Who’s The Boss?

আদি বনাম নব বিজেপির সংঘাত দেশজুড়ে

Gautam-Roy

গৌতম রায়

পশ্চিমবঙ্গের চলতি বিধানসভার ভোটে বিজেপি কে নিয়ে গোটা দেশেই একটা চাঞ্চল্য তৈরি হয়েছে।দেশের একটি অঙ্গরাজ্যের ভোটে প্রধানমন্ত্রী মোদি , স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী অমিত শাহ , বিজেপি সভাপতি নাড্ডা যেভাবে ডেইলি প্যাসেনজারি করছেন, তাতে বিজেপির জেতা নিয়ে নিঃসংশয় হওয়ার পরিবর্তে , ওই দলটির উঁচু তলার নেতা থেকে একদম ভূমিস্তরের কর্মীদের আত্মবিশ্বাস ঘিরেই কেবল পশ্চিমবঙ্গবাসীর ভিতরেই নয়, গোটা দেশবাসীর মধ্যেই প্রশ্ন উঠতে শুরু করেছে।

পশ্চিমবঙ্গের ভোট ঘিরে কি আর এস এস এবং বিজেপির ভিতরে একটা ঠান্ডা লড়াই চলছে? আর এস এস পরিমন্ডলের লোকেরা এখন বিজেপিতে খুব একটা পাত্তা পাচ্ছে না, এমন চাপা ক্ষোভ কেবল রাজ্যগত ভাবেই নয়, নাগপুরের রেশমবাগের ‘ কেশবভবন ‘ থেকে উঠে আসছে। অপর দল থেকে যেসব লোকেরা সদ্য বিজেপিতে যোগ দিয়েছেন, সেইসব লোকেদের ই বেশি করে বিধানসভার ভোটে টিকিট দিয়েছে বিজেপি- এই অভিযোগ কনভেনশনাল হিন্দুত্ববাদীদের ভিতরে বেশ জোরদার ভাবে উঠতে শুরু করেছে।তার পাশাপাশি কোনো রকম রাজনৈতিক ব্যাক গ্রাউন্ড ছাড়া টি ভি সিরিয়াল অভিনেতা , অভিনেত্রীদের একটা অংশ কে এবারের ভোটে বিজেপি টিকিট দিয়েছে।

এই বিষয়টিকেও কিন্তু আর এস এস খুব ভালো চোখে দেখে নি। বস্তুত আর এস এস নিয়ন্ত্রণাধীন বিজেপি র সঙ্গে কেবল পশ্চিমবঙ্গেই নয় , গোটা দেশেই এখন মোদির নিয়ন্ত্রণাধীন বিজেপির একটা ঠান্ডা লড়াই শুরু হয়েছে। মোদি সেভাবে সঙ্গের ছত্রছায়ায় থেকে কাজ করছেন না, যেমনটা করতেন বাজপেয়ী, আডবাণি, যোশীরা– এই অভিযোগ এবং ক্ষোভ ক্রমশঃ দানা বাঁধছে আর এস এসের সব স্তরের নেতা , কর্মীদের ই ভিতরে।ফলে আর এস এসের রাজনৈতিক সংগঠন বিজেপির ভিতরেও এখন আদি বিজেপি বনাম নব বিজেপির দ্বন্দ্বটা খুব প্রকট হতে শুরু করেছে।সেই দ্বন্দ্বের ছায়া ইতিমধ্যেই পশ্চিমবঙ্গ বিধানসভার ভোটেও পড়তে শুরু করেছে।

এই দ্বন্দ্বটা হিন্দু সাম্প্রদায়িক শিবিরে গত লোকসভা ভোটের সময়কাল থেকে শুরু হয়েছে।দীর্ঘদিন ধরে আর এস এস পরিমন্ডলে যারা আছেন, তাদের বেশি গুরুত্ব না দিয়ে তৃণমূল থেকে আসা লোকেদের গত লোকসভা ভোটে বেশি গুরুত্ব দেওয়া হয়েছে- এমন একটা চাপা ক্ষোভ সঙ্ঘ শিবিরে আছে।তবে মোটের উপর তৃণমূল থেকে এসে যারা বিজেপির টিকিটে লোকসভায় লড়েছিলেন, তাদের একটা অংশ জিতে যাওয়ার  ফলে, সঙ্ঘের ভিতরে যারা এই ক্ষোভের নেতৃত্ব দিচ্ছিলেন, তারা আর তখন বিষয়টা নিয়ে তেমন একটা এগোন নি। কিন্তু গত লোকসভা ভোটের পর থেকে ই বিজেপি যেভাবে প্রাক্তন তৃণমূল দিয়ে ভরে যাচ্ছে, এই বিষয়টি কে আর এস এসের কোনো মহল ই ঠিক ভাবে মেনে নিতে পারছে না।

বিশ্বভারতীর উপাচার্য বিদ্যুৎ চক্রবর্তীর কর্মকান্ড ঘিরে এই আর এস এস ঘরানার বিজেপি আর মোদি ঘরানার বিজেপির ভিতর দ্বন্দ্বটা এখন একদম প্রকাশ্যে চলে এসেছে। মোদির নিয়ন্ত্রণাধীন বিজেপি এখন ক্ষমতার স্বাদ দিলেও সঙ্গের মূল্যবোধ ভেঙে দিচ্ছে- এই বিতর্ক আর এস এসের একটা স্তরে ক্রমশঃ তীব্র হয়ে উঠছে। বিদ্যুৎ চক্রবর্তীর বিরুদ্ধে জাপনচিত্র জনিত মারাত্মক কিছু অভিযোগ থাকা স্বত্ত্বে ও সেই ব্যক্তিকে বিশ্বভারতীর উপাচার্য করবার বিষয়টি সঙ্ঘের একটা অংশ আদৌ মেনে নিতে পারে নি।

বিদ্যুৎ চক্রবর্তী উপাচার্য হয়েই আদি বিজেপির লোক যারা বিভিন্ন পদে বিশ্বভারতীতে কর্মরত আছেন, তাদের নানা ভাবে হেনস্থা করছেন- এই অভিযোগ খোদ আর এস এসের সদর দপ্তরে পর্যন্ত পৌঁছেছে বলে খবর।ষাটোর্ধ চক্রধর ত্রিপাঠী বিশ্বভারতীর হিন্দি বিভাগের অধ্যাপক। দীর্ঘদিন তিনি আর এস এসের সঙ্গে যুক্ত। এই চক্রধর বাবুকে উপাচার্য বিদ্যুৎবাবু নানা ভাবে হেনস্থা করছেন বলে অভিযোগ। বিশ্বভারতীর সোশাল ওয়ার্ক বিভাগের অধ্যাপক রামপ্রসাদ দাস।পঞ্চাষোর্ধ এই অধ্যাপকের বিরুদ্ধে এমন কিছু ব্যক্তিগত অভিযোগ উপাচার্য এনেছেন , যার জের নাগপুর পর্যন্ত পৌঁছেছে বলে খবর। বিনয় ভবনে শিক্ষা বিষয়ক অধ্যাপক রাজর্ষি রায়, যিনি ব্যক্তি সম্পর্কে রাজ্য বিজেপির শীর্ষ নেতা দিলীপ ঘোষের ভাগ্নে জামাই , তিনি পর্যন্ত বিশ্বভারতীর উপাচার্য বিদ্যুৎ চক্রবর্তীর রোষের হাত থেকে বাঁচেন নি।এই সমস্ত বিষয়গুলি ঘিরে রাজ্য আর এস এস  এবং নাগপুর উভয়েই ভয়ঙ্কর ক্ষুব্ধ।

এই ক্ষোভের জেরেই কি আর এস এসে র বিভিন্ন শাখা সংগঠন , যেমন হিন্দু জাগরণ মঞ্চ, হিন্দু মহাসভা, জনসঙ্ঘ ইত্যাদির ব্যানারে সঙ্ঘ ই প্রার্থী দিয়েছে?  টালিগঞ্জে জনসঙ্ঘের পক্ষ থেকে প্রার্থী হয়েছেন সুদীপ সোম। জয়নগর, কুলতলিতেও আদি বিজেপি বনাম নব বিজেপির সংঘাতের জেরে আর এস এসের ছত্রছায়ায় সেখানে আলাদা প্রার্থী দেওয়া হয়েছে। মোদির বিজেপির প্রার্থী নির্বাচনকে ঘিরে আর এস এসের ভিতরে ক্ষোভ এতোটাই তীব্র যে মধ্যপ্রদেশের মন্ত্রী বিশ্বাস সারাং কে পর্যন্ত এখানে প্রচারে এসে প্রচন্ড সমস্যার ভিতরে পড়তে হয়েছিল। সদ্য তৃণমূল ত্যাগীদের  যেমন, রাজীব বন্দ্যোপাধ্যায়, রবীন্দ্রনাথ ভট্টাচার্য, এমন কি শুভেন্দু অধিকারী কে ঘিরে এই মর্মে আদি বিজেপির ভিতরে ক্ষোভ যে, এরা মমতার এজেন্ট হিশেবে বিজেপি তে এসেছেন।বিজেপির একাংশের নেতা , কর্মী এই কথাটা প্রকাশ্যে সংবাদ মাধ্যমকে পর্যন্ত বলছেন( বর্তমান, ৮ ই এপ্রিল, ২০২১) ।

এই দ্বন্দ্ব টিকে কেবল পশ্চিমবঙ্গের প্রেক্ষিতেই ভাবলে চলবে না।১৯৭৯ সালে দ্বৈত সদস্যপদ ইস্যুটি যে ধরণের সঙ্কটের আবর্তে আর এস এস কে ফেলেছিল,যার জেরে সঙ্ঘ শেষ পর্যন্ত মোরারজি দেশাই মন্ত্রীসভা ভেঙে দেয়, এবার এই আদি হিন্দুত্ববাদী বনাম মোদির বিজেপি ঘিরে যে সঙ্কট তৈরি হয়েছে, তার পরিণাম এবং ভয়াবহকতা ঘিরে যথেষ্ট চাপান উতোর চলছে আর এস এস এবং বিজেপি মহলে। অটলবিহারী বাজপেয়ী র উপর যে ভাবে আর এস এসের নিয়ন্ত্রণ ছিল এবং বাজপেয়ী যতোটা আর এস এসের প্রতি দায়বদ্ধ ছিলেন, প্রধানমন্ত্রী হওয়ার পর থেকে মোদির ভিতরে তেমন দায়বদ্ধতা সঙ্গের প্রতি পাওয়া যাচ্ছে কি না, এটা ঘিরে সঙ্ঘের সর্বস্তরে বিতর্ক ক্রমেই জোরদার হচ্ছে।বিজেপির উপর সঙ্ঘের নিয়ন্ত্রণ আলগা হয়ে মোদি- শাহের নিয়ন্ত্রণ কায়েম হোক জোরদার ভাবে, এটা সঙ্ঘ কোনো অবস্থাতেই অনুমোদন করতে পারছে না। 

বাজপেয়ীর আমলেও দল ক্ষমতায় থাকার ফলে যারা সেখানে শামিল হয়েছিল, যাদের সেভাবে সঙ্ঘ ব্যাকগ্রাউন্ড নেই, পরবর্তী সময়ে আর এস এস কিন্তু সেইসব লোকেদের অনেকখানিই কোনঠাসা করে ফেলেছিল।তাই পশ্চিমবঙ্গ বিধানসভার ভোটে মোদির বিজেপি বনাম আর এস এস ঘরানার বিজেপির ভিতরে যে সংঘাত ক্রমেই তীব্র হচ্ছে তা হিন্দু সাম্প্রদায়িক রাজনীতির আর একটা দিককে ফুটিয়ে তুলছে। দখল করা রাষ্ট্র ক্ষমতায় তাই এখন নিজেদের নিয়ন্ত্রণ বজায় রাখার বিষয়টিই এখন আর এস এসের কাছে অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ বিষয় হয়ে উঠেছে।

Spread the word

Leave a Reply