মার্কসও চালাতেন শ্রমজীবী ক্যান্টিন
দেবাশিস চক্রবর্তী
মার্কস যখন ১৮৪৯-এ লন্ডনে এলেন, কোনোক্রমে মাথা গোঁজার ঠাঁই পেলেন এক বস্তি অঞ্চলে, তখন জার্মানি থেকে আসা শরণার্থীর স্রোত বিশ্বের সবচেয়ে শিল্পোন্নত, সবচেয়ে বড় শহরে। ১৮৪৮-র বিদ্রোহ প্রচেষ্টা ব্যর্থ হবার পরে দলে দলে জার্মানরা আশ্রয় নেয় লন্ডনে। মার্কস লন্ডনের একদল তরুণ সহকর্মীকে তাঁর তত্ত্ব বোঝাতেন, ব্ল্যাকবোর্ডে এমন অনেক কিছুই লিখে বোঝাতেন যা পরবর্তী কালে ‘ক্যাপিটাল’-এরও মূল সূত্রায়ন হবে। প্রধাণত এই ছাত্ররা ছিলেন বুদ্ধিজীবী, কারিগর। যে শ্রমিকদের মার্কস খুঁজছিলেন, এঁরা তাঁরা নন। জার্মান শরণার্থীদের মধ্যেই বরং সেই উপাদান ছিল, মার্কসের চোখও ছিল তাঁদের দিকে। এই শরণার্থীদের সাহায্য করার জন্য দিনের বেলা শহরের এক প্রান্ত থেকে অন্য প্রান্তে দৌড়ে বেড়াতেন মার্কস। লিবনেখট লিখে গেছেন সে সব কথা।
শেষ পর্যন্ত মার্কস ও তাঁর সহকর্মীরা জার্মানির সংস্কারপন্থীদের কাছে একটি আবেদনপত্র লেখেন। শরণার্থীদের দুঃসহ অবস্থার কথা বর্ণনা করে লেখা হয়েছিল: ‘তারা সকালে জানে না সন্ধ্যায় কোথায় মাথা পেতে ঘুমোবে, সন্ধ্যায় জানে না আগামীকালের খাবার কোথা থেকে আসবে… উদারনৈতিক, গণতান্ত্রিক, সাধারণতন্ত্রী বা সমাজতন্ত্রী: নানা রাজনৈতিক মত ও স্বার্থের সমর্থকদের এই নির্বাসন ও দুর্দশায় একই অবস্থা। ছেঁড়া কম্বল পরে একটা জাতির অর্ধেকই বিদেশিদের দরজায় ভিক্ষা করছে। আমাদের ফেরার স্বদেশীয়রা লন্ডনের মতো ঝকমকে মেট্রোপলিসের ঠান্ডা ফুটপাতে ঘুরে বেড়াচ্ছে…শহরের সমস্ত রাস্তায় আমাদের ভাষায় কথা বলা কোনও শরণার্থীর দুঃখের বিলাপ শোনা যাচ্ছে।’
মধ্য নভেম্বরে কিছু অর্থ এল। ১৪টি পরিবারকে দেবার মতো টাকা। এই সংখ্যা বেড়ে দাঁড়ালো ৬০টি পরিবারে। শেষ পর্যন্ত ৫০০ পরিবারের কাছে পৌঁছনোর মতো তহবিল হয়। মার্কস ও তাঁর সহকর্মীরা শরণার্থীদের একসঙ্গে থাকার একটা ব্যবস্থা করেন। এবং, স্বহাতে তৈরি করেন কমিউনিটি কিচেন বা খাবার ঘর (শ্রমজীবী ক্যান্টিন)। তৈরি করেন একটি ওয়ার্কশপ যেখানে শরণার্থীরা নিজ নিজে পেশার কারিগরি কাজ করতে পারেন। এই সমস্ত কাজই মার্কস করে বেড়াচ্ছিলেন যখন নিজের পরিবারের জন্য দু’বেলা খাবার জোগাড়ের সামর্থ্যও ছিল না তাঁর। ( তথ্যসূত্র: ডেভিড ম্যাকলেলান: কার্ল মার্কস এ বায়োগ্রাফি, ম্যারি গ্যাবরিয়েল : লাভ অ্যান্ড ক্যাপিটাল, মার্কস-এঙ্গেলস কালেকটেড ওয়ার্কস)
লং মার্চ শুরু হবার আগে চীনের কমিউনিস্টদের সবচেয়ে বড় ঘাঁটি এলাকা ছিল জিয়াঙশি। মহামারীর অসুখ, অপুষ্টি, নিকাশির অভাব, অসুস্থ হলে ঈশ্বরের ওপরে ভরসা করে বসে থাকা। লাল ফৌজ একদিকে যখন জাতীয়তাবাদী প্রতিক্রিয়াশীল সরকারের বিরুদ্ধে সশস্ত্র লড়াই চালাচ্ছে, অন্যদিকে সেই লড়াইয়ের অংশ হিসাবে জনস্বাস্থ্য অভিযান চালিয়েছে। লাল ফৌজের যোদ্ধাদের চিকিৎসা করার জন্য চীনের ওষুধে অভ্যস্ত চিকিৎসক ছাড়াও মেডিক্যাল স্কুল ও মিশন হাসপাতালে প্রশিক্ষিতদের নিয়ে ভ্রাম্যমাণ মেডিক্যাল ইউনিট গড়ে তোলা হয়েছিল। এই সঙ্গে জনগণের জন্য প্রতিষেধক স্বাস্থ্য পরিষেবা দেবার বড় কর্মসূচিও হাতে নেওয়া হয়েছিল। মেডিক্যাল ও হার্বাল সরঞ্জাম তৈরির ওয়ার্কশপ এবং চিকিৎসক ছাড়াও স্বাস্থ্যকর্মীদের জন্য প্রশিক্ষণের ব্যবস্থা ছিল। ১৯৩৩-৩৪ সালে জনগণের মধ্যে স্বাস্থ্য সচেতনতা ও চিকিৎসা ছড়িয়ে দেবার বড় অভিযান চলেছিল ডাঃ হে চেঙের নেতৃত্বে। ১৯৩৪ সালে সরকারি ফৌজ ওই ঘাঁটি এলাকা ঘিরে ফেলায় কমিউনিস্টরা সরে আসতে বাধ্য হয়, শুরু হয় লং মার্চ।
নর্মান বেথুনের কাহিনি কে না জানে? কানাডার কমিউনিস্ট পার্টির সদস্য, স্পেনের গৃহযুদ্ধে লড়াই করা বেথুন লাল ফৌজের পাশে দাঁড়াতে ১৯৩৮-এ ইয়েনানে পৌঁছান। বেথুন লাল ফৌজের অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ বাহিনী অষ্টম রুট আর্মির সঙ্গে যুক্ত হয়ে যান। বেথুন প্রায় কোনও আধুনিক সরঞ্জাম ছাড়াই শল্য চিকিৎসা করতেন। লাল ফৌজের সেনাদের জখমের অপারেশন করা ছাড়াও বেথুনের নেতৃত্বে জনগণের চিকিৎসার অভিযান শুরু করে লাল ফৌজ। একটি বৌদ্ধ মন্দিরের মধ্যে ‘মডেল হাসপাতাল’ গড়ে তুলেছিলেন তিনি। যদিও জাপানি বোমাবর্ষণে তিন সপ্তাহের মধ্যেই সেই হাসপাতাল ধ্বংস হয়। বেথুন দেখেছিলেন তাঁর কমিউনিস্ট সহযোদ্ধারা চিকিৎসার বিষয়ে সম্পূর্ণ অপ্রশিক্ষিত হলেও দুর্দশাগ্রস্ত মানুষের জন্য কাজ করার অদম্য ইচ্ছা তাঁদের আছে। তিনি তাঁদেরই অ্যানাটমি, শারীরতত্ত্ব, ছোটখাট ক্ষত সারানোর পদ্ধতি শিখিয়ে দেন। কিন্তু বৃহত্তর জনগণের মধ্যে কাজ করতে তা যথেষ্ট ছিল না। তরুণ কৃষকদের বেছে নিয়ে চিকিৎসকের এক বছরের কোর্স এবং নার্সদের জন্য ছ’মাসের কোর্সে প্রশিক্ষণ চলতে থাকে। বেথুন এঁদের বলতেন, ‘বেয়ারফুট ডক্টর’, এমন চিকিৎসক যাঁরা গ্রামের মধ্যে থেকেই উঠে এসেছেন। ডাঃ লুইস ডেভিডসনকে লেখা চিঠিতে বেথুন লিখেছিলেন, আমি কৃষক ও তরুণ শ্রমিকদের মধ্যে থেকে ডাক্তার তৈরি করতে চাইছি। আমার এই ডাক্তাররা কোনও কলেজ, বিশ্ববিদ্যালয়ে কোনোদিন যায়নি, কোনও আধুনিক হাসপাতালই চেখে দেখেনি, এমনকি অধিকাংশ কোনোদিন কোনও হাসপাতালেই যায়নি। মুক্তিযুদ্ধ শেষ হবার পরেও চীনে এই বেয়ারফুট ডাক্তারের ধারণা বহুদিন পর্যন্ত ছিল। গ্রামীণ এলাকায় স্বাস্থ্য পরিষেবা পৌঁছে দিতে বিপ্লবোত্তর চীনে তাঁরা দারুণ কাজ করেছে। এক সময়ে দশ লক্ষের বেশি বেয়ারফুট ডাক্তার চীনের প্রত্যন্ত অঞ্চলে কাজ করেছেন।
ভিয়েতনামের মুক্তিযুদ্ধ এবং সাক্ষরতার অভিযান হাত ধরাধরি করে চলেছে। ভিয়েতনামে সাক্ষরতার হার ছিল খুবই কম। তিরিশের দশক থেকেই ভিয়েতনামের মুক্তি সংগ্রামীরা কাঁধে রাইফেল নিয়েই সাক্ষরতার পাঠ নিয়েছেন, দিয়েছেন। উত্তর ভিয়েতনাম মুক্ত হলেও ফরাসি, জাপানি আগ্রাসনের মধ্যে তাকে পড়তে হয়। সেই আগ্রাসন রোখার সময়েই সাক্ষরতার অভিযান পরিচালিত হয়। ১৯৪৫-র আগস্টে উত্তর ভিয়েনাম মুক্ত হবার পরের মাসে বিখ্যাত ‘বিন দান হোক ভু’ ( গণশিক্ষার অভিযান) চালু হয়। ৯৫ হাজার শিক্ষক ২৫ লক্ষকে সাক্ষর করেছিলেন। এরপরই ফরাসী আগ্রাসনের বিরুদ্ধে লড়াই শুরু হয়। সেই যুদ্ধের সময়েও মুক্তাঞ্চলে ৭৫ লক্ষ মানুষকে সাক্ষর করা হয়। এই অভিযান শুধু সরকারি কর্মসূচি ছিল না। এতে অংশ নিয়েছেন স্বেচ্ছাসেবকরা, কমিউনিস্ট বিপ্লবী ও দরদিরা। দক্ষিণ ভিয়েতনাম মুক্ত করার লড়াইয়েও একইভাবে সাক্ষরতার অভিযানে সক্রিয় ছিল কমিউনিস্টরা। গ্রামে গ্রামে কৃষকদের শিক্ষিত করেছেন, তাঁদের বিপ্লবের সমর্থনে টেনেও এনেছেন।
উত্তর ভিয়েতনাম মুক্ত করার লক্ষ্যে দেশব্যাপী অভ্যুত্থান ও মুক্তাঞ্চল তৈরির সময়ে হো চি মিন যে দশটি নীতির কথা বলেছিলেন তার অন্যতম ছিল: নিরক্ষরতা দূর কর, সামাজিক সুরক্ষা ব্যবস্থা চালু কর এবং ক্ষতিগ্রস্তদের রিলিফ দেবার ব্যবস্থা কর। প্রতিরোধ যুদ্ধের সেনাদের জন্য ৬টি কাজ ‘অবশ্য করণীয়’ এবং ৬ টি কাজ ‘কখনো না করার’ তালিকা তৈরি করে দিয়েছিলেন হো। অবশ্য করণীয়ের মধ্যে রয়েছে : ১) মানুষের দৈনন্দিন কাজে সহায়তা করা ( ফসল কাটা, উনোনের কাঠ আনা, জল নিয়ে আসা, সেলাই করা ইত্যাদি); ২) সম্ভব হলে বাজারহাট থেকে যাঁরা দূরে বসবাস করেন তাঁদের জন্য প্রয়োজনীয় জিনিসপত্র কিনে আনা; ৩) জনগণকে জাতীয় লিপি এবং প্রাথমিক স্বাস্থ্যবিজ্ঞান সম্পর্কে শিক্ষা দেওয়া। উনোনের কাঠ আনাও বিপ্লবী কাজের অঙ্গ হতে পারে যদি মাথার মধ্যে মতাদর্শ ঠিক থাকে।
কিউবার গণচিকিৎসা ব্যবস্থা বিশ্বের বিস্ময়। বিপ্লবের পরে গোড়া থেকেই ‘সোশাল মেডিসিন’-এর ধারণাকে সামনে এনেছিলেন কিউবার নেতৃত্ব। সিয়েরা মায়েস্ত্রার পাহাড়ে পৌঁছানোর পরে কৃষকদের মধ্যে জনস্বাস্থ্যের কাজ করেছিলেন গেরিলারা। পরে, ১৯৬০-র ১৯ আগস্ট চে গুয়েভারার বিখ্যাত ভাষণ ‘অন রিভলিউশনারি মেডিসিন’ সমষ্টির স্বাস্থ্যের নীতির সূত্রায়ন করেছিল। যার ওপরে আজও কিউবার স্বাস্থ্য কাঠামো দাঁড়িয়ে আছে। কিন্তু আমরা লক্ষ্য করব সেই বক্তৃতাতেই চে বলছেন, ‘সিয়েরা মায়েস্ত্রায় আমরা যে ভুল করেছিলাম তা যেন আর না হয়। হয়ত তা ভুল ছিল না। কিন্তু আহতদের বা অসুস্থ মানুষের পাশে থাকা যেন অসম্মানজনক ছিল। আমরা সব সময়েই চাইতাম যে করে হোক একটা রাইফেল নিয়ে যুদ্ধক্ষেত্রের দিকে দৌড়োতে।’ বিপ্লবীর আত্মদর্শন। যদিও বাস্তবতা হলো সহযোদ্ধা ও জনগণের চিকিৎসার স্বার্থে ডাক্তার চে তাঁর কমরেডদের তৈরি করেছেন, এমনকি ইঞ্জেকশন দেওয়া শেখাতে নিজের শরীরকেই দিনের মধ্যে বারবার ব্যবহার করেছেন। চীনের যেমন বেয়ারফুট ডাক্তার ছিল কিউবার ফ্যামিলি ডক্টরস। তাঁরা এখনও রয়ে গেছেন। এই নেটওয়ার্কে দেশের প্রায় সব নাগরিকই রয়েছেন, পরিবার ধরে এই চিকিৎসকরা খোঁজ রাখেন। মহামারীর মতো ঘটনায় বা প্রাকৃতিক বিপর্যয়ে এই পদ্ধতি খুব কাজে লাগে। কিউবায় করোনা মোকাবিলার প্রাথমিক কাজই হয়েছে বাড়িতে। ডাক্তার ও স্বাস্থ্যকর্মীরা বাড়ি বাড়ি গেছেন, পরীক্ষা করে দেখেছেন। কেউই পরীক্ষার বাইরে থাকেননি। স্বাস্থ্যকর্মীদের বড় অংশই প্রথম দিকে ছিলেন স্বেচ্ছাসেবক, ভলান্টিয়ার্স।
১৯৪৩-র ভয়াবহ দুর্ভিক্ষ, মহামারী গ্রাস করে নেয় বাংলাকে। গ্রামবাংলা খাদ্যহীন, যেখানে সেখানে পড়ে থাকছে শবদেহ। লক্ষ লক্ষ নিরন্ন মানুষের মিছিলে ভরে উঠলো কলকাতা, সঙ্গে আর্ত চিৎকার ‘ফ্যান দাও’। একদিকে যুদ্ধের জন্য সাম্রাজ্যবাদের নীতি, অন্যদিকে মজুতদারি ও কালোবাজারীর দাপটে মানুষ মরতে থাকলেন। সঙ্গে কলেরা, ম্যালেরিয়া। কত লক্ষ লোক সেই মহাসঙ্কটে মারা গিয়েছিলেন তার কোনও ইয়ত্তা নেই। তারাশঙ্কর লিখেছিলেন, ‘আজ বাংলার চিত্রশিল্পীর মডেল হয়ে উঠেছে নরকঙ্কাল, গলিত শব, তার চারিপার্শ্বে ক্ষুধার্ত মাংসভুক কুকুর শেয়াল শকুন।।’
১৯৪২-র ভারত ছাড়ো আন্দোলনে কমিউনিস্টদের অবস্থানের জন্য জনবিচ্ছিন্নতা তৈরি হয়েছিল। দুর্ভিক্ষের সময়ে কমিউনিস্টরাই বীরদর্পে এসে দাঁড়ালো সামনের সারিতে। শুরু হলো বেনজির রিলিফ ওয়ার্ক। জেলায় জেলায় হাজার হাজার মানুষের মধ্যে ত্রাণ বিলি করে কমিউনিস্টরা। কুইনাইন বিলি করে। মজুতদারের ধানের গোলা দখল করে তা বিলি করে কৃষকদের মধ্যে। কমিউনিস্ট কর্মীরা নিজেরা অভুক্ত, অর্ধাহারে থেকে নিরন্ন মানুষকে লঙ্গরখানায় রান্না করে খাইয়ে গেছেন মাসের পর মাস।
গ্রামাঞ্চলে মজুত উদ্ধারের কাজ শুরু করেছিল মূলত কৃষক সমিতি ও মহিলা আত্মরক্ষা সমিতি। তারা কর্মীদের আহ্বান জানালো গ্রামে গ্রামে নিরন্ন মানুষের মুখে অন্ন তুলে দাও, মজুত উদ্ধার কর, লঙ্গরখানা খোলো, হাটে হাটে লাইন প্রথায় কেরোসিন বিক্রির ব্যবস্থা কর, কলেরা, বসন্ত প্রতিরোধে এগিয়ে আসো। ডাক্তারখানা খোল। সঙ্গে শামিল হল ভারতীয় গণনাট্য সঙ্ঘ, পাশে এসে দাঁড়ালো পিপলস রিলিফ কমিটি। ছাত্র ফেডারেশনের উদ্যোগে গার্লস স্টুডেন্ট অ্যাসোসিয়েশন ২৬০টি দুধের ক্যান্টিন পরিচালনা করত। বাংলার শিল্পীরা দেশের বিভিন্ন প্রদেশে নৃত্যনাট্য, নাটক, গানের মাধ্যমে ‘সেভ বেঙ্গল’-এর আওয়াজ প্রচার করলেন। বহু বিশিষ্ট শিল্পী সেই কাজে অংশ নিয়েছিলেন।
একদিকে রিলিফের কাজ, অন্যদিকে আন্দোলনের দাবি, খাদ্য শস্যের দাম কমাও, মজুত উদ্ধার কর, ত্রাণের ব্যবস্থা কর, সরকারি লঙ্গরখানা চালু কর। কলেরা বসন্তের মতো সংক্রামক রোগ প্রতিরোধে ব্যবস্থা নাও, ম্যালেরিয়া নিবারণ কর, বস্ত্র বিতরণ কর, কেরোসিনের চোরা কারবার রদ কর। পি সি যোশী লিখেছিলেন, কমিউনিস্টরা সেদিন নিজেদের বিবেককে বাঁচাতে পেরেছে, সঙ্কটে অভিভূত হয়নি। অনেকটাই কেটেছিল জনবিচ্ছিন্নতা।
মণিকুন্তলা সেন পরে লিখেছিলেন, আমাদের গঠনমূলক কাজ সম্পর্কে মাঝে মাঝে বিরূপ মন্তব্যও শোনা যেত। কেউ কেউ বলতেন-এ তো রামকৃষ্ণ মিশনের কাজ, এতে কি বিপ্লব আসবে? নিজেই জানিয়েছেন,টালিগঞ্জে বস্তি এলাকায় মনতোষিনী মাসিমার কথা, কীভাবে আপদে-বিপদে ছুটে যাওয়া এই মাসিমার ডাকে মহিলারা ছুটে আসতেন মিছিলেও।
ওপরে বর্ণিত সবক’টি পরিস্থিতিই ছিল একে অন্যের থেকে আলাদা। গত এক বছরের বেশি সময় ধরে চলা অতিমারীও অন্য যে কোনও সময়ের থেকে আলাদা। সংক্রমণের চরিত্র এবং তা মোকাবিলার জন্য গৃহীত ব্যবস্থায় অর্থনীতি ভেঙে পড়ার যুগপৎ আক্রমণের বৈশিষ্ট্যই আলাদা। এই মহামারী ঠেকাতে পারে সুসংহত রাষ্ট্রীয় পরিকল্পনা। যার অভাব প্রকট। সরকারি স্বাস্থ্য ব্যবস্থার বেহাল অবস্থার মতোই দরিদ্রতর অংশের জীবনজীবিকার রক্ষায় সরকারের ব্যর্থতাও প্রকট।
করোনার প্রথম প্রবাহে শারীরিক দূরত্বের সঙ্গে প্রবল ছিল সামাজিক দূরত্ব। প্রতিবেশীর জন্য, সহ নাগরিকের জন্য হাত বাড়িয়ে দেবার বদলে স্পর্শের আশঙ্কাই কাজ করছিল বেশি। তখন তা ভেঙেছিলেন মূলত রেড ভলান্টিয়াররা অথবা যে নামেই ডাকা হোক বামমুখী সংগঠনগুলি। একদিকে অসুস্থদের পাশে সরাসরি দাঁড়ানো, অন্যদিকে অভাবীদের পাশে দাঁড়ানো। শ্রমজীবী ক্যান্টিন থেকে সবজি বাজার, অ্যাম্বুল্যান্স থেকে হাসপাতাল নিয়ে যাওয়া। দ্বিতীয় প্রবাহে কাজ বাড়িয়ে যুক্ত হয়েছে অক্সিজেন, ওষুধের সঙ্কট। আরও দ্রুত, আরও গতি নিয়ে কাজ করা। এই নয় যে রেড ভলান্টিয়াররাই একমাত্র এ কাজ করছেন, দ্বিতীয় প্রবাহে সমাজের নানা অংশের মানুষ অনেকটাই দ্বিধার প্রাচীর ভেঙে সমষ্টির কাজ করছেন। অপরিচিতকে পরিচিত করে দিচ্ছে। কিন্তু কেউ কি অস্বীকার করতে পারেন ‘রেড’-রা এই প্রণোদনা তৈরি করেছে? অন্তত এই বাংলায়?
এ কাজ কি এনজিও-দের মতো? মিশনের মতো? সংস্কারবাদে বেপথু? হাত গুটিয়ে বসে থাকাই শ্রেয়তর ছিল তাহলে? রাষ্ট্রকে দায়িত্ব পালনের দাবি জানানো এবং চে-বর্ণিত ‘ভুল’ না করা একসঙ্গেই চলার কথা নয় কি? অসহায়, দিকভ্রান্ত মানুষের পাশে যে দাঁড়াচ্ছে তার হৃদয়ের উত্তাপ কি ইতিমধ্যেই ছড়িয়ে পড়েনি সমাজে, নাড়িয়ে দেয়নি এক পক্ষাঘাতকে? স্বতঃস্ফূর্ততার উপাদানেই ক্রমশ মিশবে পরিকল্পনা। আমূল সামাজিক রূপান্তরের স্বপ্ন দেখি বলে এখন দিবাস্বপ্ন দেখব, এ কোনও কাজের কথা নয়। ওই ‘রেড’ মাথায় নিয়ে অনেককে সঙ্গী করে চলাই এদিনের কাজ।
রক্তকরবীর নন্দিনীকে আমরা বলতে শুনেছিলাম, মানুষের দুঃখ মানুষের নাগাল চায় যে। তার সময় অল্প।