কুৎসার আড়ালে প্রকৃত সত্য (নন্দীগ্রাম সন্ত্রাস ) – অর্ণব ভট্টাচার্য

নন্দীগ্রাম: ষড়যন্ত্র আর সন্ত্রাসের ল্যাবরেটরি

সপ্তম বামফ্রন্ট সরকার পশ্চিমবঙ্গে বৃহৎ শিল্প এবং তার অনুসারী কল-কারখানা গুলির মাধ্যমে ব্যাপক কর্মসংস্থান সৃষ্টির যে পরিকল্পনা করেছিল তারই অঙ্গ হিসেবে পেট্রোকেমিক্যাল শিল্পকে আরও বিকশিত করে এরাজ্যে কেমিক্যাল হাব তৈরির প্রয়াস গ্রহণ করা হয়।২০০৫ সালে  প্রথম ভারত সরকার কেমিক্যাল হাব  সম্পর্কে সুনির্দিষ্ট ধারণা হাজির করে। প্রথমে এগুলিকে মেগা কেমিক্যাল ইন্ডাস্ট্রিয়াল এস্টেট(MCIE) বলা হত। পরবর্তীকালে এই নাম পরিবর্তন করে বলা হয় পেট্রোলিয়াম, কেমিক্যালস এন্ড  পেট্রোকেমিক্যালস ইনভেস্টমেন্ট রিজিওন(PCPIR)। এই ধরণের শিল্পাঞ্চলে পেট্রোলিয়াম এবং রাসায়নিক পণ্য উৎপাদন এবং তা রপ্তানি করার জন্য বিভিন্ন শিল্প গড়ে তোলা হয়।কেমিক্যাল হাব মানে হলদিয়া পেট্রোকেমিক‍্যালের মাপে আরও সাত-আটটি কারখানা। প্লাস্টিক, পলিয়েস্টার, রেজিন, রাবার, ঔষধি, উন্নত সুগন্ধী, আর্টিফিশিয়াল লেদার, অ্যাডেসিভ এর মত বিভিন্ন পণ্য উৎপাদন। প্রত‍্যেকটি শিল্পের জন্য অসংখ্য অনুসারী কারখানা। আবার এর অববাহিকায় ছোট বড় প্রচুর কারখানা। বিরাট কর্মসংস্থানের সুযোগ। স্বাভাবিক ভাবেই কেমিক্যাল হাব গড়বার জন্য সপ্তম বামফ্রন্ট সরকার উদ্যোগী হয়।

হলদিয়া শিল্পাঞ্চলে ইতিমধ্যেই ইন্ডিয়ান অয়েল কর্পোরেশন, হলদিয়া পেট্রোকেমিক্যালস ও মিৎসুবিশি পেট্রোকেমিক্যালস এর মত বৃহৎ পেট্রোকেমিক্যালস কোম্পানির নিজস্ব কারখানা ছিল। কিন্তু কেমিক্যাল হাব তৈরির জন্য বাড়তি আরো জমি অধিগ্রহণের প্রয়োজন হয়ে পরে। হলদিয়া শিল্পাঞ্চলের মধ্যে আর কোন বাড়তি জায়গা না থাকায় ২০০৬ সালে হলদি নদীর তীরে  নন্দীগ্রামে রাসায়নিক শিল্প তালুক বা কেমিকাল হাব গড়ে তোলার পরিকল্পনা গ্রহণ করে রাজ্য সরকার।ইতিমধ্যেই হলদিয়াতে যে পেট্রোকেমিক্যাল শিল্প গড়ে উঠেছিল তাকে কেন্দ্র করে কয়েক শত অনুসারী শিল্প হয়েছিল যেখানে লক্ষাধিক কর্মসংস্থান হয়। নন্দীগ্রামে কেমিক্যাল হাব হলে এরাজ্য যে দেশের শিল্প মানচিত্রে একটি গুরুত্বপূর্ণ স্থান অধিকার করত,বিপুল সংখ্যক কাজের সুযোগ তৈরি হত তা নিয়ে কোন সন্দেহ নেই। কিন্তু সপ্তম বামফ্রন্ট সরকারের শিল্পায়নের কর্মসূচী বানচাল করার জন্য পশ্চিমবঙ্গে বামবিরোধীদের যে রামধনু জোট হয়েছিল তা নন্দীগ্রামে এক ভয়ংকর ধ্বংসাত্মক চেহারা নেয়।রাজ্যের  বুকে তৃণমূল-মাওবাদী মিলিত সন্ত্রাসের ল্যাবরেটরি হয়ে ওঠে নন্দীগ্রাম।

নন্দীগ্রামে শিল্প গড়ার ভাবনায় শিলমোহর দেয় বিধানসভার সর্বদলীয় প্রতিনিধি দল এবং শিল্প-বাণিজ্য বিষয়ক স্ট্যান্ডিং কমিটি। ২০০৬ সালের ২৮নভেম্বর তারা  সর্বসম্মতিক্রমে রিপোর্ট দেয় যে নন্দীগ্রাম কেমিকাল হাবের পক্ষে খুবই উপযুক্ত। বিধানসভার স্ট্যান্ডিং কমিটির চেয়ারম্যান ছিলেন বিরোধী দলের নেতা। সদস্যদের মধ্যে তৃণমূল সহ অনেক বিরোধীদলের এমএলএ ছিলেন।

রিপোর্টে লেখা হয়েছিল- ‘হলদি নদীর ধারে নন্দীগ্রাম থানায় কেমিকাল হাবের এর জন্য প্রস্তাবিত ও চিহ্নিত ১০৫০০ একর জমি কমিটি ঘুরে দেখেছে। এর সঙ্গেই লাগোয়া আরো ১২ হাজার একর জমিও বিশেষ অর্থনৈতিক অঞ্চল প্রকল্পে অন্যান্য শিল্প ইউনিট স্থাপনের জন্য চিহ্নিত। নদীর পাশের জমি প্রস্তাবিত প্রকল্পের জন্য স্থানিক সুবিধা যুক্ত। বন্দরের সুবিধা গড়ে তোলা হবে, প্রয়োজনীয় সমস্ত পরিকাঠামো গড়ে তোলা হবে। কমিটির মনে হয়েছে প্রকল্পের বাস্তবতার  সম্ভাবনা প্রবল এবং ভবিষ্যত উজ্জ্বল। কমিটি মনে করে বর্তমান শিল্প পরিস্থিতি বড় আকারে পাল্টে দেবার ক্ষেত্রে তা গতি যোগাবে। এই স্থান বাছাই এর ফলে ভবিষ্যতে হলদিয়া বিনিয়োগের সকল সুবিধা যুক্ত আদর্শ জায়গা হয়ে উঠবে। তার সমস্ত সম্ভাবনা আছে। ভারতে হলদিয়া হয়ে উঠবে একটি ব্র্যান্ড নেম’।

অর্থাৎ নন্দীগ্রামে কেমিকাল হাব একইসাথে নন্দীগ্রাম ও হলদিয়া শিল্প বিকাশের পথ সুগম করবে বলে মত প্রকাশ করে বিধানসভার  স্ট্যান্ডিং কমিটি।

নন্দীগ্রামে যেহেতু অধিকাংশ জমি অনুর্বর সেহেতু সেখানে এ ধরনের শিল্প প্রতিষ্ঠার উদ্যোগ এলাকার মানুষের কর্মসংস্থানের ক্ষেত্রে বিরাট বড় সম্ভাবনা সৃষ্টি করবে বলে আশাবাদী ছিলেন সরকার ও এরাজ্যের শুভবুদ্ধি সম্পন্ন মানুষ।
নন্দীগ্রামে  অধিকাংশ জমি এক ফসলী হওয়ায় কেবল কৃষির উপরে নির্ভর করে থাকা অসম্ভব । আক্রা, মহেশতলায় দর্জির কাজের সাথে যুক্ত নন্দীগ্রামের কয়েক হাজার মানুষ। সেসময় প্রতিদিন ১৬ টি বাস নন্দীগ্রাম থেকে মহেশতলার আক্রা ফটক পর্যন্ত যাতায়াত করতো যাতে করে জীবিকার জন্য শহরমুখী হতেন সেখানকার মানুষ। এহেন নন্দীগ্রামে শিল্প স্থাপনের প্রচেষ্টাকে সাধুবাদ জানানোর বদলে রক্তের বন্যায় শিল্পায়নের প্রয়াসকে ডুবিয়ে দেয় তৃনমূল- মাওবাদী জোটের নেতৃত্বাধীন বামবিরোধী শক্তি।

নন্দীগ্রামে বামফ্রন্ট বিরোধী শক্তির অপপ্রচার সত্বেও শিল্পের পক্ষে বিপুল সংখ্যক মানুষ সমবেত হয়েছিলেন। ২০০৬সালের ১৯ ডিসেম্বর কৃষি ও শিল্প উন্নয়ন সমিতির ডাকে বারো হাজার মানুষের এক মিছিল বেরোয় নন্দীগ্রামে যেখান থেকে শিল্পবিরোধী গুজব ও অপপ্রচারে কান না দেওয়ার জন্য আবেদন করা হয়। কিন্তু বামবিরোধী রামধনু জোট সুপরিকল্পিত ভাবে হিংসা ও গুজব ছড়িয়ে পরিস্থিতি জটিল করে তোলে।
প্রথমে গুজব রটান হয় যে নন্দীগ্রামের সব জমি নিয়ে নেওয়া হবে। অথচ  নন্দীগ্রাম-১ ব্লকের ৯৯টি মৌজার মধ্যে ২৭টি মৌজায় শিল্পের জন্য জমি নেওয়ার পরিকল্পনা ছিল।
দ্বিতীয় গুজব রটানো হয় যে বেছে বেছে মুসলমানদের জমি নেওয়া হবে। অথচ শিল্পের জন্য চিহ্নিত এলাকা গুলির মধ্যে কোন মৌজায় সংখ্যালঘু জনসংখ্যা ছিল ৩০ শতাংশ, কোথাও ২০ শতাংশ অথবা ১০ শতাংশ।
এরপর গুজব রটানো হয় যে সব ধর্মস্থান ভেঙে ফেলা হবে। মন্দির-মসজিদ, কবরস্থান গুঁড়িয়ে দিয়ে শিল্প হবে। কিন্তু শিল্পের জন্য চিহ্নিত এলাকা অধিগ্রহণের ক্ষেত্রে সুনির্দিষ্টভাবে নির্দেশিকা ছিল যে ধর্মস্থান এবং সমাধিস্থল বা শ্মশান বাদ দিয়েই এ কাজ করতে হবে।
গুজব ছড়ান হয় যে জমি নিলেও কোন পুনর্বাসন দেওয়া হবে না। অথচ নিকটবর্তী হলদিয়াতে তার দশ বছর আগে থেকেই অনেকগুলি পুনর্বাসন কলোনি গড়ে উঠেছিল।

মাওবাদী,তৃণমূল, জামাতে উলেমায়ে হিন্দ, বিজেপি সহ বিভিন্ন বাম বিরোধী শক্তির একযোগে মিথ্যে প্রচারের ফলে একটা বিরাট অংশের মানুষের মধ্যে এই সব গুজব মান্যতা পেয়ে যায়। স্বামী অগ্নিবেশ,মেধা পাটেকর এর মত ব্যক্তিরা এই গুজব গুলিকে বিশ্বাসযোগ্য করে তুলতে সাহায্য করেন এবং সিপিআই(এম) এর বিরুদ্ধে ঘৃণা ছড়ানোর কাজে বিশেষ ভূমিকা নেন। বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয়ের অতিবাম ছাত্র-ছাত্রীদের একটি অংশকেও এই কাজে লাগানো হয় । ষড়যন্ত্রের ব্লু প্রিন্ট অনুযায়ী এর পর বেপরোয়া ভাবে হিংসা ছড়াতে শুরু করে দুষ্কৃতীর দল।

২০০৭সালের ৩ জানুয়ারি, কালিচরণপুর পঞ্চায়েত অফিসে “নির্মল গ্রাম” প্রকল্প নিয়ে বৈঠক চলাকালীন চড়াও হয় উন্মত্ত তৃণমূল বাহিনী। ভাঙচুর করা হয় পঞ্চায়েত অফিস, পুলিশের জিপে আগুন দেওয়া হয় এবং এক দিনেই প্রায় দেড় হাজার সিপিআইএম কর্মী ও সমর্থককে ঘরছাড়া করা হয়। এ ঘটনা যে আদৌ জনগণের স্বতঃস্ফূর্ত ক্ষোভের বহিঃপ্রকাশ ছিলনা,বরং সুপরিকল্পিত চক্রান্ত ছিল তার প্রমাণ যে এই সন্ত্রাস চালানোর আগে সাতাশটি মৌজায় গুরুত্বপূর্ণ চল্লিশটি রাস্তা চওড়া ও গভীর করে কাটা হয়েছিল, তিনটি সেতু এবং প্রায় দশটি কালভার্ট ভেঙ্গে ফেলা হয়েছিল যাতে সন্ত্রাস কবলিত এলাকায় পুলিশ ঢুকতে না পারে। নন্দীগ্রামে সিপিআই(এম)এর বিরুদ্ধে যে রামধনু জোট তৈরি হয়েছিল তাতে মূল সামাজিক শক্তি হিসেবে রসদ জুগিয়েছিল পূর্বতন ভূস্বামীরা যাদের সিলিং বহির্ভূত জমি বামফ্রন্ট সরকার ভূমিহীনদের মধ্যে বন্টন করেন। এরাই  তৃণমূল কংগ্রেসের মূল সমর্থক ছিল। এদের পরিকল্পনাকে সফল করার জন্য একদিকে সমাজবিরোধী অন্যদিকে মাওবাদীদের মত ভাড়াটে খুনিদের কাজে লাগানো হয়।  নন্দীগ্রামে সন্ত্রাসের দায়ে বিরোধীরা বামপন্থীদের উপর চাপালেও নন্দীগ্রামের মানুষ জানেন যে সেখানে কিভাবে সেখানে একের পর এক সি পি আই (এম)পার্টি অফিস পোড়ানো হয়েছে, লুটপাট চালানো হয়েছে শত শত বামপন্থী কর্মী-সমর্থকদের পরিবারে, বামপন্থী কর্মীদের নির্বিচারে খুন করা হয়েছে। সোনাচুড়ায় পঞ্চায়েত সদস্য শংকর সামন্ত কে নৃশংস ভাবে হত্যার ঘটনা  সকলের জানা।তৃণমূল কংগ্রেস এর স্থানীয় নেতৃত্ব এই  নারকীয় হত্যাকাণ্ডে জড়িত ছিলেন। নন্দীগ্রামে এরকম উন্মত্ত হিংসার বলি হন বহু বামপন্থী কর্মী-সমর্থক যাদের মধ্যে অধিকাংশই ছিলেন গরিব শ্রমজীবী মানুষ।

নন্দীগ্রাম জুড়ে চরম নৈরাজ্য চলাকালীন বামফ্রন্ট সরকারের মুখ্যমন্ত্রী বুদ্ধদেব ভট্টাচার্য ২০০৭ সালের ৯ ফেব্রুয়ারি হেঁড়িয়ার জনসভা থেকে ঘোষণা করলেন যে মানুষ যদি না চান তাহলে নন্দীগ্রামে কেমিকাল হাব হবে না এবং সরকার জমি অধিগ্রহণ করবে না। তা সত্ত্বেও সন্ত্রাস চলতে থাকে লাগামছাড়া ভাবে। ভূমি উচ্ছেদ প্রতিরোধ কমিটির নামে নন্দীগ্রামের সাতাশটি মৌজায় কেবল নয়,  প্রস্তাবিত প্রকল্পের বাইরে থাকা গোকুলপুর, সামসাবাদ, সাতেঙ্গাবাড়ি, রানিচক, টাকাপুরার মত বিভিন্ন এলাকায় লুটপাট, বাড়িঘর পোড়ানো এবং সিপিআই(এম) কর্মী,সমর্থকদের নির্বিচারে বাড়ি থেকে উৎখাত চলতেই থাকে। নন্দীগ্রামের পরিস্থিতি নিয়ে ডাকা সর্বদলীয় বৈঠকে বিরোধীপক্ষের বিধায়করা হয় আসেননি নতুবা নানা অযৌক্তিক বিতর্ক করে সভা ভেস্তে দিয়েছেন।

নন্দীগ্রামের মানুষের সম্মতি না থাকলে নন্দীগ্রামের শিল্প হবে না একথা রাজ্যের মুখ্যমন্ত্রী বলার পরেও নন্দীগ্রাম কে গোটা রাজ্য থেকে বিচ্ছিন্ন করে রাখা হয়েছিল এবং সেখানে পুলিশ প্রশাসনের প্রবেশ নিষেধ ছিল। ভারতবর্ষের সংবিধান এবং আইন-কানুন বিরোধী এই ভয়ঙ্কর নৈরাজ্যকে  প্রতিহত করে আইনের শাসন প্রতিষ্ঠা করবার জন্য নন্দীগ্রামে রাজ্য সরকারের পুলিশ বাহিনী প্রবেশ করলে তাদের ওপর  আক্রমণ নেমে আসে। পরিস্থিতি যখন হাতের বাইরে চলে যাচ্ছে সেই সময় পুলিশ গুলি চালালে বেশ কয়েকজন নিহত হন।  নন্দীগ্রামে পুলিশের গুলিতে নিহত বলে যাদের নামের তালিকা বিরোধীরা প্রকাশ করে তাদের মধ্যে কয়েকজন গুলির আঘাতে নয়, ধারালো অস্ত্রের আঘাতে নিহত হয়েছিলেন এবং একজনের মৃত্যু হয়েছিল বোমা বিস্ফোরণের ফলে। একজন কে চিন্হিত করা যায়নি।পরবর্তীকালে নন্দীগ্রামের পরিস্থিতি খতিয়ে দেখার জন্য যারা গিয়েছেন সেই রকম তথ্যচিত্র নির্মাতা ও সাংবাদিকদের কাছে নন্দীগ্রামের সাধারণ মানুষ জানিয়েছিলেন যে কিভাবে ২০০৭ সালের ১৪ই মার্চ ভাঙবেড়া ব্রিজের কাছে মহিলা এবং শিশুদেরকে সামনে রেখে পেছন থেকে আক্রমণ চালিয়েছিল মাওবাদী-তৃণমূলী দুষ্কৃতীরা।প্ররোচনা সৃষ্টি করে,হিংসাত্মক আক্রমণ চালিয়ে  নন্দীগ্রামকে কার্যত যুদ্ধক্ষেত্রে পরিণত করেছিল এই ভয়ংকর শক্তি।

মাওবাদী-তৃণমূলী-জামাত-বিজেপি জোটের  মুক্তাঞ্চল নন্দীগ্রামে ভিটে মাটি থেকে উৎখাত হয়ে যান কয়েক হাজার বাম কর্মী,সমর্থক যারা ছিলেন মুলত গরিব, নিম্নবিত্ত মানুষ। প্রায় ন’মাস তারা আশ্রয় শিবিরে কোনোমতে দিন গুজরান করেন। নিজেদের সাজানো সংসার এভাবে তছনছ হয়ে যাওয়া মন থেকে মেনে নিতে পারছিলেন না এই ভিটেহারা মানুষ। স্বভাবতই বাড়ি ফিরতে তারা মরীয়া ছিলেন। এই প্রবল জনোচ্ছাসের সামনে বামবিরোধীরা খড়কুটোর মত উড়ে যায়,আবার নন্দীগ্রামে সূর্যোদয় হয়। কয়েক মাসের জন্য আবার জীবনের ছন্দ ফিরে পায় নন্দীগ্রাম। মানুষের নিজের ঘরে ফেরাকে নন্দীগ্রামের “পুনর্দখল”বলে আখ্যা দিয়ে তৎকালীন রাজ্যপাল বিরোধীদের পালে হাওয়া দিয়েছিলেন।তার মানে কি ঘরছাড়া মানুষ নিজের ঘরে ফিরে অন্যায় করেছিলেন? যারা তাদের ভিটেমাটি কেড়ে নিয়েছিল, তারাই ছিল ন্যায়ের পথে?

নন্দীগ্রামের সিপিআই)এম) কর্মীদের সম্পর্কে অভিযোগ করা হয়েছে যে তারা নাকি নারী ধর্ষণ, শিশু হত্যার সাথে যুক্ত ছিলেন। অসংখ্য শিশুর নাকি পা চিরে হলদি নদীতে ভাসিয়ে দেয়া হয়েছে এবং নদীর জল নাকি রক্তে লাল হয়ে গিয়েছে! প্রশ্ন জাগে যে একজন শিশুর নিখোঁজ হওয়ার কোনো অভিযোগও কেন এখনো পর্যন্ত নন্দীগ্রামের কোন থানায় দায়ের হলো না? কেন একজন নারীরও শারীরিক পরীক্ষায় প্রমাণিত হলো না যে তিনি ধর্ষিতা হয়েছেন? যে কারণে হাইকোর্ট পর্যন্ত ধর্ষিতাদের সংখ্যা জানাতে পারেনি। আমাদের তো স্মরণে আছে যে কিভাবে তৃণমূল নেত্রী ভাঙ্গড়ের চম্পলা সর্দার কে ধর্ষিতা সাজিয়ে পঞ্চায়েত নির্বাচনের আগে ফায়দা তোলার চেষ্টা করেছিলেন। গোয়েবলসীয় অপপ্রচারের এই  ধারাতেই নন্দীগ্রামে ব্যাপক প্রচার হয়েছে এবং গোটা পৃথিবীতে পশ্চিমবাংলার কমিউনিস্ট কর্মী ও সংগঠকদের সম্পর্কে তীব্র বিদ্বেষ ছড়ানো হয়েছে, তাদেরকে স্বৈরাচারী ও অত্যাচারী হিসেবে প্রতিপন্ন করার চেষ্টা হয়েছে।

নন্দীগ্রামে তৃণমূল কংগ্রেসের সাথে মাওবাদীদের আঁতাতের অভিযোগে যখন উঠেছে তখন তাকে উড়িয়ে দিয়েছে তৃণমূল কংগ্রেস।অথচ  মাওবাদীদের নিজস্ব দলিলে লেখা রয়েছে ঠিক কিভাবে নন্দীগ্রামে তারা অস্ত্র প্রশিক্ষণ দেওয়া সহ নানা রকম নাশকতামূলক কাজে তৃণমূল কংগ্রেসের সাথে একযোগে কাজ করেছেন।তৃণমূল কংগ্রেসের সাংসদ কবীর সুমনের লেখা বইয়েও মাওবাদীদের সাথে তৃণমূলীদের নিবিড় সম্পর্কের খতিয়ান পাওয়া যায়। আর মাওবাদী নেতা কিষানজীতো প্রকাশ্যেই মমতা ব্যানার্জিকে মুখ্যমন্ত্রী দেখতে চাওয়ার ইচ্ছা পোষণ করেছিলেন!  ভারতবর্ষের অভ্যন্তরীণ নিরাপত্তার জন্য সবচেয়ে বিপদজনক,ভাড়াটে খুনি মাওবাদীদের সাথে দেশের একটি দক্ষিণপন্থী রাজনৈতিক দল এভাবে অন্তরঙ্গ সম্পর্কে আবদ্ধ হয়েছে  এবং কমিউনিস্ট বিরোধী ষড়যন্ত্র চালিয়ে গিয়েছে।

Spread the word

Leave a Reply