কাজের কোন দিশা নেই, ঋণের ফাঁদে রাজ্যকে নিয়ে যাচ্ছেন মমতা – চন্দন দাস…

১১ মার্চ ২০২২ শনিবার

মমতার হাসি ফোটানোর বাজেট:
কাজের খোঁজ নেই, ঋণের জাল জোরালো হচ্ছে

‘‘এই বাজেট সাধারণ মানুষের মুখে হাসি ফোটানোর বাজেট।’’ শুক্রবার মমতা ব্যানার্জি বলেছেন। বিধানসভায়।
শুক্রবার ২০২২-২৩ আর্থিক বছরের বাজেট পেশ করেছে রাজ্য সরকার। বাজেট পেশ করেছেন চন্দ্রিমা ভট্টাচার্য — তিনি রাজ্যের অর্থ দপ্তরের স্বাধীন দায়িত্বপ্রাপ্ত রাষ্ট্রমন্ত্রী।
অর্থ দপ্তর রাষ্ট্রমন্ত্রীর হাতে থাকতে পারে — এটিই দেশে এক বিরল ঘটনা। বাজেটকে অত্যন্ত গুরুত্বহীন মনে করেন মমতা ব্যানার্জি — বলাই বাহুল্য।
কিন্তু তবু বাজেট রাজ্য সরকারের প্রবণতার আয়না।
প্রমাণ — উৎসব। দুর্গাপূজা।
রাজ্য বাজেটে বরাদ্দ ছিল ৯৯ কোটি ৮৫ লক্ষ টাকা। কিন্তু খরচ হয়েছে ২০৪ কোটি টাকা। অন্তত ২০২১-২২-র সংশোধিত বাজেট তাই বলছে। আগামী আর্থিক বছরের জন্য বরাদ্দ করা হয়েছে ২০৭ কোটি টাকা। প্রবণতা বলছে — খরচ আরও বেশিই হবে।
কোন খাতে খরচ এত বেড়ে যাচ্ছে মমতা ব্যানার্জির সরকারের? বাজেট প্রকাশনীর পাতা বলছে খাতটির নাম — ‘গ্রান্টস টু পুজা অরগানাইজার।’ অর্থাৎ দূর্গাপুজোর কমিটি, ক্লাবের জন্য বাজেট বরাদ্দ ছাপিয়ে টাকা ঢালছে তৃণমূলের সরকার।
কী হাল ‘স্টুডেন্ট ক্রেডিট কার্ড’-র?
মুখ্যমন্ত্রী মমতা ব্যানার্জি বিধানসভা নির্বাচনের আগে দেদার প্রচার করেছিলেন প্রকল্পটির। গত বাজেটে বরাদ্দ ছিল ২৫০ কোটি টাকা। একটি টাকাও খরচ হয়নি। তাই সংশোধিত বাজেটে লেখা হয়েছে ‘শূণ্য।’
আগামী আর্থিক বছরে(২০২২-২৩)-এ বরাদ্দ কত? ৫০ কোটি টাকা। বরাদ্দ গত বছরের ২০%-এ নামিয়ে এনেছেন মমতা ব্যানার্জি।
সামগ্রিকভাবে উচ্চশিক্ষায় বরাদ্দ, খরচ কমাচ্ছেন মমতা ব্যানার্জি। মূলত উচ্চশিক্ষাকে বেসরকারি হাতে তুলে দেওয়ার পথে আরও এগোচ্ছে পশ্চিমবঙ্গ। মূলত নরেন্দ্র মোদীর মডেল এটি। মোদী-মডেল অনুসরণ করার এই প্রবণতা স্পষ্ট বাজেটে। ২০১৯-২০-তে উচ্চশিক্ষা খাতের ‘স্টেট ডেভেলপমেন্ট স্কীম’ গুলিতে খরচ হয়েছিল ১৬৩ কোটি ৬১লক্ষ ৯০ হাজার টাকা। গতবছর এই খাতে বাজেট বরাদ্দ করা হয়েছিল ৯৭২ কোটি টাকা। সংশোধিত বাজেটে তা নেমে এসেছে ২৮৭ কোটি ৯৫ লক্ষ ৪২ হাজার টাকায়। এবারও বাজেটে বরাদ্দ দেখানো হচ্ছে প্রায় ১১০০ কোটি টাকা। কিন্তু খরচ? বাজেট নথী বলছে বরাদ্দ আর খরচের মধ্যে বিস্তর ফারাক থাকছে উচ্চশিক্ষার বিভিন্ন রাজ্য সরকারের উদ্যোগগুলিতে।

কমছে পরিকাঠামো উন্নয়নে খরচ

পরিকাঠামোর উন্নয়নে খরচ কমানোর বিপজ্জনক উদ্দেশ্য এবারের বাজেটে স্পষ্ট করে তুলেছেন মমতা ব্যানার্জি। একটি উদাহরণ দেওয়া যাক। সংখ্যালঘু ছাত্রদের জন্য নতুন শিক্ষা প্রতিষ্ঠান তৈরির খাতে খরচ বাজেটে নির্ধারণ করা হয়েছিল ১০ কোটি টাকা। সরকার খরচ করেছে(সংশোধিত হিসাব অনুসারে) ৩ কোটি ৩৩ লক্ষ টাকার কিছু বেশি। আগামী অর্থবর্ষে বরাদ্দ করা হয়েছে মাত্র ১০ কোটি ৫০ লক্ষ টাকা।
পরিকাঠামো উন্নয়নের প্রায় সব খাতেই এমন বরাদ্দ ছাঁটাই চোখে পড়বে রাজ্য সরকারের বাজেট নথীতে।
মূলধনী খাতের বরাদ্দ, খরচ কমানোর অর্থ পরিকাঠামো উন্নয়নে ধাক্কা। কাজের সুযোগ কমে যাওয়াই মূলধনী খাতে খরচ কমানোর প্রত্যক্ষ প্রভাব। তাই হচ্ছে মমতা-শাসনে। ২০২০-২১আর্থিক বছরে মূলধনী খাতে বাজেট বরাদ্দ ছিল ৩২হাজার ৭৭৪ কোটি টাকা। সেই ক্ষেত্রে সংশোধিত বরাদ্দের হিসাব বলছে খরচ নামিয়ে আনা হয়েছে ১৯ হাজার ১৭৫ কোটি টাকায়। অর্থাৎ মূলধনী খাতে ব্যয় কমানো হয়েছে ১৩ হাজার ৫৯৯ কোটি টাকা।
শুধু তাই নয়। সরকার আর টাকা খরচ করতে চাইছে না। বলে দিচ্ছে সরকারের বাজেট বরাদ্দ।
গতবছর, তার আগের বছরের তুলনায় বাজেট বেড়েছিল ৫৩,০৫০ কোটি টাকার। এবার গতবছরের তুলনায় বাজেট বরাদ্দ বৃদ্ধি দেখানো হয়েছে ১২,৬০৩ কোটি টাকা। ২০২০-২১এ বাজেটে মোট বরাদ্দ ছিল ২,৫৫,৬৭৭ কোটি টাকা। ২০২১-২২-র বাজেটের পরেই বিধানসভা নির্বাচন ছিল। তাই সেই বছরের বাজেট হয়েছিল ৩,০৮,৭২৭ কোটি টাকার। আবার এখন সামনে কোনও ভোট নেই। বাজেট বরাদ্দ হয়েছে ৩,২১,০৩০ কোটি টাকা। অর্থাৎ বৃদ্ধি মাত্র ১২,৬০৩ কোটি টাকা।
যদি মূল্যবৃদ্ধির হার ধরা হয়, তাহলে এই বরাদ্দ বৃদ্ধি আসলে কিছুই নয়। অর্থাৎ অনেক ক্ষেত্রেই বিপুল টাকা কাটছাঁট হবে। বাজেট বরাদ্দ তাই বলে দিচ্ছে।

কাজের হদিশ নেই, সংখ্যা আছে

এই পরিস্থিতি কাজের সুযোগ বৃদ্ধি করতে পারে না। তবু রাজ্য সরকার দাবি করছে — গত একবছরে, মহামারীর মধ্যেই তারা ৩০ লক্ষ কর্মসংস্থান সৃষ্টি করেছে। আগামী ৪ বছরে ১ কোটি ২০ লক্ষ কর্মসংস্থান সৃষ্টি করবে মমতা ব্যানার্জির উদ্যোগ — তাই দাবি করছে রাজ্য বাজেট।
এ’ হলো আশার স্বপনে বুনে লোক ঠকানো।
কী বলছে রাজ্য?
এক বছরে এত কর্মসংস্থানের এই দাবি আসলে মমতা-শাসনেও রেকর্ড। কথায় কথায় ‘রেকর্ড’ দাবি করেন যে মুখ্যমন্ত্রী, তাঁর আগের দশ বছরের শাসন হার মেনেছে মহামারী, লকডাউন, দেশজোড়া কর্মহীনতার এই বছরে।
কাজ নিয়ে চালাকি করছে মমতা ব্যানার্জির সরকার!
প্রমাণ? রাজ্য সরকারের পেশ করা শুক্রবারের বাজেট। অর্থদপ্তরের স্বাধীন দায়িত্ব প্রাপ্ত রাষ্ট্রমন্ত্রী চন্দ্রিমা ভট্টাচার্য বাজেট পেশ করতে গিয়ে বলেছেন,‘‘আগামী ৪ বছরে আমরা সরকারি ক্ষেত্রে, বেসরকারি ক্ষেত্রে এবং অন্যান্য ক্ষেত্রে ও স্বনিযুক্তির মাধ্যমে ১.২০ কোটি নতুন কর্মসংস্থানের সুযোগ সৃষ্টি করতে পারব।’’
মমতা ব্যানার্জি ২০২১-র ফেব্রুয়ারিতে বিধানসভা নির্বাচনে ভোটদাতাদের প্ররোচিত করতে বলেছিলেন,‘‘আগামী ৫ বছরের মধ্যে সরকারি, আধা-সরকারি ও বেসরকারি স্তরে এবং স্বনিযুক্তিমূলক কর্মসংস্থানকে ধরে ১.৫ কোটি (১ কোটি ৫০লক্ষ) নতুন কর্মসংস্থানের সুযোগ সৃষ্টি করা সম্ভব হবে।’’
গত একবছরে ৩০ লক্ষ কর্মসংস্থান হয়েছে বলে সরকার দাবি করছে।
অর্থ দপ্তরের রাষ্ট্রমন্ত্রী কি মুখ্যমন্ত্রী মমতা ব্যানার্জির পেশ করা ১৩ মাস আগের বাজেট পড়েছিলেন? সেদিন মমতা ব্যানার্জি বাজেটে লিখেছিলেন,‘‘গত ১০ বছরে আমাদের সরকার ১কোটি ১২লক্ষ ৫০ হাজার কর্মসংস্থান সৃষ্টি করেছে।’’ অর্থাৎ মমতা ব্যানার্জি ১০ বছরে যত কাজ দিয়েছেন মানুষকে, আগামী ৪ বছরে তার থেকে বেশি কাজ দেবে বলে এবার দাবি করছেন।
কোথায় হবে? শিল্পের কোনও লক্ষ্য ঘোষিত হয়েছে? রাজ্যের বাজেটে শিল্পের কোনও কথা নেই। দেউচা পাঁচামী, তাজপুর বন্দরের মত আগে অনেকবার মমতা ব্যানার্জির ঘোষিত প্রকল্পগুলিই আবার এই বাজেটে বলা হয়েছে। গত একবছরে রাজ্যে কটি শিল্প মাথা তুলেছে? তার কোনও হিসাবই নেই বাজেট। কটি শিল্প হতে পারে তার একটি বাজেটর ৯৮ থেকে ১০১ পাতার মধ্যে ঘোষিত হয়েছে। তাতে কত কাজ হবে? রাজ্য সরকার জানিয়েছে ওই ঘোষণাগুলি বাস্তবায়িত হলে কাজ হবে ৮০,৩৩৬জনের। যদি সবকটিই চার বছরের মধ্যে শেষ হয় তবেই তা হতে পারে।
অর্থাৎ কর্মসংস্থানের দিশা নেই। মূলধনী খাতে খরচ কমছে। তবু কাজ হবে বছরে ৩০ লক্ষ — তৃণমূল ভোল বোঝাতে নেমেছে।

ধার বাড়বে, বাড়বে মদ বিক্রি

তবে মদ বিক্রি থেকে সরকার তার আয় আরও বাড়াতে চাইছে। অর্থাৎ মদের বিক্রি আরও বাড়াবে মমতা ব্যানার্জি। আগামী আর্থিক বছরে মদ বিক্রী থেকে কর বাবদ রাজ্য সরকার ১৬,৫০০ কোটি টাকা আয় করার লক্ষ্যমাত্রা নিয়েছে। যা তার প্রস্তাবিত মোট আয়ের প্রায় ১৮% হবে। এটিই দ্বিতীয় সর্বোচ্চ আয়ের পথ হবে। গত আর্থিক বছরে এই লক্ষ্যমাত্রা ছিল ১৬,১০০ কোটি টাকা। লক্ষ্যমাত্রা পূরণ করতে পারেনি। তাই এবার আরও মদ বিক্রির উপর জোর দেবে সরকার।
আর বাড়ছে ধার। দেনায় আষ্টেপৃষ্ঠে রাজ্যকে বেঁধে ফেলছেন মমতা ব্যানার্জি।
আগামী ২০২৩-র ৩১ মার্চ রাজ্যের মোট ঋণ হতে চলেছে অন্তত ৫লক্ষ ৮৬হাজার ৪৩৮কোটি টাকা। বাজেটে তা জানিয়েছে এই সরকারই। এই বিপুল ঋণের বড় অংশই হবে বাজার থেকে করা ধার। যা বামফ্রন্ট সরকারের সময় কালে অপেক্ষাকৃত কম হত। সেই সময়কালে রাজ্যের ঋণের বড় অংশ হত স্বল্পসঞ্চয় বাবদ ঋণ। কারন, কেন্দ্রীয় সরকার তাকে ঋণ হিসাবেই ধরে। মমতা-শাসনে স্বল্পসঞ্চয় মার খেয়েছে সারদা গোষ্ঠীর মত সংস্থাগুলির সুবিধা করে দেওয়ার জন্য। ঋণ বেড়েছে বাজারের — যা কোনও রাজ্যের পক্ষে অত্যন্ত বিপজ্জনক।


আগামী একবছর, অর্থাৎ ২০২২-২৩ আর্থিক বছরে বাজার থেকে ৭৩হাজার ২৮৬কোটি টাকা ঋণ নেওয়ার পরিকল্পনা করেছে রাজ্য।
প্রসঙ্গত, গত আর্থিক বছরে (২০২০-২১) বাজার থেকে ৫৯ হাজার কোটি টাকা ঋণ নিয়েছিল সরকার। চলতি আর্থিক বছরে ৭৩ হাজার কোটি টাকার ঋণ নেওয়ার কথা। ২০২০-২১ আর্থিক বছরে সংশোধিত বাজেটে ৫৬ হাজার কোটি ঋণের ধরা হয়েছিল। কিন্তু সেটা বেড়ে চলতি অর্থবর্ষে সংশোধিত বাজেটে ৬৭ হাজার কোটি টাকার ওপর ধার করে নেয় সরকার। ফলে ঋণজালে এরাজ্যেকে কার্যত আষ্টেপৃষ্টে জড়িয়ে ফেলেছে রাজ্য।
এই বাজেটে কাজের দিশা নেই। মদের বিক্রী বৃদ্ধির ইঙ্গিত আছে। আর বাজারের ধারে জড়িয়ে পড়ার অশনি সঙ্কেত আছে।

Spread the word

Leave a Reply