বিহার বিধানসভার নির্বাচনে জেডি(ইউ)-বিজেপি জোটের প্রায় ঘাড়ে নিঃশ্বাস ফেলছিল আরজেডি-কংগ্রেস-বাম জোট। এই নির্বাচনের ফলাফলের পর বাম মহল সহ বিভিন্ন রাজনৈতিক বিশ্লেষকরা পশ্চিমবঙ্গেও আসন্ন নির্বাচনে বিজেপি কে ঠেকাতে তৃণমূলের সাথে বাম ও কংগ্রসের ঐক্যবদ্ধভাবে লড়াইয়ের কথা বলছিলেন। এই প্রসঙ্গে নিজেদের অবস্থান স্পষ্ট করেছেন সিপিআই(এম) সাধারণ সম্পাদক সীতারাম ইয়েচুরি। দ্য হিন্দু বিজনেস লাইন পত্রিকাকে দেওয়া এক সাক্ষাৎকারে তিনি এই বিষয়ে পার্টির মত স্পষ্ট করেন।
সীতারাম বলেন- বাংলায় টিএমসি, বাম-কংগ্রেস এবং বিজেপি-র মধ্যে ভোটের বিভাজন নিঃসন্দেহে প্রতিযোগিতাটি ত্রিমুখী করে তুলবে,কিন্তু তার মানে এই নয় যে তাতে বিজেপির কোন সুবিধা হবে। তৃণমূল সরকারের বিরুদ্ধে এখন প্রবল প্রতিষ্ঠান বিরোধী হাওয়া রয়েছে। হুমকি, সন্ত্রাস এবং পুলিশী দমন-পীড়নের কারণে আমাদের ৫০,০০০ এরও বেশি কর্মী সমর্থক রাজ্য থেকে বিতাড়িত হয়েছে।তৃণমূলের শাসনের একদশকে তারা নিজেদের ঘরে ফিরতে পারেনি।তারা তাদের পরিবার থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে গেছে এবং তারা বিরক্ত হয়ে পড়েছে। প্রায় সমান সংখ্যক মানুষ জেলে রেয়েছেন বা তাদের মিথ্যা মামলা দিয়ে ভয় দেখানো হয়েছে। কেন্দ্র ও রাজ্যের রাষ্ট্রীয় সন্ত্রাসের সাথে জনবিরোধী আর্থিক নীতি মানুষের অবস্থা অসহনীয় করে তুলেছে।
এই প্রেক্ষিতে, বাম-কংগ্রেস জোট না থাকলে টিএমসির বিপক্ষে যে একটি বড় অংশ রয়েছে তা পুরোপুরি বিজেপির দিকে চলে যেত। এটা বিজেপির জন্য জয়ের রাস্তা পরিস্কার করে দিত। তবে জনগণ এখন জানেন যে এই দুটি মেরুকরণকারী শক্তির বিরুদ্ধে একটি ধর্মনিরপেক্ষ গণতান্ত্রিক বিকল্প আছে। টিএমসি -এর ওপর অসন্তুষ্ট জনগণের একটি বড় অংশ বাম-কংগ্রেস জোটকে সমর্থন করবে।সংখ্যালঘুরা, যাদের টিএমসি স্পষ্টতই এত বছর ধরে সন্তুষ্ট করে চলেছে, তারা বুঝতে পেরেছে যে তাদের বাস্তবিক উন্নতির লক্ষ্যে তেমন কিছুই করা হয়নি।টিএমসির বিরুদ্ধে ধর্মনিরপেক্ষ ও সংখ্যালঘু অংশের মধ্যে বিচ্ছিন্নতা তৈরি হয়েছে।বিজেপিকে পরাজিত করার তাগিদে তারা টিএমসিকে ভোট দিয়েছিল।এখন এখানে একটি কার্যকর বাম-কংগ্রেস জোট রয়েছে। ২০১৯ সালে, এই জোট কোনও বোঝাপড়াতে আসতে পারেনি এবং এটি বিজেপিকে সুবিধা দিয়েছিল।টিএমসির বিপক্ষে যারা ছিলেন তারা বিজেপির দিকে এগিয়ে গিয়েছিলেন। এটি পাটীগণিতের হিসাব নয়। এটি একটি রাজনৈতিক হিসাব। পাটীগণিতের হিসাবে, কেউ বলতে পারেন যে ভোটের বিভাজন বিজেপিকে উপকৃত করবে। আসলে, বিজেপিই এই জোটকে চেয়েছিল। তাদের হিসাবে এরফলে তাদের সুবিধা হবে।
বামপন্থীদের একাংশ ও রাজনৈতিকে বিশ্লষকদের অনেকে বিজেপিকে ঠেকাতে সর্বত্র বিহার মডেলের কথা বললেও পশ্চিমবঙ্গে কেন তৃণমূলকে সাথে নিয়ে কোন মহাজোট সম্ভব নয় সীতারাম তাও ব্যাখ্যা করেন।
তিনি বলেন যে এই বিশ্লেষণ একদমই পাটীগণিতের হিসাব। বিহারে জোট একটি বিদ্যমান সরকারের বিরুদ্ধে কাজ করেছিল। এখানে তৃণমূলের বিরুদ্ধে যে প্রতিষ্ঠান বিরোধীতা সেটার সাথে বিজেপি সম্পর্কে মানুষের বিচ্ছিন্নতাকেও হিসাবের মধ্যে রাখতে হবে।আমাদের আরও বিশ্বাসযোগ্য বিকল্প উপস্থাপন করতে হবে। বাংলায় বিজেপি ও তৃণমূল প্রকৃত বিষয়গুলো এড়িয়ে যাচ্ছে। তারা একটি বাইনারি তৈরি করার চেষ্টা করছে এবং মিডিয়া তাদের সাথে রয়েছে। তাদের কাছে এটি পিএম-বনাম-সিএম এবং টিএমসি-বনাম-বিজেপি। এই মিথ্যা দ্বিমুখীনতা পশ্চিমবঙ্গে বাম-কংগ্রেস জোটের যে দৃঢ় ভিত্তি তাকে চেপে রাখতে চায়।
রজনীকান্তের রাজনীতি থেকে সরে যাওয়া ,শশীকলার পুনরাবির্ভাব ও সামগ্রিকভাবে তামিলনাড়ুর রাজনৈতিক পরিস্থিতি সম্পর্কেও সীতারাম আলোচনা করেন।
সীতারাম বলেন যে বিজেপি চেয়েছিল রজনীকান্তের ওপর ভর করে নির্বাচনী বৈতরণী পার হওয়া যাবে কিন্তু শশীকলার রাজনীতিতে আবার ফিরে আসায় গোটা পরিস্থিতি খুবই দিশাহীন। আমরা জানিনা কোন ভাঙা গড়া চলবে। এআইএডিএমকে বিভিন্ন জনমোহিনী নীতির ওপর ভর করে জিততে চাইছে।কেন্দ্রীয় বাজেটেও অনেকগুলি স্কিম কোন ব্যয়বরাদ্দ ছাড়াই ঘোষণা করা হয়েছে। বাম ডিএমকে কংগ্রেস জোট প্রসঙ্গে সীতারাম বলেন, আমাদের জোট পদ্ধতিগতভাবে কাজ করছে। আমরা এখন আসন বরাদ্দের গুরুত্বপূর্ণ এবং কুশলী পর্যায়ে প্রবেশ করছি। আমরা আশা করি এটি সুষ্ঠুভাবে সম্পন্ন হবে। ইতিমধ্যে আমাদের যৌথ প্রচার শুরু হয়েছে।
কৃষি আইন নিয়ে কেন্দ্রের কড়া অবস্থান সম্পর্কে সীতারামকে প্রশ্ন করায় তিনি বলেন – বিজেপি স্পষ্টতই বিশ্বাস করে যে সাম্প্রদায়িক মেরুকরণ তাদের সরকারে রাখার জন্য যথেষ্ট।সংসদে তাদের ভাষণগুলো একটি স্পষ্ট ইঙ্গিত দেয় যে আগামী দিনগুলোতে আমরা আরও তীব্রতর সাম্প্রদায়িক মেরুকরণ দেখব।তবে মহামারী চলাকালীন সময়ে তারা যে অর্থনৈতিক সংস্কার শুরু করেছিল, তা শ্রমিকশ্রেণীর হাতে অস্ত্র তুলে দিয়েছে, বিশেষত শ্রম আইন বাতিল এবং বৃহত্তর বেসরকারীকরণের বিরুদ্ধে শ্রমিকরা গর্জে উঠছে।ব্যাঙ্ক আধিকারিকরা সহ ব্যাংক ইউনিয়ন দু’দিনের ধর্মঘটের ডাক দিয়েছে। ইতিমধ্যেই ট্রেড ইউনিয়নগুলোর ডাকা একটা সর্বভারতীয় সাধারণ ধর্মঘট হয়েছে।২৬ নভেম্বরের সাধারণ ধর্মঘটে কৃষকরাও শ্রমিকদের সাথে যুক্ত হওয়ায় এই সংগ্রাম আরো তীব্রতর হয়েছিল।
কৃষক, শ্রমজীবী ও মধ্যবিত্তরা এবারের বাজেট থেকে কোনও স্বস্তি পাননি। এই দুর্দশা পেট্রোল ডিজেলের লাগামহীন মূল্যবৃদ্ধিতে আরো বেড়েছে। এই সব মিলিয়ে বিজেপি সরকারের জনবিচ্ছিন্নতা বাড়ছে। আর এই কৃষি আইনের ফলে বিজেপির মূল যে জনভিত্তি তাও প্রচন্ড ধাক্কা খেয়েছে।