kakababu 2

কোন পথে?

kakababu
মুজফফর আহমদ

1926 সালের 23 শে সেপ্টেম্বর

‘গণবাণী’ তে প্রকাশিত প্রবন্ধ

গন্তব্য স্থানে পৌছানোর জন্য পথচলার শুরু করার আগেই সকলের স্থির করে নিয়ে থাকেন কোন পথে তাদের যেতে হবে। ভারতের স্বাধীনতা যদি আমরা চাই তাহলে তালাবের একটা পথ খুঁজে বের করা আমাদেরও একান্ত প্রয়োজন। কি সে পথ? আজ পর্যন্ত কত আন্দোলন বিপ্লবের কত প্রচেষ্টা হয়ে গেল কিন্তু আমরা গন্তব্য পথে এতোটুকু এগুতে পারিনি। সত্য কারের স্বাধীনতা লাভের জন্য একটা বিপ্লবের একটা আমূল পরিবর্তনের অবশ্য প্রয়োজন হবে তা অস্বীকার করার উপায় নেই। কিন্তু এ পরিবর্তনের পথ তো আমাদের আজও স্থির হয়নি।

রাষ্ট্রীয় মুক্তির যত প্রচেষ্টা এ পর্যন্ত করা হয়েছে সমস্ত তেই দেশ বলতে দেশের মাটি কি আমরা ধারণা করেছি দেশের সর্বসাধারণের শহীদ আমাদের কোন যোগই স্থাপন হয়নি। কংগ্রেসের আন্দোলন যেমন বরাবর একটা অভিজাত শ্রেণীকে ঘিরে নিয়ে চলেছিল ঠিক তেমনি চলেছিল ত্রাস নীতি যারা অবলম্বন করেছিলেন তাদেরও কর্ম। শুধু যে এ শ্রেণি গত গণ্ডির ভেতর থেকে তাঁরা কাজ করেছিলেন তা নয় তার উপরে একটা ধর্মগত গণ্ডিও আছে। শ্রীযুক্ত বারীন্দ্রকুমার ঘোষ লিখেছেন যে তারা হিন্দু রাজত্ব প্রতিষ্ঠা করার জন্যই দেশে বিপ্লব আনতে চেষ্টা করেছিলেন। শুনেছি শ্রীযুক্ত পুলিনবিহারী দাস ও সে ধারণা পোষণ করতেন। লালা হরদয়াল ও মিস্টার সাভারকার প্রভৃতি লন্ডনে যে বিপ্লববাদী দল গঠন করেছিলেন তাদের উদ্দেশ্য ভারতে হিন্দু রাজত্ব প্রতিষ্ঠা করা ব্যতীত আর কিছুই ছিল না। পক্ষান্তরে অনেক মুসলমান বিপ্লববাদী উদ্দেশ্য ছিল ভারতবর্ষে মুসলিম রাজত্ব প্রতিষ্ঠা করা। আজকাল অবশ্য এ উভয়পক্ষের অনেকেরই মতের পরিবর্তন হয়েছে। রাষ্ট্রীয় আন্দোলনের জন্য একসময় যারা রাশি রাশি টাকা ব্যয় করেছেন তারা আজকাল আর তা করেন না। কারণ তখন তারা মনে করেছিলেন যে দেশে শাসন এ পরিবর্তন ঘটলে সমস্ত ক্ষমতা তাদেরই হাতে আসবে সময়ের পরিবর্তনে সে বিশ্বাস এখন আর তাদের নেই।

অসহযোগ আন্দোলন দেশের জনসাধারণের মধ্যে একটা চাঞ্চল্যের সৃষ্টি করেছিল। দেশের সর্বসাধারণের জীবনের শহীদ রাষ্ট্রীয় আন্দোলনের একটা যোগ সাধিত হয়ে যাওয়ার লক্ষণ এ আন্দোলনের সময় স্পষ্টই দেখা গিয়েছিল। চাঞ্চল্য সৃষ্টি হওয়ার একমাত্র কারণ হচ্ছে যে অসহযোগের একটা উদ্দেশ্য ছিল ট্যাক্স বন্ধ করে দেওয়া। এরই জন্য সাধারণ লোকজন অতিশয় উৎফুল্ল হয়ে উঠেছিল। তারা আপনা হতে সংঘবদ্ধ হয়ে যখনই স্থানে স্থানে টেক্স বন্ধ করে দিতে লাগলো তখনই মহাত্মা গান্ধীর কাছ থেকে উপদেশ পাওয়া গেল জমিদারের খাজনা আদায় করে দিতে। টেক্স বন্ধ করে দেওয়ার যে ব্যাখ্যা তিনি করলেন তাতে বোঝা গেল যে কেবলমাত্র গভর্মেন্টের ট্যাক্সি বন্ধ করতে হবে জমিদার প্রভৃতির নয়। সর্বসাধারণের শহীদ আন্দোলনের যে ঝগড়া স্থাপিত হতে চলেছিল এখানেই তা কেটে গেল। অর্থাৎ অসহযোগ আন্দোলনের আন্দোলন না হয় শ্রেণি আন্দোলনে পর্যবসিত হলো। দেশের সর্ব সাধারণের গভর্মেন্টের সহিত সাক্ষাৎ ভাবে কোন লেনদেন নেই। তাদের সব কাজই হয় অপরের মধ্যবর্তীতায়। এ মধ্যবর্তী গান যতই অলস পরাশ্রিত ও পরান্নভোজী হোক না কেন মহাত্মা তাদেরকে কোন প্রকারে উত্তপ্ত করতে রাজি হলেন না। সুতরাং non-cooperation এর কর্ম তালিকায় যে ট্যাক্স বন্ধ করে দেওয়ার কথা স্থান পেয়েছিল তার কোন মূল্য রইলো না – সে ছিল একটা ভুয়া কথা।

এমনও অনেক লোক দেশে আছেন যারা মনে করেন যে যোগসাধনার ভিতর দিয়ে স্বরাজ্য লাভ হবে। কোন একটা বড় কাজ করতে যে যারা অকৃতকার্য হয়েছেন তারাই যৌগিক সাধনার আশ্রয় গ্রহণ করেছেন। কিন্তু দেশের অনেক লোকই এসবের দ্বারা প্রভাবান্বিত হয়ে থাকেন। তারা মনে করেন হয়তো সত্যিই এটা একমাত্র স্বাধীনতা লাভের পথ। এতে দেশের বাস্তবিকই ক্ষতি হচ্ছে। আমরা ভেবে স্থির করতে পারছিনা কি করে এমন সব কথা ও লোকে বিশ্বাস করে থাকে। ভারত বর্ষ একদিন এসব সাধনার চরমে পৌঁছেছিল। তা সত্ত্বেও তার পরাধীন হওয়ার কারণ কি? যদি যৌগিক সাধনা তারা স্বরাজ লাভের এতটুকুও সম্ভাবনা থাকত তাহলে গোড়াতেই সে স্বরাজ নষ্ট হতে পারত না। চিন্তা কেউ করতে চায় না, গতানুগতিকতাতে গা ভাসিয়ে একটা কিছু কূলকিনারা করে নিতে চায়।

মোটের উপরে সব কাজই নিতান্ত এলোমেলোভাবে হচ্ছে। দেশের একটা ভৌগোলিক সীমা নির্দেশ করে সেই সীমা টুকু চোখ বুজে মা মা বলে ডাকার নামে দেশ প্রেম নয়। দেশের সর্বসাধারণকে বাদ দিয়ে দেশ প্রেম হয় না। অথচ আমাদের সবকিছু হতে সর্বসাধারণ বাদ পড়ে আছে। আমাদের স্বাধীনতা লাভ বিবর্তনের পথে হবে কি বিদ্রোহের পথে হবে তা আমরা জানি নে আমরা জানি যে পথেই হোক না কেন দেশের সর্বসাধারণ সচেতন না হলে স্বাধীনতা লাভ কিছুতেই হবে না। দেশের সকল কাজ যদি সর্বসাধারণের জন্য এবং সর্বসাধারণের দ্বারা পরিচালিত না হয় তাহলে দেশ যে স্বাধীন হয়েছে এ কথা কিছুতেই বলতে পারা যায় না। জনসাধারণের সাহায্য ও সমর্থন ব্যতিরেকে দেশ কখনো প্রশাসন মুক্ত হবে না হতে পারে না। কিন্তু এই যে জনসাধারণের কথা আমরা বলছি তারা কোথায়? তাদের কোন আশা নেই ভাষা নেই শোষিত অতিষ্ঠ হয়ে হয়ে তারা ভারবাহী পশুতে পরিণত হয়েছে। জীবনের সকল সন্ধান তারা ভুলে গেছে খাওয়া কাকে বলে তারা তা জানে না।

এই মূঢ়, মূর্খ জনসাধারণকে তাদের অবস্থা সম্বন্ধে সচেতন করে তুলতে হবে। খাওয়া পড়া সম্বন্ধে একটা তীব্র আকাঙ্ক্ষা তাদের প্রাণে জাগিয়ে দিতে হবে এই আকাঙ্ক্ষা যতক্ষণ না দেশের জনসাধারণের প্রাণে জাগছে যতক্ষণ পর্যন্ত তারা এই কথাটা বুঝতে না পারছে যে তারা প্রতিনিয়ত তাদের দ্বারা উৎপাদিত সম্পদে বঞ্চিত হচ্ছে অলস লোকের দ্বারা ততক্ষণ পর্যন্ত ভারতের ভাগ্যে কোনরূপ পরিবর্তনের আশা নেই। এই একটি কথা আমরা বারেবারে বলেছি এবং বারেবারেই আমাদিগকে বলতে হবে।

আমাদের দেশের যুবকগণ দেশের মুক্তির জন্য ফাসিঁকাঠে ঝুলছেন। তাদের স্মৃতি কে আমরা চিরকাল শ্রদ্ধা করব। স্বদেশের স্বাধীনতার জন্য আমাদের যে সকল বন্ধু নানারূপ নিগ্রহ ভোগ করেছেন তারা আমাদের শ্রদ্ধার পাত্র। কিন্তু তাদের অবলম্বিত পথ যে সত্য কারের স্বাধীনতার পথ ছিল এই কথাটি আমরা কিছুতেই মেনে নিতে পারবোনা। যে সংগ্রামে তারা প্রবৃত্ত হয়েছিলেন তার শহীদ দেশের জনসাধারণের কোন জোকস ছিল না এবং ছিল না বলেই বারেবারে তারা অকৃতকার্য হয়েছেন।

যারা মধ্যশ্রেণীর লোক তাদের মধ্যে একটা উৎকট অভিজাত্য জ্ঞান আছে। তারা বিষয়ে বৈভবের মালিক। কাজেই যাদেরকে বঞ্চিত করে তারা মালিক হয়েছেন তাদের শহীদ তাদের কোনরূপ সদ্ভাব স্থাপিত হতে পারেনা হওয়া অসম্ভব। সর্বসাধারণের শহীদ তাদের একটা পার্থক্য অবিরোধ আপনা থেকেই সৃষ্টি হয়ে আছে। কিন্তু যদিও সমাজের নিম্নতর মধ্যশ্রেণীর লোকদের অবস্থা কৃষক ও শ্রমিকদের অবস্থার চেয়ে এতটুকুও ভালো নয় তথাপি শিক্ষিত বলে একটা আভিজাত্য অভিমান তাদেরও মধ্যে রয়েছে। ত্রাস নীতির পথে যারা চলে ছিলেন তারা মধ্যশ্রেণী ও নিম্ন শ্রেণীর লোক। শরবত ত্যাগী হয়ে পথে দাঁড়িয়ে তারা জনসাধারণের শহীদ মিশতে পারেননি তাদের অন্তরে একটা লুকায়িত আভিজাত্যের ভাব রয়েছে তারই জন্য। দেশের উৎপাদক সম্প্রদায়ের শহীদ আমরা মিশবো আমাদের জীবনের স্থিতিকে নিম্নতর করার জন্য নয় পর্যন্ত তাদের জীবনের স্থিতিকে উচ্চতর করে তোলার জন্য।

সাত সমুদ্র তেরো নদী পার হয়ে ইংরেজ আমাদের দেশে কেবল শাসনের জন্য শাসন করতে আসেনি। তারা আমাদিগকে শোষণ করবার জন্যই শাসন করছে। কিন্তু একা যে ব্রিটিশরা সংবাদ আমাদের উৎপাদক সম্প্রদায় কে শোষণ করছে তা নয় আমাদের দেশীয় শোষক গণ তাদেরকে অনবরত লুটছে। এসব লুণ্ঠন ও শোষণের বিষয়ে উৎপাদকদিগকে সচেতন করতে হবে। ইউরোপের শ্রমিক বা কৃষক আমাদের দেশের  কৃষক ও শ্রমিকদের ন্যায় নিরক্ষর নয়। কাজেই সে দেশে কাজ করা এদিক দিয়ে তেমন কঠিন নয় যেমন কঠিন আমাদের এ দেশে।

দেশের প্রেমে যে সকল শিক্ষিত যুবক উদ্বুদ্ধ হয়েছেন তাদের এখন একমাত্র কাজ সর্বসাধারণকে তাদের অবস্থা সম্বন্ধে সচেতন করে তোলা। শোষিত বঞ্চিত যারা তাদের হয়ে কাজ করতে হলে শোষকদের সহিত একটা সংঘর্ষ বাধবেই বাধবে। এ সংঘর্ষের জন্য প্রস্তুত হয়েই আমাদের যুবকগণ কে দেশের কাজে গণ উদ্বোধনের কাজে লাগতে হবে। শ্রেণিসংগ্রাম দেশে আমরা সৃষ্টি করিনি। যেদিন জগতে সর্বপ্রথম ব্যক্তিগত সম্পত্তির সৃষ্টি হয়েছে শ্রেণীসংগ্রামের সৃষ্টি হয়েছে সেই দিন।

Spread the word

Leave a Reply