There is no stopping anywhere :Samprikta Bose

৫ জুলাই, ২০২৩ সোমবার

প্রথম পর্ব

ব্যস্ত শহর, ত্রস্ত পা, ক্লান্ত মানুষজন! ঘামে ভেজা শরীর আরো আরো বেশী ক্লান্ত এই অসম্ভব রোদ, গরমে..”প্রখর দারুন অতি দীর্ঘ দগ্ধ দিন” সেই ঝলসানো সময়েই প্রতি বছরের মতো এবার ও ৫ই জুন ২০২৩ এসেছে, যে দিন বিশ্ব পরিবেশ দিবস। যখন আজ আমরা এই নিয়ে কথা বলছি তখন রাজ্যের তাপমাত্রা কখনো ৪০-৪২ বৃষ্টি নিয়ে কোনো কথা আবহাওয়া দপ্তর থেকেও বলতে পারছে না, বলছে চলবে এমন ই তাপপ্রবাহ । কিন্তু কেন, কেন আমাদের দেশে এই অবস্থা? আসলে

‘পশ্চিমী ঝঞ্জা “র প্রভাবে পাহাড়ি অঞ্চলে যে তুষারপাত হয় তা এবছর হয়নি, এ বার কালবৈশাখীর প্রভাব ও কম, আবার ‘লা নিনা’র (উষ্ণ জল স্রোত)’ প্রকোপ চলছে, ফলত এশিয়াতে গরম জল বঙ্গোপসাগরের দিকে আরো অনেক বেশি প্রবেশ করছে ফলে তাপপ্রবাহ বাড়ছে!

এগুলো অবশ্য ই কারণ, কিন্তু একটু গভীরে গেলেই বুঝতে পারব ‘দারুণ অগ্নিবানে ‘ সমগ্র পৃথিবীর তাপমাত্রা যে হারে বেড়ে চলছে, মেরুর বরফ গলছে, অর্থাৎ গ্লোবাল ওয়ার্মিং বা বিশ্ব উষ্ণায়ন হচ্ছে এই বিষয় গুলোর পেছনে আছে আরো বড় কারণ।

আগামী ২০বছরে পৃথিবীর তাপমাত্রা বাড়তে পারে ১.৪°C, তলিয়ে যেতে পারে বহু শহর, দ্বীপ, আরো আরো অনেক কিছু।

শুধুই কী তাপপ্রবাহ? না! আসলে ঘটনা আরেকটু, মানে আরো অনেকটাই বড়! কালো ধোঁয়ায় ছেয়ে যাচ্ছে সারা পৃথিবী, ওয়াটার টেবিলের হাইট কমছে রোজ, পৃথিবীর বুক থেকে নিশ্চিহ্ন হয়ে যাচ্ছে হাজার হাজার জীব.. ‘ তোমার প্রিয় ঋতু বর্ষা তাই / সারা বছর ধরে মেঘ জমাই “ বলতে পারি বা না পারি কখনো অসময়ে অনেক বৃষ্টি চলতেই পারে, আবার আপনি ‘Sunkissed’ বলে ছবি দিতে ভালোবাসুন বা না বাসুন এই সীমাহীন গরম আপনাকে সহ্য করতেই হবে।

তাহলে? এবার কী করা যায়? জলবায়ু পরিবর্তন তো আর আমাদের হাতে না! আলবাৎ আমাদের হাতে। এই করোনা অতিমারিতে লকডাউনের সময়ে যখন গাড়ি চলছিল না, কল কারখানা বন্ধ ছিল, তখন পরিবেশের গুণগত উন্নতি, Anthropogenic Disturbance বা মানুষের অপব্যবহারের কারণে পরিবেশের ওপর কী চরম আক্রমণ নামিয়ে এনেছে, সেটাই চোখে আঙ্গুল দিয়ে দেখিয়ে দিয়েছে। এই ‘Anthropogenic Disturbance ‘ কে “Over utilisation of Resources by people without leaving them for future use. “এতোটা generalised করে ফেলাটা বোধহয় ঠিক হবেনা!

আর এখানে ‘people’ বলতে কি সব ‘people’ এর ই অবদান আছে এই বিপর্যয়ে? হ্যাঁ আছে, কিন্তু সব ‘people’ ই কী সমান অংশীদার? সব ‘people’ ই কী একইভাবে দোষী?

এই উত্তর খুঁজতে গেলে একটু গোড়ার কথায় যেতে হবে। ওই যে back to basics, মানে স্বাভাবিক ভাবেই ‘Back to Marx ‘

পুঁজি বনাম শ্রমের দ্বন্দ্ব! সমাজকে দেখার যে আঙ্গিক পুরো পৃথিবীর দর্শন ই বদলে দিল, সেই দর্শন ই ‘Climate Change ‘ এর সমস্যা কেও বুঝিয়ে দিতে পারে।

পুঁজি বনাম পরিবেশ! এই কথা খুব স্পষ্ট ভাবে সামনে আসে যখন ২০১৪ এ নাওমি ক্লেইন তাঁর একটি বই তে ‘Capitalism v/s Climate’ কথাটি সাবটাইটেল হিসেবে ব্যবহার করেন।

পুঁজি বনাম শ্রম কেন বলছি? যদি ইতিহাসে ফিরে যাই দেখব সামন্ততন্ত্রে ছিল জল-জমির ওপরে একজন ব্যক্তির নিরবচ্ছিন্ন অধিকার এবং ক্রীতদাসদের ওপর পাশবিক শোষণ! আর এখন? সেই শোষণের ট্র‍্যাডিশন কিন্তু সমানে চলছে। শুধু এখন জল জঙ্গল জমির ওপর একছত্র মালিকানা কায়েম করতে চাইছে পুঁজিবাদ তথা ধান্দার ধনতন্ত্র। আসলে পুঁজির অবিরত বৃদ্ধি, কয়েক লক্ষ বছর ধরে বিকশিত প্রকৃতির অন্তর্বর্তী বিভিন্ন জটিল কালচক্রে বাধা সৃষ্টি করে , এর ফলে (মার্ক্সের কথায়) সমাজ ও প্রকৃতির অভ্যন্তরীন “metabolism”-এ ফাটল দেখা দেয়। আর তাই জলবায়ু পরিবর্তন এবং কার্বন, জল, ফসফরাস বা নাইট্রোজেনের জৈবিক চক্রে সংকট; জীববৈচিত্র্যের দ্রুততর হ্রাস; মাটির গুণমানে অস্বাভাবিক পরিবর্তন; এবং শিল্পাঞ্চলের রাসায়নিক দূষণ: এই সবই মানব সমাজের জন্য চূড়ান্ত আশঙ্কার অর্থাৎ, উৎপাদন এবং পুনরুৎপাদনের জন্য প্রয়োজনীয় নির্দিষ্ট প্রাকৃতিক পরিবেশের ক্ষয়, আর এই ধ্বংসাত্মক প্রবণতার সাথে, পুঁজিবাদের সৃষ্ট,দারিদ্র্য এবং চরম বেকারত্বের শিকার, সহস্র লক্ষ মানুষের সামাজিক এবং বস্তুগত বৈষম্যের সরাসরি যোগ রয়েছে।

“বাতাসে যারা মিশিয়েছে বিষ, মানুষ যারা মারে..”

আসলে পরিবেশের উপর পুঁজিবাদী আক্রমণ এর উদাহরণ লিখতে গেলে এক পৃথিবী লিখতে হবে। কলকাতা দিয়েই শুরু করি? ধরুন ইস্ট কলকাতা ওয়েটল্যান্ডসঃআমরা সকলেই নামটির সঙ্গে পরিচিত, কলকাতা মেট্রো সিটি হওয়া সত্বেও অন্যান্য মেট্রো সিটি গুলির থেকে জীবনধারণ এর মূল্য যে সস্তা, তার অন্যতম মূল কারণ এই ইস্ট কলকাতা ওয়েটল্যান্ডস। কিছু তথ্য দিলে বোঝা যাবে এই জলাজমি কিভাবে আমাদের প্রানবায়ু কে রক্ষা করছে।

মোট এলাকা ১২৫ বর্গ কিমি

সিয়েজ ট্রিট্মেন্ট (পয় নিষ্কাশন) ৬০০ মিলিয়ন লিটার

আবর্জনা নিষ্পত্তি ৪৫০০ টন

উৎপাদিত শাকসবজি ১৫০ টন

উৎপাদিত টেবিল ফিশ ৩০ টন

কর্মসংস্থানের ব্যবস্থা হয়েছে ১ ল লক্ষের জন্য

সিয়েজ ফেড ফিশারিজ ২৫৪

অনুপ্রবেশের বিরুদ্ধে এফআইআর ৩৫৭

এহেন প্রানবায়ু তে গত ১০ বছর যাবৎ রাজ্য সরকার শুধু মাত্র টাকা আর তোলাবাজির জন্যএই জলাজমির বৃহৎ অংশ বুজিয়ে গড়ে তুলেছে নানান নির্মান। কসমেটিক সৌন্দর্য বাড়াতে গিয়ে এই কাজ শুধু অবৈজ্ঞানিক নয় সাংঘাতিক ও বটে। কলকাতা ওয়েটল্যান্ড নিয়ে পরিবেশবিদদের হাজারো সচেতনতা, সতর্কীকরণ এর পরেও কোন পদক্ষেপ নিতে রাজ্য সরকার নারাজ। আসলে লুটে টান পড়বে যে! ‘রামসার সাইটে’ র গর্ব ধারণ করা এই জলা জমি তাই আজ সংকটের মুখে। আর স্বাভাবিক ভাবেই তার সাথে সংকটে গোটা কলকাতার জলবায়ু, পরিবেশ,বিপন্ন আমি, আপনিও।

সরকারের অবিমৃষ্যকারিতার উদাহরণ লাখো লাখো! পশ্চিমবঙ্গের উপকূলবর্তী অঞ্চলগুলো অবহেলার ফলে বন্যা প্রবণ ও হয়ে উঠেছে, ফলে বিপন্ন হচ্ছে এই অঞ্চলের হাজারো মানুষের জীবন জীবিকা। কখনো দীঘা কখনো মন্দারমনি কখনো তাজপুরের সৌন্দর্যায়ন হচ্ছে এবং তার থেকে লক্ষ লক্ষ টাকা মুনাফা হচ্ছে বটে কিন্তু এই অঞ্চল গুলির গুণগত উন্নয়ন বা পরিবেশ রক্ষার দিকে কোন খেয়াল নেই পশ্চিমবঙ্গ সরকারের, শুধুই আছে গালভরা কথা! ফলত এই উপকূলবর্তী অঞ্চলগুলোর মতো, এই অঞ্চলের মানুষদের ভবিষ্যত ও তলিয়ে যাচ্ছে বঙ্গপো সাগরের তলায়..

এবার আসা যাক আমাদের অন্যতম গর্ব পৃথিবীর বৃহত্তম ম্যানগ্রোভ অঞ্চল সুন্দরবনের কথায়! আমাদের এই দুর্নীতিতে আপাদমস্তক ডুবে থাকা রাজ্যের সরকারের আমলে সুন্দরবন কতটা ‘ সুন্দর ‘ আছে তা ভাবতে গেলে বেগ পেতে হবে!

বেশ কিছু বছর ধরেই উধাও হচ্ছে সুন্দরবনের ম্যানগ্রোভ, যা আরো ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে আমফান বা ইয়াসের ফলে। আসলে, এই সময়ে এই তথ্য বাইরে এলেও, এই ক্ষয়ক্ষতি কিন্তু শুরু হয়েছে বিগত বেশ কিছু বছর ধরেই। স্থানীয় বাসিন্দা, বিশেষত মহিলারা, যাঁরা আগলে রাখেন এই অঞ্চল, তারা ক্ষুব্ধ এই ঘটনায়। তাঁদের অভিযোগ, একশো দিনের কাজে ম্যানগ্রোভ লাগানোর পরিকল্পনা নেওয়া হলেও তা কার্যকরী হয়না।বনদফতরের কর্মীরা অবৈধভাবে সুন্দরবনের গাছ কাটা বন্ধ করা তো দুরস্ত বরং চোরাশিকারিরা তাদের কাছ থেকে মদত পায় বলেও অভিযোগ করছেন সুন্দরবনে বসবাসকারীদের এক বৃহৎ অংশ। বলাই বাহুল্য, সরকারের প্রচ্ছন্ন মদত ছাড়া চোরাকারবারিদের এই রমরমা এক প্রকার অসম্ভব। অথচ সুন্দর বন নাকি হেরিটেজ অঞ্চল!

সুন্দরবন আসবে আর Royal Bengal Tiger আসবে না, তা কি হয়?

এই বাঘ সংরক্ষণে “ভারত আবার জগৎ সভায় শ্রেষ্ঠ আসল লবে” এমনটাই বলছে ইন্টারনেট! আসলে ভারতবর্ষ পৃথিবীর অন্যতম দেশ যেখানে সবচেয়ে বেশী বাঘ পাওয়া যায়।২০১৮ সালে ২০০৬’এর দ্বিগুণ হয়ে গেছে বাঘের সংখ্যা! ভারতের জাতীয় পশু বাঘ! (সে নিয়ে এখন ডিবেট থাকতেই পারে যে বাঘ মাংস খায় বলে, গরুর জাতীয় পশু হওয়া উচিত কিনা, যাই হোক..) এতো ভালো ভালো খবরে গর্বে ৫৬’ থেকে ৫৮’ হয়ে যাওয়ার জোগাড়!

কিন্তু প্রদীপের নীচে অন্ধকারের মতোই পরিবেশের গল্পটা একটু অন্য। কনসার্ভেশান বায়োলজিস্টদের মতে, আসল সাফল্য তখনই আসবে, যখন আমরা বাঘের ভৌগোলিক পরিসর বাড়াতে পারব কিন্তু তার আশা দেখা যাচ্ছে না তার কারণ, হারিয়ে যাচ্ছে একের পর এক সংরক্ষিত অঞ্চল.. বিক্রী হয়ে যাচ্ছে একের পর এক বনাঞ্চল!

এই লকডাউনের সুযোগ নিয়ে আমাদের দেশের সরকার যেমন একের পর জন বিরোধী পদক্ষেপ নিয়ে ছিল, কখনো NATIONAL EDUCATION POLICY 2020র নামে শিক্ষাকে কর্পোরেটদের হতে তুলে দিচ্ছে, কৃষি আইন, শ্রম কোডের দ্বারা অনিশ্চয়তার মধ্যে ঠেলে দিচ্ছে দেশের শ্রমিক কৃষকের ভবিষ্যৎ, ব্যাংক, বীমা, রেল, স্বাস্থ্য বিক্রি করতে চাইছে সবকিছু।এতেও তৃপ্ত না হয়ে

এই লুটেরারা হাত বাড়িয়েছে পরিবেশের দিকেও। তারা নিয়ে এসেছে EIA 2020 খসড়া নীতি, যা আসলে পরিবেশকে কর্পোরেটদের হতে বিক্রী করে দেওয়ার ব্লুপ্রিন্ট।

EIA বা Environmental lmpact Assessment কী?

১৯৯৪ সালে, পরিবেশ সুরক্ষা আইন, ১৯৮৬ এর অধীনে প্রথমবারের মতো ভারতে ইআইএ (EIA) বিজ্ঞপ্তি বা ENVIRONMENTAL IMPACT ASSESSMENT NOTIFICATION প্রণয়ন করা হয়েছিল।

It Is a ‘Process used to assess the analysing studying and predicting the effect of a proposed industrial or infrastructural project on the environment. The process itself tries to prevent the approval and initiation of the proposed activity without proper oversight or taking adverse consequences on the environment.”

উদা: নদীর উপত্যকা প্রকল্প (রিভার ভ্যালি প্রজেক্ট)

৪টি ধাপে এই প্রক্রিয়া টি সম্পন্ন করা হয়:

Screening, scoping, public consultation, ও appraisal.

কেন বারবার আমরা #RejectDraftEIA2020 বলে আওয়াজ তুলছি?

যেখানে পরিবেশ রক্ষার জন্য জনগণের সাথে মতামত এবং আলোচনা আরও তীব্র হওয়ার প্রয়োজন তার বদলে EIA ২০২০ পরিবেশের ওপর পুঁজিবাদী আক্রমণের পথ আরোই মসৃণ করে দিল!

লেখাটি দুটি পর্বে প্রকাশিত…

রেফারেন্স: ড: পার্থিব বসু, ড: অনিরুদ্ধ মুখোপাধ্যায়, ড: তপন সাহা, সাম্যজিত গাঙ্গুলি, বাসব বসাক, তপন মিশ্র, ড: পুনর্বসু চৌধুরী।
রয়টার্স, রিসার্চ গেট, গণশক্তি পত্রিকা

Spread the word

Leave a Reply