লাল ঝাণ্ডাতেই বিকল্প দেখছেন কলকাতার মানুষ : প্রসূন ভট্টাচার্য

২০১৯ সালের লোকসভা নির্বাচনের পরে এবং এই বছরেরই বিধানসভা নির্বাচনের ফলাফল প্রকাশের পরে মিডিয়ার উল্লাসগুলো মনে পড়ছে? বামফ্রন্ট বিরোধী নানা শিবিরের নানা কথা, নানা আক্রমণ?

২০১৯ সালের নির্বাচনের পরে একদল আনন্দে লাফাতে লাফাতে বলেছিল, তৃণমূলের বিরুদ্ধে বাংলায় প্রকৃত বিরোধী শক্তি হিসাবে মোদী-শাহ’র গেরুয়া বাহিনী এসে গেছে। বিজেপি’ই বাংলায় তৃণমূলের বিকল্প। দু’বছর পরে বিধানসভা নির্বাচনের পরে আরেকদল বলতে শুরু করলেন, বামফ্রন্ট অস্তিত্বহীন, বাম শূন্য বিধানসভায় তৃণমূলই প্রকৃত বাম। মমতা ব্যানার্জিই নাকি বিজেপি’র বিকল্প।

সাত মাস যেতে না যেতেই কলকাতার মানুষ বুঝিয়ে দিলেন, তৃণমূল বনাম বিজেপি এই মেরুকরণের গল্পে বেশিদিন ভুলিয়ে রাখা যাবে না। তৃণমূল এবং বিজেপি’র বিরুদ্ধে প্রকৃত বিকল্প বামফ্রন্টই। প্রহসনের নির্বাচনেও বামফ্রন্টই দ্বিতীয় স্থানে উঠে এসেছে ভোট শতাংশের হিসাবে। যাদের ফিনিস বলে প্রচার করা হচ্ছিল, তাদের ফিনিক্স পাখির মতো আবার উঠে আসতে দেখা যাচ্ছে।

ফলাফল ঘোষণার পরে পাড়ায় পাড়ায় তাণ্ডব চালালো তৃণমূল

মঙ্গলবার কলকাতা কর্পোরেশনের নির্বাচনের ফলাফল প্রকাশিত হয়েছে। ফলাফলে কেন তৃণমূলের জয়জয়কার, কীভাবে তারা ৭২ শতাংশের বেশি ভোট পেলো এবং ১৩৪টা ওয়ার্ডে জয় পেলো তা নিয়ে অন্তত কলকাতার মানুষের মনে কোনো ধন্দ নেই। তাঁরা ভোটের দিনে বুথে বুথে তৃণমূলের ভোট লুটের কারবার দেখেছেন। সংবাদমাধ্যম যতটা সম্ভব চাপা দেওয়ার চেষ্টা করলেও সোস্যাল মিডিয়ায় সব তথ্য চাপা দেওয়া যায়নি। যারা কলকাতার বাইরে থাকেন তাঁরাও অনেকেই দেখেছেন কীভাবে সকাল সকাল বুথের সিসিটিভি বন্ধ করা হয়েছে কিংবা কাগজ বা কাপড় দিয়ে ঢেকে দেওয়া হয়েছে। কীভাবে বিরোধী প্রার্থী ও পোলিং এজেন্টদের হুমকি দেওয়া হয়েছে, মারধর করা হয়েছে, এমনকি মহিলারাও রেহাই পাননি এই আক্রমণের হাত থেকে। দাপিয়ে বেড়িয়েছে বাইকবাহিনী। এমন নির্বাচনের যেমন ফলাফল হওয়া স্বাভাবিক তেমন ফলাফলই শাসকদল পেয়েছে। শুধুমাত্র ১৪৪টা ওয়ার্ডের মধ্যে ১৩৪টা ওয়ার্ডে জেতাই নয়, কিংবা ৭২ শতাংশের বেশি ভোট পাওয়াই নয়, তৃণমূল বিরোধী জনতার ভোটে জেতা তিন নির্দল প্রার্থীকে তৃণমূলে ঢোকানোর তৎপরতাও শুরু হয়ে গেছে।

কিন্তু এত কিছু সত্ত্বেও ঢাকা দেওয়া যাচ্ছে ফলাফলের সেই ইঙ্গিতবাহী তথ্যগুলো। যেখানে দেখা যাচ্ছে, প্রাপ্ত ভোটের হার বেড়েছে বামফ্রন্টের। গত বিধানসভায় সংযুক্ত মোর্চা মোট ভোট পেয়েছিল ১০.৭০ শতাংশ, এরমধ্যে বামফ্রন্ট পেয়েছিল ৫ শতাংশের কিছু বেশি। এবার বামফ্রন্ট একাই পেয়েছে ১১.৮৯ শতাংশ ভোট, তার মধ্যে সিপিআই(এম) ৯.৬৩ শতাংশ, সিপিআই ১.০২শতাংশ, আরএসপি ০.৭৮ শতাংশ এবং ফরওয়ার্ড ব্লক ০.৪৪ শতাংশ। আর কংগ্রেস বিধাসনভা নির্বাচনে ভোট পেয়েছিল ২.৭৭ শতাংশ ভোট, এবার কংগ্রেস ভোট পেয়েছে ৪.১৩ শতাংশ। অর্থাৎ বামফ্রন্ট এবং কংগ্রেস উভয়েরই ভোট এবার বেড়েছে। আর বিজেপির ভোট? গত বিধানসভার তুলনায় বিজেপি’র ভোট কমেছে ১৮.৩৬ শতাংশ। গত বিধানসভায় তাদের ভোট ছিল ২৭.৫৫ শতাংশ, এবার কমে হল ৯.১৯ শতাংশ।
স্বাভাবিক বুদ্ধিতেই বলে বৃদ্ধি সত্ত্বেও জনসমর্থনের এই হার কোনোভাবেই সন্তুষ্ট হওয়ার মতো কিছু নয়। কিন্তু এই নির্বাচনটাই তো স্বাভাবিক ছিল না। শাসকদলের ভোট লুটের নির্বাচনের পরিপ্রেক্ষিতেই বিবেচনা করতে হবে বামফ্রন্টের এই জনসমর্থন বৃদ্ধি এবং বিজেপি’র জনসমর্থন হ্রাসকে। এটা শুধু কিছু মৌখিক অভিযোগের কথার কথা নয়, ফলাফলও চোখে আঙুল দিয়ে দেখিয়ে দিচ্ছে ভোট লুট সারা হয়েছে কীভাবে। শাসকদল তৃণমূল ৮০ শতাংশের বেশি ভোট পেয়েছে ৩৪টি আসনে, ৭০শতাংশের বেশি ভোট পেয়েছে ৪৪টি আসনে। ভবানীপুর বিধানসভার উপনির্বাচনে ৮টি ওয়ার্ডে মমতা ব্যানার্জি পেয়েছিলেন ৭১.৯ শতাংশ ভোট, জিতেছিলেন ৫৮ হাজার ভোটের ব্যবধানে। এখন কর্পোরেশন নির্বাচনে একটি ওয়ার্ডের ভোটেই তাঁকে টপকে গিয়েছেন তৃণমূলের অনেকেই। রাজ্যের মন্ত্রী জাভেদ খানের ছেলে ফৈয়াজ খান ৬৬ নম্বর ওয়ার্ডে জিতেছেন ৬২ হাজার ভোটের ব্যবধানে, পেয়েছেন ৮৭.৯২ শতাংশ ভোট। ৩৫ নম্বর ওয়ার্ডের তৃণমূল প্রার্থী পেয়েছেন ৯৩.০২শতাংশ ভোট। এখানে মোট ২২ হাজার ৪৬৩টি ভোট পড়েছে। তৃণমূল একাই পেয়েছে ২০হাজার ৮৯৭টি ভোট। ১০৯ নম্বর ওয়ার্ডে ৩৭ হাজার ৬২৩ ভোটের ব্যবধানে অর্থাৎ ৮৮.৫২ শতাংশ ভোট পেয়ে জিতেছেন। এই ফলাফল দেখলে সেই নির্বাচনকে কী বলা যায়? নির্বাচন নাকি প্রহসন?

শতাংশের নিরিখে দ্বিতীয় বামেরা

বামফ্রন্ট সরকার থাকাকালীন প্রতিটি পঞ্চায়েত এবং পৌরসভা নির্বাচনে আনন্দবাজার বর্তমান টেলিগ্রাফ এবং স্টেটসম্যান পত্রিকার সাংবাদিকদের একটি কঠিন দায়িত্ব থাকতো। কোথায় কোন বুথে শাসকদল অস্বাভাবিক ভোট পেয়েছে তা খুঁজে বের করার। কঠিন পরিশ্রম করে খুঁজে খুঁজে বের করে প্রথম পাতায় রিপোর্ট প্রকাশ করা হতো। এখন? সোস্যাল মিডিয়ায় ছড়িয়ে পড়েছে একটি মন্তব্য। ‘কয়েকটি বিক্ষিপ্ত শান্তিপূর্ণ ঘটনা ছাড়া এবারের কলিকাতা পৌরসভার ভোট মোটামুটি সন্ত্রাসপূর্ণ।’ কম কথায় এভাবেই ব্যাখ্যা দেওয়া যায় এই ফলাফলের।

নির্বাচনের দিন প্রকাশ্য রাস্তায় তৃণমূলের নেত্রীর হুমকি

কিন্তু এই পরিপ্রেক্ষিতেই বুঝতে হবে বামফ্রন্টের এই সামান্য জনসমর্থন বৃদ্ধির গুরুত্বকে। তৃণমূলের সন্ত্রাস ও ভোট লুটে কলকাতার নির্বাচনকে প্রহসনে পরিণত করা সত্ত্বেও বামফ্রন্টের পক্ষে জনসমর্থনের অল্প হলেও বৃদ্ধি লক্ষ্যণীয় ইঙ্গিত বলে মনে করার যথেষ্ট কারণ আছে। কলকাতায় প্রায় ৩ লক্ষ মানুষ ভোট দিয়েছেন বামফ্রন্টকে। বিধানসভা নির্বাচনে কংগ্রেস একটি ওয়ার্ডে প্রথম স্থানে এবং একটি ওয়ার্ডে দ্বিতীয় স্থানে ছিল। এবার দুটো আসনেই তারা জিতেছে। আর বামফ্রন্ট এখন ২টো ওয়ার্ডে জয়ী হওয়ার পাশাপাশি ৬৬টা ওয়ার্ডে দ্বিতীয় স্থানে রয়েছে। ভোট শতাংশের বিচারে এখন আর তৃণমূলের পরেই বিজেপি নেই, বামফ্রন্টই কলকাতায় দ্বিতীয়। এ কীসের ইঙ্গিত?

আগামী দিনে রাজ্যের জেলায় জেলায় ১১২টি পৌরসভার নির্বাচন হবে। যে মনোভাবের ইঙ্গিত কলকাতার মানুষ দিয়েছেন, লুটেরাদের বাধা ভেঙে জেলা শহরগুলির বাসিন্দারা সেই মনোভাবকে জোরের সঙ্গে প্রকাশ করতে পারলে সেটা কিন্তু বিপজ্জনক হবে তৃণমূল এবং বিজেপি উভয়ের পক্ষেই।

ফিনিশ থেকে ফিনিক্স বামেরা ফিরছে….

তৃনমূল আর বিজেপির মাঝখানে বনাম শব্দটা যে নেহাত বেমানান, সেটা কি ক্রমশ মানুষ ধরে ফেলছেন?

Spread the word

Leave a Reply