Woman in the mirror of the November Revolution – Madhuja Sen Roy



নভেম্বর বিপ্লবের ১০৭ বছর পরের বিশ্বে দাঁড়িয়ে শ্রমজীবী মহিলাদের অবস্থান নিয়ে আলোচনা করতে গেলে প্রথমেই যে কথা বলতে হয় এ বিশ্বের সমাজতান্ত্রিক ভাবধারায় উদ্বুদ্ধ মানুষেরাই প্রথম মেয়েদের অধিকার নিয়ে কথা বলেছিল। কাজের ক্ষেত্রে সমান মজুরি আর আদর্শ কাজের পরিবেশের দাবিতে সোচ্চার হয়ে ১৯০৮ সালে শিকাগো শহরে যে দর্জি শ্রমিকেরা ধর্মঘটে সামিল হয়েছিলেন তারাই তো প্রথম খেটে খাওয়া মেয়েদের কে শিখিয়েছিলেন লড়াই করে দাবি আদায়ের মন্ত্র। রোজা লুক্সেমবার্গ আর ক্লারা জেটকিনের নেতৃত্বে মেয়েদের লড়াইই তো প্রথম বলেছিল মেয়েদের ভোটাধিকার চাই। তারপর ১৯১৭ সাল। এই পৃথিবীর বুকে যাবতীয় ষড়যন্ত্র বিরোধিতা আর শত্রু তাকে পিছনে ফেলে মেহনতী জনগণের নেতৃত্বে তৈরি হল সোভিয়েত রাশিয়া। কেমন ছিল সোভিয়েতের কর্মরত মহিলারা ? খেটে খাওয়া মেয়েরা ?লেনিন বুঝেছিলেন, বিপ্লব যদি সফল করতে হয় তাহলে শ্রম শক্তিতে মেয়েদের যোগদান অত্যন্ত জরুরী।তিনিই তো বলেছিলেন রান্নাঘর আর আঁতুড় ঘরের বসতা থেকে মেয়েদের মুক্ত করার কথা। তাই বিপ্লব পরবর্তী রাশিয়ায় নিশ্চিত হয়েছে লিঙ্গ নির্বিশেষে সম কাজে সম মজুরি ।শুধু এইটুকুতেই থেমে থাকে নি রাশিয়া। মেয়েরা যাতে বাড়ির বাইরে এসে রোজগার সুনিশ্চিত করতে পারে তার জন্য শিক্ষা ক্ষেত্রেও মেয়েদের যোগদান কে সুনিশ্চিত করতে ব্যবস্থা নিয়েছিল এ বিশ্বের প্রথম সমাজতান্ত্রিক রাষ্ট্র।

সুনির্দিষ্ট পরিকল্পনায় ক্রমান্বয়ে বেড়েছিল মেয়েদের শিক্ষার হার। বেড়েছিল শ্রম বাজারে মেয়েদের অংশগ্রহণের হার ও। বিভিন্ন সূত্র মারফত জানা যায় যে আশির দশকে এসে ১৫ থেকে ৫৪ বছর বয়স পর্যন্ত মহিলাদের ৮০ শতাংশই ছিল কর্মরত। কমেছিল মজুরি বিহীন গৃহস্থালির কাজের সময়ও। কর্মরত মায়েদের বাচ্চাদের দেখভালের জন্য তৈরি হয়েছিল ক্রেশ। ১৯১৮ সালে মস্কো শহরে যেখানে মাত্র চারটি ক্রেশ ছিল, ১০ বছরের মধ্যে তার সংখ্যা বেড়ে ১৯২৮ সালে গিয়ে দাঁড়ায় ১০৪টিতে ১৯৩১ সালে এর সংখ্যা দাঁড়ায় ১২০ টি। প্রায় পঞ্চাশ হাজার শিশু প্রতি বছর এই দেশগুলির সহায়তায় বড় হতো তাই বিবাহিত মহিলাদের কর্মস্থানে যোগদানের হারও বেশ ভালো ছিল সোভিয়েত রাশিয়ায়।

আজ সোভিয়েত ‘ মুক্ত  ‘ পৃথিবীতে, এই একমেরু বিশ্বে কেমন আছে শ্রমজীবী মহিলারা? কর্মরত মহিলার সংখ্যা প্রতিদিন কমছে। শুধুমাত্র আমাদের রাজ্যেই ২০১০ থেকে ২০২০ এই এক দশকে কর্মরত মহিলার সংখ্যা কমেছে ৭%। অর্থনীতিবিদদের আশঙ্কা এই সংখ্যা চলতি বছরে আরো কমবে।কারণ, কাজের খোঁজে মেয়েদের দৌড় শ্লথ হচ্ছে প্রতিদিন। ২০১৯ সালের তুলনায় ২০২১ সালে কাজের খোঁজ করা মেয়েদের সংখ্যা কমেছে প্রায় ৩০ লক্ষ।

এ তো গেল কাজ না পাওয়া আর পাওয়ার খতিয়ান। কিন্তু যে মেয়েরা কাজ করেন তাঁদের অবস্থান কি? আমাদের দেশের ৪৮ শতাংশ মহিলা রোজগের শ্রমিক হলেও দেশের মোট অভ্যন্তরীণ উৎপাদনে তাঁদের অবদান মাত্র ১৭ শতাংশ।এই একটা তথ্যই দেখিয়ে দেয় মজুরির বাজারে মেয়েদের অবস্থান ঠিক কোথায় সারা বিশ্বের মতন আমাদের দেশেও মহিলারা সাধারণভাবে কম মজুরি এবং কম উৎপাদনশীল কাজেই শ্রম দেয় করে থাকেন মজুরীবিহীন গৃহস্থালির কাজে মহিলারা পুরুষের থেকে বেশি সময় ব্যয় করেন আমাদের রাজ্যে জনসংখ্যার বিচারে মহিলা শ্রমিকের অনুপাত মাত্র ২৩.১%। সারা দেশের গড়ের তুলনায় প্রায় সাড়ে পাঁচ শতাংশ পিছিয়ে রয়েছি আমরা। আর যে মহিলারা কাজ করেন তারা অধিকাংশই কম মজুরিতে এমনকি মজুরি বিহীন ক্যাজুয়াল ওয়ার্ক এর সাথে যুক্ত। চা শিল্প বিবি শিল্পের ক্ষেত্রে অধিকাংশই হলো মহিলা শ্রমিক। নির্মাণ শিল্পে ও মেয়েদের উল্লেখযোগ্য অংশগ্রহণ রয়েছে। এছাড়াও শুধু আমাদের রাজ্যেই প্রায় সাড়ে চার লক্ষ মহিলা আসা আইসিডিএস মিড ডে মিলের মতন প্রকল্পের সাথে যুক্ত এক বড় অংশের মহিলা গৃহসহায়িকা এবং আয়ার কাজের সাথে যুক্ত। বিড়ি থেকে জরি- প্রতিটি শিল্পের ক্ষেত্রেই মজুরিব বৈষম্য লক্ষ্য করা যায়। আর প্রকল্প কর্মীদের তো শ্রমিক হিসেবেই মান্যতা দেয়নি এদেশের সরকার। এই প্রকল্প গুলিকে গাল ভরা নামের আড়ালে আসলে বেসরকারি স্বেচ্ছাসেবী সংস্থার হাতে তুলে দিতে চাইছে এই দেশের কেন্দ্রীয় সরকার। কম ভাতায় বিনা ছুটিতে যথেচ্ছ ভাবে খাটিয়ে নেওয়া হয় আশা এবং আইসিডিএস কর্মীদের। আশা কর্মীদের ক্ষেত্রে তো বেতন ও নির্দিষ্ট না। এক এক রাজ্যে এক এক রকমের ভাতা ও অন্যান্য সুবিধা পেয়ে থাকেন তারা।

নতুন শ্রমকোডে অসংগঠিত ক্ষেত্রের মেয়েদের মাতৃত্বকালীন ছুটির সুবিধা থেকে কর্মক্ষেত্রে যৌন হয়রানি আটকানোর যে আইনি রক্ষাকবচ আগে ছিল ,তার সবটাই বাদ পড়ে গেছে। সম কাজের সম মজুরির বিষয়টিও বাদ পড়েছে এই নয়া স্লিম অ্যান্ড ট্রিম শ্রমকোড থেকে। এ কথা বলাই যায়, নতুন শ্রম কোড লাগু হলে কর্মক্ষেত্রে মেয়েদের হয়রানি শুধু বাড়বে তাই নয়, এর সাথে পাল্লা দিয়ে কমবে কাজের বাজারে মেয়েদের যোগদানের হারও।২০১২ সালে বিশ্ব ব্যাংক ‘জেন্ডার ইকুয়ালিটি এন্ড ডেভলপমেন্ট ‘ নামক বিশ্ব উন্নয়ন সংক্রান্ত একটি প্রতিবেদনে খুব স্পষ্ট করে বলেছে যে অর্থনৈতিক উন্নয়ন এবং নীতি নির্ধারণের জন্য লিঙ্গ বৈষম্য দূর করা জরুরী। বিশ্বের মোট  শ্রমশক্তির ৪০% হলো মহিলা। তাদের দক্ষতা ও প্রতিভাকে সম্পূর্ণভাবে ব্যবহার করতে পারলে সামগ্রিক উন্নয়ন বৃদ্ধি পাবে। শুধুমাত্র উন্নয়নশীল দেশগুলিতেই কৃষি উৎপাদন  বৃদ্ধি পেতে পারে ২.৫% থেকে ৪% পর্যন্ত। মেয়েদের আয় বৃদ্ধি পেলে শিশুর খাদ্য ও শিক্ষার খাতে ব্যারে যে বেশি হারে হবে সে কথা বলার অপেক্ষা রাখে না।প্রশাসনে মেয়েদের অংশগ্রহণ বাড়লে পানীয় জল ও নিকাশি ব্যবস্থা উন্নত করার উপর জোর পড়ে বেশি।কারণ, মেয়েদের কাছ থেকে কাছে এগুলির গুরুত্ব তুলনামূলকভাবে বেশি।অথচ আইনসভা গুলিতে লিঙ্গ সমতার ভিত্তিতে যে বিশ্ব তালিকা তৈরি করেছে ওয়ার্ল্ড ইকোনমিক ফোরাম তাতে গ্লোবাল জেন্ডার গ্যাপের রিপোর্ট অনুযায়ী সারা বিশ্বে ১৪৬ টি দেশের মধ্যে ভারতের স্থান ১২৭ তম। প্রশাসনে মেয়েদের কম অংশগ্রহণ আসলে অর্থনৈতিক ক্ষেত্রে মেয়েদের অবস্থান কেও ইঙ্গিত করে।

আমাদের সমাজের শ্রমজীবী মহিলারা সাধারণত দুভাবে শোষিত হয়। এক, শ্রমিক হিসেবে; দুই, নারী হিসাবে। মহিলাদের সম্পর্কে মার্কসবাদের এই মৌলিক বোঝাপড়াকে সাথে নিয়েই পথ চলেছিল সোভিয়েত ইউনিয়ন। মেয়েরা এগিয়েছিল। এগিয়েছিল সমাজ। বিজ্ঞান থেকে খেলাধুলার আঙিনায় সোভিয়েতের জয় ছিল সর্বত্র। আর আজকের ভারতের দিকে তাকালে, আমরা গোটা সমাজ আর রাজনীতির আঙ্গিনা জুড়ে মনুবাদের দাপাদাপি লক্ষ্য করি। মনুবাদ তো মেয়েদের ঘর বন্দি করে রাখতে চায়, মেয়েদেরকে শুধুই সন্তান উৎপাদনের যন্ত্র আর পুরুষের সেবা দাসী হিসেবে দেখতে চায়। তার ছাপ পড়েছে অর্থনীতিতেও। প্রতিদিন গরিব আর বড়লোকের আয়ের পার্থক্য বাড়ছে। উৎপাদন কমছে কৃষি আর শিল্পে। তাই লড়াইটা মতাদর্শের। লড়াইটা নিজেদের অধিকার বুঝে নেওয়ার। মেয়েরা এগোলে এগোবে সমাজ, এগোবে দেশ।তাই দেশকে এগিয়ে নিয়ে যেতে কর্পোরেট মদতপুষ্ট  নয়া মনুবাদীদের পরাস্ত করতেই হবে।বিপ্লব মাসে এটাই শপথ হোক সব খেটে খাওয়া মেয়েদের ,সব খেটে খাওয়া মানুষের।

Spread the word

Leave a Reply