UCC and India :Parvej Rahaman


৭ আগস্ট ২০২৩ সোমবার

প্রথম পর্ব

প্রাথমিক কথা


অভিন্ন দেওয়ানি বিধি-UNIFORM CIVIL CODE শব্দ গুলি শুনলেই যে কথাটা বেশিরভাগ মানুষের মনে ভেসে ওঠে তা হল – ভারবর্ষে মুসলমানেরা ভারতের সংবিধানের আইনের আওতায় নেই, ভারতবর্ষের মুসলমানদের জন্য দেশে আলাদা আইন আছে । ফলে মুসলমানদের প্রতি একটা অদ্ভুত দৃষ্টিভঙ্গি তৈরী হয় অন্যান্য ধর্মাবলম্বী মানুষের মনে । এমন ভাবে দেশের কিছু রাজনৈতিক দল এই কথাকে প্রচার করে যে মানুষের মনের সন্দেহ আরও বেড়ে যায় । এর সত্যতা কতটা? এর বাস্তবতা আছে কি? সত্যিই কি এদেশে মুসলমানদের জন্য আলাদা আইন আছে? এই বিষয় নিয়ে তাই খোলামেলা চর্চা খুবই জরুরি হয়ে পড়েছে ।
ভারতবর্ষ বিভিন্ন জাতির সংস্কৃতির সংমিশ্রণ | এদেশ বহু ধর্ম, জাতি, গোষ্ঠীর মানুষের সমন্বয়ে গঠিত, যারা তাদের নিজস্ব বিশ্বাস, ধর্ম, রীতিনীতি এবং ঐতিহ্য অনুসরণ করে। ‘ইউনিফর্ম সিভিল কোড’, একবার উচ্চারণ করা হলে চারিদিকে এক অদ্ভুত পরিস্থিতির উদ্ভব হয় |এই ইস্যুটির অনেকগুলি দিক রয়েছে প্রধানত কয়েকটি, রাজনৈতিক, সামাজিক বা ধর্মীয়। রাজনৈতিকভাবে দেশ দুটি ভাগে বিভক্ত, একদিকে বিজেপি এবং আরএসএস, যারা ইউনিফর্ম সিভিল কোডের পক্ষে জোরালো ভাবে লড়াই করছে এবং অন্যদিকে অন্যান্যরা এর প্রয়োগের বাস্তবতা নিয়ে সন্দেহ প্রকাশ করছে এবং আশংকা করছে যে, এর সমাজকে প্রস্তুত না করে এর প্রয়োগ করতে গেলে অস্থিরতা বৃদ্ধি পাবে । সামাজিকভাবে, সাধারণ জনগণ যারা খুব গভীরতা নিয়ে ভাবনা চিন্তা করে না, সাধারণভাবে বিভিন্ন মাধ্যমের দ্বারা প্রভাবিত হয় এবং নিজের মতামত প্রকাশ করে বা নিজের অবস্থান ঠিক করে, তারা ভারতের বৈচিত্র্যময় রাষ্ট্রব্যবস্থার এই বিষয়টি নিয়ে দোলাচলে পড়ে যায় । ধর্মীয়ভাবে, সংখ্যাগরিষ্ঠ হিন্দু এবং মুসলিম অধ্যুষিত সংখ্যালঘুদের মধ্যে বিভাজন তৈরী হওয়ার মতো অবস্থা হয়ে যায় ।
আন্তর্জাতিক ক্ষত্রের মতোই আমাদের দেশেও আইন সাধারণভাবে দু প্রকার – ফৌজদারি (CRIMINAL) এবং দেওয়ানি (CIVIL) বা পারিবারিক বা ব্যক্তিগত আইন । দেশের ফৌজদারি আইন প্রধানত দেশের IPC, CrPC, EVIDENACE ACT দ্বারা নিয়ন্ত্রিত হয় | এর আওতায় জাতি, ধর্ম, বর্ণ, লিঙ্গ নির্বিশেষে দেশের সমস্ত নাগরিক আছে । অপরাধমূলক কাজ করলে জাতি, বর্ণ, ধর্ম, লিঙ্গ, সম্প্রদায়, গোষ্ঠী – সবার জন্যই একই ফৌজদারি আইন প্রযোজ্য হয় এবং সেই আইনের আওতায় সবার বিচার এবং সাজা হয় ।
ভিন্নতা দেখা যায় ব্যক্তিগত আইনে ।
ব্যক্তিগত আইন বা পারিবারিক আইন ভারতীয় নাগরিকদের বিবাহ, বিবাহবিচ্ছেদ, রক্ষণাবেক্ষণ, উত্তরাধিকার প্রভৃতির মত ব্যক্তিগত ক্ষেত্রের বিষয় বা ক্ষেত্রগুলিকে নিয়ন্ত্রণ করে । এই আইনগুলি মূলত বিভিন্ন সম্প্রদায়ের বা গোষ্ঠীর ধর্মীয়, সংস্কৃতিক রীতিনীতি দ্বারা প্রভাবিত । হিন্দুদের যেমন পৃথক পারিবারিক / ব্যক্তিগত আইন আছে; ঠিক তেমনই মুসলিম, খ্রিস্টান, পার্সি, ইহুদি এবং অন্যান্যদেরও নিজেদের ব্যক্তিগত আইন আছে । আবার দেশের বিভিন্ন অঞ্চলের অধিবাসীদেরও (ST) নিজস্ব পারিবারিক আইন আছে ।
আবার এদেশে এর সাথে সাথে ব্রিটিশ, পর্তুগিজ এবং ফরাসিদের দ্বারা শাসিত অতীতের কলোনিগুলোতে ব্রিটিশ, পর্তুগিজ এবং ফরাসিদের আইনগত ঐতিহ্যের কিছু অংশ আজও কার্যকর আছে ।

উৎপত্তি


ভারতবর্ষে পৃথক ব্যক্তিগত আইনের উৎপত্তি সংক্রান্ত প্রশ্ন বহু পুরানো । মুঘল আমলেও বিভিন্ন ধর্মীয় গোষ্ঠী, জাতির নিজস্ব নিজস্ব পারিবারিক আইন ছিল | মুঘল সম্রাটরা মুসলমান ছাড়া অন্য কোনও ধর্মীয় গোষ্ঠী, জাতির পারিবারিক আইনে কোনও পরিবর্তন করেনি | মুঘলদের আমল থেকে চলে আসা এই নীতিকে সামনে রেখে ওয়ারেন হেস্টিং 1772 সালে ব্রিটিশ ভারতবর্ষে তার “ব্যক্তিগত আইন” নীতি চালু করেন । এই নীতি মুঘল আমলের মতোই হিন্দু ও মুসলমানদের জন্য পৃথক ব্যক্তিগত আইনকে স্বীকৃতি দিয়েছে । যদিও তখনও দেশের নাগরিকদের জন্য কোনও সাধারণ ফৌজদারি আইনও তৈরী হয়নি । চিরাচরিত চলে আসা নিয়মেই তখন এদেশের নাগরিকদের বিচার হত । ঔপনিবেশিক ভারতে ব্রিটিশ সরকার 1840 সালে লেক্স লোকি রিপোর্টার ভিত্তিতে অপরাধ, প্রমাণ এবং চুক্তি সংক্রান্ত ভারতীয় আইনের কোডিফিকেশনে অভিন্নতার প্রয়োজনীয়তার উপর জোর দেয় । এই রিপোর্টও বিশেষভাবে সুপারিশ করে যে হিন্দু-মুসলমানদের ব্যক্তিগত আইনগুলি এই ধরনের কোডিকেশনের বাইরে রাখা হবে ।
1859 সালের রানীর ঘোষণাতে বলা হয় যে, ধর্মীয় বিষয়ে কোনও ভাবেই হস্তক্ষেপ করা হবে না ।
তাই যখন ফৌজদারি আইনগুলি সংহিতাবদ্ধ হয়েছিল এবং সমগ্র দেশের সকল নাগরিকদের জন্য সাধারণ হয়ে উঠেছে, তখন ব্যক্তিগত আইনগুলি বিভিন্ন সম্প্রদায়ের জন্য তাদের নিজস্ব পৃথক কোড দ্বারা নিয়ন্ত্রিত হতে থাকে।
ব্রিটিশ প্রশাসকদের একটি বড় অংশ ব্রিটেনের হাউস অফ কমন্সে এর বিরোধিতা করেছিল। যদিও ইন্দোলজিস্ট, মুক্তিযোদ্ধা এবং কিছু বুদ্ধিজীবী ‘দেশীয় আইন’-এর পক্ষে লড়াই করেছিলেন এবং ব্যক্তিগত আইনে সাধারণ আইনের প্রয়োগ সম্পূর্ণ রোধ করেছিলেন। এর পরবর্তীতে হিন্দু পারিবারিক আইন, মুসলিম পারিবারিক আইন, খ্রিস্টান পারিবারিক আইন, পার্সি পারিবারিক আইন এবং অন্যান্য ব্যক্তিগত আইনগুলিকে ‘সংরক্ষিত’ এবং ‘সংহিতাবদ্ধ’ করা হয়েছে ।

সংবিধানের গণপরিষদ ও অভিন্ন দেওয়ানি বিধি


সংবিধানের গণপরিষদে অভিন্ন দেওয়ানি বিধি নিয়ে বিতর্ক শুরু হয় কমিটির পর্যায়ে ভারতীয় সংবিধান তৈরির প্রক্রিয়ার সময় থেকে । অভিন্ন দেওয়ানি বিধির ধারাটি নিয়ে গণপরিষদে যথেষ্ট বিতর্ক হয়েছিল , যে এটিকে কি হিসাবে সংবিধানে অন্তর্ভুক্ত করা হবে? মৌলিক অধিকার না নির্দেশমূলক নীতি?
মৌলিক অধিকার বিষয়ক উপ-কমিটিকে (Advisory Committee on Fundamental Rights) ভারতের সংবিধানে অন্তর্ভুক্ত করার জন্য মৌলিক অধিকারের একটি তালিকা তৈরি করার দায়িত্ব অর্পণ করা হয়েছিল । এই কমিটির সভাপতি ছিলেন সর্দার বল্লভ ভাই প্যাটেল | কয়েক দফা বৈঠকের পর, উপ-কমিটি মৌলিক অধিকারের তালিকা সহ – দুটি ভাগে বিভক্ত করে একটি তালিকা তৈরী করে তার মূল কমিটি-উপদেষ্টা কমিটির কাছে রিপোর্ট হিসাবে পেশ করে | অভিন্ন দেওয়ানি বিধি বা Uniform Civil Code দ্বিতীয় অংশে লিপিবদ্ধ হয় অ-ন্যায়বিচারযোগ্য মৌলিক অধিকার হিসাবে । উপ-কমিটির সকল সদস্য এই সিদ্ধান্তের সাথে একমত হননি | বিষয়টি ভোটের মাধ্যমে নিষ্পত্তি করতে হয়েছিল; 5:4 সংখ্যাগরিষ্ঠতার সাথে সর্দার বল্লভভাই প্যাটেলের নেতৃত্বে মৌলিক অধিকার সংক্রান্ত সাব-কমিটি সিদ্ধান্ত নিয়েছিল যে একটি অভিন্ন দেওয়ানি বিধি (UCC) সুরক্ষিত করা মৌলিক অধিকারের সুযোগের মধ্যে পড়ে না । এই প্রতিবেদনে ভিন্নমত নোট দিয়েছিলেন ওই কমিটির তিন সদস্য – এম আর মাসানি, হংস মেহতা এবং অমৃত কৌর | তাদের মতে অভিন্ন দেওয়ানি বিধিকে আগামী 5 -10 বছরের মধ্যে লাগু করা উচিত বলে |


1948 সালের 4 নভেম্বর আম্বেদকর খসড়া সংবিধান পেশ করেন আলোচনার জন্য গণপরিষদে। সেই খসড়া সংবিধানে অভিন্ন দেওয়ানি বিধির বিধান খসড়া অনুচ্ছেদ 35 হিসাবে রাষ্ট্রীয় নীতির নির্দেশমূলক নীতিতে (যা আদালত দ্বারা প্রয়োগযোগ্য নয়) স্থান পায়। 1948 সালের 23শে নভেম্বর গণপরিষদ আলোচনার জন্য এই বিষয়টি উপস্থাপিত করা হয় | । এই বিষয়ে বিতর্ক শুরু হলে ইসমাইল সাহেব, নাজিরুদ্দিন আহমদ, পোকার সাহেব বাহাদুর, কে.এম. মুন্সি, আল্লাদি কৃষ্ণস্বামী এবং আম্বেদকর এই বিতর্কে অংশগ্রহণ করেন | আম্বেদকর এই বিতর্কে অংশগ্রহণ করে বলেন, “এক্ষেত্রে ইউনিফর্ম সিভিল সম্পর্কে নতুন কোনও কোড কিছু ছিল না | বিবাহ, উত্তরাধিকার ক্ষেত্রগুলি ব্যতীত দেশে ইতিমধ্যে একটি অভিন্ন দেওয়ানি বিধি বিদ্যমান আছে | এই দুটি ক্ষেত্রই এর লক্ষ্য|” তিনি গণপরিষদকে স্মরণ করিয়ে দিয়ে বলেছিলেন যে অভিন্ন নাগরিক কোড শুধুমাত্র ঐচ্ছিক। এটি নির্দেশমূলক নীতিমালায় থাকার কারণে, রাষ্ট্র অবিলম্বে এই বিষয়ে আইন আনতে বাধ্য নয় | এটি যে কোনও সময় কার্যকর করা যেতে পারে | তিনি বলেছিলেন যে অনুচ্ছেদটি “কেবল” প্রস্তাব করেছে যে রাষ্ট্র একটি অভিন্ন দেওয়ানি বিধি প্রচলন করার চেষ্টা করবে, যার অর্থ এটি সমস্ত নাগরিকের উপর চাপিয়ে দেবে না। আম্বেদকর আরোও উল্লেখ করেছিলেন যে, মুসলিমদের ব্যক্তিগত আইন শরিয়ত প্রয়োগ আইন ১৯৩৭ চালু হওয়ার আগে দেশের অনেক অংশে মুসলমানরা এদেশের হিন্দু আইন মোতাবেক চলতেন । এমনকি দক্ষিণ ভারতীয় রাজ্যগুলিতে “মারুমুককাটায়াম” ব্যবস্থা দ্বারা উত্তরাধিকার ব্যবস্থাও অনেক মুসলমানের মধ্যে প্রচলিত আছে । প্রস্তাবিত প্রাথমিক সংশোধনীর প্রতিক্রিয়া বিতর্কে আম্বেদকর যুক্তি দেন যে, এই বিধানটি ভবিষ্যতের আইনসভাগুলিকে এমন আইন প্রণয়নের অনুমতি দেয় তখন, যখন তা সংশ্লিষ্ট সম্প্রদায়ের সম্মতি পাবে ৷


এরপর খসড়া ধারা ৩৫ সম্পর্কে ভোট নেওয়া হয় । গণপরিষদ অনুচ্ছেদটি গ্রহণ করে | যা পরে ভারতের সংবিধানের ৪৪ অনুচ্ছেদ হিসাবে পুনরায় সংখ্যায়িত হয় । এবং এই ধারাটি এভাবে সংবিধানে যুক্ত হয়, “ ভারতের ভূখণ্ড জুড়ে রাষ্ট্র নাগরিকদের জন্য অভিন্ন নাগরিক আইন সুরক্ষিত করার চেষ্টা করবে |”
স্বাধীনতা-পরবর্তী, ব্যক্তিগত আইনগুলি সংবিধানের যুগ্ম তালিকায় অন্তর্ভুক্ত ছিল (এন্ট্রি নং ৫) যার অর্থ সংসদ এবং রাজ্য আইনসভা – উভয়েরই এই বিষয়ে আইন প্রণয়নের ক্ষমতা রয়েছে। যদিও একবার একটি আইন সংসদে তৈরী হয়ে গেলে, রাজ্যগুলির সেই ক্ষেত্রে আইন প্রণয়নের খুব বেশি স্বাধীনতা থাকে না। সংবিধানের অনুচ্ছেদ ২৫৪ এর অধীনে এই ধরনের আইনের জন্য রাষ্ট্রপতির সম্মতি প্রয়োজন হয় । ফলে এই আইন তৈরির ক্ষেত্রে প্রধানত কেন্দ্র সরকারেরই ক্ষমতা আছে |
“সিভিল” মানে এমন বিষয় যেখানে ব্যক্তিগত অধিকার যেখানে জনসাধারণের অধিকার নেই | যেমন একটি চুক্তি, বা পণ্য / পরিষেবা বা সম্পত্তির বিক্রয় এবং ক্রয়ের ক্ষেত্রে থাকে ।
এমনকি “কোড”ও প্রতিটি পরিস্থিতিতে একটি একক আইন মানে না। এর অর্থ হতে পারে ভারতীয় দণ্ডবিধির মতো একটি আইন বা হিন্দু কোড বিল যা তিনটি ভিন্ন আইনকে অন্তর্ভুক্ত করে।
যদিও UCC-এর জন্য এখনও কোনও খসড়া বা মডেল নথি নেই । সংবিধানের প্রণেতারা কল্পনা করেছিলেন যে এটি এমন একটি অভিন্ন আইন হবে যা বিবাহ, বিবাহবিচ্ছেদ, দত্তক গ্রহণ এবং এর মতো বিষয়গুলির ক্ষেত্রে প্রতিটি ধর্মের / গোষ্ঠীর স্বতন্ত্র ব্যক্তিগত আইন গুলিকে প্রতিস্থাপন করবে।

সম্পূর্ণ প্রতিবেদনটি ৬ টি পর্বে প্রকাশিত

Spread the word