যে দেশে বেশিরভাগের বেঁচে থাকতে ন্যূনতম চাহিদার পর্যাপ্ত রসদটুকুর নিশ্চয়তা নেই সেখানে পরিকল্পনাহীন সার্বিক লকডাউন আসলে গরিব জনতার বিরুদ্ধে সরকারের শ্রেণীরাজনীতিরই বহিঃপ্রকাশ। সবাইকে এই সময়ে রাজনীতি করতে বারণ করে সরকার নিজেই সবচেয়ে উৎকট রাজনীতি করছে…
“He took her hand and left the room
HAMLET …. WILLIAM SHAKESPEARE
To put his daughter’s fate in gloom.
Right away he went to the Danish court
To tell the royal pair of this report
In short they decided to secretly spy
And used his daughter as a decoy“
ওয়েবডেস্ক, ২৪ মার্চ, ২০২০ঃ পৃথিবীর মধ্যে সবচেয়ে বিশাল চেহারার লকডাউন ঘোষণা হয় ভারতে। প্রত্যশা মাফিক এই ঘোষণা করেন প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদী নিজেই। ভারতে করোনা ভাইরাসের সংক্রমণ প্রতিরোধে দেশব্যাপী সামাজিক প্রতিবন্ধকতার এই সরকারি ঘোষণা জনমানসে একইসাথে অপরিচিত বিপদের আশংকা এবং নিজেদেরকে সুরক্ষিত রাখার প্রয়োজন দুভাবেই প্রভাব ফেলে।
যদিও প্রথম থেকেই স্পষ্ট ইঙ্গিত ছিল এধরণের ব্যাপক এবং সর্বজনীন প্রতিবন্ধক আদেশনামা কার্যকর করতে সরকারি বন্দোবস্ত আদৌ যথাযথরুপে প্রস্তুত নয়। তবু পৃথিবীর বৃহত্তম “গণতান্ত্রিক” রাষ্ট্র তার জনগণের এক বড় অংশের থেকেই এই কাজে বিপুল সমর্থন আদায় করতে সক্ষম হয়। একথা অত্যুক্তি নয় যে প্রথম দফার লকডাউন এদেশের জনগনই সফল করেছেন।
Odysseus: We need you. Greece needs you. Achilles: Greece got along fine before I was born. And Greece will remain Greece long after I am gone.
QUOTES From The Movie: TROY(2004)
সংক্রমণ যাতে মহামারীর আকার না নিতে পারে তাই এধরণের সর্বজনীন প্রতিবন্ধকতার সরকারি অধ্যাদেশের পিছনে আরও অনেকগুলি পদক্ষেপ নেবার প্রয়োজন হয়। দেশের স্বাস্থ্যবিষয়ক বিশেষজ্ঞেরা ( ICMR – Indian Council of Medical Research) সেই প্রয়োজনীয় পরবর্তী পদক্ষেপসমুহের একটি বিস্তারিত খসড়া সরকারকে পেশ করেন – প্রধানমন্ত্রীর লকডাউন ঘোষণার এক সপ্তাহ পরেই।
দেখা যাক ( ICMR – Indian Council of Medical Research)’র সেই খসড়া প্রস্তাবে সংশ্লিষ্ট বিজ্ঞানীরা কি বলেছিলেন।
১. লকডাউন ঘোষণা হয়ে যাবার ফলে অনেকেই নিজেদের স্বাস্থ্যপরীক্ষা করাতে হাসপাতাল অথবা স্বাস্থ্যকেন্দ্রগুলীতে আসতে পারবেন না। এই অবস্থায় স্বাস্থ্যপরিষেবাকেই মানুষের কাছে পৌঁছাতে হবে।
২. সপ্তাহে দুবার বাড়ি বাড়ি পৌঁছে সংক্রমনের পরীক্ষা চালানো। যাদের মধ্যে সংক্রমনের বিভিন্ন উপসর্গ দেখা দিয়েছে তাদের ৪৮ ঘন্টার মধ্যে অন্যদের থেকে আলাদা করতে কোয়ারান্টাইন কেন্দ্রে নিয়ে আসতে হবে। তাদের সাথে একই জায়গায় থাকা অন্যান্যদেরকেও পরীক্ষার আওতায় নিয়ে আসতে হবে।
৩. সারা দেশজূড়ে একইভাবে পরীক্ষার ব্যাবস্থা করা। রাজ্যগুলীর প্রশাসনের সাথে হাত মিলিয়েই এই কাজ করতে হবে যাতে খুব দ্রুত সারা দেশেই এই সংক্রমণের বাস্তব এবং প্রকৃত চিত্র বোঝা যায়।
৪. ব্যাপক আকারে কোয়ারান্টাইন কেন্দ্রের পরিকাঠামো গড়ে তুলতে হবে, বিশেষকরে বস্তিবাসি-ঝুপড়িজীবীদের জন্যেই এই ব্যাবস্থা বেশি প্রয়োজন। এই কেন্দ্রগুলীতে অসুস্থদের চিকিৎসার কাজে আইসিইউ/সিসিইউ এবং ভেন্টিলেটরের ব্যবস্থা করতে হবে বিশেষভাবে ।
৫. যারা আর্থিকভাবে স্বচ্ছল এবং নিজেদের ঘরে লম্বা সময় ধরে দুরত্ব বজায় রেখে চলতে পারবেন তাদের ব্যাতিরেকে গরীব জনতার এক বিশাল অংশ যারা বস্তিবাসী তাদের পক্ষে এই লকডাউন আদৌ কোন সমাধান হবে না। ঝুপড়ি কিংবা বস্তিতে স্থানসংকুলানের সমস্যা থাকায় নানা প্রয়োজনীয় কাজ যেমন সাধারণ শৌচালয় ইত্যাদির কারনে তারা গোষ্ঠী সংক্রমনের আওতায় চলে আসবেন খুব সহজেই। এর থেকে বাঁচতে গণহারে সংক্রমণের পরীক্ষা চালানো ছাড়া উপায় নেই।
ভারতে আর্থ-সামাজিক পরিস্থিতির কথা মাথায় রেখেই বিজ্ঞানী-বিশেষজ্ঞরা এই প্রস্তাবগুলী দিয়েছিলেন। জনগণের একটি বিরাট অংশের যেখানে নিরাপদ আশ্রয় নেই, নিশ্চিত রোজগার নেই, মজুত খাবারের কোন সুযোগ নেই তখন সরকারকেই সেইসব ক্ষেত্রে অতি দ্রুত নিজেদের বাড়তি দায়িত্ব বুঝে নিতে হয়। সারা দেশে গোষ্ঠী সংক্রমণের বিপদ এড়াতে লকডাউন পরবর্তী সময়ে সরকারি পদক্ষেপসমুহের প্রয়োজনীয়তা অপরিসীম। এক্ষেত্রে বিজ্ঞানী-বিশেষজ্ঞদের সেই পরামর্শ আদৌ মানেনি সরকার। অথচ পরিসংখ্যান দিয়ে তারা দেখিয়েছিলেন উক্ত পদক্ষেপগুলী বাদ দিয়ে শুধুমাত্র জনজীবনে লকডাউন ৪০% সংক্রমণ কমাবে বলে যে ধারণা রয়েছে তা বাস্তবে কেবলমাত্র ২০% থেকে সর্বাধিক ২৫% অবধিই কার্যকরী হবে। ঐ পদক্ষেপগুলী মেনে চললে সারা দেশে সংক্রমণের মাত্রা অন্তত সরকার যা বলছে ততটুকুও নিয়ন্ত্রণ হতে পারত।
এই পরিকল্পনা কার্যকর করতে সরকারের কোন পূর্বপ্রস্তুতি না থাকলেও প্রথম দফার সরকারি লকডাউনের সময়টুকুকেই যুদ্ধকালীন তৎপরতায় কাজে লাগানো যেত। অনেক দেরি করে সরকারের তরফে তাদের মস্তিস্ক হিসাবে কাজ করা “নীতি আয়োগ” যে পরিকল্পনার ঘোষণা করে দেখা যায় সেইসবের অনেক কিছুই মূলত অনেক আগে বিজ্ঞানী-বিশেষজ্ঞদের দ্বারা প্রস্তাবিত! অথচ তখন সরকার এই প্রস্তাবগুলীতে আমল দেবার প্রয়োজন মনে করেনি। ফলত সরকারি লকডাউন সরাসরি গরীব জনতার ক্ষতি করেছে দুদিক থেকেইঃ একদিকে তাদের ঠেলে দেওয়া হয়েছে করোনা ভাইরাসের সংক্রমণের বিপদের সামনে, আরেকদিকে সরকারি স্বাস্থ্যপরিষেবা, খাদ্যশস্য এবং অন্যান্য নিত্যপ্রয়োজনীয় সামগ্রীর কোন ব্যবস্থা না থাকায় তাদের বাধ্য হতে হয়েছে লকডাউন অমান্য করে জীবনের ঝুঁকি নিয়ে এক জায়গা থেকে আরেক জায়গায় ছুটে বেড়াতে। সাম্প্রতিক ঘটনা হিসাবে পরিযায়ী শ্রমিকদের ঘরে ফেরার উদ্দেশ্যে গোটা সংসার মাথায় নিয়ে মাইলের পর মাইল হেঁটে চলার মর্মান্তিক দৃশ্য সকলেরই মনে থাকবে।
ICMR – Indian Council of Medical Research’র পক্ষ থেকে দিল্লিতে সংক্রমণের চিত্রকে নমুনা হিসাবে রেখে প্রথম থেকেই একটি মডেল কর্মসূচির কথা বলে এসেছে যা সারা দেশের ক্ষেত্রেই প্রযোজ্য হতো।
“In Indian conditions such a lockdown provides social isolation for only the rich who live in less dense and high-floor space areas,” “To some degree it can protect them from the spread.”
Source: Article14
হঠাৎ করে ৪ ঘন্টার নোটিশে লক ডাউন ঘোষণা করেছিলেন প্রধানমন্ত্রী, মনে রাখতে হবে জনতা কার্ফ্যু সফল করতে ৪৮ ঘন্টা সময় দেওয়া হয় – বাতি জ্বালানো, ঘণ্টা-কাঁসর বাজিয়ে প্রতীকী সংহতি পালনের জন্যেও জনতাকে প্রস্তুতির সুযোগ দেওয়া হয়েছিল ! মোদী সরকার সরাসরি গরীব জনতার দুঃখ-যন্ত্রণা এড়িয়ে যেতে চেয়েছে, প্রথম থেকেই তাদের পদক্ষেপ অত্যন্ত একপেশে। কেবলমাত্র মুস্টিমেয় কিছু মানুষ, যারা এই সংক্রমণের হাত থেকে বাঁচতে বাড়তি অর্থব্যায়ের বিনিময়ে যেকোনো প্রয়োজনীয় পরিষেবা ক্রয় করতে সক্ষম তাদের বাদ দিলে বাকিদের জন্যে সরকারের অজুহাত একটাই – রাজকোষ ঘাটতি! দেশের জনগণের করের টাকায় গড়ে ওঠা রাজকোষের খরচ শুধুমাত্র কর্পোরেটদের ঋণমুকুব করতে কাজে লাগায় এই সরকার! এই লকডাউন পরবর্তী সময়ে দেশের অর্থনীতির উপরে আরও ভয়ঙ্করভাবে ধাক্কা দেবে বেরোজগারি, অনাহার এবং মূল্যবৃদ্ধি। তখন সরকারের পক্ষ থেকে সেই দায় সামলাতে অনেক বেশি চাপ পড়বে। অথচ ভবিষ্যতের সেই মূল্যবৃদ্ধির জুজু দেখিয়েই কোষাগারীয় ঘাটতি কমাতে এখন জনগণের জন্য বিনামূল্যে সরকারি গনবন্টন ব্যাবস্থা, স্বাস্থ্যপরিষেবার দায় এড়িয়ে যাচ্ছে কেন্দ্রীয় সরকার!
সরকারের এই দুর্যোগ মোকাবিলা করতে কত টাকা খরচ হতে পারে সেই নিয়ে বাস্তবিক হিসাব দেখিয়েছেন বিভিন্ন অর্থনীতিবিদেরা, একবার নয় – বারে বারে। সারা পৃথিবীতে মহামারীর মোকাবিলায় একের পরে এক দেশের সরকার মানবিক পদক্ষেপ গ্রহন করছে – ভারতে সরকার অত্যন্ত নির্লজ্জের মতো কৃপণতা দেখিয়ে চলেছে। যেকোনো অর্থনীতির সাথেই আষ্টেপৃষ্ঠে জড়িয়ে থাকে রাজনীতি, আরও সঠিকভাবে বললে বলতে হয় শ্রেণী রাজনীতি। দুনিয়াজূড়ে আজ প্রমানিত, নিজেদের ঐতিহাসিকভাবে পুনরাবির্ভাব হওয়া অর্থনৈতিক সংকট তো বটেই, এধরনের বিশ্বব্যাপী মহামারী রুখতেও Capital, Finanace, Profit Derivative এই শব্দগুলি আসলে এতটুকুও সক্ষম নয়। সমাজতান্ত্রিক শিবির আঘাতপ্রাপ্ত হবার পর থেকে এই ফিন্যান্স নির্ভর ব্যাবস্থা প্রচার করেছিল আর অন্য কোন পথ নেই – ” There Is No Alternative”। ফ্রান্সিস ফুকুয়ামা সেবার The End of History and the Last Man লিখে ফেলেন – আজ সেইসব তারা নিজেরাই আর মানতে পারছেন না। আমাদের দেশেও এমন একটা সরকার ক্ষমতায় বসে রয়েছে যাদের শ্রেণীস্বার্থ উৎকটভাবে প্রকাশ্যে একপেশে! এই মহামারীর বিপদের মুখে তাদের স্বরুপ আরও বেশি প্রকট হয়ে উঠেছে – দিনের হাতে রুমাল ছাড়া আর কিছু নেই মানুষের জন্য!
কোটি কোটি মানুষ তাদের জীবিকার উৎস হারিয়েছে, ক্ষুধা ও অপুষ্টি বাড়ছে, ইতিপূর্বেই সিপিআই(এম) এবং অন্যান্য বাম দলগুলির পক্ষ থেকে একাধিকবার কেন্দ্রীয় সরকারের কাছে আবেদন করা হয়েছে , প্রধানমন্ত্রীকে চিঠি লেখা হয়েছে। তাতেও কাজ না হওয়ায় গত ৬ এপ্রিল, রাষ্ট্রপতির কাছে আবেদন জানিয়ে চিঠি লিখেছেন সিপিআই(এম) সাধারণ সম্পাদক সীতারাম ইয়েচুরি।
সেই চিঠি পড়তে নিচের লিংক ব্যাবহার করুনঃ
রাষ্ট্রপতিকে সিপিআই(এম) সাধারণ সম্পাদক সীতারাম ইয়েচুরির চিঠি
কারোর মনে হতে পারে জনস্বাস্থ্য সম্পর্কিত আলোচনা লাফিয়ে এসে অর্থনীতির এলাকায় ঢুকে পড়ল কেন! আসলে জনস্বাস্থ্য, জনশিক্ষা, খাদ্যের গনবন্টন, জনগণের জন্য নিরাপদ আশ্রয়ের ব্যাবস্থা এই সব কিছুই একসুতোয় বাঁধা – সেই সুত্রেরই পোশাকি নাম অর্থনীতি।
অর্থনীতিকে রাজনীতি থেকে আলাদা করে দেখবার, বোঝবার পক্ষে বহু প্রচার হয়েছে, বহু অর্থব্যয় করে যুক্তি হাজির করা হয়েছে জেট প্রপালশানের হিসেব নিকেশও অর্থনীতির কাজে লাগে! ইকনোমেট্রিক্স ( Econometrics)’র নামে অর্থশাস্ত্রকে বহু বোঝা চাপিয়ে ভারাক্রান্ত করা হয়েছে যাতে সাধারণ কেউ অর্থনীতির কাছে আর যাই প্রত্যাশা করুন না কেন – ক্ষুধা, স্বাস্থ্য, শিক্ষা এবং সর্বোপরি মানুষের মতো বেঁচে থাকার দাবি না জানাতে পারেন! আসল কথাটুকু আজও একই রয়ে গেছে – তাই অর্থনীতির নামে যারা আসলে মানুষ মারার রাজনীতি করছেন তাদের কাছে মানুষ জবাব অবশ্যই নেবেন!
ভুলে গেলে চলেনা মুনাফানির্ভর সমাজব্যাবস্থা যাদের মাথায় বসিয়ে রাখে তাদের চরিত্র সম্পর্কে একটি গুরুত্বপূর্ন টিপ্পনী – “মুনাফার সুযোগ থাকলে ওরা মরা মায়ের চামড়া ছাড়িয়ে ডুগডুগি বাজাতেও পিছপা হবে না”… যিনি কথাটা বলেছিলেন তিনি লেনিন! দুদিন আগেই তাকে তার জন্মের সার্ধশতবর্ষে স্মরন করেছে গোটা দুনিয়া। মানুষের উপরে বিশ্বাস বজায় রেখে তাই এটুকু আশা অবশ্যই করা যায় যে লেনিনকে মনে রেখেই আগামিদিনে ভারতে নির্লজ্জ রাজনীতিকে পরাস্থ করতে এই ব্যাবস্থার গলাতেও মালা পরাবে দেশের জনগন!!