“Those who do not move, do not notice their chains.”- The Journey

দেবাশিস চক্রবর্তী

এই যে আমাদের রাজ্যে ইনসাফ যাত্রা হলো, ৫১ দিন ধরে প্রায় ৩ হাজার কিলোমিটার পথ বেয়ে, মানুষের সঙ্গে কথা বলতে বলতে, মানুষকে কিছু কথা বলতে বলতে পথ হাঁটা হলো, সে-কথা জানতে দেবে না বলে বাণিজ্যিক মিডিয়ার বড় অংশ সিদ্ধান্ত নিয়েছিল। কেউ বলবেন, ‘ব্ল্যাক আউট’। শুধু কি বামপন্থীদের চোখের আড়ালে রাখার মরিয়া চেষ্টায়? কথাগুলিকেও কম্বল-চাপা দেবার প্রয়াস নয় কি? যে-কথা মানুষ, বিধ্বস্ত, ছটফট করতে থাকা মানুষ বলেই ফেলেছেন, ভয়ের আগল ভেঙে সেই কথাগুলি যাতে আর কেউ শুনতে না পায়?

শুধু এই ইনসাফ যাত্রার সময়ে? শুধু আমাদের রাজ্যে? দেশের বাণিজ্যিক মিডিয়ার মোট সংবাদের মাত্র ০.৬ শতাংশ গ্রামের খবর। ভুখন্ডের ০.৬ শতাংশ কি গ্রাম? দেশের শহরে কাজ করা শ্রমজীবীদের ৫৩ শতাংশ পরিযায়ী। তাঁরা কেমন আছেন, কাজের সুরক্ষা আছে কিনা, থাকেন কোথায়, মজুরি পান কত, এক কথায় কেমন তাঁদের জীবনযাপন, জানা যায় কিছু? ৯৬ শতাংশ শ্রমজীবী অর্থনীতির ভাষায় অসংগঠিত ক্ষেত্রে কাজ করছেন- ঠিকা, অস্থায়ী, মরসুমী, চুক্তিভিত্তিক, অথবা নিছকই স্বনিযুক্ত। উৎপাদনের, পরিষেবার চাকা চালাচ্ছেন কিন্তু তাঁরা যেন থেকেও নেই। যদি না এঁদেরই কেউ কেউ ১৭ দিন আটকে পড়েন কোনো অন্ধকার নির্মাণ-সুড়ঙ্গে এবং তা ‘খবর’ হতে বাধ্য হয়। শহরের প্রায় এক-তৃতীয়াংশ বস্তিবাসী, অদৃশ্য এক যাপনকাহিনী তাঁদের। ‘তোমার ত্বকের নিচে তৃণবর্ণ দেশ শুয়ে আছে’, লিখেছিলেন আমাদের এক কবি।

এই দেশ যে মিডিয়ায় নেই, এই দেশ যে চিরন্তন ‘ব্ল্যাক আউটের’ কবলে পড়ে আছে, এই সত্যই মিডিয়ার এবং সমাজ-রাজনীতির ‘সেন্সরশিপ’। নীরবতার মাধ্যমে সেন্সরশিপ— সেন্সরশিপ থ্রু সাইলেন্স। জরুরী অবস্থা জারি না করেও যে সেন্সরশিপ চালু রাখা যায়। যে সেন্সরশিপ শুধু মিডিয়ায় নয়, সংক্রমিত হয় সামাজিক তর্কে-প্রতর্কে। যে কথাই আসল কথা, আসল কথা হওয়া উচিত তা হয়ে যায় প্রান্তিক এমনকি বিস্মরণের চাদরে ঢাকা।

শুধু এ দিয়ে হয়ত হয় না। তাই আরেকরকম সেন্সরশিপ লাগে। ইতালীয় লেখক উমবার্তো ইকো যাকে বলবেন ‘সেন্সরশিপ থ্রু নয়েজ’। এমন বিষয়ে চিৎকার জোড়ো, এমন তুচ্ছ কথাকে ঘিরে শোর মাচিয়ে দাও যে সত্যিই যা নিয়ে আলোচনা হবার কথা ছিল তা চাপা পড়ে যাবে। ইকো তাঁর এক প্রবন্ধে দেখিয়েছিলেন ইতালির টেলিভিশনে জোড়া মাথার বাছুর থেকে ব্যাগ ছিনতাইয়ের মতো এমন খবর নিয়ে ঘণ্টার পর ঘন্টা কাটিয়ে দেওয়া হচ্ছে যাতে সেই সময়ে অন্য যে খবর হওয়া উচিত ছিল তা আর হচ্ছে না। ইকোর হিসেব বলছিল, এক ঘণ্টার তথ্য স্রোতের তিন-চতুর্থাংশ এইরকম খবরে ডুবে যাচ্ছে যাতে আর নজরে না পড়ে অন্য কী ঘটে যাচ্ছে সেই সময়ে।

যত এই দুই সেন্সরশিপ বাড়বে, তত ফুটে উঠবে ফ্যাসিবাদের লক্ষণসমূহ। এই যোগসূত্রই আসল। তখন এই সেন্সরশিপ মিডিয়ার পরিধি থেকে ছিটকে পড়বে আমাদের প্রতিদিনের উঠোনের সামনে, আমাদের রাস্তায়, আমাদের পক্ষাঘাতগ্রস্ত মস্তিষ্কে, আমাদের বোবা জিহ্বায়।

২২ জানুয়ারি থেকে শুরু হবে এমন এক কান-ফাটানো, চোখ-ধাঁধানো চিৎকার, এক স্পেকটাকেল। রাম মন্দির নির্মাণ ঘিরে একদিকে চলবে অযোধ্যা থেকে বর্ণোজ্বল দৃশ্যমালার অবিরত প্রচার, অন্যদিকে দেশজুড়ে গ্রাম-শহরে ভজন-কীর্তন-অকাল দীপাবলির উৎসব। দীর্ঘ প্রস্তুতি চলেছে তার জন্য। ঘরে ঘরে পৌঁছে দেওয়া হচ্ছে বিশেষ চাল থেকে প্রদীপ, মন্দিরকে (রামেরই হোক বা অন্য যে দেবতারই) তৈরি রাখা হচ্ছে আয়োজনের জন্য। জাতীয়তাবাদের নব্য সংজ্ঞা নির্মাণের যে প্রক্রিয়া অনেক দিন ধরেই চলছে, যার কেন্দ্রে বৈচিত্র্যের বদলে প্রতিস্থাপিত করা হচ্ছে একীভূত এক ধর্মীয় পরিচিতির জাতিসত্ত্বাকে, তাকেই রাজমুকুট পড়ানো হবে এবার। যে রাষ্ট্রকে কোনো নির্দিষ্ট ধর্মের সঙ্গে মেশাবো না বলে এতদিনের চেষ্টা চলেছে, তার বিদায়বার্তা শুনিয়ে দেওয়া হবে।

দেশ সম্পর্কে, রাষ্ট্র সম্পর্কে, রাজনীতি সম্পর্কে যে ভাষ্য তৈরি করা হচ্ছে, তাকে যে নামেই ডাকা হোক না কেন তা আসলে ফ্যাসিবাদের ভাষ্য। সব ফ্যাসিবাদ এক রকমের দেখতে হয় না, হতেও পারে না, কিন্তু সব ফ্যাসিবাদী মতাদর্শ, অতি দক্ষিণপন্থার অভিন্ন কয়েকটি বৈশিষ্ট্য থাকে। উমবার্তো ইকো যাকে বলেছিলেন, ‘উর-ফ্যাসিজম’ (চিরায়ত ফ্যাসিবাদ)। মুসোলিনি-হিটলার নেই, কিন্তু ইউরোপের আজকের অতি দক্ষিণপন্থার অন্যতম উৎস হয়ে দাঁড়িয়েছে জাতিবিদ্বেষ- প্রধানত অভিবাসী-বিরোধী মতাদর্শ। ফ্রান্স থেকে উৎসারিত হয়েছে ‘গ্রেট রিপ্লেসমেন্ট’-এর তত্ত্ব, যা বলছে বিশুদ্ধ ইউরোপীয় সংস্কৃতিকে ধ্বংস করে দিচ্ছে অভিবাসীরা। ইউরোপীয়রা খতরে মে হ্যায়। জ্ঞানদীপ্তির সময়কার যুক্তিবোধের বিরুদ্ধে দাঁড় করানো হচ্ছে সনাতনী মূল্যবোধকে। ‘সনাতন’ শব্দের ভারতে যে হঠাৎ রমরমা, তা তেমন বিচ্ছিন্ন বিক্ষিপ্ত নয়! ‘ট্র্যাডিশনালিজম’ বা কোনো এক তথাকথিত চিরায়ত মূল্যবোধের ভজনা ফ্যাসিবাদের অনিবার্য উপাদান। তেমনই বৈচিত্র্যের বিরোধিতা। বৈচিত্র্যের অর্থ তো এই যে পার্থক্য থাকবে। যেমন আমাদের দেশে আছে— ভাষায়, পোশাকে, সংস্কৃতিতে এমনকি রাজনীতিতে। পার্থক্য নিয়ে এক তর্জনীর শাসন চলে না, পার্থক্য বস্তুত নিহিত এক বিরুদ্ধতা। সুতরাং বৈচিত্র্য থেকে এক ধাঁচের দিকে অভিযাত্রা ফ্যাসিবাদের কর্মসূচি। আমরা কি যথেষ্ট স্পষ্ট করে দেখতে পাচ্ছি না সেই অভিযান চলছে, অনেক দূর এগিয়েও গেছে? প্রথমে ধর্মের নামে, তারপরে ভাষার ওপরে, একদিকে পরিচিতিসত্ত্বার নামে বিভাজন অন্যদিকে সেই পরিচিতিসত্ত্বাকেই বড় এক ‘হিন্দুত্বের’ খাঁচায় ঢুকিয়ে দেওয়ার এই অভিযান এমন এক ভারত তৈরি করছে যা আমরা দেখিনি তো বটেই, যা আমরা কিছুদিন আগে কল্পনাও করিনি।

যেমন আমরা ভাবিনি আমাদের স্কুল-কলেজে এমন ইতিহাস পড়তে হবে যা মনগড়া, তা মুখস্থ করতে হবে যদি পরীক্ষায় পাস করতে হয়। আমরা ভাবিনি আমাদের সর্বোচ্চ আদালত যুক্তির বদলে বিশ্বাসকেই আশ্রয় করে রায় দিতে থাকবে, সংবিধানের আইনী বৈধতাও অনায়াসে অস্বীকার করা হবে। আমরা ভাবিনি একটা গোটা বছরে উমর খালিদের জামিনের আবেদন শোনার জন্য আধ ঘন্টা সময় দিতে আদালত ভয় পাবে। আমরা ভাবিনি একসঙ্গে ১৪৬জন সাংসদকে অধিবেশন থেকে বহিষ্কার করে দেওয়া হবে যাতে বিল পাস হয়। নতুন সংসদ ভবনে সাংসদরা প্রশ্ন তুলতে পারবেন না, এই অলিখিত ফতোয়া কার্যকর হয়ে যাবে। আমরা ভাবিনি নির্বাচন কমিশনার ঠিক করবেন প্রধানমন্ত্রী, তাঁরই পছন্দের আরেক কেন্দ্রীয় মন্ত্রী মিলে, সেখানে দেশের প্রধান বিচারপতি বাদ পড়ে যাবেন।

এইসব হতে পারছে, কেননা সমাজের মধ্যে তার নৈতিক বৈধতা তৈরির কাজ চলছে। সেই কাজের কিছুটা দৃশ্যমান, কিছুটা সন্তর্পণ। কিছুটা, হয়ত অনেকটাই সংখ্যাগুরুর ধর্মীয় পরিচিতির কাছে আহ্বান জানিয়ে, তাকে ব্যবহার করে; আর বাকিটা অর্থনৈতিক বৈষম্য ও প্রতিদিনের সঙ্কটে ভুগতে থাকা মানুষের সামনে মিথ্যার এক মহা-কাঠামো তৈরি করে। গণশক্তির প্রতিষ্ঠা বার্ষিকীর সভায় সাংবাদিক শশী কুমার ‘মিথ্যার বাস্তুতন্ত্র’ শব্দগুচ্ছ ব্যবহার করেছেন। টানা, ধারাবাহিক মিথ্যার এই বাস্তুতন্ত্রে সত্য বলা কঠিন, সত্য এক সময়ে ক্লান্তও বোধ করতে পারে। শশী কুমার আরেকটি শব্দও ব্যবহার করেছেন— ভুয়ো তথ্যের কার্পেট বম্বিং হচ্ছে। সেখানে মিডিয়া রয়েছে, সরকারী প্রচার রয়েছে, প্রযুক্তিকে ব্যবহার করে সমান্তরাল প্রচার রয়েছে। এক মিনিটে ৬৪ কোটি লোকের কাছে শুধু হোয়াটসঅ্যাপ-ফেসবুকে পৌঁছে যাবার ক্ষমতা রয়েছে আরএসএস-এর।

পুঁজির শাসন এদেশে নতুন কিছু নয়। কিন্তু এই শাসন এখন অনিয়ন্ত্রিত, বাধাহীন, বস্তুত উন্মত্ত আকার নিয়েছে। দুটি-তিনটি কর্পোরেট গোষ্ঠী দেশের যাবতীয় সম্পদের দখল নিচ্ছে, বন্দর থেকে বিমানবন্দর, খনি থেকে পেট্রোলিয়াম, বিদ্যুৎ থেকে খাদ্যপণ্য। মনোজগত, বুদ্ধির জগতেরও দখল নিতে কর্পোরেট কিনে নিচ্ছে মিডিয়া। লুটেরা পুঁজির এত শক্তি যে তার স্বার্থ দেখে ভারত সরকারকে বিদেশনীতি তৈরি করতে হচ্ছে। শ্রমনীতি তো বটেই। বিরুদ্ধতার, প্রতিবাদের, আন্দোলনের একটি একটি করে সব রাস্তাই বন্ধ করা হচ্ছে। এক খাঁচায় ধীরে ধীরে বন্দি করা হচ্ছে আমাদের জন্মভূমিকে।

মনে হয়, আর অপেক্ষার সময় নেই, দ্বিধারও কোনো অবকাশ নেই। ফ্যাসিবাদকে পূর্ণ আধিপত্যের আগেই প্রতিরোধের মুখে ফেলে দেওয়া ইতিহাসের পাঠ হবে। এ কাজ কর্পোরেটের টাকায় দল চালানো, সঙ্ঘেরই হাতে প্রত্যক্ষ-পরোক্ষে তৈরি হওয়া, মতাদর্শগত ভাবে দেউলিয়া রাজনীতির কাজ নয়। অপেক্ষাকৃত ছোট আকৃতির প্রতিক্রিয়ার শক্তি, পাড়া-বেপাড়ার মস্তান প্রতিক্রিয়ার শক্তি অনেক বড় প্রতিক্রিয়ার শক্তির সঙ্গেই চলে যাবে। কখন যাবে, কবে যাবে, কীভাবে যাবে তা নানা উপাদানের ওপরে নির্ভর করতে পারে। হিন্দুত্বের বুলডোজারের মুখে নরম হিন্দুত্বের রথ টেনেও এই বিপর্যয় আটকানো যাবে না। রাস্তাঘাটে লড়াই, রুটি-রুজির লড়াই আর মতাদর্শের লড়াইকে এক সুতোয় বেঁধে এখন প্রতিরোধের প্রাথমিক দায় বামপন্থার।

অসহায় খাঁচার পাখি বলেছিল, বলবেও, খাঁচার গান শিখে নিতে। রবীন্দ্রনাথের বনের পাখি বলেছিল, ‘না, আমি শিখানো গান নাহি চাই’। খাঁচা ভাঙার এই সময়ে স্বাধীনতার কুণ্ঠাহীন নির্ভয় গান আমাদের গাইতেই হবে। 

ছবিঃ সোশ্যাল মিডিয়া সুত্রে সংগৃহীত

Spread the word

Leave a Reply