Trump sees the ghost of communists: shantanu Dey…

ট্রাম্পের ম্যাকার্থিবাদ

কমিউনিস্টদের ভূত দেখছেন ট্রাম্প।
বিশ্বের কোনও দেশের কমিউনিস্ট পার্টির সদস্যরা আর আমেরিকায় ‘অভিবাসী’ হতে পারবেন না। সরাসরি এই নির্দেশিকা জারি করেছে ট্রাম্প প্রশাসন।
মার্কিন নাগরিকত্ব ও অভিবাসন পরিষেবা (ইউএসসিআইএস) অতি সম্প্রতি যে নীতি-নির্দেশিকা জারি করেছে, তাতে স্পষ্ট করে একথা জানিয়ে দেওয়া হয়েছে। ২ অক্টোবর এই নির্দেশিকা জারি করা হয়েছে।
গোটা গোটা শব্দে বলা হয়েছে, ‘কোনও বিদেশী রাষ্ট্র, অথবা কোনও বিদেশী রাষ্ট্রের কোনও রাজনৈতিক ও ভৌগলিক সাবডিভিশনের’ কমিউনিস্ট পার্টির সদস্যরা মার্কিনমুলুকে অভিবাসী (ইমিগ্রেট) হতে অযোগ্য হবেন। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের ‘সুরক্ষা আর নিরাপত্তার’ কথা ভেবেই না কি এই সিদ্ধান্ত।
ইয়েল বিশ্ববিদ্যালয়ের দর্শনের অধ্যাপক জ্যাসন স্ট্যানলি বলেছেন, আসলে ট্রাম্প মনে করছেন, ‘শ্বেতাঙ্গদের আধিপত্য গুঁড়িয়ে দিতে বামপন্থীরা নিয়ে আসছেন অভিবাসীদের। অভিবাসন হলো একটি কমিউনিস্ট ষড়যন্ত্র, যা গুঁড়িয়ে দেবে দেশের বর্ণবাদী চরিত্রকে, যাতে ক্ষমতা দখল করতে পারে কমিউনিস্টরা।’
এমনকি, ডেমোক্র্যাট পার্টি, যারা বিনামূল্যে সর্বজনীন স্বাস্থ্যব্যবস্থার কথা বলছেন, তাঁদেরকে ট্রাম্প বলেছেন, ‘আগ্রাসী মার্কসবাদীদের’ জন্য ট্রয়ের ঘোড়া।
আসলে ট্রাম্প ফিরিয়ে আনতে চাইছেন ম্যাকার্থিবাদ।
সেদিন চার্লি চ্যাপলিন থেকে ব্রেখট, পল রবসন থেকে পিট সিগার— কেউই রেহাই পাননি।
সেদিন মার্কিনমুলুকে ম্যাকার্থিবাদ— বোস্টন থেকে প্রকাশিত আমেরিকান হেরিটেজ ডিকশেনরির সংজ্ঞায়— ‘বিরোধীদের দমন করতে অন্যায় অন্যায্য তদন্ত অথবা দোষারোপের প্রক্রিয়া।’
১৯৫০-’৫৪। গোটা আমেরিকাজুড়ে কমিউনিস্ট-বিদ্বেষের জিগির। মার্কিন রাজনীতির ইতিহাসে ‘লাল আতঙ্কের দ্বিতীয় জমানা।’
প্রথম জমানা ১৯১৭ সালে। ‘দুনিয়া কাঁপানো দশদিনে’র পর। সোভিয়েত আতঙ্কে ভুগতে শুরু করলেন মার্কিন রাজনীতিকরা। যার প্রভাব গিয়ে পড়ে সামাজিক, সাংস্কৃতিক সমস্ত ক্ষেত্রে। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে ছড়িয়ে দেওয়া হয় ‘ওই রাশিয়ানরা আসছে।’ ১৯৫৫ সালে ইউনিভার্সিটি অব মিনেসোটা প্রেস থেকে প্রকাশিত রবার্ট কে মারের লেখা ‘রেড স্কেয়ার: এ স্ট্যাডি ইন ন্যাশনাল হিস্টিরিয়া, ১৯১৯-২০’-তে আছে তার অনুপুঙ্খ বিশ্লেষণ।
দ্বিতীয়বার ম্যাকার্থির সময়।
জোসেফ ম্যাকার্থি তখন মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের উইসকনস্টিন প্রদেশ থেকে নির্বাচিত মার্কিন সেনেটের দাপুটে সদস্য। তার আগে থেকেই মার্কিন কংগ্রেসের প্রতিনিধি। যদিও প্রচারের আলোয় আসেন ’৫০-র ফেব্রুয়ারিতে। লিঙ্কন দিবসের ভাষণ থেকে। ওয়েস্ট ভার্জিনিয়ায় রিপাবলিকান উইমেন্স ক্লাব অব হুইলিংয়ে ম্যাকার্থি দাবি করেন, বিদেশ দপ্তরে কাজ করছেন এমন কমিউনিস্ট গুপ্তচরদের নামের তালিকা তাঁর কাছে রয়েছে, যারা দেশকে বেচে দেওয়ার চেষ্টা করছে।
‘আমার কাছে এমন ২০৫ জনের একটি তালিকা রয়েছে— যে তালিকা মার্কিন বিদেশসচিবকে দিয়ে জানানো হয়েছিল, এঁরা সবাই কমিউনিস্ট পার্টির সদস্য। এঁরা এখন শুধু বিদেশদপ্তরে কাজই করছেন না, নীতি নির্ধারণেও ভূমিকা নিচ্ছেন।’ যদিও পরে তালিকার সংখ্যা কমিয়ে করেন ৫৭, আর চাপের মুখে মাত্র চারজনের নাম জানানোর কথা বলেন।
মার্কিন প্রতিনিধিসভার ‘মার্কিন-বিরোধী কার্যকলাপ (আন-আমেরিকান অ্যাক্টিভিটিস) কমিটি’র সমান্তরাল হিসেবে তখন কাজ করছে ম্যাকার্থির কমিটি। তিনি তখন মার্কিন সেনেটের ‘স্থায়ী তদন্ত সাব কমিটি’র প্রধান।
কবি-সাহিত্যিক-সাংবাদিক, নাট্যকার-শিল্পী থেকে বিজ্ঞানী— যাঁকে নিয়েই বিন্দুমাত্র সন্দেহ জেগেছে, তাঁকেই ‘কমিউনিস্ট’ বলে অভিযুক্ত করেন। সেনাবাহিনীর ভিতরে, এমনকি মার্কিন কংগ্রেসেও কমিউনিস্টরা আস্তানা গেড়েছে বলে অভিযোগ তোলেন। সর্বত্রই দেখেন কমিউনিস্টদের ভূত। নেমে পড়েন ‘ডাইনি সন্ধানে।’
যা ক্রমেই পরিণত হয় গণ-হিস্টিরিয়ায়। প্রতিটি প্রতিষ্ঠান, অঞ্চলে ‘কালো তালিকা’ করে কমিউনিস্ট তকমা লাগিয়ে শুরু হয় বয়কট অভিযান। এই জিগির কার্যত ছিনিয়ে নেয় মার্কিন নাগরিকদের স্বাধীন চিন্তা ও মতপ্রকাশের অধিকার। ভয়ে মুখ বন্ধ রাখতেন সকলেই। ম্যাকার্থিবাদের কমিউনিস্ট বিদ্বেষী জিগিরের শিকার হন বহু নিরীহ, নিরাপরাধ সাধারণ মানুষ।
সেনাকর্তারা তাঁর প্রশ্নের জবাব দিতে অস্বীকার করলে ক্ষুব্ধ ম্যাকার্থির চোখ রাঙিয়ে বলেন, ‘কমিউনিস্টদের লালন করছে এমন নামের তালিকা কি সেনাবাহিনী দেবে, না কি আমরা তাদের সেনেটে ডেকে পাঠাব?’ দাবি করেন বিরাট সংখ্যায় কমিউনিস্ট সদস্য এবং সোভিয়েত গুপ্তচরেরা রয়েছেন মার্কিন সরকারের অভ্যন্তরে। এবং সর্বত্র। কোনও তথ্য-প্রমাণের তোয়াক্কা না করে, কাউকে তাঁর প্রতিদ্বন্দ্বী মনে হলেই ‘কমিউনিস্ট’ তকমা সেঁটে দিতেন। ডেকে আনতেন সেনেটের শুনানিতে। ম্যাকার্থির অভিযোগের ভিত্তিতে, মিথ্যা প্ররোচনায় চাকরি খোয়ান অনেকে। কেউ কেউ হন একঘরে। কেউবা অপমান সহ্য করতে না পেরে আত্মহত্যা করেন।
‘কমিউনিস্টরা ক্ষমতায় এলে কী হতে পারে?’— মার্কিন মুলুকে আন-আমেরিকান অ্যাক্টিভিটিস সংক্রান্ত মার্কিন কংগ্রেসের হাউস কমিটি ঠিক ওই সময়েই প্রকাশ করে একটি প্যামপ্লেট: ‘হান্ড্রেড থিংস শুড নো অ্যাবাউট কমিউনিজম ইন ইউ এস এ’।
তাতে বলা হয়, হোয়াইট হাউসে কমিউনিস্টরা মানে:
প্রশ্ন: আমার বীমার কী হবে?
উত্তর: বীমা যাবে কমিউনিস্টদের পকেটে।
প্রশ্ন: কমিউনিজম কি এর চেয়ে ভালো কিছু দিতে পারে?
উত্তর: জীবনভর কঠোর পরিশ্রম করানো ছাড়া আর কিছুই তাদের দেওয়ার নেই।
ইন্ডিয়ানা প্রদেশের পাঠ্যবই কমিশনের পদস্থ অফিসার আদা হোয়াইট রবিন হুডের গল্প স্কুল থেকে নিষিদ্ধ করার প্রস্তব দেন। তাঁর দাবি, ‘রবিন হুড ছিলেন একজন কমিউনিস্ট।’
মার্কিন সেনাবাহিনী প্রকাশ করে ছ’পাতার প্যামপ্লেট : ‘কীভাবে চিহ্নিত করবেন একজন কমিউনিস্টকে?’
তীব্র কমিউনিস্ট বিদ্বেষ, কুৎসা প্রচার এমন জায়গায় পৌঁছয় যে মানুষ সত্য-মিথ্যা বিচারের ক্ষমতা হারিয়ে ফেলেন। যে কোনও প্রতিবাদকেই ‘দেশদ্রোহী’ (আন-আমেরিকান), ‘আতঙ্কবাদী’ তকমা সাঁটিয়ে কন্ঠরোধ করা ছিল দস্তুর।
রোজেনবার্গ দম্পতি হত্যা। গোপনে সোভিয়েত কর্তৃপক্ষের কাছে আমেরিকার আণবিক বোমাসহ গুরুত্বপূর্ণ ও স্পর্শকাতর তথ্য পাচারের অভিযোগে জুলিয়াস ও ইথেল রোজেনবার্গকে দোষী সাব্যস্ত করা হয়। যা ছিল পুরোপুরি মিথ্যা। সিআইএ এবং এফবিআই ঝুড়ি ঝুড়ি জাল তথ্য দিয়ে ফাঁসায় সম্পূর্ণ নির্দোষ এই দম্পতিকে।
এই ভুয়ো মামলায় শাস্তি— মৃত্যুদণ্ড। রোজেনবার্গ মামলা চলাকালীনই এর ন্যায্যতা নিয়ে প্রশ্ন ওঠে। পরে বিভিন্ন গবেষক ও লেখক অজস্র তথ্য দিয়ে প্রমাণ করেছেন পুরোটাই সাজানো ছিল এই মামলা। তিন বছর ধরে চালানো হয় এই মামলা।
আলবার্ট আইনস্টাইন, নোবেলজয়ী পরমাণু বিজ্ঞানী হ্যারল্ড সি উরে, কবি লুই আরাগঁ, লেখজ জ্যাঁ পল সাত্রের মতো বিশিষ্টরা মৃত্যুদণ্ড রদ করার আবেদন জানান। তবু নির্বিকার থাকে মার্কিন প্রশাসন। ১৯৫৩’র ১৯ জুন সম্পূর্ণ নিরাপরাধ রোজেনবার্গ দম্পতিকে বসানো হয় ইলেকট্রিক চেয়ারে। আসলে সেই সময় কমিউনিস্ট জুজুর ভয় দেখানোর জন্যই দরকার হয়ে পড়েছিল এই মামলা। রোজেনবার্গ দম্পতির বিরুদ্ধে ভুয়ো মামলা ম্যাকার্থির প্রচারকে দেয় জনসমর্থন।
যুক্তিহীন, আদর্শহীন, মানবতাবিরোধী এই ভয়ঙ্কর প্রচারের প্রধান পুরোহিত ছিলেন ম্যাকার্থি। এই কুৎসা প্রচারের শিকার ছিলেন চার্লি চ্যাপলিন, ব্রেখট, আর্থার মিলার, হাওয়ার্ড ফাস্ট, পিট সিগার, পল রবসন, পল সুইজি, ল্যাঙস্টন হিউজ, নোবেল জয়ী বিজ্ঞানী লাওনাস পাওলিংয়ের মতো সর্বকালের অন্যতম চিন্তাবিদ, মনীষী, শিল্পীসহ মানবতাবাদীরা।
ট্রুমানের সেই বিখ্যাত উক্তি, ‘একটি স্বাধীন দেশে মানুষের শাস্তি পাওয়া উচিত তাঁর অপরাধের জন্য, কিন্তু কখনোই বিশ্বাসের জন্য নয়।’
ডিসেম্বর, ১৯৫৪। সেনেটের একজন সদস্য হিসেবে ক্ষমতার অপব্যবহার করার জন্য সেনেট ‘সেন্সর’ করে ম্যাকার্থিকে। তিনবছর বাদে ৪৮ বছর বয়েসে তিনি মারা যান।
যদিও আজও তিনি আছেন। ট্রাম্প থেকে বোলসোনারোর মধ্যে। মোদী, মমতার মধ্যে।

Spread the word

Leave a Reply