The Poet, The Rebel: A Memoir

সুব্রত দাশগুপ্ত

রবীন্দ্রনাথ সেই বিরল প্রতিভার মানুষ যাঁর দু’টি গান দু’টি স্বাধীন সার্বভৌম দেশের জাতীয় সংগীত হিসেবে গৃহীত হয়েছে – ভারত ও বাংলাদেশ। কাজী নজরুল ইসলাম সেই ব্যতিক্রমী ব্যক্তিত্ব যিনি এই দু’টি দেশেরই নাগরিকত্বের অধিকারী এবং দু’দেশেরই উচ্চ রাষ্ট্রীয় সম্মানে ভূষিত হয়েছেন। ভারত সরকার ১৯৬০ সালে তাঁকে দ্বিতীয় সর্বোচ্চ অসামরিক সম্মান ‘পদ্মভূষণ’ প্রদান করেন  আর বাংলাদেশ সরকার ১৯৭৬ সালে তাঁকে ভূষিত করেন সে দেশের সর্বোচ্চ সম্মান ‘একুশে পদক’ – এ , এবং পরের বছরই তাঁকে “স্বাধীনতা পুরস্কার” – এ সম্মানিত করেন এবং  ‘জাতীয় কবি’ র শিরোপা প্রদান করেন।কিন্তু এ’সবই শুধু তথ্য ও পরিসংখ্যানগত বিষয় , কাজী নজরুল ইসলামের জীবন ও সৃষ্টির ব্যাপ্তি এসব ছাড়িয়ে অনেক গভীরে প্রোথিত।

ঢাকার বিশিষ্ট নজরুল-বিশেষজ্ঞ আব্দুল হাই শিকদারের মতে – ” কাজী নজরুল ইসলাম বাংলা সাহিত্যের যুগস্রষ্টা কবি। বাংলা সাহিত্য ও সংগীতের প্রায় সর্বাঞ্চলে তাঁর দৃপ্ত পদচারণা ……… তাঁর কবিতার আকাশ অসীম।অগুনতি উজ্জ্বল নক্ষত্রের সমাহার সেখানে।কারো প্রভা কারো চেয়ে কম নয়।একদিকে ‘বিদ্রোহী’ অন্যদিকে ‘গুবাক তরুর সারি’।একদিকে অগ্নি-বীণার তেজতপ্ত বৈশাখী দুপুর , অন্যদিকে ছায়ানট , সিন্ধু- হিল্লোলের জোছনাজড়ানো অনির্বচনীয় দোলা ” ( প্রসঙ্গ-কথা , সঞ্চিতা , দ্বিতীয় সংস্করণ , নজরুল ইনস্টিটিউট, ঢাকা ) |

নজরুলের গান- কবিতা-সাহিত্য সৃষ্টির সময়কাল তো মাত্র ২৩ বছর। ১৯১৯ সালে যার শুরু, আর দুরারোগ্য স্মৃতিভ্রংশ রোগে আক্রান্ত হওয়ার আগে পর্যন্ত, ১৯৪২ সালে যার শেষ। বসন্তের বজ্র নির্ঘোষের মতো যেভাবে নজরুল কাব্য- সাহিত্য জগতে নিজের আগমনকে ঘোষণা করেছিলেন , তাতে এই ভয়ানক ব্যাধিতে আক্রান্ত হয়ে তাঁর বাঁশি সংগীতহারা না হয়ে পড়লে , অগ্নি-বীণার ঝংকার স্তব্ধ না হয়ে গেলে , বাংলা তথা ভারতের সাহিত্য ও সঙ্গীত জগৎ যে আরও অনেক অনেক বেশি সমৃদ্ধ হতো , এ কথা বলাই বাহুল্য।মাত্র তেইশ বছরের সৃষ্টিশীল জীবনে তিনি রচনা করেছেন চার হাজারের অধিক গান, অসংখ্য কবিতা , ১৮ টি গল্প , 3 টি উপন্যাস এবং কয়েকটি নাটক ও প্রবন্ধ। তাই ‘Pre – senile Dimentia’ তে  আক্রান্ত হয়ে কবির এই ভয়ঙ্কর পরিণতি আসলে আমাদের সমগ্র জাতির কাছে এক নিদারুণ আঘাত , এক অপূরণীয় ক্ষতি। তাঁর লেখনী স্পর্শ করেছে সনাতন ধর্ম – সমাজ – সভ্যতা – সংস্কৃতি – দর্শন – দেশাত্মবোধ – স্বাধীনতা সংগ্রামের চিন্তাকে।

মানুষ হিসেবে তিনি ছিলেন মুক্তমনা ও অত্যন্ত আধুনিক। কোনো জীর্ণ কুসংস্কার  তাঁকে কোনোদিন স্পর্শ করতে পারেনি। বরং তাঁর লেখায় তিনি  নির্মম কষাঘাতে বিদ্ধ করেছেন ধর্মান্ধতাকে , হিন্দু ও মুসলমান উভয় সম্প্রদায়ের বিভাজনের নাটের গুরু  মোল্লাতন্ত্র এবং পুরোহিততন্ত্রকে। ‘আমার কৈফিয়ৎ’-এ লিখেছেন –

” মৌ-লোভী যত মৌলবী আর

                  ‘মোল্-লারা’ ক’ন হাত নেড়ে ,

   দেব-দেবী নাম মুখে আনে ,

                   সবে দাও পাজিটার জা’ত মেরে।”

  আবার ‘দে গরুর গা ধুইয়ে ‘ তে জানান দিলেন —

  ” মাজায় বেঁধে পৈতে বামুন

                        রান্না করে কার না বাড়ী ,

     গা ছুঁলে তার লোম ফেলেনা ,

                         ঘর ছুঁলে তার ফেলে হাড়ি ! “

ব্যক্তিগত স্তরে ধর্মবিশ্বাস-এর সঙ্গে ধর্মীয় সংস্কারের পার্থকীকরণ দৃঢ়ভাবে প্রতিভাত হয়েছে নজরুলের জীবন ও সৃষ্টিতে।

নজরুলের মতো একজন সৃষ্টিশীল অনন্য প্রতিভাধর মানুষ, যাঁর প্রতিভা ক্রমপরিব্যাপ্ত হয়েছে বিংশ শতাব্দীর প্রথমার্ধে এক ঝোড়ো জাতীয় ও আন্তর্জাতিক পরিস্থিতির মধ্য দিয়ে তিনি কি কোন  নির্দিষ্ট রাজনৈতিক অবস্থান গ্রহণ না করে থাকতে পারেন ? নিশ্চয়ই  নয়।কমরেড মুজফ্ফর আহমদ -এর লেখা থেকে উদ্ধৃত করি – ‘আমি নজরুল ইসলামের নিকট জানতে চাইলাম সে রাজনীতিতে যোগ দেবে কিনা। জবাবে নজরুল বললেন , ‘তাই যদি না দেব তবে ফৌজে গিয়েছিলাম কিসের জন্য ?’ দেশের অবস্থা তখন খুবই গরম।তাপের ওপরে চড়ালে জল যেমন টগবগ করে ফোটে দেশের বিক্ষুব্ধ মানুষও সেই রকম টগবগ করে ফুটছিল।’

 ১৯১৭ সালে রুশ বিপ্লবের মধ্য দিয়ে পৃথিবীর প্রথম শ্রমিক- কৃষকের পরিচালিত রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠা সংবেদনশীল মানুষের মনকে আলোড়িত করেছিল। কাজী নজরুলও তার ব্যতিক্রম নন।১৯১৯ সালে তিনি যে ‘ব্যথার দান’ গল্পটি লিখেছিলেন তার মধ্য দিয়ে সেই মনোভাব প্রকাশিত হয়েছিল। গল্পের দুই মূল চরিত্র সয়ফুল মূল্ক ও দারা দু’জনেই ‘লালফৌজে’ – এ যোগ  দিয়েছিলো।তাঁরা দু’জনেই ছিল ব্রিটিশ ভারতীয়। যদিও মুদ্রিত গল্পটিতে রয়েছে যে তারা ‘ মুক্তিসেবক সৈন্যদের দলে’ যোগ দিয়েছিলো।তাহলে ‘ লালফৌজে’ যোগ দেওয়ার কথাটি কি কল্পনাপ্রসূত ? না।এর মধ্যে আরও একটি ঘটনা রয়েছে।নজরুল তাঁর লেখা ‘ব্যথার দান’ গল্পটি কাকাবাবুকে দিয়েছিলেন পত্রিকায় প্রকাশের জন্য।সেই মূল লেখাটিতে ‘লালফৌজে’ শব্দবন্ধটিই ছিল। কাকাবাবু গল্পটি পড়েন এবং সেটি প্রকাশের পর যাতে ব্রিটিশ ভারতীয় পুলিশের শ্যেনদৃষ্টি থেকে গল্প এবং গল্পকারকে রক্ষা করা যায় তার জন্য ‘লালফৌজে’ শব্দটি কেটে ‘মুক্তি সেবক সৈন্যদের দলে’ কথাটি বসিয়ে দেন। এবং তাঁর হাত দিয়েই সেটি ‘বঙ্গীয় মুসলমান সাহিত্য পত্রিকা’য় প্রকাশিত হয়। পরবর্তীকালে এটা জানতে পেরে নজরুল অত্যন্ত আনন্দিত হয়েছিলেন।

 ডক্টর সুশীল কুমার গুপ্ত প্রমুখ নজরুল চরিতকার নজরুলের এই  রাজনৈতিক বিশ্বাস নিয়ে সন্দেহ প্রকাশ করলেও,  শুধু ‘সাম্যবাদী’ কবিতা লেখাই নয় , সাম্যবাদের প্রতি নজরুলের আকর্ষণ ও বিশ্বাস মূর্ত হয়ে ওঠে , ‘কাজী নজরুল ইসলাম স্মৃতিকথা’য়  কাকাবাবুর দৃঢ় ও স্পষ্ট লেখায় – ” কাজী নজরুল ইসলামের জীবনচরিত রচনা করতে গিয়ে সেটি যেমনটি ছিল তেমনটিই তাকে আঁকতে হবে। নিজের মনের রং দিয়ে নজরুলের কোন চরিতকার যদি তাঁর চিত্র আঁকতে চান তবে তিনি নিশ্চয়ই ভুল চিত্র আঁকবেন। নজরুলের ‘লাল নিশান’ সত্য সত্যই  ‘লাল’দেরই নিশান।শুধুমাত্র ‘ব্যথার দান’ গল্পে নয় , তার রচনায় যেখানেই সে ‘লাল নিশান’ কথার উল্লেখ করেছে সেখানেই সে ‘লাল’দের লাল নিশানকেই মনে করেছে। জীবনের পথে অনেক বিচ্যুতি তার ঘটেছে একথা সত্য , কিন্তু ‘লাল’ কখনো তার কাছে ‘ কালো’ হয়নি।” নজরুলের অকৃত্রিম বন্ধু ও যৌবনের অন্যতম পথপ্রদর্শক কমরেড মুজফ্‌ফর আহ্‌মদ – এর এই বক্তব্যের পর তাঁর রাজনৈতিক অবস্থান সম্পর্কে আর কিছু বলার বোধহয় প্রয়োজন হয়না |

আজ কাজী নজরুল ইসলামের একশো পঁচিশতম জন্মদিন।’ কেউ ভোলে , কেউ ভোলেনা ‘। ধূর্ত রাষ্ট্র শাসকরা  ইচ্ছাকৃতভাবেই , আত্মস্বার্থচরিতার্থতার পথে বাধা হিসেবে দেখে বিস্মৃতির অতলে ডুবিয়ে দিতে চায় এই যুগস্রষ্টাকে।আমাদের নিয়মিত চর্চায় বেঁচে থাকুক এবং প্রাণিত করুক  ‘সাম্যবাদী’ কবির আগলভাঙা ‘বিদ্রোহী’ স্পর্ধা।

আজ ১১ই জৈষ্ঠ্য, ১৪৩০ বঙ্গাব্দ। কাজী নজরুল ইসলামের ১২৪তম জন্মদিবস। তাঁর জন্ম তারিখ বাংলা ক্যালেন্ডার অনুযায়ী ১১ই জৈষ্ঠ্য, ১৩০৬ বঙ্গাব্দ। যেমন ২৫শে বৈশাখ তারিখেই রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের জন্মদিবস পালিত হয়, ইংরেজি ক্যালেন্ডারের তারিখ অনুযায়ী নয়, তেমনই কাজী নজরুল ইসলামের জন্মদিবসও বঙ্গাব্দ অনুযায়ী পালিত হয়।

Spread the word

Leave a Reply