কুৎসার আড়ালে প্রকৃত সত্য – কসবায় আনন্দমার্গী হত্যা…

কসবায় আনন্দমার্গী হত্যা: ষড়যন্ত্রের আড়ালে

১৯৮২ সালের ৩০এপ্রিল কসবায় প্রকাশ্য দিবালোকে ১৭ জন আনন্দমার্গীকে হত্যার জন্য সিপিআই(এম)কে অভিযুক্ত করে কুৎসা প্রচার এখনও চলছে।যদিও এই অভিযোগের কোন সারবত্তা নেই,তবু ঐ নৃশংস ঘটনার এত বছর পরেও যাবতীয় দক্ষিণপন্থী শক্তি এই ইস্যুতে অপপ্রচার চালিয়ে যাচ্ছে । প্রতিবছর ঐদিন আনন্দমার্গীরা কর্মসূচি পালন করে এবং নিয়ম করে সিপিআই (এম) এর বিরুদ্ধে বিষোদগার করে। অথচ কোন তদন্ত কমিশনের রিপোর্টে সিপিআই(এম)এর কোন নেতা বা কর্মী এই ঘটনার জন্য দোষী বলে প্রমাণিত নন।

১৯৮২ সালের ৩০ এপ্রিল সকালে বন্ডেল গেট, বিজন সেতু ও বালিগঞ্জ স্টেশনে ছেলেধরা সন্দেহে বেশ কয়েক জন আনন্দমার্গীকে উত্তেজিত জনতা ঘিরে ধরে প্রচণ্ড প্রহার করে এবং ১৭জন আনন্দমার্গীকে প্রকাশ্য দিবালোকে হত্যা করে।বালিগঞ্জ, কসবা অঞ্চলের বাসিন্দাদের কাছ থেকে জানা যায় যে এই ঘটনার কয়েক সপ্তাহ আগে থেকেই ছেলে ধরা সম্পর্কিত গুজব এলাকায় ব্যাপকভাবে ছড়িয়ে পড়েছিল। বোঝাই যায় যে একদিকে গুজব রটিয়ে জনগণকে উত্তেজিত করা হয়েছিল,অন্যদিকে নৃশংস হত্যাকাণ্ড ঘটাতে সমাজবিরোধীদের যুক্ত করা হয়েছিল।রাজ্য সরকার এই ভয়ঙ্কর ঘটনার সাথে সাথে প্রশাসনিক পদক্ষেপ গ্রহণ করে এবং এলাকায় শান্তি-শৃঙ্খলা ফিরিয়ে আনতে সমর্থ হয়। জনগণকে গুজবে কান না দিতে,আইন হাতে তুলে না নিতে এবং সমাজবিরোধীদের প্ররোচনায় পা না দিতে আহ্বান জানায় সরকার ও রাজ্য বামফ্রন্ট।

কসবায় আনন্দমার্গীদের এই হত্যাকাণ্ডের প্রশাসনিক তদন্ত করেন অ্যাডিশনাল আই জি (সি আই ডি)রথীন ভট্টাচার্য এবং ৪ মে এই ঘটনার বিচার বিভাগীয় তদন্তের কথা ঘোষণা করে রাজ্য সরকার। বামপন্থীরা এই হত্যাকাণ্ডের জন্য যে বিচার বিভাগীয় তদন্ত কমিশন গঠন হয় তাকে সমর্থন জানায়।অথচ রাজ্য সরকারের পক্ষ থেকে গঠন করা বিচার বিভাগীয় কমিশনের সাথে সহযোগিতা করবেনা বলে জানিয়ে দেয় আনন্দমার্গীরা। তারা কেন্দ্রীয় তদন্তের দাবী করলে কেন্দ্রীয় সরকার সে দাবী নাকচ করে দেয়।

প্রসঙ্গত উল্লেখ করা দরকার যে আনন্দমার্গ কোন নিছক ধর্মীয় সংগঠন নয়। জন্মলগ্ন থেকেই নানারকম বেআইনি ও হিংসাত্মক ক্রিয়া-কলাপের  সাথে যুক্ত এই সংগঠন। কেন্দ্রীয় সরকারের তথ্য সংস্কৃতি দপ্তর থেকে প্রকাশিত ‘Anandmarg : The truth’  পুস্তিকায় এই সংগঠনের নানাবিধ হিংসাত্মক ঘটনা উল্লেখ  করে বলা হয়েছে যে এই সংগঠনটি জাতিদ্রোহী,সাংঘাতিক বিপজ্জনক কার্যকলাপে যুক্ত এবং সংগঠনের অভ্যন্তরে ভিন্নমতাবলম্বীদের এরা নিষ্ঠুরভাবে হত্যা করে।
উল্লেখ্য যে বিজন সেতুর নারকীয় ঘটনার কয়েকদিন আগেই আনন্দমার্গীরা এই অঞ্চলে মড়ার খুলি ও খোলা তলোয়ার নিয়ে মিছিল করে এবং সেই মিছিল থেকে  কর্তব্যরত পুলিশ কর্মীদের আক্রমণ করা হয়। এর ফলে এলাকায় আতঙ্কের পরিবেশ সৃষ্টি হয়।স্বাভাবিক জনজীবন যেন আনন্দমার্গীদের দ্বারা বিঘ্নিত না হয় সেজন্য  বামপন্থীদের পক্ষ থেকে এলাকায় প্রচার সংগঠিত করা হয়।

সে বছর ১৯ মে ছিল বিধানসভা নির্বাচন। নির্বাচনের মাত্র কয়েক সপ্তাহ আগে এই চরম নিন্দনীয় ঘটনাকে রাজনৈতিক উদ্দেশ্যে ব্যবহার করতে নেমে পড়ে  যাবতীয় বাম বিরোধী শক্তি। স্থানীয় সিপিআই(এম) বিধায়ক শচীন সেনকে সরাসরি অভিযুক্ত করে আনন্দমার্গীরা এবং তাকে গ্রেফতার করার দাবী তোলা হয়। এমনকি রাজ্যপালের কাছে মিথ্যে অভিযোগ করে বলা হয় যে ঘটনার আগের দিন নাকি তিলজলায় মুখ্যমন্ত্রী জ্যোতি বসু বৈঠক করেছিলেন,অথচ সেদিন তিনি বর্ধমানে ছিলেন। কার্যত মুখ্যমন্ত্রীকেও আনন্দমার্গীদের নৃশংস হত্যার ষড়যন্ত্রে লিপ্ত থাকার জন্য অভিযুক্ত করা হয়।

চরম প্রতিক্রিয়াশীল আনন্দমার্গীরা বরাবর সিপিআই(এম)এর তীব্র বিরোধী।তাই প্রত্যাশিতভাবেই এই হত্যাকাণ্ডের দায় তারা সিপিআই(এম)এর ওপর চাপিয়ে দিয়েছিল। আর নির্বাচনের আগে রাজনৈতিক ফায়দা তোলার আশায়  কংগ্রেস সহ রাজ্যের সবক’টি বিরোধী দল একদা নিষিদ্ধ এবং নানারকম গুরুতর অভিযোগে অভিযুক্ত আনন্দমার্গীদের সুরে সুর মিলিয়ে সিপিআই(এম) এর বিরুদ্ধে অপপ্রচারে শামিল হয়ে যায়।

আসলে নির্বাচনের আগে পশ্চিমবঙ্গে হিংসাত্মক ঘটনা ঘটিয়ে তার দায় সিপিআই(এম)এর ওপর চাপিয়ে দেওয়াটা ছিল বামবিরোধীদের পুরনো কৌশল।১৯৭১ সালে নির্বাচনের তিন সপ্তাহ আগে সর্বজন শ্রদ্ধেয় নেতা হেমন্ত বসু কে খুন করে তার হত্যার দায় চাপানো হয়েছিল সিপিআই(এম)এর ওপরে। লাগামহীন কুৎসার জেরে মানুষ বিভ্রান্ত হয়েছিলেন। পরবর্তীকালে এই অভিযোগ অসত্য বলে প্রমাণিত হয়।
১৯৭৭ সালের নির্বাচনের আগেও বাঁকুড়ায় পাথরবন্দীতে হত্যাকাণ্ড ঘটিয়ে তার দায় সিপিআই(এম )এর উপর চাপানো হয়েছিল। কিন্তু এবারে মানুষ আর সেই ফাঁদে পা দেন নি। ১৯৮২ সালের ১৯ মে বিধানসভা  নির্বাচনের প্রাক্কালে এই ধরনের নারকীয় ঘটনা কে পুনরায় সিপিআই(এম)এর বিরুদ্ধে ব্যবহার করার চেষ্টা জনগণের দরবারে প্রত্যাখ্যাত হয়েছিল।প্রধান অভিযুক্ত বলে যাকে প্রমাণ করার চেষ্টা করেছিল আনন্দমার্গীরা সেই সিপিআই(এম) নেতা শচীন সেন সেবারের নির্বাচনে ১৯৭৭ সালের চেয়ে অনেক বেশি ব্যবধানে জয় যুক্ত হয়েছিলেন। 

আনন্দমার্গীদের অভ্যন্তরীণ কোন্দলের ফলেই এই ভয়ঙ্কর ঘটনা ঘটেছিল বলে ওয়াকিবহাল মহলের অনুমান। হয়তো একারণেই তারা সরকারী তদন্ত কমিশনের কাছে কখনো হাজিরা দেয়নি। হিংসাত্মক আভ্যন্তরীন কোন্দলের জন্য আনন্দমার্গ ইতিমধ্যেই কুখ্যাতি অর্জন করেছিল। আনন্দমার্গের প্রতিষ্ঠাতা আনন্দমূর্তি ১৭ জন অবধূত কে হত্যা করেছিলেন বলে তার স্ত্রী উমা সরকার ও পুত্র গৌতম সরকার অভিযোগ করেন (‘Anandmarg : The truth’ পুস্তিকা,পৃষ্ঠা ১০)।১৯৭১ সালে দলত্যাগী অবধুতদের হত্যা ও  ষড়যন্ত্রের অভিযোগে আনন্দমূর্তিকে গ্রেপ্তার করা হয়েছিল।
১৯৯৫ সালে পুরুলিয়ায় অস্ত্র বর্ষণের ঘটনা নিশ্চয়ই আমরা কেউ ভুলে যাইনি।অযোধ্যা পাহাড় সংলগ্ন এলাকায় আড়াই হাজার এ কে ফরটি সেভেন রাইফেল এবং পনের লক্ষ বুলেট সহ  বিপুল পরিমাণ মারণাস্ত্র ও বিস্ফোরক হেলিকপ্টার থেকে ফেলা হয়।  এই অস্ত্র বর্ষণের জন্য অভিযুক্ত পিটার ডেভি ও কিম ব্লিচের বক্তব্য থেকে জানা যায় যে আনন্দমার্গীদের কাছে এই বিপুল পরিমান অস্ত্র সরবরাহ করার পরিকল্পনা ছিল, যাতে সেগুলো ব্যবহার করে হিংসাত্মক পদ্ধতিতে রাজ্যের  বামফ্রন্ট সরকারকে উৎখাত করা যায়। পুরুলিয়া অস্ত্র বর্ষণ নিয়ে মামলা এখনো চলছে। বৈদেশিক মদতপুষ্ট আনন্দ মার্গের দপ্তরে অভিযান চালিয়ে  নব্বইয়ের দশকের গোড়াতে মার্কিন মুলুকে তৈরি রাইফেল, বিস্ফোরক,ওয়াকি টকি ইত্যাদি বাজেয়াপ্ত করে পুলিশ।এইসব তথ্য থেকে একথা স্পষ্ট যে পশ্চিমবঙ্গে একটা অস্থিরতা তৈরীর জন্য আনন্দমার্গীরা বহু বছর ধরেই সক্রিয়।এহেন সন্ত্রাসবাদী  সংগঠন যা কিনা পুরুলিয়ায় অস্ত্র বর্ষণ সহ নানা রকম জঘন্য কাজের সাথে লিপ্ত তাদের সুরে এখনও সুর মিলিয়ে চলেছে বিভিন্ন বাম বিরোধী শক্তি।

তৃণমূল কংগ্রেস রাজ্যে  ক্ষমতায় আসার পর আনন্দমার্গী হত্যাকাণ্ড নিয়ে বিচার বিভাগীয়  কমিশন গঠিত হয়। এখনও সেই রিপোর্ট জনসমক্ষে আসেনি। বিচারব্যবস্থা যে ঘটনার জন্য সিপিআই(এম)কে অপরাধী বলে প্রমাণ করতে পারে নি,সেই ঘটনা নিয়ে লাগাতার মিথ্যাভাষণ বামবিরোধীদের রাজনৈতিক দেউলিয়াপনারই এক জ্বলন্ত নজির।

পশ্চিমবঙ্গের জনগণের প্রতি বামফ্রন্টের চেয়ারম্যান প্রমোদ দাশগুপ্তের আবেদন…..
আনন্দমার্গীদের হিংসাত্মক কার্যকলাপের বিরুদ্ধে কনভেনশনে বক্তব্য রাখছেন সম্পাদক মন্ডলীর সদস্য বুদ্ধদেব ভট্টাচার্য।(৪ ঠা জুলাই ১৯৮২)
Spread the word

Leave a Reply