এই সংকটে নীরবতা নয় :অমিয় পাত্র…

২৭ মার্চ ২০২২ (রবিবার)

এই দুনিয়ার চালিকাশক্তি যে শ্রমজীবীরা, যারা তাদের শ্রমের বিনিময়ে আমাদের সকলের খাদ্যের যোগান দিয়ে থাকে তাদের অনেকে সব দিন দু-বেলা ভরপেট খেতে পায়না। এই খেটে খাওয়া মানুষের শ্রম দেওয়ার সামর্থ্য টুকুইতো সম্বল। এদের জমিজিরেত নেই বললেই চলে, থাকলেও যৎসামান্য। কারও দু-এক বিঘা জমি যা আছে তা থেকে এক-দেড় মাসেরও দিন গুজরান হয়না। বিজ্ঞান প্রযুক্তির অভাবনীয় অগ্রগতির যুগে মাটি কাটা, ফসল সংগ্রহ , আলু পোতাসহ প্রায় সবকিছুই মেশিনে হচ্ছে। তাই মজুরদের কাজের সুযোগ দিন দিন কমছে। এলাকাভেদে একটু কমবেশি থাকলেও চাষের কাজ গড়পড়তা বছরে ৪০-৪৫ দিন। এই কাজের বেশিরভাগ খেতমজুর মহিলারা করে থাকে। কেন্দ্রীয় সরকারের বিরুদ্ধে লড়াই করে আদায় করা কমপক্ষে ১০০ দিনের কাজের নিশ্চয়তার আইনে(রেগায়) গড়ে ৩৫- ৪০ দিন কাজ জোটে। আইনের গ্যারান্টি আছে, কিন্তু ১০০ দিন কাজ পাওয়া যাচ্ছে না। অন্যদিকে শাসক দলের পেটোয়া লোকজন কাজ না করেও এই লুটের রাজত্বে ১০০ দিনের বা তারও বেশি দিনের মজুরি পেয়ে যায়। গরীবের কাজের টাকা লুট হচ্ছে, প্রকল্পের অস্তিত্ব নেই অথচ মজুরির টাকা খরচ হয়ে যাচ্ছে, যন্ত্রদিয়ে মাটি কাটার কাজ বে-আইনি কিন্তু বিনা বাধায় হরদমই করে চলেছে। কোন প্রতিবাদকে ওঁরা পাত্তা দেয় না। প্রতিবাদ করলেই তাদের ভয় দেখানো হয়, কাজ থেকে ছাঁটাই করে দেওয়া হয়। এই অবস্থায় গরীব পরিবার নারী-পুরুষ উভয়ের চেষ্টায় বছরে হরেদরে ১০০-১২০ দিন কাজ কোনক্রমে জোটে । কিন্তু পেট চালাতে হয় ৩৬৫ দিন, উনুনে হাড়ি চড়ে ৩৬৫ দিন। এই যে বছরে প্রায় ২৪০ দিন কাজ জোটে না এই ফাঁকটা কি ‘লক্ষীর ভাণ্ডার’ পুরণ করতে পারে? না, পারেনা।

রেগায় ১০০ দিন কাজের মজুরি ২১৩০০ টাকা যা নিশ্চিতভাবে প্রতিটি পরিবারের আইন অনুযায়ী প্রাপ্য কিন্তু বাস্তবে বছরে গড়ে ৪০ দিন কাজের জন্য প্রায় ৮৫২০ টাকা পেয়ে থাকে । অর্থাৎ প্রাপ্য মজুরি বাবদ বছরে প্রায় ১২৭৮০ টাকা থেকে প্রতিটি পরিবার বঞ্চিত হচ্ছে। একদিকে প্রতিশ্রুতির ফুলঝুরি ছুটছে অন্যদিকে অভূক্ত,অর্দ্ধভূক্ত মানুষের সংখ্যা বেড়েই চলেছে । কোনক্রমে বেঁচে থাকার জন্য অকৃষি ক্ষেত্রে কাজের সন্ধানে ছুটে বেড়াচ্ছে। কারও জোটে, কারও জোটে না। কাজ কম, মজুর বেশি ফলে মজুরি কমছে। এদের একাংশ বাধ্য হয়ে কাজের জন্য অন্য রাজ্যে যেতে বাধ্য হচ্ছে। এই অবস্থা চলতে পারেনা। বছরে ২০০ দিন কাজ এবং দৈনিক ৬০০ টাকা মজুরির দাবি করা হয়েছে কিন্তু সরকার এই ন্যূনতম দাবি বিবেচনা না করে রেগার কাজের জন্য বরাদ্দের পরিমাণ ক্রমাগত হ্রাস করে চলেছে।

পশ্চিমবাংলার মানুষ কাজ, খাদ্য, মজুরি,আবাস, পানীয়জল, ও জমির অধিকারের দাবীতে দুর্বার আন্দোলন দেখেছে। আন্দোলনের ফলেই কাজের বিনিময়ে খাদ্য, খাস জমির পাট্টা, বাস্তু জমির ব্যবস্থা, মজুরি বৃদ্ধি, ভাগচাষের অধিকার নথিবদ্ধ করা- এমন অনেক অধিকার আমরা পেয়েছি। ১০০ দিনের কাজ, স্কুলে দুপুরের খাবার, খাদ্য সুরক্ষা আইন এসব-ই লড়াইয়ের প্রাপ্তি। প্রতিটি লড়াইয়ে গরীবের হাতে ছিল লালঝাণ্ডা। আজ যারা শাসক তারা কোনদিন গরীবের আন্দোলনের পাশে ছিল না। ভবিষ্যতেও থাকবেনা। লড়াই শোষিত,বঞ্চিত মানুষের সঙ্গে গরীবের শ্রমের মূল্য হজম করা জমিদার, পুঁজিপতিদের। এ লড়াইয়ে শোষকের দাপট বেশি কারণ রাষ্ট্র বা সরকার ওদের সাথে। লোকজন বেশি শোষিতের পক্ষে কিন্তু তারা অনেকেই নিজেদের স্বার্থ সম্পর্কে সচেতন নয়, ফলে জোটবদ্ধ নয়। গরীবের শত্রুদের বা শোষকশ্রেণীর রাজনৈতিক খেলাটা হল গরীবদের জোট ভাঙ্গার মারাত্মক খেলা। জাত, ধর্ম, পরিচিতির হাতিয়ারকে কাজে লাগিয়ে গরীবের একতা চূর্ন করো, ভয় দেখাও, লোভ দেখাও, ভিত্তিহীন প্রতিশ্রুতি দাও, প্রয়োজনে পুলিশকে ব্যবহার করো। শাসক দল চায় জাতের জন্য, ধর্মের জন্য লড়াই হোক, রক্ত ঝরুক, প্রানঘাতী দাংগা হোক কিন্তু কাজের জন্য, খাদ্যের জন্য বা মজুরির জন্য লড়াই যেন দানাবাঁধতে না পারে। আমাদের পথ একটাই- লড়াই, লড়াই এবং লড়াই। সব খেটে খাওয়া মানুষকে ঐক্যবদ্ধ করে লড়াই। দাবি আদায় না হওয়া পর্যন্ত লাগাতার লড়াই। দিল্লির উপকন্ঠে সমবেত কৃষকদের পথেই হাল না ছাড়ার লড়াই। এই লড়াইয়ে সারা দেশের শ্রমজীবী, কৃষক, কর্মচারী সহ গণতান্ত্রিক মানুষ সামিল হবে ২৮ এবং ২৯ মার্চ সাধারণ ধর্মঘটে।

একজন শ্রমিকের ন্যুনতম দৈনিক মজুরি হবে সেই শ্রমিকের পরিবারের একদিনের ভরনপোষণের ব্যয় সংকুলানের সমান বা বেশি । এই ন্যুনতম মজুরি শ্রমিককে কোনক্রমে বাঁচিয়ে রাখতে পারে যদি সে প্রতিদিন কাজ পায়। প্রতিদিন কাজ পাওয়ার কোন বাস্তবতা এ রাজ্যে নেই। রাজ্যের সরকার ন্যুনতম দৈনিক মজুরি নির্ধারণ করেছে ২৬৪ টাকা। সেটাও কাগজে কলমে। বেশ কয়েকটি জেলায় চালু মজুরি দৈনিক ২০০ টাকার কম। বাম-গণতান্ত্রিক সরকারের সুবাদে কেরালায় কৃষিমজুররা দৈনিক ৬৭৭.৬০ টাকা মজুরি পায় (রিজার্ভ ব্যাঙ্ক অফ ইন্ডিয়ার তথ্য অনুযায়ী) । যদিও কেরালায় অ-কৃষি ক্ষেত্রে দৈনিক মজুরির হার ৭০০-৯০০ টাকার মধ্যে। আমাদের শ্রমজীবীদের বাঁচা-মরার বিষয়টি নির্ভর করছে বছরে কতদিন কাজ পাবে এবং কি হারে মজুরি পাবে তার উপর। বর্তমানে অতিমারির পরিস্থিতিতে প্রতিটি পরিবার মাথা পিছু মাসে ৫ কেজি খাদ্যশস্য বিনামূল্যে রেশন ব্যবস্থার মাধ্যমে পেয়ে থাকে। কোভিড পরিস্থিতিতে বহু মানুষ কাজ হারিয়েছে। এই রুজিরোজগারহীন মানুষের কথা বিবেচনায় রেখে আমরা সকল পরিবারের জন্য মাথাপিছু ১০ কেজি খাদ্যশস্য বিনামূল্যে প্রদানের দাবি করে করেছি । কেন্দ্রীয় সরকারের অনিচ্ছা সত্ত্বেও মাসে মাথাপিছু ৫ কেজি খাদ্যশস্য আদায় করা সম্ভব হয়েছে। মাথায় রাখতে হবে এই অতিরিক্ত খাদ্যের সরবরাহ কেন্দ্রীয় সরকার যে কোন দিন বন্ধ করতে পারে। আমাদের দাবি ছিল রেগার কাজে বরাদ্দ বাড়িয়ে দ্বিগুণ করা কিন্তু এই খাতে মোদি সরকার ক্রমাগত বরাদ্দ কমিয়ে চলেছে। ধনীদের সেবক মোদি সরকার ধীরে ধীরে ১০০ দিনের কাজ, আই সি ডি এস প্রকল্প এমনকি গণবন্টন ব্যবস্থা তুলে দেওয়ার রাস্তায় হাঁটা শুরু করেছে। এই গনবিরোধী নীতিসমূহ প্রতিরোধ করতেই হবে।
কৃষি ক্ষেত্রকে বৃহৎ পুঁজি এবং কর্পোরেট সংস্থার স্বার্থে তুলে দেওয়ার চেষ্টা চলছে। কৃষি পণ্যের পাইকারী ব্যবসা এবং উৎপাদনে যুক্ত হতে চলেছে আদানি গোষ্ঠীসহ অনান্য কর্পোরেট সংস্থা- তার ইংগিত স্পষ্ট। এ রাজ্যের সরকার সেটাই চায় তাই কর্পোরেট স্বার্থে আইনী সুরক্ষার ব্যবস্থা করা হয়েছে। এর সঙ্গে দুটি বিষয় সরাসরি যুক্ত। কর্পোরেটের স্বার্থ রক্ষাকারী সরকার কখনো ফসলের সহায়ক মূল্য দেবেনা। ফলে কৃষক আরও দেনাগ্রস্থ হবে। জমি ছাড়তে বাধ্য হবে। এই সুযোগে জমিতে থাবা বসাবে কর্পোরেট। কৃষি হবে প্রযুক্তি নির্ভর। কাজের যেটুকু সুযোগ রয়েছে তাও থাকবে না। এর সর্বনাশা পরিনতিতে সবচেয়ে ক্ষতিগ্রস্ত হবে কৃষক ও খেতমজুর। এই বিপদ রুখতেই হবে। এই লড়াইয়ের অন্যতম দাবি তাই কৃষি ও কৃষকের স্বার্থে ফসলের সহায়ক মূল্যের।

দেশ জুড়ে ধর্মঘট হবে দেশ বাঁচানোর লক্ষ্য কে সামনে রেখে। এই সরকার বেপরোয়াভাবে দেশের সম্পদ কর্পোরেট স্বার্থে জলের দরে হস্তান্তর করে চলেছে। দেশের গনতন্ত্র বিপন্ন। কেড়ে নেওয়া হচ্ছে আমাদের অর্জিত অধিকার, জেট গতিতে মূল্যবৃদ্ধি জনজীবনকে দুর্বিষহ করে তুলেছে। দেশের অর্থনীতি বিপর্যস্ত। এই অবস্থা নীরবে মেনে নেওয়া যায়না। তাই দেশ বাঁচানোর লড়াইয়ে সর্বস্তরের জনগণকে সামিল হওয়ার আহ্বান জানানো হচ্ছে।

Spread the word

Leave a Reply