Why We Are Not Free? A Retrospect

ভারত স্বাধীন নয় কেন ?

kakababu 1

মুজফ্‌ফর আহ্‌মদ

১৯২৬ সালের ১৪ই জানুয়ারি ‘লাঙ্গল’ পত্রিকায় ভারতের স্বাধীনতার পথে অন্তরায় সম্পর্কে একটি প্রবন্ধ প্রকাশিত হয়। সেই প্রবন্ধ লেখেন ভারতে কমিউনিস্ট আন্দোলন গড়ে তোলার অন্যতম নেতৃত্ব মুজফ্‌ফর আহ্‌মদ। সেই প্রবন্ধে তিনি ভারতবাসীর দুর্দশার যে কারণগুলি ব্যাখ্যা করেছেন তা আজও প্রাসঙ্গিক – একইসাথে এই প্রবন্ধের বক্তব্য আজকের ভারতে কমিউনিস্ট আন্দোলনে যুক্ত হতে চাওয়া নবীন প্রজন্মের জন্য অবশ্যপাঠ্য। সেই কারনেই প্রবন্ধটি আজ ১৫ই আগস্ট-২০২১, ভারতের ৭৫তম স্বাধীনতা দিবসে সিপিআই(এম) রাজ্য ওয়েবসাইটে প্রকাশিত হল।

ইংল্যান্ডের ধনিক সমাজ তাদের লোভ চরিতার্থ করার জন্যে ইংল্যান্ডের নামে ভারতবর্ষকে শাসন করেছে, আর ভারতবর্ষ তার নিঃস্বার্থপরতাহেতু এই ধনিক সমাজেরই ভোগের উদ্দেশ্যে ইংল্যান্ডের নামে দাসখত লিখে দিয়ে বসে আছে। কথাটা আরো পরিষ্কার করে বলছি। ভারতে যারা জাতীয় আন্দোলন নিয়ে ব্যাপৃত আছেন তাদের অধিকাংশই ভারতের বর্তমান শাসনকে ব্যুরোক্রেসি বা আমলাতন্ত্র নামে অভিহিত করে থাকেন। এই আমলাতন্ত্রকে তারা ধ্বংস করতে চান, তবে ধ্বংস করে এর জায়গায় তারা কোন তন্ত্রের প্রতিষ্ঠা করতে চান, তা জানবার সৌভাগ্য কিন্তু আজো পর্যন্ত আমাদের ঘটে ওঠেনি। জগতে অদ্যবধি এমন কোনও তন্ত্র কল্পিত হয়েছে বলে আমরা শুনেনি, যার কাজ চালাবার জন্য আমলার প্রয়োজন হবে না। একথা স্বীকার করার উপায় নেই যে, অবস্থাভেদে এই আমলার প্রকারভেদ হয়ে থাকে। একটা তন্ত্রের প্রতিষ্ঠা যেখানে হবে সেখানে সে-তন্ত্রের একটা দফতরের প্রতিষ্ঠাও হতে হবে, আর এই দফতরটিকে রক্ষা করবার জন্য আমলারও প্রয়োজন হবেই হবে। দফতর আর আমলা এ দুটো বস্তু একেবারেই হরিহর-আত্মা, কাউকে ছেড়ে কেউ বাঁচতে পারে না। সত্যপ্রিয় ব্যক্তি মাত্রকেই স্বীকার করতে হবে যে ভারতে বর্তমানে যে শাসনতন্ত্র প্রতিষ্ঠিত রয়েছে এটা আমলাতন্ত্র নয়, – পরন্তু ধনিকতন্ত্র, অর্থাৎ ইংরেজিতে বলা হয় Plutocracy ঠিক তাই।

যাদের শোনবার জন্যে কান আছে আর দেখবার জন্যে চোখ রয়েছে, তারা জানেন ইংল্যান্ডের জনসাধারণের দ্বারা ভারতের ভাগ্য নির্ধারিত হয় না, যারা আমাদের দণ্ডমুণ্ডের কর্তা, তারা হচ্ছেন ইংল্যান্ডের জনকতক ব্যাপারী, যত পান ততই তারা চান, তাদের লোভ অপরাজেয়। নিজেদের দেশের ধন-সম্পত্তিতে  তাদের পেট ভরছে না। তাই, তারা ভারতবর্ষে ও অন্যান্য উপনিবেশে দোকান খুলে বসেছেন। ঠিক এ অবস্থা ফ্রান্সের, এ অবস্থা আমেরিকার। ফ্রান্স আর আমেরিকাকে যে গণতন্ত্র বলা হয় সেটা শুধু মনকে চোখ-ঠারা মাত্র। আসলে এই দুটো গভর্মেন্টও ধনিকতন্ত্র ব্যতীত আর কিছুই নয়। যাক, ইংল্যান্ডের ধনিক সমাজের কথা বলছিলাম। আমরা অবুঝ আর নাবালক বলে আমাদের উপকারের জন্য তারা আমাদের অভিভাবক হতে আসেননি। আমাদের এদেশ তাদের কারবারের জায়গা। সকল মহাজনেরই খরিদ-বিক্রির সুবিধার জন্য স্থানীয় দালালের প্রয়োজন হয়ে থাকে, ইংল্যান্ডের ধনিক সমাজেরও বহু ভারতীয় দালাল রয়েছেন। তারা নানা রূপে নানা আসনে অধিষ্ঠিত আছেন। জমিন কোথায় রয়েছে তা জানা না থাকলেও তারা জমিনের মালিক, কোন প্রকারে পণ্যদ্রব্য স্পর্শ না করেও তারা মহাজন অর্থাৎ লাভের মালিক, পণ্যদ্রব্য তৈয়ার না করেও তারা পণ্যদ্রব্য মালিক, আর কর্ম ক্ষেত্রে তারা যতই কম পরিশ্রম করেন ততই বেশি মাইনের মালিক। কাজেই ধনিকতন্ত্রের দ্বারা সাধারণভাবে ভারতের যতই অহিত হোক না কেন, তাদের নিজেদের হিত যথেষ্ট হচ্ছে, আর এই আত্ম-হিতের জন্যে তারা ধনিকতন্ত্রের হিতাকাঙ্খী।

এই যে রীতিনীতি চলেছে এর জন্য যারা সকল দিক থেকে ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছেন, তারা ভারতের জনসাধারণ – ভারতের কৃষক ও শ্রমিক সম্প্রদায়। কৃষকগণের দ্বারা সর্ববিধ খাদ্যোৎপাদন হচ্ছে বটে, কিন্তু সে খাদ্যোৎপাদন তাদের ভোগে যা এসে থাকে, তা না আসারই মতো । শ্রমিকদিগের অবস্থাও তথৈবচ। কারখানাতে তারা খেটে মরেন সত্য, পেটে খেতে কিন্তু যথোপযোগী খাদ্য পান না। ফলে অবস্থা এই দাঁড়িয়েছে যে ভারতের লোক দিনকে দিন রুগণ,পঙ্গু ও অল্পায়ু হয়ে পড়েছেন, ভারত ধ্বংসের পথে চলেছে।

আমরা দেখেছি কুকুর বিড়ালকে তাড়া করে নিয়ে যায়, বিড়াল তো প্রথমে প্রাণপণে ছুটে ছুটে আপনাকে বাঁচাতে চেষ্টা করে, কিন্তু পরে যখন পেরে ওঠে না, তখন ফিরে দাঁড়িয়ে পাল্টা আক্রমণ করে কুকুরকে। এও দেখেছি এই আক্রমণের চোট কুকুর প্রায় সহ্য করতে পারে না। কিন্তু, এদেশের কৃষক, এদেশের শ্রমিক দিনের পর দিন স্বার্থান্বেষী  লোকদের দ্বারা বিলুন্ঠিত হচ্ছেন, অথচ একটি প্রতিবাদের শব্দ তাদের মুখ থেকে বেরুচ্ছে না। তাদের জীবনে যোগের সাথে কোথাও দেখা-শোনা নেই, কেবল বিয়োগ আর বিয়োগ, বিয়োগের একটানা রেখাটি যেন কোথায় কোন অসীমের পানে বেড়েই চলেছে। ভারতের এ দুরাবস্থার সাথে জগতের আর কোনো দেশের অবস্থার তুলনা হয় না। আর দেশের কৃষাণ ও শ্রমিকেরাও যা পাওয়া উচিত তা হয়তো পান না, কিন্তু না পাওয়ার জন্য অসন্তোষ তারা সর্বদাই প্রকাশ করে থাকেন। এইজন্যে তাদের জীবন সকল দিক দিয়ে আমাদের দেশের কৃষক ও শ্রমিকদের চেয়ে উন্নত।

ভারতবর্ষ একটি অভিশপ্ত দেশ, নিরবচ্ছিন্ন অভিশাপ এর সকল দিককে ঘিরে রয়েছে। এদেশে প্রাচীনকালে বড় বড় ঋষিরা জন্মগ্রহণ করেছিলেন, তারা নাকি বলে গিয়েছিলেন জীবনটা নিছক মায়া ব্যতীত আর কিছুই নয়। তাদের মতো জীবনে বিয়োগের অংকটা যতই বাড়ানো যায় ততই নাকি পুণ্যের কাজ করা হয়, আর যোগের অঙ্ক বাড়ালে ভয় পাপ, এমন বড় পাপ যে তার কোনোকালে ক্ষমা নেই। পরে এলেন মুসলমানরা। তারাও নিয়ে এলেন গোটা কতক থিওলজি অর্থাৎ ব্যবস্থা-শাস্ত্রের কেতাব। কাজেই ব্যবস্থা -দাতা অর্থাৎ মোল্লার সংখ্যা এদেশে খুব বেড়ে গেল। এই মোল্লারা শিখাচ্ছেন, পৃথিবীর দুঃখ- কষ্টটা কিছুই নয়। কোনো রকম করে দুনিয়ার এ দু’দিনের জীবনটা দুঃখ-কষ্টে কাটালেই হলো, তারপরে, পরকালে অক্ষয়স্বর্গে অনন্ত জীবন, আর অনন্ত সুখ। মোটের উপর, কপট সাধু-সন্ন্যাসী- গুরু -পুরোহিত ও মোল্লা- মৌলবী-ফকিরগণ ভারতের জনসাধারণের হৃদয় হতে সকল আশা-আকাঙ্ক্ষার বিলোপ-সাধন করে দিয়েছেন। এদের ফাঁদে পড়ে ভারতের কৃষক ও শ্রমিকগণ বাকির লোভে হাতে-পাওয়া জিনিসটা খুইয়ে বসে আছে। শ্রেণী হিসেবে এই কপট সাধু -সন্ন্যাসী ও মোল্লা-মৌলবী প্রভৃতির সংখ্যা নিতান্ত কম নয়। এঁরা শ্রমবিমুখ লোক, আপনাদের ষোলআনা ভাগের জন্য জনসাধারণের মধ্যে ত্যাগের বাণী প্রচার করে থাকেন। এদের পেশা হচ্ছে, কৌশলজাল বিস্তারপূর্বক নিরীহ চাষী-মজুরদিগকে লুট করা। কাজেই, শ্রেণী হিসেবে এঁরাও ধনিকতন্ত্রের খুব বড় সহায়ক।

ভারতের প্রাণশক্তি হচ্ছে ভারতের চাষী আর মজুরগণ। এদের সংখ্যা শতকরা ৯৫ জনের কম নয়। ভারতের পূর্ণ স্বাধীনতা লাভ করা এদের চাওয়া-না-চাওয়ার উপরে নির্ভর করছে। এরা আপনাদের পাওনা ষোল আনা বুঝে নিতে বদ্ধপরিকর না হলে ভারতের বর্তমান শাসন-প্রণালীর আমূল পরিবর্তন কিছুতেই সাধিত হতে পারে না। কিন্তু এদের জীবনে পাওয়ার আকাঙ্ক্ষাই যদি না জন্মে তবে কিসের জন্যে এরা পাওয়ার দাবি জগতের সম্মুখে পেশ করতে যাচ্ছেন? ভারতের নবীন শিক্ষিত সম্প্রদায়কে এ-ক্ষেত্রে সমবেত হতে হবে। চাষী আর মজরদের মধ্যে জীবনের বাণী প্রচার করা আর তাদের সত্যকারের জীবনের সন্ধান দেওয়াই নবীন শিক্ষিত সমাজের একমাত্র কাজ। চাষী আর মজুরদের বলতে হবে, তোমরা অজানা ভবিষ্যতের লাভের আশায়, বর্তমানের শ্রমলব্ধ ধন পরের পায়ে বিলিয়ে দিয়ে বসে আছ, কিন্তু জানো না তোমরা, বিয়োগের ভিতর দিয়ে লাভ কখনো হতে পারে না। লাভের জন্য যে যোগ চাই-ই চাই। তাদের বোঝাতে হবে, তাদের শ্রমের ধনে তাদের ভোগের অধিকার ষোল আনা রয়েছে, সে -অধিকার ত্যাগ করে তারা পৌরুষের পরিচয় না দিয়ে কাপুরুষতার পরিচয়ই দিচ্ছে, মনুষ্যত্ব হতে তারা বহু দূরে সরে পড়েছে। এককথায়, জীবনে খাওয়া-পরার তীব্র আকাঙ্ক্ষা যতদিন না আমাদের দেশের কৃষক ও শ্রমিকগণের প্রাণে জাগবে ততদিন আমাদের অবস্থার পরিবর্তন কিছুতেই হবে না। পরিবর্তনের প্রয়োজনের সৃষ্টি না হলে পরিবর্তন কেনই বা হবে?

কপট সাধু-সন্ন্যাসী ও মোল্লা- মৌলবী প্রভৃতির দুষ্টু আওতা হতে ভারতের কৃষক ও শ্রমিকজীবনকে সম্পূর্ণ মুক্ত না করতে পারলে আমাদের উদ্ধারের আশা একেবারেই নেই। এ অবস্থায় আমাদের শুধু যে দাসত্বের ঘৃণিত জীবন বহন করতে হবে, তা নয়, আমাদের জীবন দিনকে দিন যেমন ক্ষয়প্রাপ্ত হচ্ছে, তাতে আমরা ধরাবক্ষ হতে একেবারেই বিলুপ্ত হয়ে যাব।

মূল প্রবন্ধের বানানরীতি যতদূর সম্ভব বজায় রাখার চেষ্টা করা হয়েছে।  

Spread the word

Leave a Reply