শমীক লাহিড়ী
কর্পোরেট পুঁজি বা লগ্নী পুঁজির বিশেষ সমর্থন ছাড়া অতি দক্ষিণ পন্থা বা ফ্যাসিবাদের উত্থান কখনই হয়না। প্রখ্যাত পোলিশ অর্থনীতিবীদ মিশ্যঁল কালেকি, ফরাসি অর্থনীতিবীদ ড্যানিয়েল গুয়েরিন সহ বহু অর্থনীতিবীদ দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের প্রাক্কালে জার্মানির হিটলারের উত্থানের পেছনে বেয়ার কোম্পানি সহ আরও কয়েকটি কর্পোরেট, ইতালিতে মুসোলিনীর উত্থানে ফিয়াট সহ কয়েকটি কর্পোরেট, জাপানে তোজোর উত্থানে নিও জাইবাৎসু বা নতুন শিল্প গোষ্ঠী যেমন নিশান ইত্যাদি কর্পোরেটগুলি গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা নিয়েছিল – এটা তথ্য সহকারে দেখিয়েছেন।
দেবে আর নেবে
একইভাবে আমাদের দেশেও নরেন্দ্র মোদীর উত্থানে আদানি সহ হাতে গোনা কয়েকটি কর্পোরেট বিপুল অর্থ ব্যয় করেছে, যা আজ প্রমাণিত। দিল্লীর একটি অসরকারী সংস্থার রিপোর্ট অনুযায়ী ২০১৯ সালে লোকসভা নির্বাচনে বিজেপি ২৭ হাজার কোটি টাকা খরচ করেছিল। অর্থাৎ প্রতিটি লোকসভা আসনে গড়ে ৪৯.৮২ কোটি টাকা খরচ করেছিল বিজেপি। কোন কর্পোরেট কত টাকা দিচ্ছে কোন রাজনৈতিক দলকে, এটা যাতে প্রকাশিত না হয় তাই মোদী-শাহ জুটি ক্ষমতায় এসেই নির্বাচনী বন্ড প্রথা চালু করে। এই নতুন প্রথা অনুযায়ী কারা কোন রাজনৈতিক দলকে কত অর্থ দিচ্ছে তা প্রকাশ করা আর বাধ্যতামূলক নয়।
যে অর্থ ঢেলেছে এই কর্পোরেট কোম্পানিগুলি বিজেপির জন্য, তার কয়েকগুণ অর্থ লুঠ করে নিচ্ছে সরকারের পৃষ্ঠপোষকতায় এরা। আজকের যুগে ক্রোনি বা ধান্দার পুঁজিবাদ ও শাসক গোষ্ঠীর মধ্যে এক গভীর অনৈতিক অশুভ আঁতাত গড়ে উঠেছে। এই অশুভ আঁতাতের ফলেই বিপুল লুট চালানো সম্ভব হচ্ছে বাছাই করা কয়েকটি কর্পোরেট কোম্পানির পক্ষে।
শুধু এদেশেই নয়, অতি দক্ষিণপন্থী ইজরাইলের নেতানেয়াহু সরকারের আনুকুল্যে সেই দেশের পোর্ট, প্রতিরক্ষা সরঞ্জাম তৈরি, আর্টিফিসায়াল ইনটেলিজেন্স ল্যাব সহ নানা জায়গায় বিনিয়োগ ও ব্যবসার রাস্তা তৈরি করেছে এরা। অবশ্যই এক্ষত্রেও মোদীভাইয়ের সহযোগিতা রয়েছে। অস্ট্রেলিয়ার ক্যুইন্সল্যান্ডে কয়লা খনি, পোর্ট, রেল ইত্যাদি বিনিয়োগের রাস্তা পরিস্কার করার জন্য নরেন্দ্র মোদী নিজেই সে দেশে ছুটে গিয়েছিলেন শুধু তাই নয়, প্রাথমিক বিনিয়োগের অর্থ যোগাড় করার জন্য ভারতীয় স্টেট ব্যাঙ্ককে মাঝে রেখে বাকি রাষ্ট্রায়ত্ত্ব ব্যাঙ্কগুলিকে নিজে ডেকে নির্দেশ দিয়েছিলেন, এও তো সবাই জানে।
দেশের একটার পর একটা সরকারী সম্পদ তুলে দেওয়া হচ্ছে আদানি শিল্প গোষ্ঠীর হাতে। ইতিমধ্যে ১২টি সরকারী জাহাজ বন্দর এবং কয়েকটি বিমানবন্দর জলের দরে বিক্রি করা হয়েছে আদানিকে। এই সম্পদ কেনার জন্য আবার সরকারী আর্থিক প্রতিষ্ঠান জীবন বীমা নিগম, স্টেট ব্যাঙ্ক অফ ইন্ডিয়া সহ কয়েকটি রাষ্ট্রায়ত্ত ব্যাঙ্ক থেকে বিপুল ঋণ দেওয়ার ব্যবস্থা করে দিয়েছেন প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদী।
জীবন বীমা নিগম আদানি গ্রুফ অফ ইন্ডাস্ট্রিজের ৩০,১২৭ কোটি টাকার শেয়ার কিনেছে যার বর্দ্ধিত মূল্য দেখানো হয়েছে ৫৬,১৪২ কোটি টাকা। পাঞ্জাব ন্যাশনাল ব্যাঙ্ক একইভাবে ৭ হাজার কোটি টাকা বিনিয়োগ করেছে। স্টেট ব্যাঙ্ক অফ ইন্ডিয়া বিনিয়োগ করেছে ২১ হাজার কোটি টাকা। অবশ্য এই ব্যাঙ্কের চেয়ারম্যান দীনেশ খাড়া ৩রা ফেব্রুয়ারী, ২০২৩ এক বিবৃতিতে জানিয়েছেন এর পরিমাণ ২৭ হাজার কোটি টাকা। এছাড়াও জম্মু-কাশ্মীর ব্যাঙ্ক, ব্যাঙ্ক অফ বরোদাও বিপুল টাকা ঢেলেছে আদানির নানা ব্যবসায়ে।
কিন্তু হিন্ডেনবার্গ রিসার্চ রিপোর্ট প্রকাশিত হওয়ার পর যে অসম্ভব গতিতে আদানির কোম্পানিগুলির শেয়ার মূল্য কমছে তাতে রাষ্ট্রায়ত্ত আর্থিক প্রতিষ্ঠানগুলি যে ক্ষতির মুখে পড়ছে, তার কোনও উল্লেখ এখনও পর্যন্ত সরকার করছে না। অভিযোগ, এখন মোদী সরকার নানা কর্পোরেট সংস্থাকে নাকি প্রভাবিত করছে, যাতে আদানি’র ডুবন্ত শেয়ার বাজারকে ভাসিয়ে রাখার জন্য আদানি’র কোম্পানিগুলোর শেয়ার কেনে তারা।
আড়াল করো অপরাধ
এর আগে আদানিদের হীরে ব্যবসায় কর ও শুল্ক ফাঁকি দেওয়ার অভিযোগে চলা তদন্ত হঠাৎই বন্ধ হ’য়েছিল কার নির্দেশে? বিদ্যুৎ সরঞ্জাম নিয়ে চলা তদন্তই বা ধামাচাপ পড়লো কিভাবে? কর্ণাটকে লৌহ আকরিক আমদানি- রপ্তানির ক্ষেত্রে আদানিদের দুর্নীতির বিরুদ্ধে চলা তদন্ত ধামাচাপা দেওয়া হয়েছিল কার নির্দেশে? এর প্রতিবাদে বিচারপতি হেগড়ে পদত্যাগও করেছিলেন। সাংবাদিক পরঞ্জয় গুহ ঠাকুরদা’কে জেলে পাঠানো হ’য়েছিল, আদানিদের দুর্নীতি প্রকাশ্যে আনার জন্য। এরকম বহু ঘটনা দেখে মনে হতেই পারে, আদানিদের অপরাধ আড়াল করার জন্যই যেন বিজেপি সরকারে এসেছে।
লুঠ হচ্ছে মানুষের টাকা
সরকারী ব্যাঙ্ক বা বীমা কোম্পানিতে অর্থ গচ্ছিত রাখেন সাধারণ মানুষ। সাধারণ মানুষের গচ্ছিত এই টাকা অবাধে লুঠ হচ্ছে। আদানি গ্রুপ অফ কোম্পানিসগুলির শেয়ার মূল্য রকেট গতিতে পতনের ফলে আসলে সাধারণ মানুষের সঞ্চিত টাকাই লুঠ হয়ে যাচ্ছে। ঠিক যেমন সারদা- রোজভ্যালি সহ অনেকগুলি পঞ্জী কোম্পানিতে মানুষের গচ্ছিত টাকা লুঠ হয়ে গিয়েছিল তৃণমূল সরকারের নেতা-মন্ত্রীদের প্রত্যক্ষ-পরোক্ষ সহায়তায়, তেমনভাবেই সরকারের ঘরে গচ্ছিত সাধারণ মানুষের অর্থ লুঠ হচ্ছে নরেন্দ্র মোদী সরকারের পৃষ্ঠপোষকতায়।ঐ পঞ্জী কোম্পানিগুলি বামফ্রন্ট সরকারের পতন ঘটিয়ে তৃণমূলের সরকার গঠনের জন্য যেমন বিপুল অর্থ ব্যয় করেছিল, তেমনই ক্রোনি কর্পোরেট কোম্পানিগুলিও নরেন্দ্র মোদীকে প্রধানমন্ত্রী করা ও তার সরকার রক্ষার জন্যও অর্থ ব্যয় করে।
ভাই-বহেন এক হ্যায়
আদানির এই সর্বগ্রাসী লুঠের বিরুদ্ধে খুব স্বাভাবিকভাবেই নীরব বাংলার মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দোপাধ্যায়। লোকসভায় আদানিদের লুঠের বিরুদ্ধে বিরোধীদের বিক্ষোভ বা বিরোধী দলের সভায় অনুপস্থিত তৃণমূল সাংসদরা, মুখ্যমন্ত্রীর নির্দেশেই। এই রাজ্যে দেউচা পাচামীর ১০ হাজার একর জমি, তাজপুর পোর্ট সহ অনেক প্রকল্প আদানিদের হাতে তুলে দেওয়ার কারিগর মুখ্যমন্ত্রী নিজেই। এই জন্যই বিজেপি ৫,২৭০ কোটি টাকা নির্বাচনী তহবিলে পেয়েছে, আর তার পরেই স্থান তৃণমূলের। নির্বাচনী বন্ডের মাধ্যমে ৫২৮.১৪ কোটি টাকা জমা হয়েছে তৃণমূলের তহবিলে ২০২২ সালে, যা আগের বছর ছিল মাত্র ৪২ কোটি টাকা।
লুঠেরাদের প্রতিনিধি বিজেপি- তৃণমূল
নরেন্দ্র মোদী-মমতা বন্দোপাধ্যায় দেশ-রাজ্যের সাধারণ মানুষকে লুঠ করার অবাধ সুযোগ করে দিচ্ছেন আজকের যুগের গন্ডেরিরাম বাটপারিয়াদের আর তার বিনিময়ে এদের হাতে ক্ষমতা তুলে দেওয়া আর ক্ষমতায় টিকিয়ে রাখার অর্থ যোগাচ্ছে এ যুগের জালিয়াতরা। এই জালিয়াতদের হাতেই আছে দেশের বেশিরভাগ টেলিভিশন- সংবাদপত্রের নিয়ন্ত্রণ। তাই বাটপারিয়াদের কাহিনীও তেমনভাবে প্রকাশিত হয়না, আর তার লুঠের বিরুদ্ধে মানুষের প্রতিবাদও প্রতিফলিত হয়না বাজারী সংবাদমাধ্যমে।
ক্ষমতাচ্যূত করতে হবে লুঠেরাদের রক্ষাকর্তাদের
বিজেপি-তৃণমূলকে ক্ষমতায় রেখে, এ যুগের বাটপারিয়াদের লুঠ বন্ধ করা যাবে না। তাই সম্মিলিতভাবে সব মানুষকে রুখে দাঁড়াতে হবে, প্রতিবাদে রাস্তায় নামতে হবে, বাটপারিয়াদের রক্ষাকর্তা বিজেপি-তৃণমূলকে ক্ষমতা থেকে টেনে নামাবার জন্য।