AIKS-1

We Will Not Step Back – AIKS WB State Conference

ওয়েবডেস্ক প্রতিবেদন

সব গ্রামে কৃষক সভা, সব কৃষক কৃষক সভায় – এই স্লোগানকে সামনে রেখে গতকাল থেকে হাওড়া’তে (কমরেড আব্দুর রেজ্জাক মণ্ডল নগর) শুরু হয়েছে কৃষক সভার ৩৭তম রাজ্য সম্মেলন। পশ্চিমবঙ্গের বিভিন্ন জেলা থেকে কৃষক সভার প্রতিনিধিরা গতকাল সকালেই এসেছেন, যোগ দিয়েছেন সম্মেলনের কাজে। হাওড়া ময়দানের শরৎ সদনে (কমরেড হীরেন সাহা মঞ্চ) এই সম্মেলন আয়োজিত হয়েছে।

সম্মেলন শুরু হয় সংগঠনের রক্ত পতাকা উত্তোলন এবং শহীদ বেদিতে শ্রদ্ধার্ঘ নিবেদন করে। কমরেড হান্নান মোল্লা সম্মেলনের অধিবেশনে উদ্বোধনী বক্তব্য রাখেন। সেই বক্তব্যে উঠে এসেছে সারা দেশে কৃষকদের জীবন-যন্ত্রণার কথা, তাদের লড়াই-আন্দলনের কথা। দীর্ঘ এগারো মাস ব্যাপি দেশের রাজধানীর উপকণ্ঠে কৃষকরা আটকে রয়েছেন – মোদী সরকার তাদের দিল্লীতে ঢুকতে দেয় নি, তারা চেয়েছিলেন দিল্লীর রামলীলা ময়দানে নিজেদের সমাবেশ আয়োজন করতে। সরকার রাস্তা কেটে, ব্যারিকেড বসিয়ে, দেওয়াল তুলে অবরোধ করেছে। এই আন্দোলন সম্পর্কে সুপ্রিম কোর্ট প্রশ্ন তুললে সংযুক্ত কিষাণ মোর্চা জানিয়েছে দেশের রাজধানী ঘিরে তারা অবরোধ করেনি – করেছে সরকার নিজেই। আসলে মোদী সরকার কৃষকদের কথা শুনতেই চায় নি, এখন দীর্ঘ আন্দোলনের চাপে তারা নিজেদের সুর নরম করে কোর্টের কাছে হাজির হয়েছে। সারাদেশে ৫০০ টিরও বেশি কৃষক সংগঠন একসাথে মিলে তৈরি হয়েছে সংযুক্ত কিষাণ মোর্চা, এই জোট গড়ে তোলার কাজ শুরু হয়েছিল অনেক আগেই। জোট গড়তে নেতৃত্ব দিয়েছে সারা ভারত কৃষক সভাই। সংযুক্ত কিষাণ মোর্চার লক্ষ্য একটাই – নয়া তিন কৃষি আইন বাতিল না করে তারা পিছু হটবেন না। আমাদের দেশে এমনিতেই সরকারী ন্যুনতম সহায়ক মূল্যের সুবিধা পেতেন মাত্র ১০ শতাংশ কৃষক, নয়া আইনের ফলে সেই সুযোগটুকুও তারা হারাবেন। সারা দেশে বেশিরভাগ জায়গাতেই কৃষক মান্ডী নেই, স্বামীনাথন কমিশনের সুপারিশ ছিল দেশ জুড়ে ২.৫ লক্ষ কৃষকমান্ডী প্রতিষ্ঠার (চাষের জমি থেকে প্রতি ৯ কিলোমিটারের মধ্যে একটি মান্ডী থাকতে হবে, কারন ছোট, মাঝারি কৃষকের পক্ষে বেশি দূরে ফসল নিয়ে গিয়ে বিক্রির সুযোগ নেই)। কমিশনের সুপারিশ ছিল কৃষকের উৎপাদন খরচের ১.৫ গুণ দামই হবে ন্যুনতম সহায়ক মূল্য এবং একইসাথে সরকারকে এককালীন কৃষকদের ঋণ মুকুব ঘোষণা করতে হবে – তবেই দেশের কৃষক এবং কৃষি ব্যাবস্থা বাঁচবে – ২০১৪ সালে ক্ষমতায় আসার আগে বিজেপি প্রতিশ্রুতি দিয়েছিল মোদী ক্ষমতায় এলে তারা সেই সুপারিশ মেনে ঋণ মুকুব করবে এবং ন্যুনতম সহায়ক মূল্যে (খরচের দেড়গুণ হিসাবে) ফসল কিনতে মান্ডী ব্যবস্থার সম্প্রসারন করবে। অথচ ভোটে জিতে তারা সেই কথার খেলাপ করল, কোর্টের সামনে সরকার জানিয়ে দিল ঋণ মুকুব করা হবে না, মান্ডী সম্প্রসারনও কিছুই হয় নি। কৃষকদের সাথে বিশ্বাসঘাতকতা করে এখন সরকার তিনটি নতুন কৃষি আইন নিয়ে এসেছে যাতে দেশের কৃষক নির্ভর কৃষি ব্যাবস্থাটাই ধ্বংস হয়ে যাবে – গোটা ব্যাবস্থাটাকে কর্পোরেটদের হাতে তুলে দিতেই এমন আইন করেছে সরকার। ভারতে তিন দশকেরও বেশি সময় ধরে উদার অর্থনীতির জমানা চলছে – এই সময়কালে চার লক্ষ কৃষক ঋণের বোঝায় আত্মহত্যা করতে বাধ্য হয়েছেন, নতুন আইন এলে কৃষকদের যেটুকু অধিকার রয়েছে তাও চলে যাবে। মোদী সরকারের এই কৃষক মারা নীতির কথা বুঝে গেছেন দেশের কৃষকরা। তারা লড়াই শুরু করেছেন শুধু সরকারের আইন বাতিলের নয় -একইসাথে এই আন্দোলন সারা দেশে কর্পোরেট শক্তির বিরুদ্ধেও – তাই আক্রমনের নিশানায় রয়েছে আদানি, আম্বানির ব্যাবসায়ী গোষ্ঠীও। পাঞ্জাব, হরিয়ানা এবং সংলগ্ন প্রদেশগুলিতে ধনী চাষিদের ঘনত্ব বেশি – নয়া আইনে সবার আগে ক্ষতিগ্রস্থ হবেন তারাই – সেই কারনেই সেখানকার কৃষকরা এই লড়াইতে সবার আগে রাস্তায় নেমেছেন। আমাদের রাজ্যে ছোট, মাঝারি কৃষক বেশি তাদের উপরে এই আঘাত নামবে ধীরে – এখানেই পশ্চিমবঙ্গে কৃষকসভার কাজের গুরুত্ব। এই রাজ্যেও কৃষকদের লড়াই-আন্দোলনকে সংহত করতে হবে আগামির ভয়াবহতা সম্পর্কে তাদের যথাযথরূপে ওয়াকিফহাল করে।

কমরেড হান্নান মোল্লা উল্লেখ করেছেন স্বাধীনতার আগে পরে ভারতে এতবড় কৃষক আন্দোলন কখনো হয় নি, এতগুলি সংগঠন একসাথে মিলে আন্দোলন পরিচালনার কাজও নজীরবিহীন। একইসাথে এই কৃষক আন্দোলন দেশের মানুষের বিভিন্ন দাবিসহ গণতান্ত্রিক আন্দোলন গড়ে তোলার কাজেও রাস্তা দেখাচ্ছে – প্রতিদিন আন্দোলনে দেশের মানুষের বিভিন্ন অংশ যুক্ত হচ্ছেন, শ্রমিক সংগঠনগুলি প্রথম থেকেই এই লড়াইতে পাশে রয়েছে। দেশজুড়ে সফলভাবে পালিত হচ্ছে রেল রোকো, ধর্মঘট। এই প্রথম ভারতে কর্পোরেট বিরোধী আন্দোলন এমন মাত্রায় সংগঠিত হয়েছে -সেই কাজে প্রথম রাস্তায় নেমেছে কৃষকরাই, এমনকি লকডাউনের বিধিনিষেধ অগ্রাহ্য করেই। কারন এই লড়াই তাদের বেঁচে থাকার লড়াই। তিনি বিশেষভাবে উল্লেখ করেছেন এই আন্দোলন নিয়ে ভারতের সংসদে কোন আলোচনা না হলেও অন্যান্য দেশের সংসদে গুরুত্ব সহকারে আলোচনা হয়েছে, নোয়াম চমস্কি উল্লেখ করেছেন ভারতের কৃষক আন্দোলন এখন সারা পৃথিবীর মেহনতি মানুষদের লড়াইতে এক আলোকবর্তিকা। এই রাজ্যেও কৃষকদের নিজেদের অধিকার প্রতিষ্ঠার লড়াই গড়ে তুলতে হবে। সম্মেলনের লক্ষ্য হোক সেই আন্দোলন গড়ে তোলার রূপরেখা নির্ধারণে।

সংগঠনের রাজ্য সম্পাদক কমরেড অমল হালদার প্রতিনিধিদের সামনে সম্মেলনের খসড়া প্রতিবেদন পেশ করেছেন, তিনি উল্লেখ করেছেন এই মুহূর্তে আমাদের রাজ্যের বিভিন্ন জেলায় বন্যা পীড়িত মানুষদের কথা। ছোট চাষি, মাঝারি কৃষক এবং ক্ষেতমজুরেরা বিপর্যস্ত অবস্থায় দিন কাটাচ্ছেন। রাজ্যের সরকার চমকের রাজনীতিতে জনগণকে ভুলিয়ে রাখতে চাইছে – গত দশ বছরে পশ্চিমবঙ্গে ২২০ জন কৃষক আত্মহত্যা করেছেন, অথচ সরকার সেই তথ্য স্বীকার করছে না। বন্যা পীড়িত জেলাগুলিতে সম্মেলনের কাজে কৃষকরা এসেছেন – প্রয়োজনে সাঁতার কেটে এসেছেন, কিন্তু তাদের সবার মুখে মনের কথা স্পষ্ট বোঝা যাচ্ছে নিজেদের লড়াইকে শাণিত করতে যেকোনো বাধা পেরোতে তারা প্রস্তুত। এই মনোভাবকেই সংহত করতে হবে, কৃষকসভার রাজ্য সম্মেলন হয়ে উঠুক আগামী দিনে রাজ্যে মেহনতি মানুষের লড়াই – আন্দোলন গড়ে তোলার প্রথম ধাপ।

Spread the word

Leave a Reply