সৌভিক ঘোষ
লেনিনের বাঁ হাতের লেখা এবং অন্তর্ঘাতের প্রেক্ষাপট
বিপ্লব পরবর্তী গৃহযুদ্ধের পর্ব কাটিয়ে উঠে সোভিয়েত ব্যবস্থা সবে একটু একটু করে মাথা তুলতে শুরু করেছে। রাশিয়ার নির্দিষ্ট পরিস্থিতি অনুশীলনে (ইউরোপের তুলনায় অর্থনৈতিক দিক থেকে অনেকটা পেছিয়ে থাকা রাষ্ট্র) লেনিন New Economic Policy বা NEP প্রবর্তন করতে বাধ্য হলেন। সমাজতন্ত্রের দৃষ্টিভঙ্গীতে এই সিদ্ধান্ত কিছুটা পেছিয়ে আসাই ছিল, বলশেভিকরা বাধ্য হলেন দেশের শিক্ষিত, উচ্চশিক্ষিত পেটি বুর্জোয়া – টেকনোক্র্যাটদের সোভিয়েত ব্যবস্থায় জায়গা দিতে – সাধারণ শিক্ষাটুকুর সুযোগ থেকে বঞ্চিত, অনভিজ্ঞ শ্রমিক-মেহনতি জনগনের দেশ পরিচালনার কোন অভিজ্ঞতা ছিল না। তাদের জন্য তখনও অবধি একটিই ঐতিহাসিক উদাহরণ – প্যারি কমিউন। লেনিন বলতে বাধ্য হলেন “… বিপ্লব যাদের সদর দরজা দিয়ে বের করে দিয়েছিল তারাই পিছনের দরজা দিয়ে আবার ভিতরে ঢুকে পড়ল”। সাম্রাজ্যবাদের ঘেরাটোপে থাকা রাশিয়ার এছাড়া কোন উপায় ছিল না – দ্রুত নিজেদের পায়ে দাঁড়ানোর মতো শক্তি অর্জন না করতে পারলে সমাজতন্ত্রের বাস্তব অভিজ্ঞতা নির্মাণ করা যেত না। এমন একটা পরিস্থিতিতে বলশেভিক পার্টির একাদশ পার্টি কংগ্রেস হয় ১৯২২ সালে। NEP প্রসঙ্গে লেনিন সেই কংগ্রেসে বলেন “… নেপের সবেচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ সমস্যা হল নতুন যে অর্থনীতি আমরা গড়ে তুলতে শুরু করেছি ( যদিও খুবই খারাপভাবে সেই কাজ শুরু হয়েছে, সমাজতান্ত্রিক অর্থনীতির ভিতের উপরে দাঁড়িয়ে উৎপাদনএবং বন্টনের সমস্যাকে সমাধান করা) তার সাথে কৃষি অর্থনীতির সংযোগ স্থাপন”।
এভাবেই লেনিনের বক্তব্যে চিহ্নিত হল আগামীদিনে সমাজতন্ত্র নির্মাণের পরবর্তী পদক্ষেপ – রাশিয়ায় কৃষি অর্থনীতির সংস্কার। লেনিন নিজে সেই কাজ শেষ করে যেতে পারেন নি। NEP ঘোষণার সাথে সাথেই পার্টির মধ্যে বিতর্ক শুরু হল – এর দ্বারা আদৌ সমাজতন্ত্র নির্মাণ হচ্ছে না, এই অজুহাতে। পার্টির দুইজন অগ্রণী নেতা ট্রটস্কি এবং বুখারিন সেই বিরোধিতায় সবচেয়ে বেশি সক্রিয় হলেন – তাদের বক্তব্য এই নীতির ফলে সমাজতন্ত্রকে আত্মসমর্পণ করতে বাধ্য করা হচ্ছে। পুঁজিবাদী শক্তিসমৃদ্ধ ইউরোপের বিভিন্ন উন্নত দেশের সাথে রাশিয়ার অবস্থার যে বিস্তর ফারাক তাকেই এরা অস্বীকার করলেন। NEP-এর বিরোধিতায় নিজেদের বামপন্থী বিপ্লবী প্রমান করতে যারা অতি সক্রিয় ছিলেন তাদের উপরে জনগনের আস্থা কমতে শুরু করল, পার্টির মধ্যেও তাদের প্রভাব কমতে শুরু করে তখন থেকেই।
এই নীতিতে ছোট কারখানা মালিক, ব্যবসায়ীরা এবং বড় বড় চাষি (যাদের কুলাক বলা হত) রাষ্ট্রীয় মদতে কিছুটা বাড়তি সুযোগ পায় – সেইসাথে দেশের প্রায় ধ্বংসপ্রাপ্ত উৎপাদন ব্যবস্থা নতুন গতিও পেল। ইউরোপের অবরোধের মধ্যেই নিজেকে টিকিয়ে রাখার শক্তি অর্জন করল সোভিয়েত ইউনিয়ন।
কিন্তু ‘এখনই সমাজতন্ত্র নির্মাণ করতে হবে’ – এই দাবীতে বলশেভিক নেতৃত্বের একটা অংশ নিজেদের বাস্তবতা রহিত রোম্যান্টিক বিরোধিতা জারী রাখেন। এরাই বিপ্লবের আগে গোপন পরিকল্পনা কাগজে লিখে ফাঁস করেছিলেন (জিনোভিয়েভ এবং কামেনেভ), প্রবল শক্তিধর জার্মানির আগ্রাসন রুখতে শান্তিচুক্তি (ব্রেস্তলিতোভোস্ক)-সম্পাদনার দায়িত্ব পেয়েও তাকে বানচাল করে দিতে উদ্যত হন (ট্রটস্কি) এবং শান্তিচুক্তির ফলে কমিউনিস্ট আন্তর্জাতিকের নীতি লঙ্ঘিত হবার নামে সোভিয়েত ব্যবস্থা ধ্বংস হলেও কুছ পরোয়া নেই এমন প্রচার করেন (বুখারিন) – এইবার দেশ গঠনের পরিকল্পনায় এদের বাধায় লেনিন কিছুটা একা হয়ে পড়েন। সাধারণ জনগনের সেই অর্থে দেশ পরিচালনার কোন অভিজ্ঞতা নেই, বাইরে থেকে কোন দেশের সাহায্য নেই – অথচ আক্রমণ নেমে আসার বিপদ রয়েছে, উপযুক্ত শিক্ষা নেই – খাদ্য সংকট প্রবল, কার্যত সার্বিক দুর্যোগের পরিস্থিতি। এই অবস্থায় জনগণকে ভুল বুঝিয়ে বিপ্লব এবং সমাজতন্ত্রের নামে উত্তেজিত করে খাদের কিনারায় ঠেলে নিয়ে যেতে চেয়েছিলেন যারা তাদের আটকাতে এগিয়ে এলেন স্তালিন।
পরে স্তালিনের লেখায় আমরা যা পাই “… জার্মানির মতো বিকশিত শিল্প কারখানা যদি আমাদের হাতে থাকতো তাহলে আমরা পুঁজিবাদী দেশসমুহের পিছনে পড়ে থাকবো এই ভয় থাকতো না। আমরা ধীরে সুস্থে কলকারখানা-শিল্প স্থাপন করতে পারতাম, আমাদের এমন ভরসা থাকতো যে এক ধাক্কাতেই আমরা পুঁজিবাদী দেশগুলিকে পিছনে ফেলে রেখে সামনে এগিয়ে যেতে পারি। কিন্তু বাস্তব হল এই যে তখনও অবধি আমরা যন্ত্রবিদ্যা এবং অর্থনীতির দিক থেকে ভয়াবহ রকমের অনগ্রসর ছিলাম….. আমাদের লগ্নীর অর্ধেক সরিয়ে রাখতে পারতাম। তাহলে সুতীর জামাকাপড়, চামড়ার সামগ্রী, পশম এবং রবার আমদানি করা যেত। কিন্তু এমন করা হলে ট্র্যাক্টর – কারখানা এবং মোটরগাড়ির কারখানাগুলি গড়ে উঠত না। বিরাট লৌহ-শিল্প স্থাপন করা যেত না, ভারী যন্ত্র নির্মাণের ধাতুও পাওয়া যেত না… সাম্রাজ্যবাদী দেশগুলির ঘেরাটোপে আমরা পড়ে থাকতাম নিরস্ত্র হয়ে, নিঃস্ব হয়ে… সশস্ত্র হস্তক্ষেপ করতো তারা, লাগিয়ে দিত যুদ্ধ এবং সর্বাধুনিক অস্ত্রের আক্রমনের সামনে সেই রক্তাক্ত এবং অসম যুদ্ধে আমাদের খালি হাতে লড়াই করতে হতো… তাই সামনের দিকে এগিয়ে যেতে বিশেষ কর্মসূচির প্রয়োজন ছিল”।
দেখা গেল কিছুদিন আগে অবধি যিনি ছিলেন রাশিয়ার ভিতরে গোপনে পার্টি সংগঠন পরিচালনার দায়িত্বে, বিপ্লব পরবর্তী গৃহযুদ্ধের সময় লাল ফৌজের দায়িত্ব নিয়ে (নভেম্বর বিপ্লবের সময় লাল ফৌজ (Red Army)-র দায়িত্বে ছিলেন ট্রটস্কি) প্রতিবিপ্লবকে পরাজিত করলেন – সরকারী দায়িত্ব বলতে ছোট একটি ঘরে জাতিসমস্যা বিষয়ক কমিশার হিসাবেই সবাই যাকে চিনত সেই স্তালিন আরেকবার লেনিনের পাশে এসে দাঁড়ালেন। এবারেও তার কাজ একই – উদ্ভুত নির্দিষ্ট সমস্যার সমাধান।
লেনিনের জীবদ্দশায় বারে বারে স্তালিন সংকটের বিশেষ বিশেষ সময়ে তার পাশে এসে দাঁড়িয়েছেন – সমাধান বাতলে দিতে বই লিখে নিজেকে পন্ডিত প্রমান করা তার অভ্যাস ছিল না ঠিকই, সমস্যার সমাধানে তার পদ্ধতি ছিল মার্কসবাদীদের যা হতে হয় সেটাই। সমস্যার একেবারে গোড়ায় পৌঁছে যেতেন, সকলের সাথে মত বিনিময় করেই সিদ্ধান্ত নিতেন – কিন্তু একবার সিদ্ধান্ত নেওয়া হলে তিনি ছিলেন সম্পূর্ণ আপোষহীন, তখন স্তালিনের চেতনায় আর কোন দোলাচল থাকতো না। এখানেই তার অনন্যতা। এই কারনেই তিনি দেশের সাধারণ মানুষের নেতা ছিলেন, আবার ঠিক এই কারনেই পন্ডিতমহল তাকে অপছন্দ করতেন – লেনিন তাকে চিনেছিলেন “এক চমৎকার জর্জিয়ান” বলে, ম্যাক্সিম গোর্কিকে চিঠি লিখে জানিয়েছিলেন “ রাশিয়ায় জাতি সমস্যার সমাধানে একজনকে আমরা পেয়েছি…”। লেনিন প্রথমবার হার্ট অ্যাটাকে আক্রান্ত হলেন একাদশ কংগ্রেসের পরেই, তার কিছুদিন বাদে আরেকবার এবং পরে কিছুটা সেরে উঠেও (পক্ষাঘাতের কারনে ডান হাত কাজ করছে না বলে বাঁ হাতে লেখার অভ্যাস অবধি শুরু করেছিলেন) তৃতীয়বার ১৯২২ সালের ৯ই মার্চ। ১৯২৩ সালের ১৭ই এপ্রিল ছিল পার্টির দ্বাদশ কংগ্রেস। ১৭ই এপ্রিল সম্মেলনের মঞ্চে সাংগঠনিক রিপোর্ট পেশ করতে উঠলেন স্তালিন। ততদিনে কমিউনিস্ট পার্টিতে তার সাংগঠনিক দক্ষতা সম্পর্কে কমরেডরা নিশ্চিন্ত হয়েছেন। সকলেই কম বেশি উপলব্ধি করেছিলেন লেনিনের শারীরিক অবস্থা আর ঠিক হওয়ার নয় – লেনিনের পরে পার্টির নেতৃত্ব কারা সামলাবেন সেকথা চিন্তা করার সময় উপস্থিত হল।
ক্ষমতার লক্ষ্যে একদল বলশেভিক !
এতদিন যারা লেনিনের বিরোধিতায় সরব ছিলেন তারাই সামনে এগিয়ে এসে নতুন যুদ্ধ শুরু করলেন। বেঁচে থাকতে এরা নিজেদের ক্ষমতা ব্যবহার করে লেনিন’কে ‘বাতিকগ্রস্থ কাণ্ডজ্ঞানহীন – রাশিয়ায় শ্রমিকদের পশ্চাদপদতার সুযোগ নেন” বলে সমালোচনা করতেন। লেনিনের মৃত্যুর পরে নিজেদের প্রতিষ্ঠা করতে নির্লজ্জের মতো এরা তাকেই আশ্রয় করতে চাইলেন। স্তালিনকে পার্টির সাধারণ সম্পাদকের পদে দেখতে চাননি লেনিন – এই মতকে প্রতিষ্ঠা করতে কংগ্রেসে পেশ করা হল লেনিনের চিঠি (স্তালিন বিরোধী আন্তর্জাতিক পন্ডিত মহলে এই চিঠি লেনিনের উইল নামে পরিচিত)। সেই চিঠির কিছুটা পড়ে আর কিছুটা চেপে রেখে ট্রটস্কি প্রমান করতে চাইলেন লেনিন নিজেই স্তালিনের অপসারন চেয়েছেন। স্তালিন সকলের সামনে সেই চিঠির সম্পূর্ণ বয়ান প্রকাশ করলেন – “His replacement should have just one point of superiority over Stalin, more tolerant, more loyal, kinder” অর্থাৎ লেনিন পার্টির সাধারণ সম্পাদকের পদে এমন একজনকে চাইছেন যিনি কমরেডদের সাথে রুঢ়তা ছাড়া আর সব বিষয়েই স্তালিনের মতোই হবেন কিংবা স্তালিনের চাইতেও বেশি কিছু। ঐ একই চিঠিতে উল্লেখ ছিল জিনোভিয়েভ, কামেনেভ আদৌ বলশেভিকই নন, ট্রটস্কি সম্পর্কে সাবধান করেছিলেন ইনি যে কোন সমস্যার আমলাতান্ত্রিক সমাধানে আগ্রহী, নিজের মত প্রতিষ্ঠা করতে না পারলে করতে পারেন না এমন কাজ নেই। এই চিঠির প্রসঙ্গে কেউ ভাবতে পারেন লেনিন কি কমিউনিস্ট পার্টিকে নিজের জমিদারি ভাবতেন যে এমনভাবে উইল লিখে গেলেন? আসলে কমিউনিস্ট পার্টির পদ্ধতির সাথে সঠিক অর্থে পরিচিত হলে এমন অস্বচ্ছ ধারণা স্পষ্ট হয়ে যায় (ইউরোপের পন্ডিতেরা এই কারনেই সোভিয়েতকে বুঝতে পারেন না), লেনিন বুঝতে পেরেছিলেন বেশিদিন বেঁচে থাকবেন না। তাই পার্টি কংগ্রেসে নিজে উপস্থিত হতে পারলে যে বক্তব্য রাখতেন সেটাই লিখে গেলেন। এই চিঠি কোন উইল না, কমিউনিস্ট দায়িত্ববোধের, নৈতিকতার এক উজ্জ্বল নিদর্শন। অতীতে নিজেদের বিশ্বাসঘাতকতার কথা পুনরায় সামনে এলে সমস্যা হতে পারে এই ভেবে জিনোভিয়েভ, কামেনেভ নিজেদের অবস্থান বদলালেন – জিনোভিয়েভ সম্মেলনে বললেন “একটি ক্ষেত্রে লেনিনের দুর্ভাবনা ভুল প্রমানিত হয়েছে। স্তালিন নিজের রুঢ় আচরণ সংশোধন করে যোগ্যতার সাথেই সম্পাদকের কাজ করছেন”। ট্রটস্কি’র উচ্চাশায় ভবিষ্যতের নেপোলিয়ন’কে খুঁজে পেলেন বুখারিন, কামেনেভ, তারাও স্তালিনের পক্ষেই ভোট দিলেন।
লেনিনের চিঠি কাজে না আসায় ট্রটস্কি শেষ চেস্টা করলেন, মৃত্যুর আগে লেনিন স্তালিনের সাথে সব সম্পর্ক ছিন্ন করেছিলেন, মুখ দেখতে চান নি এইসব বলে। লেনিনের বোন উলিয়ানোভা উপস্থিত ছিলেন, তিনি জানালেন লেনিনের এমন ব্যবহারের কারন। বুলেটের আঘাতে পক্ষাঘাতগ্রস্থ লেনিন নিজের অসহায় অবস্থা শেষ করতে চেয়েছিলেন। জানতেন কেবলমাত্র প্রকৃত বিপ্লবীর কাছেই এমন প্রত্যাশা করা যায়। তাই স্তালিনকে ডেকে পাঠিয়ে তার কাছে বিষ চেয়েছিলেন! স্তালিন এমন আবদার সরাসরি প্রত্যাখ্যান করেন এবং কড়া পাহারার বন্দোবস্ত করেন যাতে আর কেউ লেনিনের কথায় প্রভাবিত না হতে পারে। নিজে প্রকৃত বিপ্লবী ছিলেন বলেই জানতেন অমন মৃত্যু লেনিনকে মানায় না। এই ক্ষোভেই স্তালিনের সাথে সব সম্পর্ক ছিন্ন করতে চেয়েছিলেন মৃত্যুপথযাত্রী লেনিন।
দ্বাদশ সম্মেলনে বলশেভিক পার্টির কমরেডরা স্তালিনকেই পার্টির নেতা হিসাবে নির্বাচিত করলেন। শুরু হল এক নতুন অধ্যায় – একদিকে সোভিয়েতের উত্থানে দেশের জনগনের সাথে বলশেভিকদের নজীরবিহীন লড়াই, আরেকদিকে সোভিয়েতকে ভিতর থেকে ধ্বংস করতে ষড়যন্ত্র। তার নেতৃত্বেও আরেক দল – তারাও খাতায় কলমে বলশেভিক! পার্টির মধ্যে সামনে থেকে লড়াইতে স্তালিনকে পরাজিত করা গেল না বলে গোপনে ষড়যন্ত্র হল যাতে আঁতুড় ঘরেই সদ্যজাত সোভিয়েতকে শেষ করে দেওয়া যায়, আরেকদিকে দলের মধ্যে উপদলের স্বাধীনতার নামে নির্লজ্জের মতো পার্টি বিরোধী কাজ শুরু হল। একের পর এক খনি অঞ্চলে আচমকা জল ঢুকে গেল, সারা দেশজূড়ে কলকারখানার যন্ত্রপাতি হঠাৎ করেই খারাপ হয়ে বসে যেতে লাগল, শিল্পকারখানায় আগুন লাগার ঘটনা ছড়িয়ে পড়ল – সর্বত্র অরাজকতা ছড়িয়ে পড়ার লক্ষণ ফুটে উঠল। সারা দেশে গরু খোঁজার মতো করে অনুসন্ধান চলল, ধরা পড়ল অগুনতি প্রতিবিপ্লবী গ্রুপ, এদের অনেকেই বিদেশ থেকে আমন্ত্রন করে ডেকে আনা দক্ষ ইঞ্জিনিয়ার, যন্ত্রবিদ কিংবা বিশেষ দক্ষতাসম্পন্ন এবং রাশিয়ার শিক্ষিত, বনেদি বড়লোক পরিবারের সন্তান (NEP এর পরিকল্পনায় এদের বিশেষ যত্ন সহকারে দায়িত্ব দেওয়া হয়েছিল) – সবাই সোভিয়েতের গলা টিপে মারতে চায়। নিজেদের স্বার্থসিদ্ধির বিনিময়ে জনগনের জীবনে দুর্দশা নেমে এলে আসুক। আরও অনুসন্ধানে জানা গেল এরা সকলেই কোন না কোনভাবে ট্রটস্কি হতে অনুপ্রাণিত। ট্রটস্কিই অনেকদিন ধরে পার্টিতে উপদল, গ্রুপের স্বাধীনতার পক্ষে সবচেয়ে বেশি সোচ্চার ছিলেন। জনগনের শত্রুরা গ্রেপ্তার হল, ট্রটস্কি এতকিছুর পরেও শুধু পার্টি থেকেই অপসারিত হলেন। সেদিন সকলে জানল দেশের স্বার্থের প্রসঙ্গে স্তালিন কতটা কঠিন হতে পারেন। এতদিন পার্টিকে ব্যাবহার করে তিনি স্তালিনের নামে কুৎসা করেছেন, যেমন ইচ্ছা সমালোচনা করেছেন। কিন্তু কিছু পাওয়ার লোভে নেতার নামে মিথ্যা প্রশংসার বদলে এই কাজ করতে যথেষ্ট হিম্মত লাগে, তাই ঐসময় পার্টিতে অনেকেই ট্রটস্কির মুন্ডু চাইলেও স্তালিন তার পাশেই ছিলেন। এবার ট্রটস্কি মরিয়া, পার্টির নামে কুৎসা করছেন, দেশের ক্ষতি করছেন – জনগনের সর্বনাশ ডেকে আনতে চাইছেন, আজ তার পাশে যারাই থাকুক না কেন স্তালিন তার পাশে থাকবেন না। সেদিন বুখারিন, জিনোভিয়েভ, কামেনেভ’রা নিজেদের পরিচয় গোপন করে স্তালিনের পাশেই এসে দাঁড়ালেন – ট্রটস্কির মতো সাহস, পান্ডিত্য কিংবা খ্যাতি তাদের ছিল না, তাই তারা লুকিয়ে অন্তর্ঘাতের পরিকল্পনা জারী রাখলেন। কার্যত দেশ গড়ার কাজে স্তালিন হয়ে পড়লেন একা। ট্রটস্কি মেক্সিকোয় নির্বাসনে চলে গেলেন – আর কখনো নিজের দেশে ফিরতে পারলেন না।
এর পরে আক্রমন এল সমাজতন্ত্র গড়ার প্রথম পদক্ষেপেই। বুখারিন প্রচার করতে শুরু করলেন যৌথ খামার ব্যবস্থার নামে স্তালিন গ্রামে রক্তগঙ্গা বইয়ে দিচ্ছেন। আন্তর্জাতিকভাবে মার্কসবাদে পন্ডিত হিসাবে পরিচিত নিকোলাই বুখারিন তখন কুলাক (বড় চাষি)-দের আসন্ন বিপদের কথা ভেবে যতদূর যাওয়া যায় যেতে প্রস্তুত। যৌথ খামার ব্যবস্থা যে লেনিনের অসমাপ্ত কাজেরই পরের ধাপ একথা ভুলে গিয়ে, উৎপাদন ব্যবস্থাকে নতুন পর্যায়ে নিয়ে যাওয়ার প্রয়োজনকে অস্বীকার করে সবাইকে লাল সন্ত্রাসের ভয় দেখাতে শুরু করলেন। বহুযুগ ধরে চলা সামন্ততান্ত্রিক অচলাবস্থা কাটিয়ে সোভিয়েত তখন পরিকল্পনা নিয়েছে রাশিয়ার ইতিহাসে চাষা শব্দটার নতুন অর্থ রচনা করা হবে, জমিদার-জোতদারদের শাসন শেষ করে দেশজূড়ে গড়ে উঠবে ফসল উৎপাদনের এক অভিন্ন সমবায় – চাষা পরিচিত হবে কৃষিমজুর হিসাবে। মানুষের ইতিহাসে এক নতুন অধ্যায় লেখা হবে। দুনিয়া দেখবে পুঁজিবাদ সর্বশক্তিমান নয়, তাকে পিছনে ফেলে উৎপাদন, বণ্টন এবং সম্পদ সৃষ্টি করতে আরও বেশি মজবুত বিকল্প অর্থনীতি সম্ভব – তারই নাম সমাজতান্ত্রিক নির্মাণ। সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ হল সেই ব্যবস্থা মুনাফার অমানবিকতায় জারিত না, আগাগোড়া মানবিক। কিন্তু এই কাজ সহজে হয় নি। বহুযুগ ধরে যারা প্রভুত সম্পদের মালিকানা পেয়ে অভ্যস্ত তারা সহজে নিজেদের সুবিধা ছেড়ে দিতে রাজি নয়, কিছু জায়গায় সত্যিই রক্তাক্ত প্রতিরোধ গড়ে ওঠে – তাকে পরাজিত করতে গেলে খালি হাতে, স্বপ্নদ্রস্টার মতো বিপ্লবী বুলি আওড়ালে শুধু চলত না। বুখারিন এই সত্যটুকু ভুলে গেছিলেন, স্তালিন মনে রেখেছিলেন। তখনও তিনি বুখারিনকে নিজের কমরেড বলেই ভাবতেন, তার এমন ভ্রান্ত অবস্থান সম্পর্কে জনগনকে সাবধান করতে শুধু উল্লেখ করলেন “…দেখা যাচ্ছে বুখারিন মার্কসবাদীই হয়ে উঠতে পারেন নি। উৎপাদিকা শক্তির বিকাশ অবশ্যাম্ভাবি, একে জোর করে আটকে রাখা যায় না, আটকে রেখে সামনে এগোনো যায় না”। পরিকল্পিত অর্থনীতির বিজয়রথ এগোতে শুরু করল। প্রমান হল মানুষ যদি সচেতন ভাবে উৎপাদনের কাজে নামে তাহলে বাধা যতই কঠিন হোক না কেন তাকে হারিয়ে দেওয়া যায়। একদিকে যন্ত্রশিল্পের প্রয়োজনীয়তা আরেকদিকে গ্রামের ক্ষুদ্র উৎপাদক (জমিহীন বা ছোট জমি থাকা কৃষক পরিবার)-দের মাঝের সংকট দূর করা গেল। সমাজতন্ত্রের শত্রুরা আতংকে কাঁপতে শুরু করল।
এই প্রেক্ষাপটেই দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ, আন্তর্জাতিক শক্তি হিসাবে ফ্যাসিবাদের উত্থান এবং যুদ্ধবিরোধী চুক্তি ভঙ্গ করে সোভিয়েত ইউনিয়নের উপরে ফ্যসিস্তদের আক্রমণ। এর প্রতিরোধে জনগনের নেতৃত্বে এক অসামান্য লড়াই (There is no land behind Volga!) – স্তালিনগ্রাদের যুদ্ধ, এককথায় যা ইতিহাসে নজীরবিহীন। এই লড়াইয়ের শেষে সোভিয়েত বহু ক্ষয়ক্ষতি (মিত্রশক্তির দেশগুলির মধ্যে সোভিয়েতের ক্ষতির পরিমানই সবচেয়ে বেশি) সহ্য করেও বিজয়ী – তারই প্রত্যক্ষ এবং পরোক্ষ প্রভাবে দুনিয়াজূড়ে উপনিবেশগুলির স্বাধীনতা অর্জন, পৃথিবীর নানা অংশে সমাজতান্ত্রিক শাসনের প্রতিষ্ঠা। পুঁজিবাদের আন্তর্জাতিক শক্তির প্রতিস্পর্ধায় আন্তর্জাতিক সমাজতান্ত্রিক শক্তি – চোখে চোখ রেখে। এইসবকিছুর পিছনে একটি ছোট শব্দ – স্তা… লি… ন। রাইফেলের বোল্ট টেনে লক করার আওয়াজ।
ইতিহাসের নায়ক এবং অসমাপ্ত মূল্যায়নের সমস্যা
আমাদের মনে রাখতেই হয় স্তালিন ঈশ্বর ছিলেন না। না দেখা ভবিষ্যৎ সম্পর্কে লাইব্রেরীর সেমিনারে অন্তহীন বিতর্ক জারী রাখার বদলে বাস্তব পরিস্থিতি অনুযায়ী মার্কসবাদ-লেনিনবাদ সম্মত পথে চলতেই তার দক্ষতা ছিল সবচেয়ে বেশি। তার কাজের ধারায় স্পষ্ট, তিনি দুনিয়ার সামনে একটা বাস্তব উদাহরণ নির্মাণ করতে চেয়েছিলেন – সমাজতন্ত্র কি করতে পারে, আর কোথায় তার সীমাবদ্ধতা – সেই কাজই তিনি শেষ অবধি করে গেছেন। দুনিয়ার শ্রমজীবী মানুষের জন্য স্বপ্ননির্মাণে তার ভূমিকা এখানেই। সেই পথে এগোতে বিস্তর বাধা পেরিয়েছেন স্তালিন – কখনো পণ্ডিতদের সন্দেহের কারনে, কখনো ক্ষমতার লক্ষ্যে নিছক ব্যাক্তিগত লোভের কারনে। আক্রান্ত হয়েছেন সীমানার বাইরে থেকে, হামলা সামলেছেন দেশের মধ্যে বিপ্লবী নামধারী শক্তির কাছ থেকে, এমনকি নিজেদের পার্টির ভিতরে একদা ঘনিষ্ঠ কমরেড এমন ব্যক্তিদের ষড়যন্ত্রের কবলে পড়েছেন বারে বারে। লেনিন নিজের চিঠিতে উল্লেখ করেছিলেন ট্রটস্কি এবং স্তালিন উভয়ের বিরোধ আগামীদিনে পার্টির জন্য ভয়ংকর বিপদ ডেকে আনবে। সেই বিরোধ অমিমাংসিত পরিণতির দিকে এগোল কার দোষে? স্তালিন? ট্রটস্কি? এই মূল্যায়নের কাজ আজও শেষ হয় নি। স্তালিন বুঝেছিলেন পার্টির একটা বড় অংশই চাইছে নেতৃত্বের এক অংশের সাথে আরেক অংশের সংঘাত হোক রক্তাক্ত পথে এবং এমনটা হলে ভয়াবহ পরিস্থিতি তৈরি হবে। বহু সংগ্রামের অভিজ্ঞতা কাজে লাগিয়েই প্রত্যেক কমরেডকে চিনতেন তিনি, প্রত্যেকের সক্ষমতা এবং দুর্বলতা সম্পর্কে একটা স্পষ্ট ধারণা ছিল তার। ট্রটস্কি সম্পর্কে “জিনোভিয়েভ এবং লেনিনগ্রাদের কমরেডরা ট্রটস্কির বহিস্কার চাইছেন। আমরা জিনোভিয়েভ, কামেনেভের কথায় মাথা কেটে ফেলার নিতিতে কান দিই নি, কারন এই নীতির ফলে পার্টিতে ভয়ংকর বিপদ ডেকে আনতে পারে। আমরা কেন্দ্রীয় কমিটিতে সংখ্যাগরিষ্ঠেরা একমত হই নি… এ হল রক্ত বইয়ে দেওয়ার পদ্ধতি। আজ একটি মাথা কাটবেন, আগামীকাল আরেকটি, তারপরে তৃতীয়। পার্টির আর কি বাকি থাকবে?” কিংবা বুখারিনের প্রসঙ্গে “… জোটবদ্ধভাবে যারা তাকে (বুখারিন-কে) কোতল করার কথা বলছেন তারা ভুলে যাচ্ছেন পার্টির অনেক নেতৃস্থানীয় কমরেডই আমাদের নতুন কৃষি লাইন প্রচার করছেন, তাদের যে কেউই ভুল করতে পারেন।… এই চরম দাবীর অর্থ কী? রাইকভ, কালিনিন, টমস্কি, মলোটভ, বুখারিনকে বাদ দিয়ে পার্টি চালাও। যে কমরেডদের নাম করলাম তাদের বাদ দিয়ে পার্টি চলতে পারে না। বুখারিনের বিরুদ্ধে ভিত্তিহীন কুৎসা এখনও চলছে কেন? ওরা বুখারিনের রক্ত চাইছেন।… সে রক্ত আমরা ওদের উপহার দেব না” বলে আমাদের সতর্ক করে গেছেন স্তালিন। এই সতর্কতা আজও প্রাসঙ্গিক, অভ্যন্তরীণ মতভেদের সুযোগ নিয়ে বাইরের শত্রুকে সুবিধা করে দেবার নীতি সম্পর্কেই স্তালিনের সাবধানবানী।
সোভিয়েত পার্টিতে ছেলেখেলা করা কমরেডরা ছিলেন না। ট্রটস্কি, জিনোভিয়েভ, কামেনেভ এবং বুখারিনের মতো যারা লেনিনের ছিলেন তারা প্রত্যেকেই জার শাসিত রাশিয়ায় বিপ্লবী সংগ্রামে নেতৃত্ব হিসাবে সরাসরি যুক্ত ছিলেন – নিজেদের মৃত্যুর সম্ভাবনা সম্পর্কে উদাসিন থেকেই। ট্রটস্কি, জিনোভিয়েভ, কামেনেভ কিংবা বুখারিন যাদের নাম নিয়ে আজও সারা পৃথিবীতে স্তালিনের নামে কোটি কোটি ডলার খরচ করে কুৎসার বাণিজ্য চলছে তারা প্রত্যেকেই সোভিয়েত বিপ্লবে অবদান রেখেছিলেন। একইমাত্রায় নির্ধারিত কর্তব্য সমাধান করেছিলেন স্তালিন। কিন্তু অন্য অনেকের সাথে তার চরিত্রগত কিছু ফারাক ছিল। সাফল্যে আত্মহারা হবার লোক তিনি ছিলেন না, বিরাট দায়িত্ব হাতে নিয়েও প্রশান্ত থাকার শিক্ষা তিনি লেনিনের থেকেই পেয়েছিলেন। এই বিশেষ মনোভাবটি ভাল করে বুঝতে না পেরেই অনেকে স্তালিন সম্পর্কে কঠিন, রুঢ় এসব অভিযোগ তোলেন। যৌথ খামার প্রতিষ্ঠা হওয়ার পরে প্রতিবিপ্লবী কুলাকদের বিচার সম্পর্কে কমরেডদের সতর্ক করে দিতে প্রবন্ধ লিখলেন “Dizzy with success” শিরোনামে, যার মূল কথা অশান্তি প্রতিরোধের কর্তব্য পালনে স্থানীয় স্বেচ্ছাচারী নেতাদের নিয়ন্ত্রন করার সময় এসেছে। তবে কি সামান্য মুচি পরিবারের সন্তান হিসাবে নিজের জন্মপরিচয়েরই খেসারত দিয়েছেন স্তালিন? তার অসামান্য দক্ষতাই অন্যদের ঈর্ষার হেতু হয়ে উঠেছিল? নাকি বিভিন্ন ব্যাক্তিত্বের ভিন্ন মতের সংঘাতে সত্য উৎসারিত হওয়া সম্পর্কে মাও সে তুংয়ের কথামতো “শত পুষ্পের বিকশিত হবার পথ, শত পথের মাঝে একটি সত্য বেরিয়ে আসার উপায়” যে ঐতিহাসিক শিক্ষা আগামী প্রজন্মের জন্য রয়ে যেত তাকে ক্ষমতা দখলের লড়াই বলে দাগিয়ে দিতে পারলে ‘সব রাজনীতিই খারাপ’ নামক রাজনীতির জয় নিশ্চিত হয় বলেই এত আয়োজন? নিকিতা ক্রুশ্চভের সবচেয়ে বড় দুর্নীতি এই যে তিনি দুনিয়াজূড়ে কমিউনিস্টদের সংহতির গোড়ায় আঘাত করলেন এবং এমনটা করলেন যখন স্তালিন আর বেঁচে নেই। যদিও সোভিয়েত পার্টির বিংশতিতম কংগ্রেসে খ্রশ্চভের সেদিনকার মিথ্যাচার আজকের দিনে নির্জলা মিথ্যা প্রমানিত হয়েছে। বহু রহস্য উন্মোচনের ঘোষণা হলেও তার একটি বিষয়েও কোন প্রমান পাওয়া যায় নি, উল্টে স্তালিনের সঠিক পদক্ষেপেরই তথ্য প্রকাশিত হয়েছে তবু প্রচার চলছে স্তালিন এই করেছিলেন, সেই করেছিলেন। এহেন কুচক্রিবৎ সংস্কৃতি কমিউনিস্টদের মধ্যে কখনো ছিল না, মুক্ত হাওয়ার নামে নির্বোধের মত অপপ্রচারে আক্রান্ত হয়ে কুৎসা চিবিয়ে চলার এই সংস্কৃতিকে রুখে দেবার সময় এসেছে। আন্তর্জাতিক কমিউনিস্ট বৃত্তে একটা সময় অবধি আন্তর্জাতিক নেতৃত্বের ধারণা চালু ছিল – কমিন্টার্ন। শুরুর কয়েক দশক বাদ দিলে আন্তর্জাতিক নেতৃত্বের নাম করে বিভিন্ন দেশের কমিউনিস্ট পার্টির উপরে একতরফা সিদ্ধান্ত চাপিয়ে দেওয়া শুরু হয়, একে আটকে দিলেন স্তালিন নিজে, কমিন্টার্ন বন্দোবস্ত খারিজ করলেন। এই মানুষটি অন্যের গণতান্ত্রিক অধিকার মানতেন না একথা মেনে নেওয়া চলে? আন্তর্জাতিক খ্যাতিসম্পন্না সাংবাদিক অ্যানা ল্যুইস স্ট্রং-এর লেখা থেকে স্তালিনের যে ব্যক্তিত্ব ফুটে ওঠে তা এক ধীরস্থির, অতি বিচক্ষন, প্রাজ্ঞ নেতার – যিনি অন্যের কথা শোনেন বেশি, নিজে বলেন কম তাও সবার শেষে এবং যখন বলেন তাকে সিদ্ধান্ত হিসাবে মেনে নিতে কারোর অসুবিধা হয় না। অ্যানা বিশেষ জোর দিয়েছেন পরস্পর বিরোধী মতামতের মধ্যে থেকে সারাংশটুকু টেনে বের করে আনতে স্তালিনের দক্ষতার উপরে, ভারতের বিপ্লবীরা নিজেদের দেশে কর্মসূচির প্রশ্নে স্তালিনের সম্মুখে উপস্থিত থেকে একই অভিজ্ঞতার সাক্ষী থেকেছেন। এসবই আজকাল ছাপার অক্ষরে পাওয়া যায়। ট্রটস্কি এবং স্তালিনের মধ্যেকার বিরোধ তাদের দুজনের মৃত্যুর পরেও প্রবহমান (উন্নত ধনতান্ত্রিক দেশের মার্কসবাদীদের সাথে তৃতীয় বিশ্বে সক্রিয় কমিউনিস্টদের মধ্যে) – দুই পক্ষের মতান্ধদের মধ্যে, অথচ এর সুযোগ নিচ্ছে পুঁজিবাদ, সাম্রাজ্যবাদ – কমিউনিস্টদের লড়াইটা পুঁজিবাদের বিরুদ্ধে একজোট না হয়ে একে অন্যের বিরুদ্ধে শক্তিক্ষয় করে চলেছে। এইটুকু মনে রাখলে একই ভুল বারে বারে ফিরে আসা রুখে দেওয়া যায়। হারিয়ে দেওয়া যায় এক বিরাট চক্রান্ত যার উদ্দেশ্য সমাজতন্ত্রের বিকাশ রুদ্ধ করা – মানবমুক্তির আসল প্রশ্নকে পিছনে ফেলে একক ব্যাক্তির বিকাশের নামে মুনাফার সংস্কৃতিকে জিইয়ে রাখা। মুনাফার আন্তর্জাতিক শক্তি সেই চক্রান্তে অনেকটা সফল একথা পরিস্কার, এর প্রতিরোধে আজকের দিনে কমিউনিস্টরা কি ব্যবস্থা নেবেন সেটাই প্রশ্ন। সেই বিরাট প্রশ্নকেই এক কথায় এই নিবন্ধের শিরোনাম হিসাবে বেছে নিয়েছি আমরা – আজও কেন স্তালিন?
নায়করা ইতিহাস সৃষ্টি করেন না, ইতিহাস নিজের গতিপথে নায়ক বেছে নেয় – স্তালিনের বক্তব্য জনগণই আসল শক্তি যাদের বিরুদ্ধে কখনো কোন ক্ষমতাবান টিকে থাকতে পারেন না, এমন কোন সেনাবাহিনী নেই যা চিরকাল অজেয় থাকতে পারে। ইতিহাসের শিক্ষা এই যে মানুষ ভুল করেন আবার সেই ভুল থেকে শিক্ষা নিয়ে ইতিহাস নির্মাণও করতে পারেন – সাময়িক বিপর্যয়ে কমিউনিস্টদের হতোদ্যম হলে চলে না, জনগনের সাথে থেকেই তাদের উন্নতির জন্য সক্রিয় হতে হয়। সেই সক্রিয়তা আজও এমন সবাইকে একজায়গায় চাইছে যারা মুক্তির অগ্নিপথে চলতে সক্ষম – আমরা সময়ের দাবী মেনে কতদূর এগোতে পারি আজকের আন্তর্জাতিক কর্মসূচি সেটাই।
বহুপথগামী ঘৃণ্য চক্রান্তের জবাবে একটা কথার উল্লেখই বোধহয় যথেষ্ট হবে – বুখারিনের জেল ডায়েরি সম্পর্কে প্রচার স্তালিন সেইসব প্রকাশ করতে দেন নি। সেই লেখার একটি অংশের শিরোনাম The material base for socialist culture – তারই এক জায়গায় উল্লেখ রয়েছে “… In our country the crying contradiction between the development of industry and not very productive ‘small and very small’ peasant household expressed itself with special force –as Stalin understood in his time.” – এক সময় যৌথ খামার ব্যবস্থার সমালোচনায় মুখর ছিলেন, পরে নিজেই স্বীকার করলেন ঐ সমস্যার সমাধান জরুরী ছিল (অবশ্য এই লেখায় স্তালিনের সমালোচনা নেই বলে ইংরেজি অনুবাদক উল্লেখ করছেন বুখারিনের পক্ষে জেলে বসে সেই কাজ করা সম্ভব ছিল না) এবং স্তালিন সঠিকভাবেই সেই সমাধানের পথে এগিয়েছিলেন। মস্কো মামলায় কমিউনিস্ট পার্টির পক্ষে আইনজীবী ভিসিনস্কির সওয়ালে বেসামাল হয়ে পড়ে একে একে সকলেই স্বীকার করেছিলেন তারা দেশের বিরুদ্ধে চক্রান্তে জড়িত – বুখারিন শেষ অবধি লড়ে গেছিলেন। জারের বিরুদ্ধে লড়াইতে অভিজ্ঞ বিপ্লবী বুখারিন, খুব সহজেই নিজের লেখা গোপনে জেলের বাইরে পাঠিয়ে দিতে পারতেন (লেনিন অবধি সেই কাজ অনেকবার করেছেন, সেই শিক্ষা সোভিয়েত পার্টিতে প্রচারিত হত, মুসোলিনির জেলে আটক থেকেও আন্তোনিও গ্রামশী এই কাজ করেছেন) অথচ সেই চেনা পথে না হেঁটে লুবিয়াংকা জেলে থাকাকালীন লেখা নিজের দলিল সুরক্ষিত রাখতে তিনি সেসব একজনেরই হাতে পাঠিয়ে দিয়েছিলেন। সেই একজন কে? স্তালিন ! ১৯৩৭ সালে বুখারিন স্তালিনের উদ্দেশ্যে তিনি চিঠি লিখে বলছেন – “…Dont let this work perish. I repeat and emphasize: this completely apart from my personal fate. Don’t let it be lost!”
জার শাসনের নিপীড়ন সহ্য করা পোড়খাওয়া বিপ্লবীরা যার বিরুদ্ধে একজোট হলেন, গোপনে নিজের লেখা পাচার না করে তারই হাতে নিজের লেখা সেই ডায়েরি কেন তুলে দিলেন বুখারিন? স্তালিনকে নিশানা করে কমিউনিস্টরা নিজেদের ঐক্য ভেঙ্গে কুৎসায় ব্যস্ত থাকলে আসলে কাদের লাভ? এই সহজ প্রশ্নটি মাথায় রাখুন – অনেক অন্ধকার কেটে যাবে।
তথ্যসুত্রঃ
১) স্তালিন রচনাবলী (খণ্ড ১০) – ফরেন ল্যাঙ্গুয়েজেস পাবলিশিং হাউজ, মস্কো
২) স্তালিন রচনাবলী (খণ্ড ১১-১২) – ফরেন ল্যাঙ্গুয়েজেস পাবলিশিং হাউজ, মস্কো
৩) দ্য স্তালিন লিগ্যাসি আইভরি ফ্ল্যড বাট আইভরি স্টিল – হিরেন মুখার্জি
৪) স্তালিন এরা – অ্যানা ল্যুইস স্ট্রং
৫) দ্য গ্রেট কন্সপিরেসিঃ দ্য সিক্রেট ওয়ার এগেইন্সট সোভিয়েত রাশিয়া – অ্যালবার্ট ই কাহন, মাইকেল সেয়ার্স –
৬) স্তালিন – আ বায়োগ্রাফি – রবার্ট সার্ভিস, প্যান ম্যাকমিলান
৭) প্রতিবিপ্লব – উৎপল দত্ত, এম সি সরকার অ্যান্ড সন্স প্রাইভেট লিমিটেড
৮) ইকোনমিক প্রব্লেমস ইন ইউএসএসআর – স্তালিন, মস্কো
৯) রেভল্যুশন বিট্রেইড – লিয় ট্রটস্কি, আকার বুকস
১০) মাই লাইফ, অ্যান অ্যাটেম্পট অ্যাট অ্যান অটোবায়োগ্রাফি – লিয় ট্রটস্কি, সি স্ক্রিবনার্স সন্স
১১) সোশ্যালিজম অ্যান্ড ইটস কালচার – বুখারিন, সিগাল বুকস