বিশিষ্ট চিন্তাবিদ ডি.ডি. কোসাম্বি ভারতীয় সামন্ততন্ত্রের সঙ্কট চিত্রিত করতে একটি উদাহরণ ব্যবহার করেন: ১৭৬১ সালে পানিপথের তৃতীয় যুদ্ধে, একপক্ষের সেনাদের যথেষ্ট খাবার ছিল না, অন্য পক্ষের সেনারা গ্রামে গ্রামে লুটপাট করে খিদে মেটাতে পেরেছিল, সংক্ষেপে, উভয় পক্ষই তার সেনাবাহিনীর জন্য থাবারের ব্যবস্থা রাখেনি।
একইভাবে, ভারতীয় পুঁজিবাদের সঙ্কট স্পষ্টভাবে একটি ঘটনা দ্বারা চিত্রিত করা যায় : এই ভয়াবহ মহামারির মধ্যেও, দেশের রাজধানীর বেশ কয়েকটি হাসপাতালের চিকিৎসা কর্মীদের কিছু সময়ের জন্য নিয়মিত বেতনও দেওয়া হয়নি।
তবে এই ঘটনাটি কেবল ভারতীয় পুঁজিবাদের সংকটই নয় তার সাধারণ চরিত্রটাও তুলে ধরেছে। এটি বুঝতে, আসুন আমরা কিছুটা পিছনে ফিরে যাই।
এই মহামারিরও আগে এবং এমনকি অর্থনৈতিক সঙ্কটে ভারত আক্রান্ত হওয়ারও আগে, এই দেশে এমন একটি স্বাস্থ্যব্যবস্থা ছিল যা নিঃসন্দেহে বিশ্বের নিকৃষ্টতমগুলোর মধ্যে গণ্য হত; এবং এটি বিন্দুমাত্র ভারত একটি “উদীয়মান অর্থনৈতিক মহাশক্তি” এই লম্বাচওড়া দাবির সঙ্গে সামঞ্জস্যপূর্ণ নয়।
এর একটি সুস্পষ্ট সূচক হ’ল মোট অভ্যন্তরীণ উৎপাদনের বা জিডিপির কত শতাংশ স্বাস্থ্যখাতে বারদ্দ করা হয়।এবিষয়ে সুদঢ় এবং ধারাবাহিক দেশব্যাপী তথ্য নেই বললেই চলে ; তবে বিশ্বব্যাংকের কিছু পরিসংখ্যান রয়েছে।সেই তথ্য অনুসারে ভারতের মোট স্বাস্থ্য ব্যয় অর্থাৎ সরকার কী ব্যয় করে এবং মানুষ তাদের পকেট থেকে কী ব্যয় করে, জিডিপির শতাংশ হিসাবে, ২০১৭ সালে এটি ছিল মাত্র ৩.৫৩%।
সাব সাহারান আফ্রিকা
এই ব্যয় একই বছরের সাব-সাহারান আফ্রিকার তুলনায় কম ছিল (৫.১৮%)। সাব-সাহারান আফ্রিকায় দক্ষিণ আফ্রিকার মতো একটি “সমৃদ্ধ” দেশ অন্তর্ভুক্ত; তবে ভারতের ব্যয়ের শতাংশ দক্ষিণ আফ্রিকা বাদ দিয়ে সাব-সাহারান আফ্রিকার চেয়েও কম ছিল।
বিশ্বব্যাংক দেশগুলিকে বিভিন্ন আয়ের নিরিখে বিভিন্ন গোষ্ঠীতে বিভক্ত করে যেমন উচ্চ আয়, মধ্যম আয় এবং নিম্ন আয় এবং গোষ্ঠীগুলোকে বিভিন্ন উপ-গোষ্ঠী যেমন নিম্ন মধ্যম আয়, উচ্চ মধ্যম আয় ইত্যাদিতে।
জিডিপির শতাংশ হিসাবে ভারতের মোট স্বাস্থ্য ব্যয় এই জাতীয় প্রতিটি গোষ্ঠী বা উপ-গোষ্ঠীর তুলনায় কম ছিল। ভারতের এই ব্যয় উচ্চ আয়ের দেশগুলির (১২.৫৩%), নিম্ন ও মধ্য আয়ের দেশগুলির (৫.৩৯%), নিম্ন আয়ের দেশগুলির (৫.২৪%), মধ্য আয়ের দেশগুলির (৫.৩৯%), নিম্ন মধ্য আয়ের দেশগুলির (৩.৮৬%) এবং উচ্চ মধ্য আয়ের দেশগুলি (৫.৮৪%) এর চেয়ে কম ছিল।
এটা বাস্তব যে, ভিন্ন ভিন্ন মানের জাতীয় তথ্য থেকে সংগৃহীত আন্তর্জাতিক পরিসংখ্যানগুলো অনেকটাই ত্রুটিপূর্ণ; তবে এই সিদ্ধান্তের সত্যতা সম্পর্কে খুব কম সন্দেহ থাকতে পারে যে ভারতে জিডিপির শতাংশ হিসাবে মোট স্বাস্থ্য ব্যয় বিশ্বের সমস্ত দেশের তুলনায় সবচেয়ে কমের দিকে।এটা পুরো দক্ষিণ এশিয়ার মতোই (৩.৪৬%); তবে এর কারণ এটাই যে বাংলাদেশ এবং পাকিস্তান উভয়ের ব্যয়ই এর থেকে কম এবং ভারত দক্ষিণ এশিয়ার ভরকেন্দ্র।
তবে বাংলাদেশের ক্ষেত্রে আমাদের অবশ্যই মনে রাখতে হবে যে ওষুধের দামগুলো সরকারি নীতি অনুসারে কম রাখা হয়, স্বাভাবিকভাবেই জিডিপির তুলনায় স্বাস্থ্য ব্যয়ের পরিমান ভারতের তুলনায় কম হলেও তা খারাপ স্বাস্থ্যব্যবস্থার নির্দেশক নয়।
মার্কিন স্বাস্থ্যব্যবস্থার ক্ষেত্রে যে দুর্বলতা দেখা যায় তার কারণ এটাই যে আমেরিকায় এই পরিসেবা স্বাস্থ্য বীমার উপর নির্ভর করে যেখানে বেসরকারি হাসপাতাল এবং বীমা সংস্থাগুলি উভয়েই মুনাফার লক্ষ্যে কাজ করে।
তাৎপর্যপূর্ণভাবে , কিউবার (১১.৭৪%) জিডিপির শতাংশ হিসাবে মোট স্বাস্থ্য ব্যয়ের অঙ্কটি বিশ্বে সর্বাধিক এমনকি এবং ইংল্যান্ড (৯.৬৩%), জার্মানি (১১.২৫%) এবং ফ্রান্সের (১১.৩১%)থেকেও বেশি।
উন্নত পুঁজিবাদী দেশগুলির মধ্যে কেবল মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের স্বাস্থ্য খাতে ব্যয়(১৭.০৬%) কিউবার থেকে বেশি। তবে মার্কিন স্বাস্থ্যব্যবস্থার ক্ষেত্রে এটা সুবিদিত যে উচ্চ স্বাস্থ্য ব্যয় সত্ত্বেও আমেরিকার স্বাস্থ্য পরিসেবার অবস্থা দুর্ভাগ্যজনক, কারণ এটি স্বাস্থ্য বীমার উপর নির্ভর করে যেখানে হাসপাতাল এবং বীমা সংস্থাগুলি উভয়েই মুনাফার লক্ষ্যে পরিসেবা দেয়।মার্কিন ব্যবস্থার বিপরীতে ইউরোপ বা কিউবার ক্ষেত্রে স্বাস্থ্য ব্যবস্থার মূল দায়িত্ব সরকারের।
যদিও আমরা মোট স্বাস্থ্য ব্যয়কে স্বাস্থ্য পরিসেবার অবস্থার ইঙ্গিত হিসাবে ব্যবহার করেছি, বাস্তবে এটা কিছুটা বিভ্রান্তিকর সূচক। এর একটা কারণ আমরা সবেমাত্র উল্লেখ করেছি – মোট স্বাস্থ্য ব্যয়, যার মধ্যে বেসরকারি চিকিৎসার ব্যয়ও অন্তর্ভুক্ত রয়েছে যা মুখ্যত মুনাফা কেন্দ্রিক।এর ফলে স্বাস্থ্যখাতে ব্যয়ের এই সার্বিক হিসাব বহুক্ষেত্রেই উচ্চ হারে মুনাফার দ্বারা বর্ধিত হয়ে থাকে।
বেসরকারিকরণ
উচ্চ হারে মোট স্বাস্থ্য ব্যয়ের দ্বিতীয় কারণ হল একটা বড় অংশের মানুষ তাদের সম্পদ বিক্রি করতে বাধ্য হয় চিকিৎসার খরচ মেটাতে আর এর ফলে অনেক সময় তারা দারিদ্র্যের গভীরে ডুবে যায়।
মোট স্বাস্থ্য ব্যয়ের একটা উচ্চ হার তাই সর্বদা ভাল লক্ষণ নয়। বহুক্ষেত্রে মানুষের দুর্দশার বিনিময়ে এই হার অর্জিত হতে পারে।
ভারতে আসলে এটাই ঘটে চলেছে।কৃষকদের ঋণ বৃদ্ধি ও তার ফলে কৃষকদের মধ্যে আত্মহত্যা বেড়ে যাওয়ার পেছনে এখটা প্রধান কারণ হল চিকিৎসাজনিত খরচের চড়া হার। নয়া-উদারবাদী শাসনে স্বাস্থ্য পরিসেবার ব্যাপক বেসরকারিকরণের ফলে এটি ঘটেছে।
এই সমস্ত কারণে, জিডিপির শতকরা হিসাবে স্বাস্থ্যখাতে সরকারের ব্যয় , জিডিপির শতাংশ হিসাবে মোট স্বাস্থ্য ব্যয়ের চেয়ে মানুষের স্বাস্থ্য পরিস্থিতির একটা উন্নততর সূচক এবং এই মানদণ্ডে ভারতের ভূমিকা আরও বেশি বেহাল।
ভারতে জিডিপির শতাংশ হিসাবে জনস্বাস্থ্যে ব্যয় করা হয় মাত্র ১% এর একটু বেশি, যা বিশ্বের সবথেকে খারাপ অবস্থায় থাকা দেশগুলোর সাথে তুলনীয়।উদাহরণস্বরূপ, ২০১৭-১৮ সালে ভারতের ক্ষেত্রে এটি ছিল ১.১৭%, যা এমনকি “নিম্ন আয়ের দেশগুলি” (যাদের ক্ষেত্রে ছিল ১.৫৭%) এর চেয়েও অনেক কম। সামগ্রিকভাবে ইউরোপীয় ইউনিয়নের জন্য এই ব্যয় ছিল প্রায় ৭%: উপরে উল্লিখিত হিসাবে ইতিমধ্যেই লক্ষ্যনীয় যে ইউরোপীয় দেশগুলিতে জনসাধারণের জন্য স্বাস্থ্যখাতে মুখ্যত সরকার অর্থ ব্যয় করে থাকে যা কীনা কল্যানকর রাষ্ট্রের একটা গুরুত্বপূর্ণ ভিত্তি।
জিডিপির শতকরা হিসাবে ভারতের জনস্বাস্থ্য ব্যয় আমাদের প্রতিবেশী দেশসমূহ, যেমন শ্রীলঙ্কা, ভুটান এবং নেপালের তুলনাতেও কম, যাদের মধ্যে কিছু দেশ মাথাপিছু আয়ের ক্ষেত্রে ভারতের চেয়ে দরিদ্র ।
সবথেকে আশ্চর্যের বিষয় হল জিডিপির শতাংশ হিসাবে জনস্বাস্থ্য ব্যয় এক দশক ধরে শতকরা ১% আশেপাশেই আটকে রয়েছে। ২০০৪-০৫ সালে ছিল ০.৯%; ২০১০-১১-এ ১.১% এবং ২০১৭-১৮-এ ১.১৭% এবং ২০১৮-১৯-এ ১.২৮%। জিডিপির অনুপাতের এই স্থবিরতা নিম্নলিখিত কারণে উল্লেখযোগ্য।
জিডিপি বাড়ার সাথে সাথে এমনকি ট্যাক্স-জিডিপি অনুপাত অপরিবর্তিত রয়েছে বলে ধরে নিয়েও সরকারের কর বাবদ আয় একই হারে বৃদ্ধি হওয়া উচিত। কিন্তু প্রশাসন বা প্রতিরক্ষা খাতে ব্যয় সরকারী আয়ের হিসাবে একই হারে বাড়ানো উচিত নয়, বরং অন্যান্য ক্ষেত্রে জন্য আরও ব্যয় বরাদ্দের পরিমাণ বাড়ানো উচিত; এগুলির জন্য ব্যয়, তাই দ্রুততর হারে বাড়তে পারে, যাতে জিডিপিতে তাদের অংশ বৃদ্ধি পায়। স্বাস্থ্যখাতে ব্যয় এমনি একটি বিষয়।
জিডিপিতে স্বাস্থ্যখাতে ব্যয়ের ভাগ বৃদ্ধির প্রত্যাশা করার আরও একটা কারণ রয়েছে। যেহেতু নয়া-উদারনৈতিক সরকারের অধীনে কর্মসংস্থান বৃদ্ধির হার মোট মজুত শ্রমশক্তির আপেক্ষিক আয়তনের তুলনায় কম হয়, তাই ব্যবস্থার একটা স্বতঃস্ফূর্ত প্রবণতা হল নিযুক্ত শ্রমিকদের আসল মজুরি বৃদ্ধি না ঘটিয়ে খালি তাকে টিঁকিয়ে রাখার স্তরেই আবদ্ধ রাখা।
অবস্থার অবনতি
আপেক্ষিক মজুত শ্রমের বৃদ্ধির কারণে কর্মসংস্থানের তুলনায় বেকারত্বের অনুপাত যেহেতু বৃদ্ধি পেয়েছে, ও একইসাথে শ্রম উৎপাদনশীলতা বৃদ্ধির কারণে আয়ের বৈষম্য যথেষ্ট পরিমাণে বৃদ্ধি পাওয়ায় শ্রমজীবী মানুষের গড় অবস্থার অবনতি ঘটেছে।
বৈষম্য এবং ভয়াবহ দারিদ্র্যের এই বৃদ্ধির সময়ে , জিডিপিতে জনস্বাস্থ্যে ব্যয়ের অংশকে বাড়িয়ে রাষ্ট্র প্রশমকের ভূমিকা নেবে বলে আশা করতে যেতে পারে।এমনকি অনেকে এই প্রত্যাশাও করতে পারে যে নয়া উদারবাদী এই ব্যবস্থায় স্বতঃস্ফূর্ততার ফলে যখন শ্রমজীবিদের অবস্থা আরো দুর্বিষহ হয়ে উঠছে তখন রাষ্ট্র উপশমের ব্যবস্থা করবে।কিন্তু, বাস্তবে আমরা এর ঠিক বিপরীত চিত্র দেখতে পাই: জনস্বাস্থ্য কে রুদ্ব করে স্বাস্থ্য পরিসেবা আরও ব্যয়বহুল করে রাষ্ট্রের পদক্ষেপগুলো এই ক্রমবর্ধমান দুরবস্থাকে আরো জটিল করে তোলে।
এতে ভারতীয় পুঁজিবাদের অদ্ভুত প্রকৃতির চরিত্রটা আরো স্পষ্ট হয় যেখানে ব্যবস্থা দ্বারা স্বতঃস্ফূর্তভাবে চাপিয়ে দেওয়া নিপীড়ন প্রশমিত করার চেয়ে রাষ্ট্রীয় পদক্ষেপ ইচ্ছাকৃতভাবে নিপীড়নকে আরা ত্বরান্বিত করে।
কৃতজ্ঞতা স্বীকার : https://www.newsclick.in/