ওয়েবডেস্ক প্রতিবেদন
সৌভিক ঘোষ
দিল্লীর বিজ্ঞান ভবনে আয়োজিত অনুষ্ঠান।
সেই অনুষ্ঠানে মাথা কেটে ফেলাকেই অসামান্য শাসনের নিদর্শন হিসাবে তুলে ধরলেন অমিত শাহ।
লাচিত বরফুকনের ৪০০ তম জন্মবার্ষিকী ছিল গতকাল। লাচিত ছিলেন আহম রাজত্বের কম্যান্ডার- বাংলায় যাকে সেনাপতি বলে। ভারতের ইতিহাস বলতে চিরকাল যারা রাজা-রাজড়াদের বাইরে কিছু ভাবতে পারেনি সেই বিজেপি হঠাৎ সেনাপতিদের নিয়ে এহেন আয়োজন করল কেন? মোদী যেভাবে অমিত’কে তুলে ধরতে চাইছেন বা ব্যবহার করছেন ইত্যাদি- সেই জন্যই কি?
ইতিহাস পাঠের কতিপয় ঘরানা আছে। প্রথাসম্মত পণ্ডিতমহলে সেই বিষয়টি হিস্টিরিওগ্রাফি বলে পরিচিত। ফরাসী আনাল স্কুল, জাতিয়তাবাদী দৃষ্টিভঙ্গি কিংবা প্রাচীনত্বের দিক থেকে বিচার করলে হাল আমলের নিম্নবর্গীয় বিবেচনাবোধ- এসবই হল ঘটে যাওয়া অতীতকে সঠিকভাবে চিনে নিতে বিভিন্ন পূর্বনির্ধারিত অবস্থান। আবার বিজ্ঞান-প্রযুক্তি ও বস্তুবাদী দর্শনের ভিত্তিতেও ইতিহাসের পর্যালোচনা হয়। সোভিয়েত ইউনিয়ন বিধ্বস্ত হলে সেই চর্চায় ভাঁটা পড়ে, এই বছর চিকিৎসাবিজ্ঞানে নোবেল পুরষ্কার ঘোষণা হলে মানুষ কি করে মানুষ হল সেইসব পুনরায় মনে পড়ে যাচ্ছে। বিবেচনার দৃষ্টিভঙ্গিতে ফারাক থাকলেও ইতিহাসের শিক্ষা বলেও একটা বিষয় আছে- পন্ডিত হন বা না হন, তাকে এড়িয়ে যাওয়ার উপায় নেই।
মনে রাখতে হবে সামনেই গুজরাটে নির্বাচন। উন্নয়নের নামে গুজরাট মডেলের ফানুস ফেঁসে গেছে (অনেক আগেই এমুন হয়েছে ঠিকই, তবু হাওয়া ভরে চালিয়ে যাওয়া হচ্ছিল বলেই উল্লিখিত হল)। সুতরাং ভোট জিততে ভরসা সেই উগ্র জাতীয়তাবোধ। আর কে না জানে, এসব করতে সফল বলেই অমিত শাহ মোদী-শাসনে সেনাপতির মর্যাদা পান।
তাই লাচিত বরফুকন। ঠিক কি করেছিলেন এই সেনাপতি? মোগল সেনাবাহিনীর বিরুদ্ধে ১৬৭১ সালে সরাইঘাটের যুদ্ধে নেতৃত্ব দিয়েছিলেন। সেই যুদ্ধের এক বছর তার মৃত্যু হয়। লাচিতের বীরত্বকে স্মরণে রেখেই ভারতীয় সেনাবাহিনীতে সেরা ক্যাডেটদের পুরস্কার নামাঙ্কিত- এখন নয়, ১৯৯৯ সাল থেকেই। দেশকে ভালোবাসাতে জাতীয়তাবাদী দৃষ্টিভঙ্গির পরিসর কোনদিনই ভূগোলের সীমাবদ্ধতা টপকায় না। অন্যের সাম্রাজ্য কেড়ে নেওয়া হোক কিংবা নিজেদের সাম্রাজ্য বাঁচানো হোক, সামন্ত ধারনায় বীরেরা চিরকাল জমির প্রসঙ্গেই আটকে থাকেন। আজকের ভারতে বিজেপি রাজনীতির নামে যাকিছু করছে তাকে একদিকে জমি কেড়ে নেওয়া, আরেকদিকে জমি বাঁচানোর রণকৌশলই বলে। তাই আহম রাজত্বের বিরগাথাও হয়ে উঠছে ইতিহাস বিকৃতির হাতিয়ার।
অমিত শাহ নির্দেশ দিয়েছেন, নতুন করে দেশের ইতিহাসের গৌরব পুনরুদ্ধার করতে হবে। সেই ‘কাজে’ সরকার যে পাশে থাকবে তাও শুনিয়ে দিয়েছেন। লাচিত বরফুকন শুধুমাত্র আসামের মানুষেরই বিশেষ আবেগের বিষয় এমনটা না হলেও (কারণ ভারতীয় সেনাবাহিনীর পদক কোনও প্রাদেশিক ব্যাপার না) অমিত’রা সেটাই চান। আসাম সহ গোটা উত্তর-পূর্ব ভারত নাকি সুরক্ষিত থেকেছিল সরাইঘাটের যুদ্ধজয়ের কারনে, এসব বলার সময় কেউ তাকে প্রশ্ন করেন নি। অমিত’দের হয়ত জানা নেই- গতকালের অনুষ্ঠানে প্রকৃত অর্থে কোনও ইতিহাসবিদ উপস্থিত থাকলে সেই প্রশ্ন উঠতই। প্রশ্ন তোলাই ইতিহাসবিদদের অন্যতম কাজ।
আমাদের দেশের ইতিহাসকে রাজা-রাজড়াদের সাম্রাজ্য বিস্তার (পড়ুন অন্যের রাজত্ব কেড়ে নেওয়া) বলে দেখানোই দস্তুর। রাজার ইচ্ছায় ইতিহাস লেখা হত বলেই তার প্রতিষেধ হিসাবে বিভিন্ন লোকশিল্পে (যার কিছুটা স্থানীয় ইতিহাস রচনার ভিত্তি, সবটা নয়) বিকল্প ভাষ্যের চল রয়েছে। অমিত বিক্রমের নানা বীরগাথা গ্রাম ভারতের কোনায় কোনায় ছড়িয়ে-ছিটিয়ে রয়েছেও। এতদিন সেইসব ‘লোককথা’ বলেই চিহ্নিত হত। কিন্তু দেশের ইতিহাস বলে যা লেখা রয়েছে তাকে বদলাতে না পারলে যে ভোটের ময়দানে ‘স্ট্রাটেজিক অ্যাডভান্টেজ’ মিলবে না- মাথা দখলের যে কৌশল আজকের ভারতে দক্ষিণপন্থার অন্যতম হাতিয়ার আধুনিক যুগে তার ঐতিহাসিক নিদর্শনগুলিও কিন্তু দেশীয় নয়। ইতালি থেকে কাজ শিখে আসা এবিএস মুঞ্জের স্মৃতিকথাতেই এর প্রমাণ রয়েছে।
বিজ্ঞান ভবনের অনুষ্ঠানে অমিত বলেছেন- লাচিতদের যুদ্ধের কারনেই মোগল সেনাবাহিনী পিছু হটে এবং ভারত নাকি পুনরায় স্বরাজ্যের দিকে এগোয়। কোন ইতিহাস নতুন করে লিখতে চাইছেন অমিত’রা? মোগল সাম্রাজ্যের পতনের পরেই ভারত নিজের স্বাধীনতা হারিয়েছিল- ব্রিটিশ সাম্রাজ্যের উপনিবেশের পরিণত হয়েছিল- এই ইতিহাস? নাকি ব্রিটিশদের বিরুদ্ধে ভারতের প্রথম স্বাধীনতা যুদ্ধে সেনানায়ক ছিলেন মোগল বাদশাহ বাহাদুর শাহ জাফর- এই সত্যই বদলে দিতে চান তারা? সিপাহী বিদ্রোহ তো ব্রিটিশ সাম্রাজ্যবাদের দেওয়া অভিধা, ১৮৫৭’র সংগ্রামকে ভারতের প্রথম স্বাধীনতা যুদ্ধ বলে বিবেচনা করেছিলেন কার্ল মার্কস, একসময় আরএসএস-বিজেপি প্রচার করত সাভারকর’ও নাকি এসব বলতেন। তাহলে কি অমিত সেটুকুও জানেন না?
আসলে জানেন। জানেন বলেই বদলের কথা বলেন।
উত্তর-পূর্ব ভারতের ইতিহাস, সংগ্রাম ও সংস্কৃতিকে ভারতের মূলধারা থেকে বিচ্ছিন্ন করে দেখানোই বিজেপি’র আজকের রাজনীতি। বহুভাষা, বহু বিশ্বাস এবং বহু মতামতের দেশই ভারত- আগেও তাই ছিল, আজও তাই আছে। ‘এক দেশ, এক ভাষা’ বলে সংসদে আইন প্রণয়ন করছে যারা, হিন্দিকে জোর করে রাষ্ট্রভাষা বলে চালিয়ে দিতে চাইছে যারা সেই আরএসএস-বিজেপি’র থেকে ভারতীয়রা ইতিহাসের পাঠ নেবে না।
লাচিত বরফুকন নিশ্চয়ই বীর। মুখোমুখি সংগ্রামে জীবনপণ লড়াই যেকোনো সেনাবাহিনীরই স্বাভাবিক দস্তুর, সব দেশেই- এসব নতুন কিছু না। নতুন যা কিছু তা শুধু এটুকুই যে লাচিত যাদের সাথে নিয়ে লড়েছিলেন তারাও এক রাজার পক্ষে ছিলেন, যাদের বিরুদ্ধে লড়েছিলেন তারাও ছিলেন আমাদেরই দেশের সম্রাটের পক্ষেই। মোগল শাসনকে ভারতের ইতিহাসের বাইরের বিষয় বলে বিবেচনা করা- ইতিহাস এবং ঐতিহ্য দুদিক থেকেই মুর্খামি ছাড়া আর কিছু নয়।
এবার মাথা কাটার প্রসঙ্গ। সামরিক লক্ষ্যে নেওয়া সিদ্ধান্ত অনুযায়ী কেল্লা বানাতে না পারায় নিজের আত্মীয়ের (শাহের বয়ানে মামা, ইতিহাস বলছে প্রযুক্তিবিদ) মাথা কেটে ফেলার নির্দেশ দেন লাচিত। মার্কিনী কায়দায় ইন্ডিয়া ফার্স্ট বলতে শেখা অমিত’দের এমন আচরণ হয়ত খুবই পছন্দের। সারা দেশে ছোটদের উদ্দেশ্যে মাতৃভাষায় লেখা লাচিত বরফুকনের জীবনী পড়ানোর যে পরিকল্পনা তিনি জানিয়েছেন, তাতেও নিশ্চয়ই ঐ ঘটনার উল্লেখ থাকবে- বা হয়ত শুধু অমন ঘটনারই উল্লেখ থাকবে। মাথা কেটে ফেলার গল্প বড়াই করে না বললে যে মাথা দখলের রাজনীতি চলে না! ভুলিয়ে দেওয়া হবে সক্রেটিসের কথা, যিনি উল্লেখ করেন- দুর্ভাগ্য তাদের না যাদের ইতিহাসে বীর নেই, হতভাগ্য হল সেই জাতি যার শুধুই এমন বীরের প্রয়োজন হয়।
আসলে অমিত’রা যাদের ইচ্ছায় এসব বলছেন, করছেন তাদের মাথায় একটা ভূত ঢুকে রয়েছে। সেই ভূত অতীত সম্পর্কে ভিত্তিহীন অহমিকাকে আশ্রয় করে গড়ে ওঠে, বাস্তব পরিস্থিতির সমস্যা সমাধানের ব্যর্থতা ভুলে থাকতে অজুহাত যুগিয়ে টিকে থাকে। ভারতের যাবতীয় অতীত, ইতিহাস, দর্শন ও প্রজ্ঞার যথার্থ সমন্বিত রূপ যার মধ্যে দিয়ে প্রকাশিত হয় সেই রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর এহেন ভূত সম্পর্কে লিখে গেছেন-
‘ভবিষ্যৎকে মানলেই তার জন্যে যত ভাবনা, ভূতকে মানলে কোনো ভাবনাই নেই; সকল ভাবনা ভূতের মাথায় চাপে। অথচ তার মাথা নেই, সুতরাং কারো জন্যে মাথাব্যথাও নেই।
তবু স্বভাবদোষে যারা নিজের ভাবনা নিজে ভাবতে যায় তারা খায় ভূতের কানমলা। সেই কানমলা না যায় ছাড়ানো, তার থেকে না যায় পালানো, তার বিরুদ্ধে না চলে নালিশ, তার সম্বন্ধে না আছে বিচার।
দেশসুদ্ধ লোক ভূতগ্রস্ত হয়ে চোখ বুজে চলে। দেশের তত্ত্বজ্ঞানীরা বলেন, “এই চোখ বুজে চলাই হচ্ছে জগতের সবচেয়ে আদিম চলা। একেই বলে অদৃষ্টের চালে চলা। সৃষ্টির প্রথম চক্ষুহীন কীটাণুরা এই চলা চলত; ঘাসের মধ্যে, গাছের মধ্যে, আজও এই চলার আভাস প্রচলিত।”
শুনে ভূতগ্রস্ত দেশ আপন আদিম আভিজাত্য অনুভব করে। তাতে অত্যন্ত আনন্দ পায়।’
আজকের ভারতীয়দের অবশ্য এসব দেখে ভয় পেলে চলবে না।
শেষ বিশ্বযুদ্ধে কিছু দেশের মাথায় অমন ভূত চেপেছিল- সেইবারের মতোই আজও ভূত ছাড়িয়ে দেওয়া যাবেখন।