২৯ এপ্রিল, ২০২০
বিশ্বজোড়া লকডাউন কায়েম করা হয়েছে করোনা ভাইরাসের সংক্রমণ মোকাবিলায়। লকডাউন কি আদৌ এই সমস্যার যথাযথ সমাধান নাকি দুনিয়াজূড়ে নিজেদের আর্থ-রাজনৈতিক কর্তৃত্ব বজায় রাখতেই এক নতুন বন্দোবস্ত করছে ধনতন্ত্র? সেই উত্তর খুঁজতেই হবে আমাদের…
ওয়েবডেস্ক’র নিজস্ব প্রতিবেদন
করোনা ভাইরাসের কোন প্রতিষেধক এখনো আবিষ্কার করা যায়নি। সেই গবেষণার কাজ চলছে সারা পৃথিবীতে। বিজ্ঞানী, বিশেষজ্ঞেরা এই গবেষণার সাফল্য নিয়ে আশা প্রকাশ করেছেন – হয়ত আগামিদিনে (যদিও গবেষণা শুরু হবার অন্তত ১২ মাস আগে এধরনের প্রতিষেধক সাধারণের জন্য মেলে না) মানুষকে বাঁচাতে বিজ্ঞানের আরও একটি অবদান শিশুপাঠ্যক্রমের অন্তর্গত হবে। প্রশ্ন এই গবেষণার ফলাফল নিয়ে আদৌ নয়। প্রশ্ন হল নতুন করে একটি মহামারী আজকের আধুনিক পৃথিবীতে (যেমনটা ধনতান্ত্রিক শক্তিধর দেশগুলি বরাবর দাবি করে এসেছে) যেভাবে প্রভাব বিস্তার করেছে, যেভাবে মানুষ আক্রান্ত হচ্ছেন এই সংক্রমণে এবং সেই সমস্যার সমাধানকল্পে আধুনিক রাষ্ট্রব্যবস্থা যা যা পদক্ষেপ নিয়েছে বা নিতে চলেছে সেইসব কি আদৌ গোটা পৃথিবীর মানুষের জীবনমুখি? নাকি এখানেও চার্লস ডারউইনের “যোগ্যতমের উদ্বর্তন” তত্বের নাম করে কিছুজনকে বাড়তি সুরক্ষা দিয়ে বাকি এক বিরাট অংশকে মৃত্যুমুখে ঠেলে দিতে চাইছে ফিন্যান্স পূঁজি নির্ভর আধুনিক(!) সমাজব্যবস্থা? গোটা মানবজাতি যখন এক অভূতপূর্ব বিপদের মুখোমুখি দাঁড়িয়ে রয়েছে তখন সর্বশক্তিমান রাষ্ট্রব্যাবস্থাগুলী কিভাবে সেই বিপদের মোকাবিলা করতে চায় সেটাই সবচেয়ে বড় প্রশ্ন। আর তাই এই প্রশ্নের সাথে জড়িয়ে আছে অর্থনীতি আর রাজনীতি। মানুষের জীবন বাঁচানোর সদিচ্ছার প্রকাশে পুঁজিবাদী ব্যাবস্থার ইতিহাস ভীষণরকম অমানবিক। আশংকা সেখানেই।
এখনও অবধি গোটা পৃথিবীজূড়ে সতর্কতামূলক ব্যাবস্থা হিসাবে লকডাউনের নামে যা করা হয়েছে তার সারাংশ হল যে যেখানে যে অবস্থায় রয়েছে তাকে সেখানেই, সেই অবস্থাতেই থাকতে বাধ্য করছে সরকারগুলি। বিজ্ঞানীরা জানিয়েছেন এই ভাইরাস একজনের থেকে আরেকজনের শরীরে ছড়িয়ে পড়ে, মূলত ড্রপলেট’র মাধ্যমে – এছাড়াও আক্রান্ত ব্যাক্তির ব্যবহার্য সামগ্রীর বাইরের ত্বকে ভাইরাসটি আটকে থাকে – ঐ উপরিত্বক থেকেও সংক্রমণ ছড়ানোর আশংকা থেকে যায়। প্রথমে সংক্রমণের ছড়িয়ে পড়া আটকাতে “সোশ্যাল ডিস্টেন্সিং” ব্যাবস্থাকেই যথেষ্ট বলে মনে করা হলেও, দেখা গেল কিছুদিনের মধ্যেই দুনিয়াজূড়ে মানুষের মধ্যে ইতিমধ্যেই সংক্রমণ ভয়ানক পর্যায়ে ছড়িয়ে পড়েছে। তখন গোটা ব্যবস্থাটাকেই রাতারাতি লকডাউন’র চাদরে মূড়ে ফেলা হল।আপাতত সংক্রমণ রোধে সবচেয়ে কার্যকরী হাতিয়ার হিসাবে লকডাউনকেই মান্যতা দিয়েছে সবাই। এই লকডাউনে প্রত্যেককেই তাদের নিজেদের ঘরবাড়িতে আটক থাকতে হচ্ছে – অতী জরুরী পরিষেবার অন্তর্গত আউটলেটগুলীই একমাত্র খুলে রাখা হয়েছে। এই অবস্থায় সবচেয়ে দুর্ভোগে পড়েছেন গরীব মানুষ – যারা সারা পৃথিবীর জনসংখ্যার সিংহভাগ। এদের নিরাপদ আশ্রয়ের জায়গা অপর্যাপ্ত (আশ্রয়হীনদের বাদ রেখে মাথা গোঁজার ঠাঁইটুকু রয়েছে যাদের তাদেরকেই হিসাবে ধরা যায়) , দৈনিক আয়ের উপরে নির্ভরশীল, খাবার-পানীয় জলের দুইদিনের মজুতটুকুও নেই – কোন স্বাস্থ্যবীমা নেই (যা না থাকলে আধুনিক স্বাস্থ্য পরিষেবার মহান বেসরকারি উদ্যোগের সুযোগ মেলে না) ! মোটের উপরে কাজ না জুটলে অর্ধাহার – অনাহারেই দিন গুজরান করতে হয় এইসব মানুষদের। লকডাউন কার্যত এদের উপরে দুইদিক থেকে চেপে বসা আক্রমন। একদিকে সংক্রমণের বিপদ থেকে নিজেদের সুরক্ষিত রাখতে প্রয়োজনীয় ঘরবন্দি বন্দোবস্তোয় এরা অপারগ কারণ সেই সংস্থান নেই, স্যানিটাইজার, মাস্ক এবং অন্যান্য পাবলিক হাইজিন সামগ্রী এদের পক্ষে দিবাস্বপ্ন – অন্যদিকে নিজেদের টিকিয়ে রাখতে দুবেলা দুমুঠো খাবার – পানীয় জল এবং প্রয়োজনীয় ওষুধটুকুর ন্যুনতম মজুত না থাকায় নানাভাবে নিজেদের খিদেটুকু মেটাতে বেপরোয়া হয়ে বেড়িয়ে পড়ে পুনরায় সংক্রমনের বিপদের সুম্মুখিন হওয়া ( এক্ষেত্রে আইন ভাঙ্গার অপরাধে পুলিশি হেনস্থার কথা বাদ দেওয়া হল)। সাম্প্রতিককালে ভারতে এভাবে লকডাউনে আটকে পড়ে নিজেদের বাঁচাতে লক্ষ লক্ষ পরিযায়ী শ্রমিক পরিবারগুলীর কয়েকশো মাইল পায়ে হেঁটে নিজেদের ঘরে ফিরে যাবার ঘটনা উপরের দুটি যুক্তিকেই প্রমান করে।
পুঁজিবাদী ব্যবস্থা এমনিতেই মানবিক যুক্তির তোয়াক্কা করে না। অতিমারি, মহামারি হালফিলের ব্যাপার (অন্তত ১০০ বছর পরে এরকম জরুরী অবস্থা দেখা দিয়েছে), এরকম না হয়ে যখন সবকিছু স্বাভাবিক ছিল (যদিও তখনো গরীব মানুষ, বেশিরভাগ মানুষ অর্ধাহার, অনাহারেই দিন কাটাত) সেইসময়েও রাস্ট্রের পক্ষ থেকে জনগণের উদ্দেশ্যে যেকোন সামাজিক কর্মসূচি যাতে সরকারের খরচ হয় যেমন খাদ্যের গনবন্টন, সরকারি স্বাস্থ্যপরিষেবা, সরকারি শিক্ষা কিংবা সরকারের উদ্যোগে কর্মসংস্থান যেমন ভারতের ক্ষেত্রে গ্রামীণ রোজগার নিশ্চয়তা প্রকল্প ইত্যাদি, সেইসবকিছুকেই টাকাপয়সার নয়ছয় বলে চিহ্নিত করেছে ফিন্যান্স-ক্যাপিটাল! সরকারি খরচকে বেঁধে ফেলা হয়েছে কেবলমাত্র বিত্তবানেদের আর্থিক ক্ষতির দায়ভার বহন করার ক্ষেত্রে – সাধারণ মানুষকে মহামারীর সময়ে আটকে রাখার অনেক, অনেক আগেই যাবতীয় সরকারি খরচকে একমাত্র রাষ্ট্রীয় ধনবানের উদ্দেশ্যে “কোয়ারেন্টাইন” করেছে পুঁজিবাদ। ২০০৮ নাগাদ মেরিল লিঞ্চ, লেম্যান ব্রাদার্স এইসব ইনভেস্টমেন্ট ব্যাংকগুলীকে বেইল আউট প্যাকেজ দেয়া থেকে শুরু করে গতকাল ভারতে রিজার্ভ ব্যাংক অফ ইন্ডিয়ার নেপথ্যে ভারত সরকারের পক্ষ থেকে দেশের সরকারি টাকা তছরুপ করে বিদেশে পালিয়ে যাওয়া বিভিন্ন সংস্থার কর্ণধারদের বকেয়া ঋণ মুকুব করে দেবার ঘটনা পুঁজিবাদের পক্ষে রাস্ট্রকে নিজেদের কর্তৃত্বের অধীনে “কোয়ারেন্টাইন” করারই প্রত্যক্ষ প্রমান। বিশ্বকল্যানের উদ্দেশ্যে এই ব্যাবস্থার আধুনিকতম সুত্র হল আর্থিক ক্ষেত্রে যাবতীয় মুনাফার কেন্দ্রিভুত বেসরকারিকরন এবং ঐ একই ক্ষেত্রে যাবতীয় ক্ষতির সর্বজনীন জাতীয়করণ!
এমন নয় যে বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা (WHO) করোনা ভাইরাসের সম্ভাব্য ভয়াবহ মহামারী নিয়ে শক্তিশালী রাষ্ট্রসমূহকে সতর্কবার্তা দেয় নি। কিন্তু পরমানু বিস্ফোরণে শক্তিধর ব্যাবস্থা জীবাণু সাথে মোকাবিলায় এইভাবে বলে বলে গোল খাবে তা এরা নিজেরা কিংবা এদের গুণকীর্তনকারীরা কেউই আন্দাজ করতে পারেনি। মার্কস সেই কবেই লিখে গেছিলেন নিজেদের তৈরি করা সংকট (মূলত অতি উৎপাদনের সংকট) মোকাবিলা করতে পুঁজিবাদ একেবারেই অযোগ্য, বারে বারে তারা সংকট মোকাবিলা করতে গিয়ে যা করে তাতে সংকট আরও ঘনীভূত হয় এবং পরেরবার আরও বেশি ভয়ংকরভাবে ফিরে আসে। এক দীর্ঘ সময় ধরে পুঁজিবাদ মৌলিক বিজ্ঞান গবেষণাকে অপ্রয়োজনীয়, অপ্রাসঙ্গিক, পয়সা নষ্ট বলে সমালোচনা করেছে, এর সপক্ষে জনমত গঠন (Consent Manufacturing) করতে প্রচুর অর্থব্যয় করেছে! দুনিয়াজুড়ে মৌলিক বিজ্ঞান গবেষণায় সরকারি অর্থের বিনিয়োগ ভয়ংকভাবে কমানো হয়েছে। নজর দেওয়া হয়েছে প্রযুক্তি গবেষণার নামে পুলিশি রাষ্ট্রব্যাবস্থা কায়েম করার জন্য নেটওয়ারকিং ব্যাবস্থাকে কাজে লাগানোয়। প্রযুক্তির দানবীয় প্রয়োগে জনজীবনের তথ্য (সে যত গোপন কিংবা ব্যাক্তিগতই হোক না কেন) আহরণ করে তাকে নিজেদের স্বার্থে ব্যাবহার করার নাম দেওয়া হয়েছে বিজ্ঞানের উন্নতিসাধন ( আর্টিফিশিয়াল ইন্টেলিজেন্স’র ব্যাবহার করে নজরদারি চালানো এই ব্যাপারে সর্বোৎকৃষ্ট উদাহরণ যা আজকাল সবদেশে প্রয়োগ করা হচ্ছে)। এর উদ্দেশ্য একটাই জনজীবনে সরকারবিরোধী মনোভাবের আঁচ মেপে নিজেদের কর্তৃত্ব কায়েম রাখতে প্রয়োজনীয় পদক্ষেপ গ্রহনে আগাম সতর্ক থাকা! এক ঝলকে দেখে নেওয়া যাক শেষ কয়েকটি বছরে পৃথিবীর বড়বাবু হিসাবে কর্তব্যরত আমেরিকায় কিভাবে বিজ্ঞান গবেষণায় খরচ কমানো হয়েছে সেই খতিয়ান।
ভারতেও সরকারের পক্ষ থেকে এভাবেই ধারাবাহিকভাবে মৌলিক বিজ্ঞান গবেষণায় সরকারি অর্থব্যয় বরাদ্দ সংকুচিত করা হচ্ছে । এর ফলে আখেরে মানুষের জীবন প্রভাবিত হবে সেই দূরদৃষ্টি পুঁজিবাদী ব্যাবস্থার উন্নয়নের মডেলে কোনদিনই ছিল না, বরং এর বিরুদ্ধে মুখ খুললে তারা যত গুরুত্বপূর্ন ব্যাক্তিত্বই হন না কেন তাদেরকে প্রত্যক্ষ সরকারি মদতে সেকেলে, উন্নয়ন বিরোধী এবং বামপন্থী তকমা দিয়ে কোনঠাসা করা হয়েছে – এখনও হচ্ছে। যুক্তি সেই একটাই বিজ্ঞান হোক, প্রযুক্তি হোক তার গবেষণার অভিমুখ মানবকল্যান হবে না, বরং মুনাফা নিশ্চায়ক হাতিয়ার হয়ে উঠবে। এই ব্যবস্থায় বিজ্ঞানী, প্রযুক্তিবিদ, চিকিৎসক, গবেষক প্রত্যেককেই মুনাফার লক্ষ্যে কাজ করা যন্ত্রাংশ হিসাবে ব্যবহার করা হয়, তারা আসলে পুঁজিবাদের টিকে থাকার অস্ত্র ছাড়া আর কিছুই নন, মেধাবৃত্তিকার বলে চিহ্নিত করে তাদের চেতনায় সমাজের অন্যদের তুলনায় কিছুটা বাড়তি অহমিকা এবং অন্যদের তুলনায় বেশ কিছুটা বাড়তি পারিশ্রমিক ব্যাতিত আর কিছুই পুঁজিবাদ দেয় না – শুনতে, ভাবতে, বুঝতে এবং মেনে নিতে কষ্ট হলেও এটাই সত্যি। আরও মজার বিষয় হল মার্কস-এঙ্গেলস রচিত কমিউনিস্ট ইস্তাহারে সেই কথাই লেখা ছিল!
তবু এই ব্যবস্থার মধ্যে থেকেই ব্যবস্থার বিরুদ্ধে সোচ্চার হয়ে ওঠেন নানা জন, নানা ভাবে, নানা ভাষায়। সেইসব ধামাচাপা দিয়ে নিজেদের কায়েমি শ্রেণীস্বার্থ টিকিয়ে রাখতে এই অমানবিক ব্যাবস্থার ঠিকেদারেরা নানা সরকারি পন্থাও অবলম্বন করেন। বিপদের সম্মুখিন হয়ে নিজেদের অভিজ্ঞতা, শিক্ষা এবং মেধা ব্যবহার করে পরিস্থিতির মূল্যায়নের পরে যারা ব্যবস্থা বদলের কথা বলেন বা বলছেন তারা সকলেই বামপন্থী এরকম আদৌ নয়। কিন্তু তাদের অভিযোগ যেহেতু ব্যবস্থার বিরুদ্ধে আঙ্গুল তুলে বদলের কথা বলে তাই তাদের দমন, পীড়ন করাই হয়ে ওঠে পবিত্র কর্তব্য!
বর্তমান পরিস্থিতিতে শক্তিশালী রাষ্ট্রগুলী লকডাউনের সুযোগকে কাজে লাগিয়ে ভবিষ্যতের পৃথিবীতে নিজেদের নিপীড়নের স্থাপত্য খাড়া করতে চাইছে এরকমটাই মনে করছেন প্রাক্তন মার্কিন জাতীয় নিরাপত্তা পরিষদের নেটয়ার্কিং সিস্টেমের কর্মী এডওয়ার্ড স্নোডেন। সম্প্রতি ভাইস টিভির সাথে একটি সাক্ষাতকার চলাকালীন স্নোডেন লকডাউন পরবর্তী যুগের অবস্থা কেমন হতে পারে সেই নিয়ে মন্তব্য করতে গিয়ে এরকমই মতামত রেখেছেন। তার কথায় আসলে জনগণের মনে চেপে বসা আতংককে কাজে লাগিয়ে শক্তিধর রাস্ট্রগুলি নিজেদের “Architecture of Oppression” কে ঝালিয়ে নিতে চাইছে। এডওয়ার্ড স্নোডেন বামপন্থী একথা তার শুত্রুরাও বলবেন না, কিন্তু এই অবস্থায় মেধাধর এবং পুলিশি রাষ্ট্রব্যাবস্থা সম্পর্কে সম্যকরুপে ওয়াকিবহাল একজন ব্যাক্তি হিসাবে তার এই “Whistle Blowing” মন্তব্য ধনতান্ত্রিক শক্তিশালী রাষ্ট্রব্যবস্থা সমূহকে আগামী দিনে বহু মানবিক এবং ন্যায্য প্রশ্নের সামনে টেনে এনে কাঠগড়ায় দাঁড়াতে বাধ্য করবে সন্দেহ নেই।