চেতনায় থাকুক উত্তরাধিকার
সীতারাম ইয়েচুরি
‘ভারত ছাড়ো’ আন্দোলনের ৭৫তম বার্ষিকীতে রাজ্যসভার আলোচনায় সাংসদ হিসাবে নিজের বক্তব্য পেশ করেন ভারতের কমিউনিস্ট পার্টি (মার্কসবাদী)’র সাধারণ সম্পাদক সীতারাম ইয়েচুরি। সেই আলোচনা আজকের ভারতের প্রেক্ষিতেও যথেষ্টই প্রাসঙ্গিক। সেই বক্তব্যেরই বাংলা অনুবাদ সিপিআই(এম) রাজ্য ওয়েবসাইটের পক্ষ থেকে প্রকাশিত হল।
আজ ‘ভারত ছাড়ো’ আন্দোলনের ৭৫তম বার্ষিকী পালিত হচ্ছে, এ এক ঐতিহাসিক এবং অত্যন্ত গৌরবের সন্ধিক্ষণ। এই আয়োজনে আমরা শুধু ইতিহাসই স্মরণ করি না, আমরা সেই উদ্দেশ্যটিরও সন্ধানে ব্রতী হই যা এই আন্দোলনকে এক সফল সংগ্রামে উন্নীত করেছিল।
ইতিহাসের পাতা উল্টে দেখলে এই আন্দোলন প্রসঙ্গে মহারাষ্ট্রের স্বাধীন রাজ্য সাতারার উল্লেখ পাওয়া যাবে। স্বাধীন সাতারা গঠন আন্দোলনের নেতা ছিলেন নানা পাতিল, যিনি কমিউনিস্ট পার্টির সদস্য ছিলেন। পরবর্তীতে নানা পাতিল দেশের সংসদের দুই কক্ষেই সদস্য নির্বাচিত হন। কেউ যদি ভারতের স্বাধীনতা সংগ্রামের ইতিহাস এবং বিভিন্ন ব্যাক্তি কিংবা দলের ভূমিকা বিচার করতে চান তাহলে খুঁজে পাবেন সুভাষচন্দ্র বসুর তৈরি ঝাঁসির রানী ব্রিগেডটি নেতৃত্ব দিয়েছিলেন লক্ষ্মী সেহগল যিনি সিপিআই(এম) এর সদস্য ছিলেন এবং পরে রাষ্ট্রপতি পদপ্রার্থী হিসাবে আমরা তাকে মনোনীতও করি। আমাদের সবাইকে সচেষ্ট থাকতে হবে দেশের প্রকৃত ইতিহাসকে কেউ যেন নিজেদের স্বার্থে বদলে দিতে না পারে – যদি আজও কেউ সেলুলার কারাগার দেখতে যান তবে দেখবেন সেখানকার ফলকে লেখা বন্দীদের নামের তালিকায় ৮০%ই ছিলেন কমিউনিস্ট। এরা প্রত্যেকেই হয় অবিভক্ত বাংলার অথবা অবিভক্ত পাঞ্জাবের মানুষ ছিলেন।
সবাই স্মরণে রাখুন চট্টগ্রাম অস্ত্রাগার অভিযান – তার অন্যতম নেতৃত্ব কল্পনা দত্ত – তিনি কে ছিলেন? এটাই আমাদের সকলের প্রকৃত ইতিহাস।
‘ভারত ছাড়ো’ আন্দোলনের ৫০তম বার্ষিকীতে আমাদের তৎকালীন রাষ্ট্রপতি মাননীয় শ্রীশঙ্করদয়াল শর্মা এই কক্ষেই আয়োজিত রাত্রিকালীন অধিবেশনে উল্লেখ করেছিলেন (সেই সময় দেশের সংসদে ইতিহাসকে স্মরণ করতে এবং শেখার উদ্দেশ্যে রাত্রিকালীন অধিবেশনের প্রচলন ছিল – এখনকার মতো জিএসটি বা অন্য কোন নতুন পরিকল্পনা লাগু করতে রাত্রিকালীন সময়কে বেছে নেওয়া হত না) – আহমেদাবাদে কল-কারখানাগুলিতে একের পর এক বড় ধরনের ধর্মঘট সংগঠিত হবার পরেই ১৯৪২ সালের ৫ সেপ্টেম্বর দিল্লি থেকে লন্ডনে কর্মরত ভারত সংক্রান্ত সচিবের কাছে একটি বার্তা গিয়েছিল, সেই চিঠিতে ভারতের কমিউনিস্ট পার্টি সম্পর্কে রিপোর্ট করা হয়েছিল – ‘এইসব আচার আচরণ এটাই প্রমাণ করে যে এরা কমিউনিস্ট বিপ্লবী, অবশ্য এই সত্য অনেক আগেই আমাদের কাছে স্পষ্ট ছিল যে ভারতের কমিউনিস্ট পার্টির বেশিরভাগ সদস্যই হলেন ব্রিটিশ বিরোধী বিপ্লবী’। এর পরেও কি এই প্রসঙ্গে আরো কিছু বলার দরকার পড়ে? এই লড়াই দেশের মধ্যে বহুবিধ সংগ্রামের ধারাকে একজোট করে এমন এক আন্দোলন হিসাবে গড়ে ওঠে যার একটিই সাধারণ বৈশিষ্ট ছিল – তাঁরা সবাই ছিলেন ব্রিটিশ শাসনের বিরোধী। একথা অবশ্যই স্বীকার করতে হবে যে আন্দোলনের নেতৃত্ব ছিল সর্বভারতীয় জাতীয় কংগ্রেসেরই হাতে কিন্তু আমরা সকলে সেখানে ছিলাম, আমরা অর্থাৎ তৎকালীন কমিউনিস্টরা সবাই এই লড়াইতে যুক্ত ছিলেন।
১৯২১ সালে এ আই সি সি’র আহমেদাবাদ অধিবেশনে প্রথমবারের জন্য পূর্ণ স্বাধীনতার স্লোগান সহ একটি প্রস্তাব উত্থাপন করা হয়। এই প্রস্তাব উত্থাপন করেছিলেন মৌলানা হসরত মহানি এবং স্বামী কুমারানন্দ। এক মৌলানা এবং আরেক স্বামী একযোগে ভারতের কমিউনিস্ট পার্টির পক্ষ থেকে পূর্ণ স্বাধীনতার দাবিতে প্রস্তাব করছেন – এটাই আমাদের দেশের স্বাধীনতা আন্দোলনের প্রকৃত চরিত্র। মহাত্মা গান্ধী তখন তা গ্রহণ করলেন না ঠিকই, কিন্তু শেষ পর্যন্ত ১৯২৯ সালে কংগ্রেসের লাহোর অধিবেশনের সময় “পূর্ণ স্বরাজ” স্লোগান উত্থাপিত হল। এই হল আমাদের ইতিহাস – এটাই আমাদের গর্বের ঐতিহ্য এবং সেই ঐতিহ্য কারোর একার না তা সকল দেশবাসীর, সকল ভারতীয়ের।
এডওয়ার্ড লাউড নামে একটি ব্রিটিশ রাজকর্মচারী ছিলেন। তিনি ১৮৫৭’র মহাবিদ্রোহ চলাকালীন ভারতে যা কিছু ঘটছিল তা নথিভুক্ত করেছিলেন। সেই নথিতে উল্লেখ রয়েছে – “যদি শিশুসুলভ রাজপুত, ধর্মান্ধ ব্রাহ্মণ, শূকর বিদ্বেষী এবং শূকর ভক্ষক – গোমাংস ভক্ষক এবং গোমাতার উপাসক সবাই একত্রিত হয়ে যায় ভারতে ব্রিটিশ শাসনের কোন ভবিষ্যৎ নেই”। আমি আরেকবার উল্লেখ করতে চাই যে এই হল সেই ঐক্য যার কারনে আমরা আমাদের স্বাধীনতা অর্জন করেছি। আজ এই ইতিহাস সৃষ্টিকারীদের শ্রদ্ধা নিবেদন করতে গেলে যারা সেই মহান ঐক্যসাধন করে সংগ্রাম পরিচালনার মধ্যে দিয়ে ভারতকে স্বাধীন করেছেন – যার জন্য আমরা সকলেই গর্বিত, সেইসব ঐতিহাসিক কর্তব্যপালনকারীদেরই কথা স্মরণ করা উচিত। এ কে গোপালন ১৯৪৭সালের ১৫ আগস্ট তামিলনাড়ুর মেলোর জেলে বন্দী থাকা অবস্থাতেই জাতীয় পতাকা উত্তোলন করেছিলেন।
এই হল সেদিনের আন্দোলনের সম্মিলিত ইতিহাস – আমাদের স্বাধীনতা সেই ঐক্যেরই স্বাতন্ত্র্য বজায় রাখে। আজ আমরা ৭৫তম বার্ষিকী পালন করতে গিয়ে দেশের ভবিষ্যতের দিকে তাকিয়ে রয়েছি। মাননীয় প্রধানমন্ত্রী তার ‘মন কি বাত’ অনুষ্ঠানে বলেছেন – ১৯৪২ সাল থেকে শুরু করে ১৯৪৭ পর্যন্ত সময়ই স্বাধীনতা আন্দোলনের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ পাঁচ বছর এবং তাই ২০১৭ থেকে ২০২২সালের মধ্যেকার পাঁচ বছরে আমাদের সেই উদ্দেশ্য অর্জন করতে হবে। আমি উল্লেখ করতে চাই সেই উদ্দেশ্য বলতে আসলে কি বোঝাতে চাইছেন তিনি? ১৯৪৭ সালে আমাদের দেশ স্বাধীনতা লাভ করে – আজকের দিনে প্রত্যেক ভারতবাসীর কাছে সেই দিনটি পবিত্র। কিন্তু সেই পবিত্রতার আসল উপলব্ধি কোথায়? সেই উপলব্ধি রয়েছে আমাদের ঐক্যের মধ্যে, আমাদের ঐক্যবদ্ধ সংগ্রামের মধ্যে। কিন্তু একইসাথে মনে রাখতে হবে সেই ঐতিহ্যকে ছুঁড়ে ফেলেই ঐ পাঁচ বছরে তৎকালীন ভারতবর্ষে বিভেদের রাজনীতি মাথাচাড়া দিয়েছিল, ব্রিটিশ শাসকের সফল চক্রান্তের কবলে পড়েই ঐ পাঁচ বছরে আমাদের দেশের জনগণ অভূতপূর্ব জাতিবিদ্বেষের আক্রমনের মুখ পড়েন, আন্দোলনের মুখ ঘুরিয়ে দেবার চেষ্টা হয় এবং দেশভাগের মধ্যে দিয়ে স্বাধীনতা অর্জিত হয় – তিনি কোন উদ্দেশ্যের পুনঃপ্রচার চাইছেন তা স্পষ্ট নয়।
প্রধানমন্ত্রী উল্লেখ করেছেন দেশকে সাম্প্রদায়িকতার বিষমুক্ত করতেই হবে – আমি স্পষ্ট ভাষায় বলছি সেই উদ্দেশ্যে কি আমরা আদৌ সক্রিয় রয়েছি? সেই উদ্দেশ্যেই আমি ১৯৪২ থেকে ১৯৪৭ সালের গর্বের আন্দোলনের উল্লেখ করার সাথেই সেই সময়কার অন্ধকার দিকগুলির কথাও তুলে ধরলাম। এই উপমহাদেশের জনগণের বহু আত্মত্যাগ, লড়াই – সংগ্রাম যেমন সত্য তেমনই দুর্ভাগ্যজনক এই যে আমাদের স্বাধীনতার সাথেই জড়িয়ে রয়েছে দেশভাগের ইতিহাস যার পিছনে কাজ করেছিল সাম্প্রদায়িক রাজনীতি। সেবার একদিকে পাকিস্তান গড়ে উঠলেও আমরা ধর্মনিরপেক্ষ, সাধারণতন্ত্র বিশিষ্ট গণতান্ত্রিক দেশ হিসাবে ভারত-কে প্রতিষ্ঠা করলাম। এই ধর্মনিরপেক্ষতা, সাধারণতন্ত্র এবং গণতান্ত্রিক ব্যবস্থাই আমাদের দেশের সংবিধানের মূল ভিত্তি। এই ভিত্তির উপরে নির্ভরশীল থেকেই আমাদের ভবিষ্যতের দিকে এগিয়ে যাওয়ার পরিকল্পনা করা উচিত। যদি আজ আমরা ‘ভারত ছাড়ো’ আন্দোলনের ঐতিহ্য পালনে সত্যই ইচ্ছুক হই তবে আমাদের উচিত সেইসব অর্থনৈতিক সিদ্ধান্তকে বাতিল করা যার কারনে আজকের ভারতে ভয়ানক অসাম্য সৃষ্টি হয়েছে, যা দেশের বুকে দারিদ্রকে বাড়িয়ে চলেছে, যা ধনী এবং অসহায়ের মধ্যেকার ব্যবধান বাড়িয়ে চলেছে। আজকের দিনে পুনরায় দুই ভারত গড়ে উঠেছে – একটি ভারত ধনীদের দখলে, আরেকটিতে গরীব ভারতীয়দের অধিকার। আজ ভারতের মোট জিডিপি’র ৬০ শতাংশই মোট জনসংখ্যার ১ শতাংশের দখলে চলে গেছে – এই কি সেই স্বপ্নপূরণ যার জন্য আমরা স্বাধীনতার লড়াই করেছিলাম? সারা পৃথিবীর মধ্যে যুব বয়স্ক মানুষ সবচেয়ে বেশি আমাদের দেশে – সেই দেশ তাদের ভবিষ্যৎ সুনিশ্চিত করতে কি পদক্ষেপ নিচ্ছে? আমি সেই নয়া উদারবাদের প্রতি সকলের দৃষ্টি আকর্ষণ করতে চাইব যা আমাদের দেশের জনগণকে দারিদ্র্যের কিনারায় নিয়ে গেছে, আমি সেই সাম্প্রদায়িক মনোভাবের প্রতি সকলের দৃষ্টি আকর্ষণ করতে চাইব যা আজকের ভারতকে ভাঙতে চাইছে, দেশের জনগণের ঐক্যকে বিনষ্ট করে দেশের উজ্জ্বল ভবিষ্যৎের পথে বাধাস্বরুপ হচ্ছে। আজ শুধুই অতীত দিনের রোমন্থন আর যথেষ্ট না, আমরা কি এখনো পরস্পরের প্রতি দোষারোপেই দিনপাত করে চলব? আমাদের সিদ্ধান্ত নিতেই হবে – আমরা সামনের দিকে এগিয়ে যাব নাকি এখনো অতীতের মুখাপেক্ষী হয়েই থাকব? আজকের ভারতে ‘ভারত ছাড়ো’ স্লোগান উত্থাপন করতে হবে সেই সকল ধারণার প্রতি যা আমাদের পশ্চাদপদ করে রাখতে চায়, এছাড়া সামনের দিকে এগোনোর রাস্তা নেই।
আজ যদি অতীত স্মরণে স্বার্থকতা পেতেই হয় তবে একটি গান আমাদের সবার মনে রাখা উচিত বলে আমি মনে করি –
“মন্দির, মসজিদ – গুরুদুয়ারো মে বাঁট দিয়া ভগবান কো
ধরতি বাঁটি, সাগর বাঁটা –
মত বাঁটো ইনসানকো”
মাননীয় অধ্যক্ষ মহাশয়, আমি চাইবো আমাদের ইতিহাসের শিক্ষা এই প্রত্যয়েই স্থিত হোক, আমরা ধর্মনিরপেক্ষ, সাধারণতন্ত্র বিশিষ্ট গণতান্ত্রিক দেশ হিসাবে ভারতকে এগিয়ে নিয়ে যাব এবং অতীতের ভুলকেই পুনরাবৃত্ত করে ভারতকে একটি ‘হিন্দু পাকিস্তান’-এ পরিণত হতে না দেবার শপথ গ্রহণ করব।
ওয়েবডেস্কের পক্ষে অনুবাদঃ সৌভিক ঘোষ