UCC and India :Pervej Rahaman

৭ আগস্ট ২০২৩ সোমবার

দ্বিতীয় পর্ব

স্বাধীনতা পরবর্তী সময় ও দেওয়ানি বিধি


সংবিধানের চতুর্থ অংশে রাষ্ট্রীয় নীতির নির্দেশমূলক নীতির রূপরেখা দেওয়া হয়েছে, যেগুলি আইনের আদালতে প্রয়োগযোগ্য বা ন্যায়সঙ্গত না হলেও দেশের শাসনের জন্য মৌলিক। সংবিধানের রাষ্ট্রীয় নীতির নির্দেশমূলক নীতিগুলির অন্তর্গত অনুচ্ছেদ 44 অনুযায়ী ভারতের সমগ্র অঞ্চল জুড়ে নাগরিকদের জন্য একটি অভিন্ন নাগরিক কোড সুরক্ষিত করার চেষ্টা করবে। কিন্তু স্বাধীনতার পর থেকে সরকারগুলি ভারতের বৈচিত্র্যকে সম্মান করার জন্য সকল নিজ নিজ ধর্ম-ভিত্তিক নাগরিক কোডের অনুমতি বজায় রেখেছে ।
সংবিধানের প্রণেতারা অনুচ্ছেদ 44-এ “ইউনিফর্ম” শব্দটি ব্যবহার করেছেন এবং “সাধারণ” নয়, কারণ “সাধারণ” মানে “সকল পরিস্থিতিতে এক এবং একই”, যখন “ইউনিফর্ম” মানে “অনুরূপ পরিস্থিতিতে একই” ।
বিভিন্ন মানুষের বিভিন্ন আইন থাকতে পারে, কিন্তু একটি নির্দিষ্ট গোষ্ঠীর মধ্যে আইনটি অভিন্ন হওয়া উচিত। সংবিধানের অনুচ্ছেদ 14 এর অধীনে সমতার অধিকারের অধীনেও এই ধরনের শ্রেণীবিভাগ অনুমোদিত হয়েছে ।
স্বাধীন ভারতবর্ষে প্রচলিত কয়েকটি ব্যক্তিগত আইন –
The Converts’ Marriage Dissolution Act, enacted during 1866
The Indian Divorce Act, enacted in 1869
The Indian Christian Marriage Act, enacted during 1872
The Kazis Act, enacted during 1880
The Anand Marriage Act, enacted in 1909 (For Sikhs)
The Indian Succession Act, enacted during 1925
The Child Marriage Restraint Act, enacted in 1929
The Parsi Marriage and Divorce Act, enacted in 1936
The Dissolution of Muslim Marriage Act, enacted during 1939
The Special Marriage Act, enacted during 1954
The Hindu Marriage Act, enacted during 1955
Hindu Adoption and Maintenance Act, 1956.
The Foreign Marriage Act, enacted in 1969 and
The Muslim Women (Protection of Rights on Divorce) Act, enacted in 1986
হিন্দু ব্যক্তিগত আইন চারটি বিলে লিপিবদ্ধ আছে: হিন্দু বিবাহ আইন, হিন্দু উত্তরাধিকার আইন, হিন্দু সংখ্যালঘু এবং অভিভাবকত্ব আইন, এবং হিন্দু দত্তক ও রক্ষণাবেক্ষণ আইন। এই আইনে ‘হিন্দু’ শব্দটি শিখ, জৈন এবং বৌদ্ধদেরও অন্তর্ভুক্ত করেছে । আবার Anand Marriage Act 1909 এর মাধ্যমে শিখ সম্প্রদায়ের জন্য আলাদাভাবে বিবাহ পদ্ধতি চালু আছে |
ব্রিটিশদের দ্বারা প্রণীত 1939 সালের আইন বলে, যে, মুসলমানরা তাদের ব্যক্তিগত আইন (অর্থাৎ, শরিয়ত) দ্বারা পরিচালিত হবে। শরিয়ত মুসলিমদেরকে ইসলামিক রীতি অনুযায়ী তাদের আচার-অনুষ্ঠান অনুসরণ করার অনুমতি দেয়, বিয়ে, তালাক, সন্তানের হেফাজত বা উত্তরাধিকার – এইসব ক্ষেত্রে |
হিন্দুরা যদিও ব্যক্তিগত আইনের কিছু বিধি মেনে চলে – তাহলেও তারা বিভিন্ন রাজ্যে তাদের বিভিন্ন জনগোষ্ঠীর ভিন্ন ভিন্ন আচরণ-রীতিনীতিকে স্বীকৃতি দেয়। মুসলিম ব্যক্তিগত আইনও সর্বক্ষেত্রে একই রকম নয়। যেমন সুন্নি বোহরা মুসলিমদের অনেকে উত্তরাধিকারের ক্ষেত্রে হিন্দু আইনের নীতিগুলো অনুসরণ করেন।
হিন্দু ধর্মের দেওয়ানি বিধিতেও সমানতা নেই |1955 সালের হিন্দু বিবাহ আইনে ঘনিষ্ঠ আত্মীয়দের মধ্যে বিয়ে নিষিদ্ধ হলেও দক্ষিন ভারতে একে শুভ বলে মনে করা হয় এবং এর প্রচলন আছে । এমনকি 1956 সালের হিন্দু উত্তরাধিকার আইনটিতে কন্যা সন্তানের সম্পত্তিতে কোনও অংশীদারিত্ব ছিল না 2005 সাল পর্যন্ত । স্ত্রীরা এখনও ভাগিদার নয় বা তাদের উত্তরাধিকারের সমান অংশ নেই।
একইভাবে, মুসলিম ব্যক্তিগত আইন বা 1937 সালে পাস করা শরীয়ত আইনের ক্ষেত্রেও কোন অভিন্ন প্রযোজ্যতা নেই। উদাহরণস্বরূপ, শরীয়ত আইন জম্মু ও কাশ্মীরে প্রযোজ্য নয় । সেখানকার মুসলমানরা তাদের প্রথাগত আইন দ্বারা নিয়ন্ত্রিত হয় । দেশের বাকি অংশে মুসলিম ব্যক্তিগত আইনের মধ্যেও তারতম্য আছে । মুসলমানদের নির্দিষ্ট সম্প্রদায়ের জন্য প্রযোজ্যতাও পরিবর্তিত হয়।
এছাড়া দেশের অনেক উপজাতি গোষ্ঠী তাদের ধর্ম নির্বিশেষে তাদের নিজস্ব প্রচলিত আইন মেনে চলে | উত্তর-পূর্বে, 200 টিরও বেশি উপজাতি রয়েছে যার নিজস্ব বৈচিত্র্যময় প্রথাগত আইন রয়েছে। সংবিধান নিজেই নাগাল্যান্ডের স্থানীয় রীতিনীতিকে রক্ষা করে। অনুরূপ সুরক্ষা মেঘালয় এবং মিজোরামও উপভোগ করে।
1960-এর দশকের গোড়ার দিকে যখন গোয়া, দমন এবং দিউ পর্তুগিজ শাসন থেকে মুক্ত হয়, তখন একটি সংসদীয় আইন সেই অঞ্চলগুলিতে 1867 সালের পর্তুগিজ সিভিল কোডের অব্যাহত প্রয়োগের ব্যবস্থা করেছিল। যদিও সেখানে হিন্দুদের জন্য একটি আইন (“The Gentile Hindu Customs and Usages Code.”) আছে যাতে দুই স্ত্রী রাখার অধিকার সংরক্ষিত আছে। যদিও সেখানে হিন্দুদের জন্য একটি পৃথক আইন আছে | যাতে হিন্দু পুরুষকে দ্বিতীয় বিবাহ করার অনুমতি দেওয়া হয়েছে একটি বিশেষ ক্ষেত্রে | যদি স্ত্রীর 25 বছর বয়সের মধ্যে কোনও সন্তানের জন্ম দিতে না পারেন বা 30 বছির বয়স পর্যন্ত কোনও পুত্রসন্তাসন জন্ম দিতে না পারেন, তাহলে সেই হিন্দু মানুষ আবার বিয়ে করতে পারে | এটিও একটি বিশেষ ব্যতিক্রম | এতেও নারীর সমানাধিকার ক্ষুন্ন হচ্ছে |
একইভাবে, পুদুচেরিতে, রেনোনক্যান্টস (ভারতীয় যাদের পূর্বপুরুষরা ফরাসি শাসনের সময় ব্যক্তিগত আইন পরিত্যাগ করেছিল) নামে পরিচিত নাগরিকদের একটি বড় অংশ এখনও 218 বছরের পুরানো ফরাসি সিভিল কোড 1804 দ্বারা পরিচালিত হয় ।

অভিন্ন দেওয়ানি বিধির সাংবিধানিক বাধ্যবাধকতা


একটা কথাকে খুব বেশি করে চালিয়ে দেওয়া হয়েছে যে, সংবিধানের রাষ্ট্রীয় নীতির নির্দেশমূলক নীতি (Directive Principles of State Policy) র অন্তর্গত 44 নম্বর ধারায় অভিন্ন দেওয়ানি বিধির উল্লেখ আছে । এবং এই অভিন্ন দেওয়ানি বিধি চালু করা না হলে তা সংবিধানকে অবমাননা করা হবে |
সংবিধানের 44 অনুচ্ছেদ বলা হয়েছে, “রাষ্ট্র নাগরিকদের জন্য অভিন্ন নাগরিক আইন সুরক্ষিত করার চেষ্টা করবে ভারতের ভূখণ্ড জুড়ে ।”
ঠিক এর আগের 43 নং অনুচ্ছেদে উল্লেখ আছে যে, “সমস্ত শ্রমিক, কৃষি, শিল্প বা অন্যথায় কাজ করা শ্রমিকদের জন্য জীবিকার মজুরি, কাজের শর্তগুলির একটি শালীন মান ইত্যাদি, রাষ্ট্র উপযুক্ত আইন বা অর্থনৈতিক সংস্থার মাধ্যমে বা অন্য কোনো উপায়ে নিশ্চিত করার চেষ্টা করবে। এবং তাদের জীবন, অবসর এবং সামাজিক ও সাংস্কৃতিক সুযোগের পূর্ণ উপভোগকে নিশ্চিত করতে রাষ্ট্র গ্রামীণ এলাকায় ব্যক্তিগত বা সমবায় ভিত্তিতে কুটির শিল্পের উন্নয়নের জন্য প্রচেষ্টা চালাবে। এটাও আইনের সমানতার কথা বলে । যেখানে শ্রমজীবী মানুষের জন্য সারা দেশে একই ধরণের আইন তৈরী করার কথা বলা আছে । এই ব্যবস্থা চালু করার কোনও উদ্যোগ তো ছেড়ে দিন । এর বিন্দুমাত্র উল্লেখও কেউ করে না । সংবিধানের 43 নং অনুচ্ছেদে উল্লেখ করা হয়েছে যে “রাস্ট্র উপযুক্ত আইন প্রণয়নের মাধ্যমে প্রচেষ্টা চালাবে”, কিন্তু 44 অনুচ্ছেদে “উপযুক্ত আইন প্রণয়নের মাধ্যমে” বাক্যাংশটি অনুপস্থিত। কিন্তু আলোচনা হবে অনুচ্ছেদ 44 কে নিয়ে , অনুচ্ছেদ 43 নিয়ে নয় |


আবার, সংবিধানের ৩৯ নং ধারায় রাজ্যগুলির জন্য অবশ্য পালনীয় নীতি হিসাবে উল্লেখ রয়েছে- বিবিধ প্রশ্নে সুনির্দিষ্ট অধিকারসমূহকে সুরক্ষিত রাখতে রাজ্যগুলীকে যে সকল নীতি প্রণয়ন করতে হবে-
ক) জীবন-জীবিকার উপযুক্ত উপায়গুলিতে নারী – পুরুষ নির্বিশেষে সকল নাগরিকের অধিকার সমান।
খ) সামাজিক সম্প্রদায়ের যৌথ সম্পত্তির অধিকারটি সকলের জন্য এমনভাবেই সুষমবণ্টিত হবে যাতে সার্বিক উন্নয়ন সুনিশ্চিত হয়।
গ) সর্বসাধারণের স্বার্থ ক্ষুণ্ণ করে কতিপয়ের হাতে সম্পদ ও উৎপাদনের উপকরনসমূহকে কেন্দ্রিভুতকরণের উদ্দেশ্যে অর্থনৈতিক কর্মকাণ্ড পরিচালিত হবে না।
ঘ) সম পরিমান কাজে নারী – পুরুষের বেতন সমান হবে।
ঙ) অর্থনৈতিক দূরবস্থার তাগিদে গুরুতর স্বাস্থ্যহানী হতে পারে এমন কাজে নারী – পুরুষ, কম বয়সী শিশুদের নিযুক্ত হতে বাধ্য করা যাবে না।
চ) শিশুদের সার্বিক বিকাশের জন্য প্রয়োজনীয় সুযোগ-সুবিধা দেওয়ার কাজটি সুচারুভাবে লভ্য হতে হবে। তাদের প্রাপ্য মর্যাদা ও স্বাধীনতা খর্ব হলে চলবে না। অপ্রাপ্তবয়স্ক ও যুববয়সী সকল নাগরিককে শোষণের থেকে সুরক্ষিত রেখেই তাদের নৈতিক ও বৈষয়িক প্রাপ্যসমুহকে নিশ্চিত করতে হবে।

সংবিধানের ৩৭ নং অনুচ্ছেদে স্পষ্ট ভাবে বলা হয়েছে যে, নির্দেশক নীতিগুলি কোনও আদালত কর্তৃক প্রয়োগযোগ্য নয়, তবে একই সাথে উল্লেখ করা হয়েছে যে এগুলি দেশ পরিচালনার ক্ষেত্রে মৌলিক এবং আইন প্রণয়নে এই নীতিগুলি প্রয়োগ করা রাষ্ট্রের কর্তব্য হবে।
এগুলো দেখলেই বোঝা যায় যে সংবিধানের নির্দেশমূলক নীতির ছত্রে ছত্রে দেশের সকল নাগরিকদের সামাজিক, অর্থনৈতিক দিক থেকে সমতা বিধানের কথা বলা হয়েছে | কিন্তু স্বাধীনতার 75 বছর পার করেও কোনও সরকারই এ নিয়ে কোনও রা কাটেন না | বরং দেশের কিছু সম্পদশালী মানুষ, বৃহৎ ব্যবসায়ী, শিল্প মালিকের মুনাফার দিক আরও সহজ করার লক্ষ্যে ভুরি ভুরি আইন তৈরী ও লাগু করা হয়েছে | বঞ্চিত হয়েছে সাধারণ নাগরিকদের সংবিধান স্বীকৃত অধিকার | অর্থ্যাৎ অভিন্ন দেওয়ানি বিধির কথার পেছনে সংবিধানের বাধ্যবাধকতা নয় ধুয়ো তোলার পিছনেও নির্দিষ্ট লক্ষ্য আছে ।

সম্পূর্ণ প্রতিবেদনটি ৬ টি পর্বে প্রকাশিত

Spread the word

Leave a Reply