যয় বরাদ্দ ছিল ৩৪%। যুব জনসংখ্যার মধ্যে আজ কিউবায় সাক্ষরতার হার ১০০%।স্কুল,কলজে নিযুক্ত শিক্ষকদের ৬০% মহিলা। ১৯৫৯ এর পর মাত্র ১০ বছরে টেকনিক্যাল কলেজ ও বিশ্ববিদ্যালয়ে ছাত্র সংখ্যা বৃদ্ধি পায় যথাক্রমে ২৪০০০ ও ২০০০০।
শিক্ষার পাশাপাশি ফিদেল সরকার জোড় দেয় স্বাস্থ্যব্যবস্থার হালহকিকত বদলে।দেশের সাধারণ মানুষের অনাহার,ব্যাধি দূর করে,জীবনের মানোন্নয়নের জন্য সদ্য ভূমিষ্ঠ সরকার গুরুত্ব আরোপ করে প্রাথমিক স্বাস্থ্য ব্যবস্থা ঢেলে সাজানোর জন্য। ফ্যামিলি ফিজিশিয়ান - ফ্যামিলি হেলথকেয়ার প্রফেসনাল এর মাধ্যমে কার্যত চিকিৎসাব্যবস্থা পৌঁছে যাচ্ছে সাধারণের উঠোনে।প্রতি হাজার পরিবারের জন্য আছে ১ জন চিকিৎসক,বছরে অন্তত একবার সেই পরিবারের চেক আপ করা যায় বাধ্যতামূলক। সাম্রাজ্যবাদী আমেরিকা যখন দেশে দেশে সৈন্য, অস্ত্র মজুত করে- ফিদেল, চে’র উত্তরাধিকার কিউবার প্রায় ৩০০০০ চিকিৎসক, স্বাস্থ্যকর্মী তখন বিশ্বে ৬০টি দেশে চিকিৎসা পৌঁছে দিতে ব্যস্ত।
স্বাস্থ্যখাতে কিউবার ব্যয় বরাদ্দ বাজেটের ১০%। বর্তমান সময় মানুষের গড় আয়ু বেড়ে হয়েছে ৭৮.৭ বছর। ১৯৫৯ এ শিশুমৃত্যুর হার ছিল প্রতি ১০০০ এ ৩৭.৩। একটা সিস্টেমের বদল তাকে নামিয়ে আনলো ৪.২% যা সমগ্র লাতিন আমেরিকায় সর্বনিম্ন। ১৯৯৯ এ হাভানায় প্রতিষ্ঠিত লাতিন আমেরিকান স্কুল অফ মেডিসিন থেকে আজ অবধি বিশ্বের বিভিন্ন দেশের প্রায় ৩০০০০ ছাত্র-ছাত্রী চিকিৎসাশিক্ষা লাভ করেছে।
তবে সোভিয়েত ইউনিয়নের পতনের পর কিউবার সামনে উপস্থিত হয় চ্যালেঞ্জের সময়।সোভিয়েত থেকে আসা বিপুল পরিমাণ অনুদান বন্ধ হয়ে পথ চলা হয়ে ওঠে বিপদসঙ্কুল। শিক্ষা ও স্বাস্থ্যখাতে ব্যয় কমাতে বাধ্য হয় সরকার। তথাপি মাথা নীচু করেননি কাস্ত্রো। এখানেই কার্যকরী হয় তার দীর্ঘদিন ধরে মানুষের মধ্যে বপন করে আসা বিপ্লবের বীজ। চিকিৎসক, শিক্ষকরা নিজেদের পারিশ্রমিক কমিয়ে সাধারণ মানুষের জন্য পরিষেবা দিতে রাজি হন। সাধারণ ঘরের ছেলেমেয়েরা এগিয়ে আসেন শিক্ষকতার কাজের জন্য।
ফ্লোরিডার ৯০ কিমি দূরে অবস্থিত আয়তনে ওহিও প্রদেশের থেকেও ছোট এক রাষ্ট্রের এই বেপরোয়া মনোভাব আমেরিকা মেনে নেয়নি কখনও। একের পর এক অযৌক্তিক নিষেধাজ্ঞা জারি করে অর্থনৈতিক ভাবে পঙ্গু করে দিতে চেয়েছে কিউবাকে। সমস্যার প্রতিকারেও কিউবার ঢল হয়েছে শিক্ষা ও স্বাস্থ্য। কিউবার ৭০% বিদেশী মুদ্রা আমদানির উৎস স্বাস্থ্য। বিভিন্ন দেশে চিকিৎসা সরঞ্জাম,ওষুধ এমনকি চিকিৎসক স্বাস্থ্যকর্মী পাঠিয়ে বা মেডিক্যাল টুরিজমের মাধ্যমে আর্থিক ভিত্তি শক্তিশালী হয়েছে কিউবার। শিক্ষার বিভিন্ন উদ্ভাবন বিপণনের মাধ্যমেও এই দেশ গুরুত্বপূর্ণ উপার্জন করে থাকে।
কাস্ত্রো - সাভেজের নেতৃত্বে এই শতাব্দীর দোরগোড়ায় পিংক টাইডে ভর করে স্বাবলম্বী হওয়ার স্বপ্ন দেখেছিল লাতিন আমেরিকা। কিন্তু সাভেজের মৃত্যু, ফিদেলের অসুস্থতার ফলে ফিকে হয়ে আসতে থাকে গোলাপী বিপ্লব। বলিভারের আমেরিকায় সাম্প্রতিক সময়ে যেন আবার সেই বামপন্থার প্রত্যাবর্তনের রূপকথা। বলিভিয়া, আর্জেন্টিনা, নিকারাগুয়া, হন্ডুরাস, কলম্বিয়া, চিলি একের পর এক রাষ্ট্র ভরসা রাখছে বাম পথে। বোরিক থেকে পেত্র, মোরালেস থেকে ওর্তেগা সবার মুখেই কাস্ত্রোর উত্তরাধিকার বহনের শপথ। প্রতিটা দেশের সরকারই গুরুত্ব আরোপ করেছে শিক্ষা, স্বাস্থ্যে। সদর্পে ঘোষণা করছে ইয়াংকি বিরোধী অবস্থান। অবিনশ্বর হয় উঠছেন ফিদেল। আন্দিজ জুড়ে উদ্ভাসিত হয়ে উঠছেন বলিভার, ফিদেল, চে, সাভেজরা।
সাম্প্রতিক কালে আমাদের দেশের স্বাস্থ্য ও পরিবারকল্যাণ দফতরের সমীক্ষা জানান দিয়েছে আমাদের দেশে ৬ মাস- ৫ বছর বয়সী শিশুদের মধ্যে গত ৮ বছরে রক্তাল্পতার হার বৃদ্ধি পেয়েছে ৯%। হাঙ্গারওয়াচ নামক বেসরকারি সংস্থার সমীক্ষা জানাচ্ছে বাংলায় ৬৯% মানুষ প্রতিদিন অভুক্ত থাকছেন।
সমীক্ষাগুলির ভয়াবহ তথ্য আমাদের জানিয়ে যাচ্ছে গোটা ব্যবস্থাটা ভেঙে পড়ার কথা। এখানেই বিশ্বজনীন হয়ে উঠছেন ফিদেল, তার প্রবর্তিত কিউবার শিক্ষা, স্বাস্থ্যের অভূতপূর্ব অগ্রগতির মাধ্যমে।