দীপ্তজিৎ দাস
ইতমাদ, ইত্তিহাদ, কুরবানী। তিনটি নীতিবাক্যকে সামনে রেখে পথচলা শুরু করে সুভাষচন্দ্র বসু পরিচালিত আজাদ হিন্দ ফৌজ। উর্দু শব্দ তিনটির বাংলা তরজমা করলে দাঁড়ায় বিশ্বাস একতা এবং আত্মত্যাগ। পরাধীনতা বিধ্বস্ত জাতির কাছে এই তিনটি শব্দের মূর্ত প্রতীক যেন সুভাষ বোস। ব্রিটিশের গোলামীর বিরুদ্ধে তিনি যেন দেশপ্রেমের জ্বলন্ত মশাল। নিখোঁজ হওয়ার ৭৭ বছর পেরিয়েও ভারতবাসীর চোখে প্রতিরোধের আগুন তিনি। স্বাধীনতার ৭৫ বছর পেরিয়েও আজাদীর প্রকৃত অমৃত খুঁজতে মন্থন চলে তার ভাবনার। স্বভাবতই তার নাম ব্যবহার করে ক্ষুদ্র রাজনৈতিক স্বার্থসিদ্ধি করতে চায় সুবিধাবাদীরা।
স্বাধীনতা সংগ্রামে প্রতিনিয়ত বিশ্বাসঘাতকতা করে আসা সংঘের উত্তরাধিকাররা আজ নিমগ্ন এ বাংলার শ্রেষ্ঠ সন্তানের ভাবমূর্তি ব্যবহার করে নিজেদের ভঙ্গুর ইমেজ জোড়া লাগানোর কাজে। ২০১৪ সালে ক্ষমতায় আসীন হওয়ার পরই নরেন্দ্র মোদী বলেছিলেন নেতাজি সংক্রান্ত অনেক অপ্রকাশিত ফাইল মানুষের সামনে আনা হবে। ৯ বছর পেরিয়ে গেলেও দিনের আলো দেখেনি মোদির আরও একটি জুমলা। সাম্প্রতিক সময়ে আরএসএস-এর মুখপত্র অর্গানাইজার পত্রিকা লেখা হয়েছে জাপানে নেতাজীর মৃত্যু হয়নি। তার পরের বছরগুলিতে নেতাজি সংক্রান্ত গবেষণা এবং সত্য উদঘাটনের সময় এসেছে। ৯ বছরে যে তথ্য প্রকাশিত হয়নি আবারও রাজনৈতিক অছিলায় তাকে নিয়ে ছলনার এক নিম্ন রুচির অবলম্বন সংঘের। এ বছরই ২৩শে জানুয়ারি শহীদ মিনারের সামনে কুচকাওয়াজের আয়োজন করেছে স্বয়ংসেবকরা। সেই অনুষ্ঠানে অতিথির আসন অলংকৃত করবেন ভারতজুড়ে বিদ্বেষের বিষবাষ্প ধূমায়িত করা মোহন ভাগবত। তাদের কর্মসূচির নাম ‘নেতাজি লহ প্রণাম’।
ঠিক একই সময় নেতাজির উত্তরাধিকার দাবি করছেন সংঘ এবং নেতাজির চিন্তাধারা সম্পূর্ণ বিপরীতধর্মী। জার্মানি থেকে পিটিআইকে দেওয়া এক সাক্ষাৎকারে সুভাষ বোসের কন্যা অনিতা বসু পাফ জানিয়েছেন,’ নেতাজির আদর্শ ধর্মনিরপেক্ষতা। সব ধর্মের সমস্ত মানুষের সমন্বয় কাঙ্ক্ষিত ছিল তার। কিন্তু আরএসএসের ভাবাদর্শ এর উল্টো।’ একই সঙ্গে তিনি জানিয়েছেন নেতাজি ছিলেন বামপন্থার আদর্শ উদ্বুদ্ধ। দক্ষিণপন্থার সাথে কোন রকম আপোষে তার ছিল ঘোর অনীহা। সংঘের বক্তব্যের সম্পূর্ণ বিপরীতে অবস্থান করছেন সুভাষ তনয়া। ভারতের স্বাধীনতা সংগ্রামের আলোকে সুভাষ বোসের অনন্য আত্মত্যাগের নজিরের সাপেক্ষে আলোচনা করে বিশ্লেষণ করা যাক উভয়ের দাবির বাস্তবতা।
অজস্র রক্ত অশ্রু আত্মত্যাগ শাহাদাতের বিনিময় ছিনিয়ে নেওয়া ভারতবর্ষের স্বাধীনতার ইতিহাসে কেবল পিছন থেকে ছুরি মারাই একমাত্র ভূমিকা ছিল আরএসএসের। সৃষ্টির সময় থেকেই আরএসএসের প্রধানরা মনে করতেন হিন্দুদের একমাত্র শত্রু মুসলমান খ্রিস্টান এবং কমিউনিস্টরা। ব্রিটিশের বিরুদ্ধে সংগ্রামের পরিবর্তে আদর্শ হিন্দুয়ানীর জন্য এদের বিরুদ্ধেই সংঘাতে অবতীর্ণ হওয়ার আহ্বান জানিয়েছিলেন তারা। আরএসএস নেতা মুঞ্জে সরাসরি মুসোলিনির সংস্পর্শে আসেন এবং তার ক্রিয়াকলাপ দ্বারা প্রভাবিত হয়ে সংঘের অভ্যন্তরেও তা প্রণয়ন করবার প্রচেষ্টা করেন। হিন্দু মহাসভার অগ্রণী সেনানি সাভারকার ইতিহাসে মুছলেখা দেওয়ার রেকর্ড করেছিলেন। ১৯৪২ ভারত ছাড়ো আন্দোলনের উত্তাল তরঙ্গ যখন ছড়িয়ে পড়েছে দেশজুড়ে। উত্তরপ্রদেশের বটেশ্বরে পুলিশের সামনে নিজেকে রক্ষার জন্য সংগ্রামী নেতা লীলাধর বাজপেয়ী ও তার সঙ্গীদের ধরিয়ে দেন অটল বিহারী বাজপেয়ী। বেইমানি যাদের রক্তে দেশের রাজনীতিতে প্রাসঙ্গিকতা এবং ছদ্ম জাতীয়তাবোধের উন্মাদনা ছড়িয়ে দেওয়ার জন্য তাদের ব্যবহারের প্রয়োজন হয় জাতির এই নায়ককে।
১৯০৭ সালে বাংলায় ‘হিন্দু আন্দোলন’ এবং পাঞ্জাবে ‘হিন্দু সভা’ হিন্দু স্বাতন্ত্রবোধকে সংগঠিত রূপদান করে। এই উদ্দেশ্যরই আরো বিস্তৃতি স্বরূপ ১৯১৩ সালে সারা ভারত হিন্দু মহাসভা প্রতিষ্ঠিত হয়। স্বাধীনতার পরিবর্তে হিন্দু জাতীয়তাবাদকে সংহত করতে তৎপর হয় তারা। অন্যদিকে ১৯০৬ সালে প্রতিষ্ঠিত হয় সারা ভারত মুসলিম লীগ। সেই বছরই পয়লা অক্টোবর মুসলিম সম্প্রদায়ের আধ্যাত্মিক নেতা আগা খাঁর নেতৃত্বে এক প্রতিনিধি দল সিমলায় ভাইসরয় লর্ড মিন্টোর সঙ্গে দেখা করে মুসলমান সম্প্রদায়ের স্বার্থ রক্ষার দাবি জানান। ভারতবর্ষের রাজনীতিতে ক্রমে মাথাচাড়া দিতে থাকে দ্বিজাতি তত্ত্বের বীজ। ছাত্রাবস্থায় এই পরিস্থিতির বিশ্লেষণ সুভাষ বোসকে ইংরেজের বিভেদ নীতি সম্পর্কে সচেতন করেছিল। রবীন্দ্রনাথের ঐক্যের এবং বিশ্ব সংস্কৃতির সমন্বয় ভাবনার দ্বারা প্রভাবিত হয়ে সুভাষচন্দ্র দেশবাসীকে ধর্মীয় গোঁড়ামি ও সংকীর্ণতা বর্জন করে স্বাধীন ভারত গঠনের দায়িত্ব পালন করতে আহ্বান জানান। ১৯২৫ সালে রাষ্ট্রীয় স্বয়ংসেবক সংঘ প্রতিষ্ঠার পর হিন্দু সংখ্যাগুরুবাদের পক্ষে প্রতিনিয়ত সওয়াল করতে থাকে তারা। দেশের স্বাধীনতা আন্দোলন দুর্বল করার এই ঘৃণ্য প্রয়াসের বিরুদ্ধে বি এস মুঞ্জের কড়া সমালোচনা করেন সুভাষ বোস। পরবর্তী সময়ে শ্যামাপ্রসাদ মুখার্জী কংগ্রেস ত্যাগ করলে বন্ধু সুভাষচন্দ্র বসুকে তার সাথে টানার প্রয়াস করেন তিনি। একান্ত আলাপে শ্যামাপ্রসাদ কে বিভাজনের নোংরা রাজনীতি থেকে সরে আসার পরামর্শদান সুভাষ ঘোষ। কিন্তু ১৯৩৯ সালের সাভারকারের কলকাতা সফরের সময় হিন্দু মহাসভায় যোগদান শ্যামাপ্রসাদ। এরপর বিভিন্ন স্থানে হিন্দু মহাসভা সমাবেশের আয়োজন করলে সুভাষ বোসের দল ফরওয়ার্ড ব্লকের কর্মীরা সরাসরিভাবে সেই সভা বানচাল করে দেওয়ার চেষ্টা করেন। এমনকি এক সভা চলাকালীন ঢিল মেরে শ্যামাপ্রসাদের মাথা ফাটিয়ে দেওয়া হয়। ১৯৪০-এ ঝাড়খণ্ডের সভা থেকে হিন্দু মহাসভার ধর্মের নামে ধর্মকে কলুষিত করে রাজনীতি করার অপপ্রয়াসকে তীব্র আক্রমণ করেন তিনি। আপাদমস্তক সম্প্রীতির ভ্যানগার্ড সুভাষ বসু হিন্দু মহাসভা এবং আরএসএসের বিভাজনের রাজনীতির বিরুদ্ধে সরব ছিলেন।
সম্প্রতি আরএসএসের মুখপত্র অর্গানাইজার কে দেওয়া সাক্ষাৎকারে মোহন ভগবত বলেছেন, ‘ দেশের হিন্দু সমাজ যুদ্ধের মধ্যে আছে। যুদ্ধের সময় আগ্রাসী মনোভাবই স্বাভাবিক।’সরাসরি ভাবে দেশে বিদ্বেষের বাতাবরণ সৃষ্টি করার পক্ষে সওয়াল করেন যিনি আজকে তিনিই সুভাষচন্দ্র বসুর জন্মদিনে আরএসএসের অনুষ্ঠানের প্রধান অতিথি। অথচ প্রতিনিয়ত নিজের অনুশীলনের মাধ্যমে দেশের স্বাধীনতা সংগ্রামের স্বপক্ষে সম্প্রীতির বার্তার প্রচার করেছিলেন সুভাষ বসু।
সাম্প্রদায়িকতাবাদের সংকীর্ণতা মুক্ত এক পরিবারে বেড়ে ওঠেন তিনি। তার বাড়ির পরিচারকরা নানা ভাষা এবং ধর্মের ছিল। জীবনের যাত্রাপথেই ঔদার্য এবং মানব প্রেমের ভাবনার সঞ্চার হয় তার মধ্যে। রামকৃষ্ণ এবং বিবেকানন্দের রচনাবলী, তার মনে গভীর আলোকপাত করে।’ মধ্যযুগের ‘স্বার্থপর মঠ জীবন ‘ বা বেন্থাম ও মিল প্রচারিত আধুনিক ‘উপযোগ বাদ’ সম্পর্কে তার মনে নেতিবাচক মনোভাব সৃষ্টি হয়। ছাত্র জীবনে প্রেসিডেন্সি কলেজ থেকে বিতাড়িত হওয়ার পর কটকে ফিরে রোগীর সেবা, মৃতদেহ সৎকার, টাইফয়েড আক্রান্ত সাঁওতাল ছাত্রের সেবা ইত্যাদি কাজে তিনি নিযুক্ত হন। ভারতবর্ষে যখন সাম্প্রদায়িকতার বিষ ছড়িয়ে পড়েছে আকাশে বাতাসে সেই সময় এক আধুনিক মানুষ কোন মানুষ হিসেবে ১৯২১ সালে রাজনীতিতে আত্মপ্রকাশ ঘটে সুভাষচন্দ্র বসুর। বাংলায় ঘটে চলা হিন্দু মুসলমান হানাহানির পরিস্থিতি কিছুটা নিয়ন্ত্রণে আনার জন্য ১৯২৩ সালে দেশবন্ধু চিত্তরঞ্জন দাস ‘বেঙ্গল প্যাক্ট’ চুক্তি প্রস্তাব করেন। সুভাষচন্দ্র সরাসরি এই প্রস্তাবের স্বপক্ষে বিভিন্ন জায়গায় সভা সমিতিতে অংশগ্রহণ করেন। কংগ্রেসের বেঙ্গল প্রাদেশিক কমিটিতে ‘ বেঙ্গল প্যাক্ট ‘ স্বীকৃত হলেও তথাকথিত দক্ষিণপন্থীরা এর তীব্র বিরোধিতা করেন। সর্বভারতীয় অধিবেশনে তা পত্রপাঠ খারিজ হয়ে যায়। ১৯২৪ সালে কলকাতা কর্পোরেশনের নির্বাচনে মেয়র নির্বাচিত হন চিত্তরঞ্জন দাস। সে সময় কর্পোরেশনের প্রধান কার্যনির্বাহীর পদে আসীন হন সুভাষচন্দ্র বসু। ঠিক একই সময় কর্পোরেশনের ডেপুটি মেওয়ার ছিলেন হোসেন শহীদ সোহরাবর্দি। প্রধান কার্যনির্বাহীর সহায়ক ছিলেন আব্দুর রশিদ খান। দেশ জুড়ে যখন দাঙ্গার ভয়াবহ আগুন জ্বলে উঠছে, সে সময় কলকাতা কর্পোরেশনের এমন নিদর্শন ছিল প্রকৃত ঐক্যের বার্তা বাহক।
পরবর্তী সময়ে আজাদ হিন্দ ফৌজ পরিচালন কালেও নেতাজির ধর্মীয় গোড়ামী মুক্ত প্রগতিশীল মননের পরিচয় পাওয়া যায়।’ লাল কিলে সে আই আওয়াজ/সায়গল ধীলো শাহনওয়াজ’ শ্লোগানে মুখরিত হয় তামাম ভারতবর্ষ। সে সময় আজাদ হিন্দ বাহিনীর প্রধান তিনজন কমান্ডার একজন প্রেম সায়গল আরেকজন শাহনওয়াজ খান অপরজন বলজিৎ সিং ধীলো। নিজের উত্তরসূরি হিসেবে আজাদ হিন্দ বাহিনীর দায়িত্ব সুভাষ বসু সপে যান এম.জেড কিয়ানির হাতে। স্বপ্নে লালিত অখন্ড ভারতবর্ষের এক অনবদ্য প্রতিচ্ছবি ফুটে ওঠে আজাদ হিন্দ বাহিনীর প্রতিটি আচরণে। হিন্দু মুসলমান শিখ খ্রিস্টান ধর্মের ভেদাভেদ ভুলে লড়াইয়ের ময়দানে সকলে ভাস্বর হয়ে ওঠে দেশের মুক্তির জন্য। সেনাবাহিনীকে সম্ভাষণের জন্য সেনা নায়কের আহ্বানে প্রথম ‘জয় হিন্দ’ স্লোগানটি ব্যবহার করেন আবিদ হাসান সাফরানি। জার্মানি থেকে জাপান দুঃসাহসিক সাবমেরিন যাত্রায় সুভাষ বোসের একমাত্র সঙ্গী সেই আবিদ হাসান ই। জীবনের শেষ যাত্রায় বিমানে কাবুলে তার সঙ্গী হয়েছিলেন একজন মুসলমান হাবিবুর রহমান। দেশ যখন প্রতিদিন ভাঙছে ধর্মের নামে ,বর্ণের নামে ,ভাষায়, জাতে তখন আজাদ হিন্দ বাহিনীর এই সম্প্রীতির নিদর্শন ছিল প্রকৃতই স্বাধীনতার অভিন্ন অভিপ্সা র প্রতি জোরদার সওয়াল। তাই ধর্মের কারবারিদের মুখে নেতাজির অপব্যবহার স্বাধীনতা সংগ্রামের বিকৃতির শামিল।
রাজনীতির সূচনা থেকেই বামপন্থার প্রতি বিশেষ আকর্ষণ ছিল সুভাষচন্দ্র বস। ১৯২১ সালে কংগ্রেসের আমেদাবাদ অধিবেশনে কমিউনিস্ট নেতা মৌলানা হযরত মোয়ানি ও স্বামী কুমারানন্দ প্রথম পূর্ণ স্বরাজের দাবি উত্থাপন করেন। সেসময় তা বাতিল হয়ে গেলেও এই উদ্যোগের প্রভূত প্রশংসা পরবর্তী সময় করেছিলেন সুভাষ বোস। বিশ্বের ইতিহাস অধ্যয়ন করে শিল্প বিপ্লব এবং ফরাসি বিপ্লবের আদর্শ সম্পর্কে অনুরক্ত হন তিনি।সোভিয়েতের সমাজতন্ত্রের মডেল তার মনে গভীর প্রভাব ফেলে। ১৯২৮ সালে কংগ্রেসের কলকাতা অধিবেশনে প্রায় পঞ্চাশ হাজার শ্রমিকের সংগঠিত মিছিল কক্ষে প্রবেশ করে পূর্ণ স্বরাজের দাবি জানায়। অধিবেশনে সুভাষচন্দ্র ও জহরলাল নেহেরু পূর্ণ স্বরাজের দাবির স্বপক্ষে ঝাঁঝালো বক্তব্য পেশ করেন। কিন্তু শেষ পর্যন্ত গান্ধীজীর ভাবে নেহেরু সরে এলেও সুভাষচন্দ্র পূর্ণ স্বরাজের দাবিতে অনড় থাকেন। পরবর্তীকালে ১৯২৯ এর লাহোর অধিবেশনে এ কংগ্রেস পূর্ণ স্বরাজের দাবি গ্রহণ করে। সেই বছরই সর্বভারতীয় শ্রমিক সংগঠন নিখিল ভারত ট্রেড ইউনিয়ন কংগ্রেসের সভাপতি নির্বাচিত হন সুভাষচন্দ্র বসু। দেশের স্বাধীনতা সংগ্রামের অগ্রগতির জন্য শ্রমিক কৃষকদের সংগঠিত করার গুরুত্ব অনুধাবন করেছিলেন তিনি। পাশাপাশি বৈষম্যের বীজ উপড়ে ফেলে সাম্যবাদের মডেলে দেশকে গড়ে তোলার বার্তার সওয়ার ছিলেন তিনি। ১৯৩০ সালের মে মাস নাগাদ বিপ্লবী বারীন্দ্র ঘোষ কে একটি চিঠিতে তিনি লেখেন,’ রাজনৈতিক সামাজিক ও অর্থনৈতিক এই তিনটি দাসত্ব থেকে মুক্তি চাই। আমাদের গড়তে হবে একটি মুক্ত ও শ্রেণীহীন সমাজ যার ভিত্তি হবে সাম্যবাদ বা কমিউনিজম।’
পরবর্তী সময়ে কংগ্রেসের অভ্যন্তরে বারংবার ট্রেড ইউনিয়ন এবং গণফ্রন্টের গুরুত্ব সম্পর্কে সোচ্চার হোন নেতাজি এবং নেহেরু। ১৯৩৮ সালে হরিপুরা কংগ্রেস থেকে কংগ্রেসের সভাপতি পদে নির্বাচিত হন সুভাষচন্দ্র বসু। তার এই নির্বাচনের পিছনে গুরুত্বপূর্ণ অবদান ছিল বামপন্থীদের। সভাপতি হিসেবে প্রথম ভাষণে তিনি আন্দোলন সংগ্রাম পরিচালনার পাশাপাশি দেশ গঠনের একটি মডেলও পেশ করেন। দেশ ও জাতির প্রধান সমস্যা হিসেবে তিনি বৈষম্য সম্পদের অসম বন্টন এবং দারিদ্রকে চিহ্নিত করেন। ধর্মীয় বিভাজন যে স্বাধীনতা সংগ্রামের পথে প্রধান অন্তরায় তার অনুভব ছিল প্রতিপদে।আপোষ রাজনীতির বিরুদ্ধে অনড় অবস্থান এবং সমাজতান্ত্রিক ঝোঁক কংগ্রেসের অভ্যন্তরে দক্ষিণপন্থীদের চক্ষুশূল করে। ১৯৩৯ সালের ত্রিপুরী কংগ্রেসে কৃপালিনী ভুলাভাই দেশাই সহ গান্ধীর অনুচররা সরাসরি ভাবে সভাপতি হিসেবে নেতাজীর প্রতি অনাস্থা আনেনে। কিন্তু সুভাষচন্দ্রের পক্ষে সমর্থনের জোয়ার হিসেবে হাজির হয় বামপন্থীরা। গান্ধীজীর প্রস্তাবিত সভাপতি পদপ্রার্থী পট্টভি সীতারামাইয়ার বিরুদ্ধে বামপন্থীরাই সভাপতি হিসেবে সুভাষচন্দ্র এর নাম প্রস্তাব করেন। ভোটাভুটিতে শেষ পর্যন্ত সুভাষ বোস জয়ী হলে গান্ধীজি বলেন পট্টোভি র পরাজয় আমার পরাজয়। অন্যদিকে কমিউনিস্ট পার্টির সাধারণ সম্পাদক পি.সি যোশী সুভাষচন্দ্রের এই বিজয়কে অভিনন্দন জানিয়ে বলেন ,’ cadres decide everything’। কিন্তু গান্ধীজীর কূটনীতির ফলে কংগ্রেসের কার্যকরী কমিটিতে ১৫ জন সদস্যদের মধ্যে ১৩ জনই সরাসরি তার বিরোধীতা করতে থাকেন। কিছুটা বাধ্য হয়েই দলত্যাগ করেন সুভাষ বসু। রাজনৈতিক জীবনে এহেন ঝড়ের পরিস্থিতিতেও এদেশের বামপন্থীরা ছিলেন সুভাষচন্দ্রের প্রধান সহায়ক। পাশাপাশি বামপন্থার প্রতিও গভীর অনুরাগ ছিল নেতাজির।
কংগ্রেস ত্যাগের পর সুভাষচন্দ্র নতুন দল ফরওয়ার্ড ব্লক গড়ে তোলেন। এই জটিল পরিস্থিতিতে বামপন্থীরা ছিল দ্বিধাবিভক্ত। একদিকে সুভাষ বোসের দেশপ্রেমের উপর এদেশের কমিউনিস্টদের ছিল অগাধ বিশ্বাস। পাশাপাশি কংগ্রেসের কাঠামোর বাইরে বেরিয়ে এসে সরাসরিভাবে দেশব্যাপী স্বাধীনতা সংগ্রামের ঝড় তোলাও ছিল সেই সময় কঠিন বিষয়।তথাপি বিভিন্ন সময় ফরওয়ার্ড ব্লক ও কমিউনিস্টরা একসাথেই পথ চলেন। স্বয়ং সুভাষ বোস লেফট কনসোলিডেশন কমিটি গড়ে তোলার উদ্যোগ নেন। দেশের স্বাধীনতার লক্ষ্যে প্রথমত সমস্ত বামপন্থী শক্তিকে সমবেত করা এবং সর্বোপরি সমস্ত স্বাধীনতাকামী শক্তিকে যুক্ত মঞ্চের আওতায় আনার প্রয়াস চালিয়ে যান তিনি। ১৯৪০ সালে অন্ধকূপ হত্যার স্মৃতিবাহী হলওয়েল মনুমেন্ট অপসারণের বিরুদ্ধে ফরওয়ার্ড ব্লকের লড়াইয়ে সামিল হয় কমিউনিস্টরা। বিভিন্ন সময় কমিউনিস্ট পার্টির মুখপত্র ন্যাশনাল ফ্রন্টে প্রবন্ধ লেখেন নেতাজি। আবার ফরওয়ার্ড ব্লকের মুখপত্র সম্পাদকমন্ডলীতে যুক্ত ছিলেন কমিউনিস্ট নেতা গোপাল হালদার, বিনয় ঘোষ, এস উপাধ্যায়রা। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ চলাকালীন পরিস্থিতির বিশ্লেষণ নিয়ে নেতাজি ও কমিউনিস্টদের কিছুটা মতপার্থক্য হয়। অক্ষ শক্তির বিজয় মানব সভ্যতার ইতিহাসকে বিপথে চালিত করতে পারে এই বিশ্লেষণ থেকে বামপন্থীরা যুদ্ধের সময় নিজেদের ফ্যাসিবাদের বিরুদ্ধে প্রতিষ্ঠিত করে। কিন্তু সম্ভবত ফ্যাসিবাদের সরাসরি বিপদ সম্পর্কে প্রত্যক্ষ অভিজ্ঞতা না থাকায় পরিস্থিতি বিশ্লেষণে কিছুটা অপারগ হন নেতাজি। দেশপ্রেমের অকৃত্রিম আবেগ থেকেই ‘শত্রুর শত্রু আমার মিত্র’ এই নীতিতে উদ্বুদ্ধ হন নেতাজি। তবে বামপন্থীদের সাথে তার সৌহার্দ্যর সম্পর্ক বজায় ছিল আজীবন। ব্রিটিশ পুলিশের চোখে ধুলো দিয়ে দেশ থেকে পলায়নকালে কাবুল পর্যন্ত তার শরিক হয়েছিলেন কমিউনিস্ট নেতা ভগত রামতলওয়ার। জার্মানি গিয়ে হিটলারের সাথে সাক্ষাৎ করে সৈন্যবাহিনী গড়ে তুললেও ইহুদিদের প্রতি তার নৃশংস অত্যাচারের বিরুদ্ধে সরব হন নেতাজি। প্রধানত তার নির্দেশেই ফৌজের সেনারা ফুয়েরারের কথায় সোভিয়েতের বিরুদ্ধে যুদ্ধে অংশগ্রহণে অসম্মত হয়। পরিনামে কয়েকজন সেনাকে মৃত্যুদণ্ডে দণ্ডিত করা হয়। ডুবোজাহাজে চড়ে অকুতোভয় সফরের মাধ্যমে জাপান পৌঁছান সুভাষ বসু। তার ছয় মাস আগেই সেখানে আজাদ হিন্দ বাহিনী গড়ে তুলেছিলেন মোহন সিং। এই বাহিনীর রাজনৈতিক নেতা ছিলেন রাসবিহারী বসু। মূলত তারা আহ্বানেই জাপান পৌঁছান নেতাজি। সেখানে আজাদ হিন্দ ফৌজের দায়িত্ব নিয়ে গড়ে তোলেন আজাদ হিন্দ সরকার। উদাত্ত কন্ঠে আওয়াজ তোলেন ‘দিল্লি চলো’। তবে বার্মায় আং সান জাপানের বিরুদ্ধে বিদ্রোহ করলে সেনাবাহিনীকে তার প্রতিরোধে অংশগ্রহণ করা থেকে বিরত রাখেন নেতাজি। এই আচরণ থেকে মনে করা যেতে পারে, প্রধানত ব্রিটিশ বিরোধীতা থেকেই জার্মানি ও জাপানকে কাজে লাগাতে চাইলেও তাদের বিপদ সম্পর্কে ওয়াকিবহাল ছিলেন তিনি। ১৯৯৭ সালে নেতাজি ও আমরা শীর্ষ প্রবন্ধে কিংবদন্তি কমিউনিস্ট নেতা জ্যোতি বসু লেখেন,’ বার্মায় অং সান যেমন জাপানিদের কাছ থেকে অস্ত্রশিক্ষা গ্রহণ করেন কিন্তু শেষ পর্যন্ত তাকে জাপানিদের বিরুদ্ধেই সেই প্রযুক্তি ব্যবহার করতে হয়। সুভাষও দরকার হলে বন্দুকের নল জাপানিদের বিরুদ্ধে ঘুরিয়ে দিতেন।’অনেক ঐতিহাসিক এর মতেই প্রথমে জার্মানি বা জাপানের শরণাপন্ন হওয়ার পরিবর্তে নেতাজি সোভিয়েতের কাছে সাহায্যের আহ্বান জানান। কিন্তু বিশ্বযুদ্ধের এক গুরুত্বপূর্ণ বাঁকে দাঁড়িয়ে সোভিয়েত সেই প্রস্তাবের সম্মত হয়নি। কিন্তু তার বাহিনীকে সোভিয়েতের বিরুদ্ধে কোন ভাবে ব্যবহার করতে দেননি। আজাদ হিন্দ বাহিনীর অভ্যুত্থান ব্যর্থ হলে সেনাদের কারারুদ্ধ করা হয়। লালকেল্লায় সেই বীর সেনানিদের কোর্ট মার্শাল শুরু হলে গোটা দেশজুড়ে প্রতিবাদের ঝড় উঠে। এই লড়াই সংগ্রামে সম্মুখ সারিতে নেতৃত্ব দেন কমিউনিস্টরা। ১৯৪৫ সালে কলকাতা শহরে আজাদ হিন্দ বাহিনীর সৈনিকদের মুক্তির দাবিতে মানুষের মহা মিছিলে পুলিশের গুলিতে শহীদ হন ছাত্র রামেশ্বর ব্যানার্জি ও বলাই মিত্র। ছেচল্লিশে জানুয়ারিতে আজাদী সেনা বরহানউদ্দিন ও রশিদ আলী দোষী সাব্যস্ত হলে দেশজুড়ে যে বিক্ষোভের আগুন দাবানলের মতো ছড়িয়ে পড়ে তারপর কেন্দ্রে ছিলেন কমিউনিস্টরা। দেশজোড়া সেই দ্রোহের মশালে ছাড়খার হয়েছিল ব্রিটিশরাজ। অদৃশ্য থেকেও কলকাতার রাজপথে, বোম্বাইয়ের কলকারখানায়, মাদ্রাজের সুতাকলে সেই অকুতোভয় বিদ্রোহের মুখ হয়ে উঠেছিলেন নেতাজি।
পরাধীনতার অভিশাপে বিদ্ধ জাতির মুক্তি সংগ্রামে জীবনপণ সংগ্রাম করেছিলেন কমিউনিস্টরা। ঠিক তেমনি দেশপ্রেমের চেতনায় প্রগাঢ় রোমান্টিকতায় বিদ্রোহের বার্তা বাহক হয়ে উঠেছিলেন সুভাষ বসু। জাপানের স্বৈরাচারী শাসক তোজোর সাথে তার সাক্ষাতের ঘটনা কেউ কেউ ভুল ভাবে বিশ্লেষণ করলেও কমিউনিস্টদের চোখে তিনি ছিলেন অত্যন্ত দেশপ্রেমিক। বিভিন্ন সময় স্বাধীনতার ইতিহাসে কমিউনিস্টদের ভূমিকা খাটো করে দেখানোর জন্য কেউ কেউ নেতাজি সম্পর্কে কমিউনিস্টদের ধারণা বিকৃত করেন। বারংবার বহু লোকমুখে শ্রুত হয় ‘তোজোর কুকুর’ কথাটি। তবে আজ অবধি কোন কমিউনিস্ট দলিলে ,ইশতেহারে, রিপোর্টে কোথাও নেতাজি সম্পর্কে এমন মূল্যায়ন হয়েছে তার প্রমাণ দেখানোর হিম্মত কারও নেই। ১৯৪৬ সালে ‘ জনযুদ্ধ ‘ পত্রিকায় একটি কার্টুন প্রকাশিত হয় সেখানে দেখা যায় একজন মানুষ একটি গাধার পিঠে সওয়ার হয়েছেন। গাধার মুখের জায়গায় নেতাজির মুখ ও মানুষটির মুখের জায়গায় তোজোর মুখ বসানো ছিল। এই ছবি প্রকাশের পরই পার্টির তরফ থেকে তীব্র ধিক্কার জানানো হয় এবং পরবর্তী সংখ্যায় এই ছবি তুলে নেওয়া হয়। পরবর্তী সময়েও বহু কমিউনিস্ট নেতা তাদের আলোচনায় ভারতবর্ষের স্বাধীনতা সংগ্রামে সুভাষ বোসের অভাবনীয় আত্মত্যাগ ও তার দেশপ্রেমের চেতনার ভূয়সী প্রশংসা করেছেন। পাশাপাশি সেই কার্টুন সম্পর্কে তীব্র ধিক্কারও জানিয়েছেন। প্রযুক্তির যুগে এহেন ভ্রান্ত সংবাদ যেন ইতিহাসকেই বিকৃত করা। রাজনৈতিক জীবনে বারংবার নেতাজি ও বামপন্থীরা এক সূত্রে এসেছেন। পথের কিছু ভিন্নতা থাকলেও লক্ষ্য এবং আদর্শ সম্পর্কে তাদের পার্থক্য ছিল না বিন্দুমাত্র। কমিউনিস্টদের আনা পূর্ণ স্বরাজের প্রস্তাবের পক্ষে ব্যাটন ধরেন সুভাষচন্দ্র বসু। আবার কংগ্রেসের সভাপতি পদে সুভাষচন্দ্র বসুর নাম প্রস্তাব করেন কমিউনিস্টরা। পরস্পরের প্রতি শ্রদ্ধা ভালোবাসা ও দেশপ্রেমের জন্য ভেদাভেদ ভুলে সার্বিক ঐক্য গড়ে তোলার পথে নেতাজি ও কমিউনিস্টরা হয়েছিলেন সম্পৃক্ত।
বর্তমান সময়ে প্রতিনিয়ত ধর্ম,বর্ণ ,জাতের নামে ভাঙছে আমাদের দেশ। প্রতিবাদে আবার গড়ে উঠছে সম্প্রীতির ব্যারিকেড। যে ব্যারিকেডে আজও উজ্জ্বল হয়ে ওঠেন সুভাষচন্দ্র বসুরা। স্বাধীনতা সংগ্রাম সঞ্জাত ধারায় অবিরত বহমান থাকাই এদেশের গন্তব্য। আর সেই পথে এক উজ্জ্বল আলোকবর্তিকা হিসেবে পথ দেখান নেতাজিরা। এদেশের লড়াই সংগ্রামের ইতিহাসে আত্মত্যাগে বামপন্থীদের কোন বিকল্প নেই। স্বদেশ স্বরাজের আবেগে উদ্বুদ্ধ সুভাষচন্দ্র বামপন্থীদের কাছে বিপন্ন জাহাজের বিশ্বস্ত নাবিক। ইতিহাসের পর্যালোচনায় বামপন্থীদের সাথে সুভাষ বসুর নৈকট্য প্রশ্নাতীত। ছদ্ম জাতীয়তাবাদের কলুষিত দেশে সুভাষিত ইতিহাসের প্রচার তাই সময়ের কর্তব্য।