…আমার পানে চেয়ে চেয়ে খুশি থাকো
২০১৬ সালের জুলাই মাসে ভারত তার দেশে নয়া উদার অর্থনৈতিক নীতির ও নয়া উদারনৈতিক সংস্কার নীতির পঁচিশ বছর পার করেছে। সেই সময় সি পি আই (এম)’র কেন্দ্রীয় কমিটি ‘নয়া উদারনীতির প্রকোপে শ্রমিকশ্রেণীর সামাজিক- অর্থনৈতিক পরিবর্তন’ সম্পর্কিত একটি নোট প্রকাশ করে। সেই নোটে বলা হয়েছিল ভারতের শ্রমিক শ্রেণীর বাহিনী অনেক বড়, বেশিরভাগ দেশের শ্রমিকশ্রেণীর সংখ্যা যা, তার থেকে অনেক বেশি। কৃষির ভয়াবহ সংকটে কৃষি ছেড়ে বেরিয়ে আসছে মানুষ। তারা যুক্ত হচ্ছে অকৃষিকাজে । শ্রমিকের পরিচয়ে বেঁচে থাকার জন্য। নিজেদের শ্রমশক্তিকে বিক্রি করতে। শ্রমিক হিসাবে বেশিরভাগের কর্মসংস্থান হচ্ছে অসংগঠিত ক্ষেত্রের বিভিন্ন অংশে। এদেশে শ্রমের বিপুল মজুত বাহিনী ( বিগত লোকসভা নির্বাচনের আগে ফাঁস হওয়া এক সমীক্ষায় প্রকাশ হয়েছিল দেশে বেকারীর হার মোট শ্রমশক্তির ৬.১ শতাংশ ২০১৭-১৮তে। শেষ ৪৫ বছরে যা সর্বোচ্চ)।
সেই চাপেই প্রকৃত মজুরি হ্রাস পাচ্ছে, উৎপাদনশীল ক্ষেত্রে শ্রমিকদের শোষণ বাড়ছে। পুঁজির ক্রমবর্ধমান অত্যাচারের শিকার হচ্ছে। পুঁজিবাদের যে পর্ব চলছে তার বৈশিষ্ট্য হচ্ছে পুঁজির অত্যাচার জোরদার করার জন্য বিভিন্ন পদ্ধতি, প্রকল্প , প্রকরণ উদ্ভাবন করা। রাষ্ট্র শ্রমিকের স্বার্থের বিনিময়ে মালিক পক্ষকে তার মুনাফা বৃদ্ধির এই উদ্যোগে মদত দেয়।
সিপিআই (এম)’র পর্যবেক্ষণ সংক্রান্ত নোটে বলা হয়েছিল যে শ্রম আইনকে নমনীয় করে মালিকদের হায়ার এন্ড ফায়ার নীতি গ্রহণে সাহায্য করা হচ্ছে এবং এটি নয়া উদার নীতির একটি গুরুত্বপূর্ণ বৈশিষ্ট্য। গুরুত্বপূর্ণ শ্রম আইন ইত্যাদি সংশোধনের কাজ -গতি পেয়েছে। যদিও শ্রমিক আইন গুলি কার্যকরী আছে তবু রাষ্ট্রের ভূমিকা হয়ে দাঁড়িয়েছে ওইসব আইনকে বাস্তবায়িত করার পরিবর্তে ওইসব আইন ভাঙ্গাকেই উৎসাহিত করা। উদারনীতির যুগে বিচার ব্যবস্থাও আইনের ব্যাখ্যা করতে গিয়ে শ্রমিকের পাশ থেকে সরে পুঁজির পক্ষে দাঁড়াচ্ছে। রাষ্ট্রের এই ভূমিকাই পরিলক্ষিত হয়েছে বিজেপি – আরএসএস পরিচালিত কেন্দ্রীয় সরকারের সাম্প্রতিক ৪টি শ্রমকোড প্রণয়নে।
সলিল চৌধুরী লিখেছিলেন- পৃথিবীর ইতিহাসে কবে কোন অধিকার-বিনা সংগ্রামে শুধু চেয়ে পাওয়া যায়? আমাদের দেশের শ্রমিকদের নিজেদের জীবন অভিজ্ঞতালব্ধ দাবি, দাবি আদায়ের আন্দোলন, স্বাধীনতা এবং স্বাধীনতার পূর্বে সরকারকে শ্রম আইনগুলি গড়ে তুলতে বাধ্য করেছিল। শ্রম আইনগুলি এমনভাবে তৈরি করা হয়েছিল যা শ্রমিকের সুরক্ষা কবচ বলা চলে। সেই সুরক্ষা কবচগুলোই ধ্বংসের দিকে নিয়ে যাওয়া হয়েছে। দু’দিনের প্রচলিত শ্রম আইনে শ্রমিকদের অধিকার এবং সুবিধাগুলো কেড়ে নেওয়া হয়েছে অথবা খর্ব করা হয়েছে নতুন শ্রম কোডে। সংবিধানের মৌলিক অধিকার পর্যন্ত খর্ব করা হয়েছে। নতুন শ্রমকোডকে অভিযুক্ত করা হচ্ছে সংবিধানের ১৪, ১৯(১), ২১, ২৩, ২৪ ধারা লঙ্ঘন করার, নির্দেশাত্মক নীতির ৩৯(এ),৪১ থেকে সরে আসার। অর্থাৎ আইনের চোখে সমতা, অ্যাসোসিয়েশনের অধিকার, রাষ্ট্রের জীবন ও ব্যক্তি-স্বাধীনতা রক্ষা, বলপূর্বক কাজ না করানো, ১৪ বছরের কমবয়স্ক শিশুকে দিয়ে কাজ না করানো, বেঁচে থাকার জন্য সমান অধিকার দিতে রাষ্ট্রের বাধ্য থাকা, কাজ ও শিক্ষার অধিকারকে রাষ্ট্রের পক্ষ থেকে সুরক্ষিত করা-এই সব কিছুকে পাশ কাটিয়ে শ্রম দাসত্বের উদ্দেশ্যে শ্রমকোড তৈরি করা হয়েছে।
ইন্ডাস্ট্রিয়াল ডিসপিউট অ্যাক্ট১৯৪৭, দি ট্রেড ইউনিয়ন অ্যাক্ট ১৯২৬, ইন্ডাস্ট্রিয়াল এম্প্লয়মেন্ট (স্ট্যান্ডিং অর্ডারস) অ্যাক্ট ১৯৪৬-এই তিনটি পুরনো শ্রম আইনকে সংস্কারের কথা ওঠে, বলা হয় ৯৪ বছর আগেকার আইন! এই সময়ে কাজ, কাজের পরিস্থিতি, দেশের অর্থনীতি, শ্রমিকের চরিত্র সবই বদলেছে। ২০০২ সালের জুন মাসে দ্বিতীয় জাতীয় লেবার কমিশনের সুপারিশ ছিল মজুরি, শ্রম, শ্রম বিরোধ, শিল্প বিরোধ বিষয়ক আইনগুলি সুসংবদ্ধ ও সময়োপযোগী করা- শ্রমিকের স্বার্থে। সেই সংস্কার হলো, কিন্তু তা শ্রমিকের স্বার্থের সম্পূর্ণ বিপরীতে।
আইনগুলি সম্পূর্ণ তৈরি হওয়ার আগে কেন্দ্রীয় ট্রেড ইউনিয়নগুলো এবং বিভিন্ন সংস্থা বিভিন্ন রকম পরামর্শ সরকারকে দেয়। সরকার সেগুলোকে তোয়াক্কা করেনি। যে ক্ষুদ্র পরিবর্তন হয়েছিল সেই পরিবর্তনটা একেবারে সাধারণ প্রসাধনী পরিবর্তন। আসলে পুঁজির কাছে বিকিয়ে দেওয়াটা পাকাপাকি ছিল বলে পরিবর্তনের কোনো সুযোগ ছিল না।
প্রথমে আসে মজুরি সংক্রান্ত কোড। আগের এই সংক্রান্ত চারটি আইনকে বাতিল করে। এরমধ্যে সবচেয়ে পুরনোটি ১৯৩৬ সালের। নতুন এই কোড ঠিক করবে শ্রমিকের ন্যূনতম মজুরি,পেনশন, সাধারণ মজুরি ইত্যাদি। এটি গুরুত্বপূর্ণ এই কারণে যে দেশের ৪৬ কোটি শ্রমজীবী মানুষ আছেন যার ৪৯ শতাংশ মজুরির উপর নির্ভরশীল।
১৯৪৮ এর ন্যুনতম মজুরি আইনে গঠিত ত্রিপাক্ষিক কমিটি শ্রমিকের ন্যূনতম মজুরি প্রসঙ্গে বলেছিল-ন্যুনতম মজুরি শ্রমিককে শুধু তার জীবনের অস্তিত্ব রক্ষার জন্যই দেওয়া হবে না, তার দক্ষতা রক্ষার জন্য শিক্ষা ,স্বাস্থ্য, বিনোদনের বিষয়ও বিবেচনায় থাকবে। পরিবারকে ৩ ইউনিট ধরে ইউনিট পিছু ২৭০০ ক্যালরি শক্তি সম্পন্ন খাবার, পরিবার পিছু ৭২ গজ পরিধেয় কাপড়, ন্যূনতম বাড়ি ভাড়া ছাড়াও জ্বালানি, আলো ইত্যাদির জন্য কুড়ি শতাংশ অতিরিক্ত ন্যুনতম মজুরিতে যুক্ত করা হয়।
১৫তম ভারতীয় শ্রম সম্মেলনে বলা হয়েছিল ন্যুনতম মজুরি হবে এমন যা মানবিক প্রয়োজন মেটাতে সক্ষম। ১৯৯১তে সুপ্রিম কোর্টের ঐতিহাসিক রায় ঘোষণা করে শ্রমিকের ন্যূনতম মজুরি নির্ধারণে তার ছেলেমেয়েদের পড়াশোনার, স্বাস্থ্যখরচ, উৎসবের বিনোদন , বার্ধক্য, বিবাহ ইত্যাদি বিষয় দেখার জন্য ২৫ শতাংশ অতিরিক্ত যুক্ত করতে হবে। কেন্দ্রীয় বেতন কমিশনের ন্যুনতম মজুরি নির্ধারণে এই সব ভাবনার সঙ্গে বাজারদরকে মাথায় রেখে বিজ্ঞান ভিত্তিক ন্যুনতম মজুরি পূর্বের ৭০০০ থেকে ১৮০০০ টাকা করার সুপারিশ করা হয়।২৯শে জুন ২০১৬ কেন্দ্রীয় সরকার তা গ্রহণ করে। নতুন শ্রমকোডে দেশে শ্রমিকের গড় ন্যূনতম দৈনিক মজুরি আগের চেয়ে ২ টাকা বেড়ে ১৭৮ টাকা হয়েছে। মানে মাসে ৪৬২৮ টাকা। এটাই নাকি হবে ন্যাশনাল ফ্লোর লেভেল মিনিমাম ওয়েজ।
৩১টি রাজ্য, কেন্দ্রশাসিত প্রত্যেক অঞ্চলেই এর চেয়ে বেশি ন্যূনতম মজুরি চালু ।আই এল ও বলেছে যে ভারতে ৪১ শতাংশ মানুষ মনে করে যে তারা স্বল্প মজুরি পান। এশিয়া-প্রশান্ত মহাসাগরীয় দেশগুলির ২২টির মধ্যে মজুরির দিক থেকে পিছনের দিকে চার নম্বরে ভারত। যে দেশে দারিদ্র বেকারি বৈষম্য, জিনিসের দাম ঊর্ধ্বমুখী সেই দেশে ন্যুনতম মজুরির সংস্কারের এই হাল। দেশের ৫৭ শতাংশ নিয়মিত কর্মী ১০,০০০ নিচে মাসিক মজুরি পায়। ক্যাজুয়াল কর্মীদের ৫৯ শতাংশের মাসিক মজুরি ৫০০০ টাকার নিচে।৮৪.৩ শতাংশের মাসিক মজুরি৭৫০০ টাকার নিচে। চুক্তি শ্রমিকের ৬৬.৭ শতাংশের মাসিক মজুরি ৭০০০ টাকার নিচে। এরকম এক অবস্থায় নতুন শ্রমকোডে ইউনিয়নের অধিকার থাকলো না কোম্পানির আয় ব্যয় হিসাব পরীক্ষা করার। মজুরি বৃদ্ধি কিংবা বোনাস নিয়ে দরকষাকষির অধিকার ও এতে ব্যাহত হল।
কোন সংস্থায় ন্যূনতম মজুরি যদি না দেওয়া হয় তাহলে শ্রমিকরা শ্রমবিবাদ করতে পারবে না। কোন সংস্থায় নোটিশ না দিয়ে দশ বা তার বেশি শ্রমিক ধর্মঘট করলে একদিনের জন্য আট দিনের বেতন কাটা যাবে।সমকাজে সম বেতনের প্রসঙ্গ এই কোডে উল্লেখ করাই হয়নি। এরপরেও রাজ্য সরকার গুলোকে যেমন খুশি ন্যূনতম মজুরি নির্ধারণের ছাড়পত্র দিয়েছে এই কোড। প্রশাসক, আমলারা তাদের মর্জি মত ন্যুনতম মজুরি ঠিক করবে ।দক্ষ, অদক্ষ শ্রমিকের কোন সীমারেখা রাখবে না। এর ফলে ন্যুনতম মজুরি কমানোর প্রতিযোগিতা করে এক রাজ্য থেকে আরেক রাজ্যে শিল্প ভাঙানোর পাল্লা শুরু হয়েছে। আগে শিল্পভিত্তিক ন্যূনতম মজুরি ছিল। এখন তো সময়ভিত্তিক, উৎপাদনের ওপর নির্ভরশীল হবে।
কারখানায় সময়ের স্বাভাবিক ঘন্টা রাজ্য সরকারের উপর ছেড়ে দেওয়া হয়েছে। সংগ্রাম অর্জিত শ্রমিকের ৮ ঘন্টা কাজ এখন ১২ ঘন্টা থেকে আরো উপরে উঠবে। একই ধরনের শিল্প পৃথক পৃথক কারখানায় পৃথক ন্যুনতম মজুরি থাকবে। আগে ন্যুনতম মজুরি তো হচ্ছে কিনা তা দেখার জন্য ইন্সপেক্টর ছিল। তার মান এখন উপদেষ্টায় নামিয়ে আনা হয়েছে। ইন্সপেক্টর এর হাতে কোন ক্ষমতা থাকবে না শুধু মালিককে পরামর্শ দেওয়া ছাড়া। শ্রম আইন লঙ্ঘন হলে মালিককে সময় দেওয়া হবে সংশোধিত হওয়ার জন্য। সেই সময়ের কোন সীমারেখা নেই। ন্যুনতম আগে মালিকের বিরুদ্ধে ফৌজদারি আইনে ব্যবস্থা নেওয়া যেত, তা উঠে গিয়ে এখন দেওয়ানী আইনে ব্যবস্থা নেওয়া হবে! শ্রমিক আদালতে যেতে পারবে না, ব্যবস্থার কাছে আবেদন করতে পারবে মাত্র।
ইন্ডাস্ট্রিয়াল রিলেশনস কোন ২০২০তে মালিকদের হাত শক্ত করা হয়েছে। স্থায়ী চাকরির পরিবর্তে ‘নির্দিষ্ট সময়ের জন্য চাকরি’র(Fixed Term Employment) অনুমতি দেওয়া হয়েছে। কোন সামাজিক সুরক্ষা থাকবে না, চাকুরীর নিরাপত্তা থাকবে না, অধিকার দাবি করতে পারবে না যদি তার কাজের পুনর্নবীকরণ না হয় এই ভয়ে। ঘুরিয়ে নাক দেখিয়ে মালিককে বলা হলো ‘হায়ার এন্ড ফায়ার’ করো। আগে ছিল ১০০, এখন বলা হলো ৩০০’র নীচে শ্রমিক থাকবে যে সংস্থায় সেখানে কোন সরকারি অনুমতি ছাড়াই লে অফ, ছাঁটাই ,ক্লোজার মালিক করতে পারবে। এতে ৭০ শতাংশ কারখানায় কর্মরত শ্রমিকরা বিপদগ্রস্ত হবে। দেশের ৭৪ শতাংশ সংগঠিত ক্ষেত্রের শ্রমিকদের স্বার্থহরণ করার সুযোগ মালিকের হাতে তুলে দেওয়া হল।
অধিকার অর্জনের স্বাভাবিক অস্ত্র ধর্মঘটকে হাতুড়ি দিয়ে স্তব্ধ করার ব্যবস্থা এই কোডে হয়েছে। ধর্মঘটের ৬০ দিন আগে নোটিশ দিতে হবে। শ্রমিক মালিকের আলোচনার মধ্যবর্তী সময়ে কোন ধর্মঘট করা যাবে না। সেই আলোচনা শেষ হয়ে যাওয়ার সাত দিনের মধ্যেও ধর্মঘট করা যাবে না। শিল্প বিরোধ ট্রাইব্যুনালে কোন মামলা নিষ্পত্তি হয়ে যাওয়ার ৬০ এর মধ্যেও কোন ধর্মঘট করা যাবে না। অমিত যদি এইসব আইন ভাঙ্গে তাহলে তার আর্থিক জরিমানা, কারাবাস ইত্যাদি হবে।
ট্রেড ইউনিয়নের দাবি ছিল আবেদনের ৪৫ দিনের মধ্যে ট্রেড ইউনিয়ন রেজিস্ট্রেশন দিতে হবে। এখন ট্রেড ইউনিয়ন রেজিস্ট্রেশন করার ক্ষেত্রে এমন বাধা তৈরি করা হয়েছে যাতে রেজিস্ট্রেশন পাওয়া প্রায় অসম্ভব হয়ে দাঁড়াবে। সমস্ত কিছু নিয়ম পালন করে ট্রেড ইউনিয়ন রেজিস্ট্রেশনের আবেদন করলেও রেজিস্টারের অধিকার থাকবে তা বাতিল করার। বলা হচ্ছে ন্যূনতম ১০০ জন শ্রমিক আবেদন না করলে ট্রেড ইউনিয়নের রেজিস্ট্রেশন দেওয়া হবে না আইএলও কনভেনশন ৮৭ এর পরিপন্থী।লেবার কোড বলে কিছু থাকবে না। এর অর্থ শ্রমদপ্তরে শ্রম আধিকারিক থাকবে না।আগের ট্রেড ইউনিয়ন অ্যাক্টে ছিল ট্রেড ইউনিয়নের পদাধিকারী তিন বছরের মধ্যে একবার নির্বাচন করার। এবার সেটা করা হলো দু’বছর। নতুন শ্রম কোড ট্রেড ইউনিয়ন এর আভ্যন্তরীণ কাজেও হস্তক্ষেপ করেছে। কোন ট্রেড ইউনিয়ন যদি মনে করে কোন ধর্মঘটে শ্রমিক অংশগ্রহণ করেনি বলে তাকে শাস্তি দেবে নতুন সমকোণ বলছে তা করা যাবে না। তার সদস্যপদ খারিজ করলে তাকে ফেরত দিতে হবে এবং উল্টে ট্রেড ইউনিয়নকেই ওই ব্যক্তিকে ক্ষতিপূরণ দিতে হবে। নয়া উদারনীতি প্রণীত ‘Trade Union Free Workplace’ এর যাবতীয় ব্যবস্থা শ্রম কোডের মাধ্যমে করা হয়েছে।
দি সোশ্যাল সিকিউরিটি কোড ২০২০ তৈরি হয়েছে এই সংক্রান্ত ৯টি আইনকে একত্রিত করে। স্বাধীনতার ৭৫ বছর পর মাত্র ৯.৩ শতাংশ শ্রমিক-কর্মচারী সামাজিক সুরক্ষা পেয়েছে। সেই সামাজিক সুরক্ষার ছিটেফোঁটাও এই নতুন কোডে থাকবে না।আগে সামাজিক সুরক্ষা না মানলে মালিকের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়া যেত এখন সে বাধ্যবাধকতা থাকবেনা।আগে সামাজিক সুরক্ষা আইন লঙ্ঘনকারীর জেলে যাওয়ার ধারা ছিল। এখন শুধু জরিমানা দিলেই হবে।
পি এফ,গ্রাচুইটি, মাতৃত্বকালীন সুবিধা ইত্যাদি স্টাটুইটরি বকেয়া মালিকের পক্ষে দেওয়া বাধ্যতামূলক। যদি কেউ না দিত তাহলে তার ৫ বছরের জেল হতো। এবারের আইনে তা কমে ৩ বছর হয়েছে। মালিকের বোঝা কমেছে,শ্রমিকের বোঝা বেড়েছে। অসংগঠিত ক্ষেত্রের শ্রমিকদের কল্যাণে গঠিত বিভিন্ন তহবিলগুলির অর্থ শ্রমিকদের কাছে পৌছাচ্ছে না। সরকার সেই অর্থ অন্য কাজে ব্যবহার করছে। এই তহবিল শ্রমিকদের জন্যই ব্যবহার করার জন্য কোন বাধ্যতামূলক নির্দেশিকা এই নতুন কোডে নেই। এছাড়া এই কোড সরকারী ঘোষণামত সার্বজনীনও নয়। ২০ বা তার বেশি শ্রমিক কাজ করেন এমন সংস্থা পি এফ আইনের আওতায় আসবে। ১০ বা তার বেশি শ্রমিক কাজ করে এমন সংস্থায় গ্রাচুইটি দেওয়া যাবে। ১০ বা তার বেশি শ্রমিক কাজ করে এমন সংস্থায় মাতৃত্বকালীন সুবিধাদি পাওয়া যাবে। দেশের শ্রম সংস্থার যে কাঠামো তাতে বোঝাই যাচ্ছে সামাজিক সুরক্ষা খুবই স্বল্পসংখ্যক মানুষের কাছে পৌঁছবে। এছাড়াও সামাজিক সুরক্ষার জন্য সরকারের যে আর্থিক দায়িত্ব অনুল্লেখিত থেকেছে।
দি অকুপেশনাল সেফটি, হেল্থ অ্যান্ড ওয়ার্কিং কন্ডিশন কোড২০২০ একটি অন্যতম নতুন শ্রমকোড। এই কোডে মোট ১৩টি পুরনো শ্রম আইনকে যুক্ত করা হয়েছে।এটা করার ফলে বিড়ি, নির্মাণ,মোটর ট্রান্সপোর্ট, আন্ত: রাজ্য পরিযায়ী শ্রমিক,সেলস প্রোমোশন,সিনে ওয়ার্কার্স ওয়েলফেয়ার বোর্ড এর ফলে উঠে যাবে। এক উল্লেখযোগ্য অংশ এই বোর্ডগুলি থেকে সুবিধা পেতো,এখন থেকে আর সেই সুবিধা পাবে না।
শ্রমকোডগুলির পুনর্গঠন পুরোটাই গোলমেলে। Recognition of negotiating unions,mode of verification of membership, ওয়েজ কি, ওয়ার্কার কে, এমপ্লয়ি কে, কোন কিছুই নির্দিষ্ট নয়। সরলীকরণ আর সময়োপযোগী করার নামে শ্রমিকদের অধিকার নিয়ে যথেচ্ছাচার করা হয়েছে। সরকারের অন্তরঙ্গ বন্ধু বৃহৎ পুঁজি ও কর্পোরেট সংস্থা যারা দেশের ও জনগণের সর্বনাশ করে চলেছে তাদের স্বার্থ রক্ষা করতে অনেক বেশি তৎপর আর এস এস – বিজেপির কেন্দ্রীয় সরকার। এরাই ভোগ করছে যাবতীয় সুবিধা। ব্যাংক লোনের টাকা লোপাট করছে। দেশের সম্পদ ,জনগণের অর্থ যারা লুট করছে তাদের আরো লুট করার ব্যবস্থার জন্য শ্রমিকের গলা কাটার ব্যবস্থা করা হয়েছে।
অতিমারিকালীন পরিস্থিতির সময় শ্রম আইন অকার্যকারি করার নেতৃত্ব দিয়েছিল বিজেপি পরিচালিত রাজস্থান সরকার। বিজেপি পরিচালিত উত্তর প্রদেশ সরকার বলেছিল শ্রম আইন স্থগিত রাখো তিন বছরের জন্য। মধ্যপ্রদেশের সরকার বলেছিল চুলোয় যাক শ্রম আইন ১০০০ দিনের জন্য। বিজেপির গুজরাট সরকার বলেছিল চাপা রাখো শ্রম আইন ১২০০ দিনের জন্য। মালিকদের সংস্থাগুলো -কাউনসিল অব ইন্ডিয়ান এম্প্লয়িজ ,ফিকি,অ্যাসোচেম আরজি জানিয়ে ছিল ২-৩ বছরের জন্য শ্রমিকের দিনে ১২ ঘন্টা কাজ বাধ্যতামূলক করার জন্য। তাদের সকল আশা পূর্ণ করে শ্রমকোডের সংস্কারের মাধ্যমে সরকার বৃহৎ পুঁজি আর কর্পোরেটকে বার্তা পাঠিয়েছে – তুমি খুশি থাকো, আমার পানে চেয়ে চেয়ে খুশি থাকো।