The struggle Of the Alternative front is necessary

৬ আগস্ট ২০২৩ রবিবার

প্রথম পর্ব

কদিন আগে সারা দেশে ঘটা করে নরেন্দ্র মোদী ও তার সরকারের ন’বছর পূর্তি উৎসব পালিত হল। সরকারি মিডিয়ায় প্রধানমন্ত্রীর ‘মন কি বাত’ শোনানো হলো দেশবাসীকে। খাদ্য,বস্ত্র,বাসস্থান,শিক্ষা,স্বাস্থ্য ইত্যাদি পরিমাপক গুলির গত ন’বছরে কতটা উন্নয়ন ঘটলো তার প্রকৃত তথ্য পাওয়ার যাবতীয় উৎসমুখ সরকারি উদ্যোগে বন্ধ করে দেওয়া হয়েছে। সরকারি ভাষ্যে দেশের মানুষকে এ বিষয়ে যে তথ্য গেলানোর চেষ্টা চলছে তাতে বিস্তর চটকদারি থাকলেও সত্যতা কতখানি তা নিয়ে সন্দেহ আছে। গত ন’বছরে ভারতবর্ষ নামক যুক্তরাষ্ট্রীয় ধর্মনিরপেক্ষ গণতন্ত্রের এই দেশটির মূলগত ধারণার বদল ঘটিয়েছে বর্তমান বিজেপি সরকার। এই প্রথম, সামাজিক সমীক্ষার রিপোর্ট অনুযায়ী বিশ্বের কাছে ভারত এমনই এক সংসদীয় গণতন্ত্রের ভিত্তিতে নির্বাচিত সরকারের দ্বারা পরিচালিত দেশ, যেখানে গণতান্ত্রিক পরিসর খুবই সীমিত। সারা দুনিয়া জেনে গেছে এখানে স্বৈরাচারী শাসন চলছে। তাই গণতন্ত্রের সূচকে আমরা পিছিয়ে গেছি বেশ কয়েক ধাপ। স্বাধীনতার পর এই প্রথম একটি সরকার চলছে যারা সংবিধান মোতাবেক তৈরি হওয়া আস্ত একটি রাজ্যকে ভেঙে দুটো কেন্দ্র-শাসিত অঞ্চল বানিয়েছে– জম্মু-কাশ্মীর ও লাদাখ। এর আগে, গত শতাব্দীর সত্তর ও আশির দশক পর্যন্ত কংগ্রেস পরিচালিত সরকারগুলি মনিপুর, ত্রিপুরা, হিমাচল প্রদেশ, নাগাল্যান্ড, মেঘালয়, অরুণাচল প্রদেশ, গোয়া ইত্যাদি একের পর এক কেন্দ্র-শাসিত অঞ্চল কে রাজ্য বানিয়েছে। সংকীর্ণ হিন্দুত্বের রাজনীতিকে পুঁজি করে এভাবে পেছনদিকে এগিয়ে চলার ঘটনা আগে কখনো ঘটেনি।

যুক্তরাষ্ট্রীয় ব্যবস্থা ও ধর্মনিরপেক্ষতা

স্বাধীন ভারতে এই প্রথম একটি সরকার আমরা দেখছি যারা ‘যুক্তরাষ্ট্রীয় ব্যবস্থা’ ও ‘ধর্মনিরপেক্ষতা’ শব্দদুটিকে অস্বীকার করে শুধু তাই নয়, সংবিধান থেকে মুছে দিতে চায়। হিন্দুত্বের আদর্শে চলা শাসক দলের সরকারের প্রতিটি কাজকর্মের প্রধান অভিমুখ হলো একটি কেন্দ্রীয় হিন্দুরাষ্ট্র গঠন। বর্তমান সরকার দেশের বিজেপি বিরোধী রাজ্যগুলির স্বাধীন ও স্বতন্ত্র অস্তিত্ব স্বীকার করে না। ‘কৃষি’ সংবিধানের রাজ্য তালিকাভুক্ত বিষয় অথচ রাজ্যগুলিকে কিছু না জানিয়েই একতরফা কৃষক বিরোধী ও কর্পোরেট বান্ধব কৃষি আইন তৈরি করেছে কেন্দ্রীয় সরকার। ‘শ্রম’ সংবিধানের যুগ্ম তালিকাভুক্ত বিষয় হলেও রাজ্যগুলির কোনো মতামত না নিয়েই শ্রমিক বিরোধী শ্রমকোড তৈরি করেছে কেন্দ্রীয় সরকার। ‘শিক্ষা’ সংবিধানের যুগ্ম তালিকাভুক্ত বিষয় হলেও রাজ্যগুলির সাথে কোন রকম আলোচনা ছাড়াই হিন্দুত্বের প্রচার ও প্রসারের লক্ষ্যে শিক্ষার স্বার্থবিরোধী কর্পোরেট বান্ধব নতুন শিক্ষানীতি চালু করেছে কেন্দ্রীয় সরকার। জি এস টির মাধ্যমে রাজস্বের সিংহভাগ রাজ্যগুলি থেকে আদায় হলেও তার যথাযথ বন্টনের ক্ষেত্রে জি এস টি কমিশনকে মান্যতা না দিয়ে মুখ ঘুরিয়ে থাকে কেন্দ্রীয় সরকার।
প্রায় প্রতিটি বিজেপি বিরোধী রাজ্যে রাজনৈতিক অস্থিরতা তৈরি করবার জন্য বেছে নেওয়া হয়েছে রাজ্যপালের অফিসকে। সঙ্ঘ পরিবারের পরিকল্পনা মাফিক ধুরন্ধর সঙ্ঘ প্রচারক সহ বিজেপি নেতাদের রাজ্যপালের পদে বেছে নেওয়া হয়েছে। কেরালা, তামিলনাড়ু, ছত্রিশগড়, পশ্চিমবঙ্গসহ বেশ কিছু রাজ্যে সমান্তরাল প্রশাসন চালানোর চেষ্টা করছেন রাজ্যপালরা, যা যুক্তরাষ্ট্রীয় কাঠামোর পরিপন্থী। পশ্চিমবঙ্গের স্বৈরাচারী সরকার বহু অপকর্ম করছে এ কথা ঠিক। তার বিরুদ্ধে বামপন্থীদের নেতৃত্বে রাজনৈতিক প্রতিবাদ ও প্রতিরোধ আন্দোলনও অব্যাহত। তবে তার পাল্টা হিসেবে রাজ্যপালের কাজকে কখনোই সমর্থন করা যায় না। মনে রাখতে হবে, এ আরেক বৃহত্তর ষড়যন্ত্রের অংশ। অতীতে রাজ্যপালের পদে কিছু রাজনৈতিক নিয়োগ হলেও কখনো দেশজুড়ে এ ধরনের যুক্তরাষ্ট্রীয় ব্যবস্থা টিকে থাকার সার্বিক সংকট তৈরি হয়নি।
ধর্মনিরপেক্ষ রাষ্ট্রের সর্বোচ্চ গণতান্ত্রিক প্রতিষ্ঠান নবনির্মিত সংসদ ভবন উদ্বোধন হচ্ছে হিন্দু ধর্মাচরণের মধ্য দিয়ে। ধর্মনিরপেক্ষতার মূল ভাবনাকে এ ধরণের আঘাত অতীতের কোন নির্বাচিত সরকার দেয় নি। রাষ্ট্রের প্রতিটি নাগরিকের ব্যক্তিগত ধর্মাচরণের অধিকার (ধর্ম মানা বা না মানার) যেমন সুরক্ষিত থাকবে তেমনি রাষ্ট্রের কোনো ধর্ম থাকবে না বা কোন ধর্মের প্রতি রাষ্ট্র পক্ষপাতিত্ব করবেনা– ধর্মনিরপেক্ষ রাষ্ট্রের এই আদর্শগত বোঝাপড়া এদেশে এখন কঠিন চ্যালেঞ্জের মুখে দাঁড়িয়ে।

সংসদীয় গণতন্ত্র

সংসদীয় গণতন্ত্র এভাবে এদেশে অতীতে কখন বিপন্ন হয়নি। দেশের সংসদীয় গণতন্ত্রে প্রথম আঘাত আসে ১৯৭৫ সালে জরুরি অবস্থা জারি হওয়ার পর। সারা দেশ জুড়ে তার প্রতিবাদে সামিল হয়েছিলেন লক্ষ লক্ষ মানুষ। আজকের ‘ইন্ডিয়া’র মত তখনও ঐ আধা ফ্যাসিস্ট সন্ত্রাসের বিরুদ্ধে জোট বেঁধেছিল তখনকার বিরোধী রাজনৈতিক দলগুলি। চরম আক্রমণের মুখে দাঁড়িয়ে সি পি আই এম সহ বামপন্থী দলগুলি সেই লড়াইএ গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা নিয়েছিল। ঠিক দু’বছরের মাথায় সাজা পেয়েছিল কংগ্রেস দল। কেরালা বা পশ্চিমবঙ্গে এর আগে হলেও দেশে এই প্রথম অকংগ্রেসী সরকার গড়ে উঠেছিল মোরারজি দেশাইর নেতৃত্বে। বর্তমান সরকার তার ন’বছরের মেয়াদকালে বিহার,কর্ণাটক, মহারাষ্ট্র, মধ্যপ্রদেশ, মনিপুর, গোয়া, অরুণাচল প্রদেশ, ঝাড়খন্ড, মেঘালয়– একের পর এক রাজ্যে সংবিধানকে নস্যাৎ করে ক্ষমতা দখল করেছে। হয় ৩৫৬ ধারা জারি করে নির্বাচিত সরকারকে ভেঙেছে নতুবা গরু ছাগলের মত এম এল এ দের কেনা বেচা করেছে। এম এল এ বা এম পি কেনা বেচা আগে হয়নি এমনটা নয়। গত শতাব্দীর শেষের দিকটায় এই রোগ দেখা দেওয়ায় দলত্যাগ বিরোধী আইন পাশ হয়েছিল সংসদে। সেই আইন এখনো আছে যদিও বিজেপি সরকার তার তোয়াক্কা করে না।
২০১৪ সালে ক্ষমতায় এসেই অরুণাচল প্রদেশে এই কাজ শুরু করে বিজেপি। সে বছর অরুণাচলের ৬০টি আসনের মধ্যে বিজেপি পেয়েছিল মাত্র ১১ টি আসন আর কংগ্রেস পেয়েছিল ৪২ টি। নির্দল ও অন্যান্যরা ৭টি আসন পেয়েছিল। বিজেপির এম এল এ কেনাবেচার খেলা শুরু হওয়ার পর এই সংখ্যা দু বছরের মাথায় পাল্টে দাঁড়ায় বিজেপি ৪৮, কংগ্রেস ১। ঐ বছর ৮১ আসনের ঝাড়খন্ড বিধানসভায় বিজেপি পেল ৩৫ টি। তার সহযোগী জে এস ইউ পেল ৫টি আসন। এরপর শুরু হল কেনাবেচা। ঝাড়খন্ড বিকাশ মোর্চার ৮ জনের মধ্যে ৬ জন চলে এল বিজেপিতে। আরো কিছু নির্দল কেনা হল। অনেকটা সেই ছোটবেলার নতুন ব্যবসায়ী খেলার মত। সরকার গড়লো বিজেপি। এরপর ২০১৫ সালে বিহারে, ২০১৭ সালে গোয়ায়, মনিপুরে, ২০১৮ সালে মেঘালয়ে, ২০১৯ ও ২০২২ এ মহারাষ্ট্রে, ২০২০ সালে মধ্যপ্রদেশ এই এক কান্ড করেছ ওরা। রাজস্থানে এখনকার সরকারটাকে ভাঙবার অনেক চেষ্টা করেছে, কিন্তু পারেনি। এই কাজে প্রায় প্রতিটি রাজ্যে রাজ্যপালের অফিসকে ন্যক্কারজনক ভাবে ব্যবহার করা হয়েছে। কত কোটি কোটি টাকার যে লেনদেন হচ্ছে এর পেছনে তার ইয়ত্তা নেই। কোথা থেকে আসছে এই বিশাল অংকের অর্থ কেউ জানে না। আমরা শুধু এটুকু জানি আদানি আম্বানিদের মতো শিল্পপতিরা যাদের সম্পদ এই ন’বছরে কয়েকশ গুণ বেড়েছে, তারা এই খেলার প্রধান স্পনসরার। ই এম এস নামবুদ্রিপাদের নেতৃত্বাধীন কেরালার প্রথম অকংগ্রেসী সরকারকে ফেলতে বিদেশী শক্তি সক্রিয় হয়েছিল। এ খবর আমরা অনেক পরে জানতে পেরেছি। একইভাবে বর্তমান বিজেপি সরকারের আমলে এই এম পি এম এল এ কেনাবেচার খেলায় বাইরের কত বহুজাতিক পুঁজি যুক্ত হয়েছে তা নিশ্চয়ই ভবিষ্যতে স্পষ্ট হবে। এখন তো কোনো রাজ্যের নির্বাচন হলে সেখানকার এয়ারপোর্টে চার্টার্ড প্লেন দাঁড়িয়ে থাকে নির্বাচিত এমএলএ দের ভিন্ রাজ্যের রিসর্টে নিয়ে যাওয়ার জন্য। মিডিয়া ঘটা করে দেখায়ও সেসব। ব্যাপারটা শুনতে বা দেখতে খারাপ লাগলেও নির্মম বাস্তব। বিজেপি এদেশের সংসদীয় গণতান্ত্রিক ব্যবস্থাকে বাজারে নামিয়ে এনেছে।
এমনিতে বিজেপি বা তাদের মেন্টর সঙ্ঘ পরিবার সংসদীয় ব্যবস্থাকে খুব একটা মান্যতা দেয় তা না। আর এস এস প্রথম থেকেই এদেশের সংবিধান কে এড়িয়ে মনুবাদী শাসনব্যবস্থা কায়েম করার পক্ষে তাদের মত প্রকাশ করেছে। তাদের রাজনৈতিক মুখ বিজেপি পার্লামেন্টে আসার পর এখন পর্যন্ত যত বিল গত ন’বছরে পাশ হয়েছে, তার শতকরা ৯৯ ভাগ হয়েছে একতরফা– কোনো আলোচনা ছাড়াই। বর্তমান অধিবেশনে প্রথম দিন থেকেই বিরোধী সাংসদরা মনিপুর নিয়ে সংসদে আলোচনা ও প্রধানমন্ত্রীর বিবৃতি দাবি করে এসেছেন। এত বড় একটা ঘটনা, একটা রাজ্য প্রায় তিন মাস ধরে জাতিদাঙ্গার আগুনে জ্বলছে, কয়েকশো মানুষ নিহত হয়েছেন, অথচ দেশের প্রধানমন্ত্রী সংসদে তা নিয়ে মুখ খুলতে নারাজ। মনিপুরের এই ঘটনার দায় বিজেপি এড়িয়ে যেতে পারে না। উত্তর পূর্ব ভারতের ‘সেভেন সিস্টার’ এই রাজ্যগুলির খনিজ ও অন্যান্য গুরুত্বপূর্ণ সম্পদ কর্পোরেট মালিকানায় তুলে দেওয়ার লক্ষ্য নিয়ে পরিকল্পনামাফিক পরিচিতি-সত্তার রাজনীতিকে সামনে রেখে জাতিদাঙ্গার আগুন লাগানো হয়েছে। অসহায়ভাবে প্রাণ হারানো মানুষগুলোর কবর কোথায় হবে তা নিয়েও লড়ছে দুই গোষ্ঠী! মনিপুরের এই আগুন ছড়াতে শুরু করেছে প্রতিবেশী রাজ্যগুলিতেও। সংসদে বিরোধীরা যদি এ নিয়ে প্রধানমন্ত্রীর উপস্থিতিতে আলোচনা চান, এতে অপরাধ কোথায়? খোদ সুপ্রিম কোর্ট অব্দি মণিপুরের এই ঘটনায় গভীর উদ্বেগ প্রকাশ করে সরকার কি করছে তা জানতে চেয়েছে। অধিবেশন শুরুর দিন বাইরে সাংবাদিকদের কাছে অল্প দু-একটি কথা বলা ছাড়া মোদি নিরুত্তর। ওনার এই দম্ভ সংসদীয় ব্যবস্থার প্রতি বিজেপির অনাস্থারই বহিঃপ্রকাশ।

সম্পূর্ণ নিবন্ধটি তিনটি পর্বে প্রকাশিত…

Spread the word

Leave a Reply