Site icon CPI(M)

পরিবেশ রক্ষা ও আন্তর্জাতিক বাম আন্দোলন : সাম্যজিত গঙ্গোপাধ্যায়…

৫ জুন ২০২২, (রবিবার)

মানবসভ্যতার ইতিহাসের একটা অংশ যদি খালি মানুষের ইতিহাস হয়ে থাকে, তবে বাকিটুকু মানুষের এবং প্রকৃতির, একত্রে। মানুষ প্রকৃতির সন্তান, পরিস্থিতির ফসল। তা সত্ত্বেও, পরিবেশের সঙ্গে সম্পর্কটা চেতনার স্তরে যেন বৈরিতার, সংঘাতের। উন্নততর প্রযুক্তি, বিশ্বায়ন মানুষের প্রকৃতির প্রতি নির্ভরশীলতা কমাতে পারেনি, উল্টে সংঘাতের মাত্রারই বৃদ্ধি ঘটিয়েছে আরো। বিপন্ন প্রকৃতি, পরিবর্তিত জলবায়ু যেমন একদিকে উত্তরোত্তর সংকট উপস্থিত করছে, তেমনই পুঁজিবাদ এখনও বাড়তি মুনাফার সন্ধানে, ‘বীরভোগ্যা বসুন্ধরা’-র অজুহাতে সমগ্র মানবজাতির কবর খুঁড়ে চলেছে। এক আম্ফানেই আর্থিক ক্ষয়ক্ষতির পরিমাণ ছিল প্রায় চোদ্দো বিলিয়ন মার্কিন ডলার। এবং সেই ক্ষতিটা প্রায় পুরোপুরিই দক্ষিণবঙ্গের সাধারণ খেটে-খাওয়া মানুষের। উল্টোদিকে মার্কিন তেল কোম্পানি এক্সনমোবিল এই ২০২১-এ মন্দার বাজারেও লাভ করেছে প্রায় তেইশ বিলিয়ন মার্কিন ডলার, পুরোটাই তেল ও প্রাকৃতিক গ্যাস থেকে। প্রকৃতি এবং মানুষের যৌথ বিপন্নতার মাঝেও যখন পুঁজি স্পষ্টই বেছে নেয় মুনাফাকে, তখন বামপন্থীদের কর্তব্য হয়ে দাঁড়ায় পরিবেশরক্ষা। কারণ লড়াইটা স্রেফ প্রকৃতিকে বাঁচাবার নয়, মানুষের নিজের বাঁচারও।

রাজনীতিতে পরিবেশ-ভাবনা নতুন বিষয় না। ঊনবিংশ শতাব্দীর শুরুর দিকের রোমান্টিসিজম পরিবেশ রক্ষার পক্ষে সজোরে সওয়াল করে, যদিও তা শিল্প বিপ্লবের পরিবর্তনশীল পরিস্থিতির সামনে অতীতকে ধরে রাখার তাগিদে। বিংশ শতাব্দীর প্রথম ভাগ অবধি ইউরোপীয় রাজনীতিতে প্রকৃতি-চিন্তা মূলত সেই রোমান্টিক ধারণার উপরেই তৈরি। এর মাঝে মার্ক্স-এঙ্গেলসের লেখায় প্রকৃতি ও পুঁজির সম্পর্কের কথা এসেছে, ক্রপটকিন সম্পদের যৌথ মালিকানার মধ্যে প্রাকৃতিক সম্পদ শুধু নয়, সমগ্র প্রকৃতিকেই রাখতে চেয়েছেন। বিপ্লবের পর রাশিয়া, চীনেও পরিবেশ রক্ষার্থে পদক্ষেপ নিয়েছে কমিউনিস্ট পার্টি পরিচালিত সরকার। কিন্তু সরাসরি পরিবেশ রক্ষায় গণআন্দোলন দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ-পরবর্তী যুগের ফসল। একদিকে ক্রমাগত পরিবেশ দূষণ ও বিশ্ব উষ্ণায়নের ফলে একাধিক দুর্যোগ (যার সবথেকে ভয়ঙ্কর উদাহরণ সম্ভবত লন্ডন স্মগ), সাথে জ্বালানি সংকট, সঙ্গে ঠান্ডা যুদ্ধের ভ্রুকুটি – এমন পরিস্থিতিতে ইউরোপে ‘পরিবেশবাদী’, ‘ecologist’, ‘environmentalist’ বা ‘green’ আন্দোলনগুলো প্রত্যেকেই শুরু হয় যুদ্ধবিরোধী, পারমাণবিক অস্ত্রবিরোধী আন্দোলন হিসেবে।

কিন্তু আন্দোলন এটুকুতেই সীমাবদ্ধ ছিল এমনটা নয় – ষাট ও সত্তরের দশকের সর্বব্যাপী সামাজিক সংকট এই আন্দোলনকে ঠেলে দেয় মানবমুক্তির দিকে, পুঁজিবাদ-বিরোধিতার দিকে। পুঁজির বিরোধিতা ছাড়া পরিবেশ দূষণের বিরোধিতা করা যাবে না, পরিবেশবাদী আন্দোলনের শুরু থেকেই এটুকু স্পষ্ট ছিল সবার কাছে। আন্দোলনের মূল সংগঠক বিভিন্ন কমিউনিস্ট ও সোশ্যালিস্ট পার্টি এবং বাম গণসংগঠন। পশ্চিম ইউরোপের প্রায় প্রত্যেক দেশেই তৈরি হয় পরিবেশবাদী দল বা গ্রীন পার্টি। নেদারল্যান্ডসে কমিউনিস্ট পার্টি, প্যাসিফিস্ট সোশ্যালিস্ট পার্টি ও অন্যান্য সহযোগী দল মিলে তৈরি করে গ্রীন লেফট, ডেনমার্কে তৈরি হয় রেড-গ্রীন মুভমেন্ট, আইসল্যান্ডে লেফট-গ্রীন এলায়েন্স। পরিবেশবাদীদের মধ্যে সবথেকে শক্তিশালী দল হিসেবে উঠে আসে জার্মানির এলায়েন্স নাইনটি-গ্রীন পার্টি।  নব্বইয়ের দশকে নয়া উদারবাদের হাত ধরে সোশ্যাল ডেমোক্র্যাট দলগুলির আরো দক্ষিণে সরতে থাকার পর বাম রাজনীতিতে সোশ্যাল ডেমোক্র্যাটদের ফেলে আসা জায়গার বেশ খানিকটা দখল করে পরিবেশবাদী দলগুলো। নির্বাচনী সাফল্য পাবার সাথে সাথেই বেশ কিছু সদর্থক সংস্কারও সম্ভবপর হয়ে ওঠে এই বিভিন্ন গ্রীন পার্টিদের হাত ধরে। কিন্তু সব সাফল্য দীর্ঘস্থায়ী হয়নি, উল্টে পরিবেশবাদী দলগুলো শ্রেণীবিচ্ছিন্ন হয়েছে বহু জায়গায়, সোশ্যাল ডেমোক্র্যাটদের মতোই ধাবমান হয়েছে মধ্য-দক্ষিণপন্থার দিকে। জার্মানির গ্রীন পার্টির উদাহরণই ধরা যাক। ইউরোপের সবথেকে বড় গ্রীন পার্টি ২০২১-এর সাধারণ নির্বাচনের আগে দাবি করে বসে, তারা গণআন্দোলন এবং বাণিজ্য- দুয়েরই হাত ধরতে চায় একসাথে। গ্রীনদের পরিবেশ রক্ষায় নেওয়া পদক্ষেপের মূল লক্ষ্যবস্তু তুলনামূলক রুগ্ন এবং দূষণ সৃষ্টিকারী শিল্পগুলো। এই শিল্পগুলো বন্ধ হলে সে অর্থে পুঁজিপতিদের তেমন সমস্যা নেই, বরং সুবিধাই হয় যদি কারখানা সরিয়ে নেওয়া যায় এমন কোথাও যেখানে শ্রম সস্তা, পরিবেশের বিধিনিষেধ কম। কিন্তু de-industrialization এর ফলে যে বেকারিত্ব, আর্থিক সংকট সৃষ্টি হবে তার প্রতিকার করার বিষয়ে নিশ্চুপ গ্রীনরা। জ্যাকবিন পত্রিকার দেওয়া ‘বাইসাইকেলে সওয়ার নয়া উদারবাদ’ নামটা নেহাত ভুল লাগে না এই পরিস্থিতিতে।


তবুও, এত বিচ্যুতি সত্ত্বেও, পশ্চিম ইউরোপের পরিবেশবাদী আন্দোলনকে পুরোপুরি ব্যর্থ হিসেবে দেগে দেওয়া যায় না। ইউরোপীয় গ্রীন রাজনীতির সবথেকে গুরুত্বপূর্ণ অবদান সম্ভবত পরিবেশ রাজনীতিতে শ্রেণীচেতনার বিকাশ ঘটানো। নরওয়ের রেড-গ্রীন বা হল্যান্ডের গ্রীন লেফটরা বাম অবস্থানে অনড় থেকেই পরিবেশবাদী রাজনীতি করছে, সাফল্য পাচ্ছে। শুধু পোশাকি ‘গ্রীন’ বা ‘ইকোলজিস্ট’ নামধারী দল নয়, বহু মূলধারার radical বাম ও কমিউনিস্ট পার্টিও লড়াই করে চলেছে পরিবেশবাদী agenda-কে নিয়ে। নির্মিত হচ্ছে নতুন বিশ্বের স্বপ্ন।

ইউরোপ বা আমেরিকার সাথে লাতিন আমেরিকার পরিবেশবাদী রাজনীতির মূল ফারাক তার উৎসে। লাতিন আমেরিকার পরিবেশ রক্ষার রাজনীতির উৎপত্তিই হয়েছে আগে সমাজের দুর্বলতম অংশের জীবন-জীবিকা ও বাসস্থান রক্ষার রাজনীতি হিসেবে। লাতিন আমেরিকায় জন্মমুহূর্ত থেকেই পরিবেশবাদী রাজনীতি পুঁজিবাদ-বিরোধী। চিকো মেন্ডেসের নামের সাথে আমরা মোটামুটি সকলেই পরিচিত। ব্রাজিলের রাবার প্ল্যান্টেশনের শ্রমিক চিকো একদিকে নেতৃত্ব দিয়েছিলেন সংঘবদ্ধ শ্রমিক আন্দোলনের, অপরদিকে সেই শ্রমিক আন্দোলনকেই রূপান্তরিত করেছিলেন পরিবেশ রক্ষার লড়াইয়ে। রাবার প্ল্যান্টেশনের মালিকদের চক্ষুশূল হয়ে ওঠা চিকো ১৯৮৮-র ২২ ডিসেম্বর খুন হন মালিকপক্ষের ভাড়াটে গুণ্ডাদের হাতে। মৃত্যু অমরত্ব দিয়েছে চিকোকে। চিকো মেন্ডেস না থাকুন, রয়ে গেছে উপজাতি, কৃষক ও রাবার শ্রমিকদের নিয়ে তাঁর হাতে গড়ে তোলা সংগঠন, রয়ে গেছে তাঁর অমোঘ উক্তি, ‘শ্রেণীসংগ্রাম ছাড়া পরিবেশবাদী রাজনীতি হলো বাগান করার সমতুল্য’। কিন্তু লাতিন আমেরিকায় পরিবেশবাদ স্রেফ চিকো মেন্ডেসেই শুরু এবং শেষ নয় – প্রচারের আলো তেমন না থাকলেও তার ব্যাপ্তি ইউরোপের থেকে কম নয় কোনো অংশে। এই রাজনীতির মূল ভিত্তি হলো আদিবাসী ও উপজাতি মানুষের অধিকারের লড়াই। সর্বগ্রাসী কর্পোরেট পুঁজি এবং মার্কিন সাম্রাজ্যবাদের হাত থেকে অরণ্য ও প্রকৃতিকে রক্ষা করার লক্ষ্যেই এই রাজনীতি। কারণ আমাজন-আন্দিজের প্রকৃতিকে রক্ষা না করতে পারলে বিপন্ন তাদের নিজেদের অস্তিত্ত্বও – এ কথা লাতিন আমেরিকার মানুষ পাঁচশো বছর ধরে ইউরোপীয় ও মার্কিনি ঔপনিবেশিক শোষণে ভালো করে বুঝে গেছেন। হোসে মারাতেগুই চেষ্টা করেছিলেন মার্ক্সবাদকে মেলাতে উপজাতি সমাজের বিকেন্দ্রীভূত, সামাজিক মালিকানা নির্ভর ব্যবস্থার সাথে মেলাতে। জীবদ্দশায় সেই সাফল্য তিনি দেখে যেতে পারেননি। কিন্তু আজ মার্কিন সাম্রাজ্যবাদের আতঙ্ক হয়ে উঠেছে যে বামপন্থী শক্তি, তার ভিত্তিপ্রস্তর একদিন স্থাপন করে গেছিলেন মারাতেগুইই। চিলি, পেরু, বলিভিয়া, ভেনেজুয়েলায় জয়ী হয়েছে বামেরা। ব্রাজিল, কলম্বিয়া, উরুগুয়েতে জয়ের মুখে দাঁড়িয়ে। এবং প্রত্যেক জায়গাতেই বাম আন্দোলনে শুধু পুঁজিবাদ বিরোধিতা নেই, আছে অরণ্য রক্ষা, অরণ্যবাসীর অধিকার রক্ষার শপথ।
শ্রমজীবী মানুষের নেতৃত্বে পরিবেশরক্ষার রাজনীতিতে লাতিন আমেরিকার সাফল্য অনুপ্রেরণা দিয়েছে অন্যত্রও। উত্তর-পূর্ব সিরিয়ায় বিভিন্ন বামপন্থী বিপ্লবী গোষ্ঠী ইসলামিক স্টেট ও তুর্কি সাম্রাজ্যবাদকে পরাস্ত করার পর সামাজিক পুনর্গঠনের চেষ্টা করে চলেছে, যা সচরাচর রোজাভা বিপ্লব নামে পরিচিত। রোজাভা বিপ্লবেও সমাজতন্ত্র নির্মাণে পরিবেশবাদ গুরুত্বপূর্ণ অঙ্গ। এবং এই পরিবেশবাদের মূল ভিত্তি, লাতিন আমেরিকার মতোই, সেই শ্রমজীবি জনতাই। শিল্পে-সাহিত্যে যতই মানুষ এবং প্রকৃতিকে বিরুদ্ধপক্ষে দাঁড় করানো হোক না কেন, আসলে তো আমরা একই। একে-অপরকে ছাড়া চলবে কী করে!

ইউরোপ বা আমেরিকার তুলনায় এই পরিবেশ সংকটে অনেক বেশি বিপন্ন তৃতীয় বিশ্বের তুলনামূলক অনুন্নত, দুর্বল, জনবহুল দেশগুলো। ভারত বা বাকি উপমহাদেশ, কেউই ব্যতিক্রম নয় তার থেকে। এবং তাই, পরিবেশ রাজনীতি আরো বেশি গুরুত্বপূর্ণ আমাদের জন্য। এই পরিস্থিতিতে ইউরোপ এবং লাতিন আমেরিকা, দু’জায়গারই পরিবেশবাদী আন্দোলনের সাফল্য ও ব্যর্থতা থেকে আমাদের শিক্ষা নিতে হবে। পরিবেশরক্ষা স্রেফ গাছপালা বাঁচানো বা দূষণ কমানোয় সীমাবদ্ধ নয়, এর মূল লক্ষ্য মানুষের জীবন, জীবিকা এবং সংস্কৃতি রক্ষা – এই ধারণাটা জনগণের কাছে তুলে ধরা বামপন্থীদের প্রাথমিক কর্তব্য। কর্পোরেট লালসার প্রথম এবং প্রধান শিকার অনগ্রসর শ্রেণীর শ্রমজীবী মানুষ – ছোটনাগপুরের অরণ্য থেকে সুন্দরবন, উত্তরাখণ্ড থেকে উত্তরপূর্ব ভারত, বিপর্যয়ের বলি তারাই। প্রকৃতি রক্ষার আন্দোলনকে তাদের অধিকার রক্ষার লড়াইয়ে পরিণত করা জরুরি। লাতিন আমেরিকার শিক্ষা এখানে পাথেয় হতে পারে আমাদের।

একই সঙ্গে নাগরিক পরিসরে পরিবেশবাদী আন্দোলনের ক্ষেত্রে ইউরোপের মতো ব্যর্থতা এড়ানোর প্রতিও সচেতন হওয়া আমাদের কর্তব্য। গণপরিবহনের উন্নতি, পরিচ্ছন্ন জ্বালানি ব্যবহারের মতো ক্ষেত্রে সদর্থক ভূমিকা নেওয়া যেমন আমাদের কর্তব্য, তেমনই দেখতে হবে যাতে শ্রমিকের অধিকার সুরক্ষিত থাকে, প্রযুক্তির প্রগতি যাতে শ্রমিক ছাঁটাইয়ের অজুহাত না হয়ে দাঁড়ায়। দেউচায় কয়লা খনি নির্মাণ নিয়ে এখন রাজ্য ও কেন্দ্র, দুই সরকারই বদ্ধপরিকর – কর্পোরেট স্বার্থ শিরোধার্য তাদের কাছে। যতই চেষ্টা চলুক গোটা বিষয়টাকে কৃষি বনাম শিল্পের লড়াইয়ের স্তরে নামিয়ে দিতে, দেউচার লড়াই আদতে বাসস্থান রক্ষার লড়াই, প্রকৃতির সাথেই জীবন-জীবিকা ও সংস্কৃতি রক্ষার লড়াই। দেউচা-পাচামিতে কয়লাখনি তৈরি হওয়া মানে এক অভূতপূর্ব প্রাকৃতিক বিপর্যয়ের পথ খুলে যাওয়া। আর তাই, কয়লা খনি ও পাথর খাদান আটকাবার এ লড়াইয়ে পরাজয় হলে স্রেফ বামপন্থী বা পরিবেশবাদীদের পরাজয় হবে না, পরাজয় হবে সাধারণ মানুষের। আর তাই, লড়াইটা জানকবুল।

শেয়ার করুন