৭ই নভেম্বর-নভেম্বর বিপ্লব দিবসের এবছর ১০৬তম বার্ষিকী। কমিউনিস্ট বিরোধীরা ক্লান্তিহীনভাবে প্রশ্ন করে যায়,সোভিয়েত ইউনিয়ন আজ নেই তাহলে কেন ইতিহাসে পরিণত হওয়া নভেম্বর বিপ্লবের বার্ষিকী উদযাপন করি? আমরা মনে করি আজ সোভিয়েত ইউনিয়ন না থাকলেও নভেম্বর বিপ্লবের অভিজ্ঞতা আজকের পরিস্থিতিতেও চিরন্তনভাবে প্রাসঙ্গিক। মানব সভ্যতার ইতিহাসে এটা ঐতিহাসিক উজ্জ্বলতম ঘটনা যা সপ্রমাণিত করেছে মানুষই হলো তার ভবিষ্যতের চূড়ান্ত নির্ধারক এবং শোষিত শ্রেণীসমূহের চূড়ান্ত হস্তক্ষেপ ইতিহাসের ধারাকে পরিবর্তন করে দিতে পারে।নভেম্বর বিপ্লবের জয়লাভ সঠিক অর্থেই মার্কসীয় তত্ত্বের প্রয়োগিক সাফল্যের এক অনন্য প্রমাণ ও মার্কসবাদকে সৃজনশীল বিজ্ঞান হিসাবে সন্দেহাতীতভাবে প্রতিষ্ঠিত করেছিল। এই বিপ্লব বিশ্বে একটা নতুন যুগের সূচনা করেছিল। এটা শুধুমাত্র জার- স্বৈরতন্ত্র বিরোধী একটা বিপ্লব ছিল না; চরিত্রের বিচারে ছিল সাম্রাজ্যবাদ বিরোধী, পুঁজিবাদ বিরোধী এবং সমাজতান্ত্রিক। শোষণমুক্ত সমাজব্যবস্থা গড়ে তোলার লক্ষ্যে মানব সভ্যতার অনিবার্য অগ্রগতির যে কথা মার্কসবাদ বলে সেই সত্য মহান নভেম্বর বিপ্লব দৃঢ়তার সাথে প্রতিষ্ঠিত করে।
লিও হুবারম্যান বলেছিলেন- “ঊনবিংশ শতাব্দীর সমাপ্তির ১৭ বছর আগে কার্ল মার্কস প্রয়াত হয়েছেন।বিংশ শতাব্দীর শুরুর ১৭ বছর পর কার্ল মার্কস পুনর্জীবন লাভ করেছেন।”নভেম্বর বিপ্লবের প্রাসঙ্গিকতা আলোচনা প্রসঙ্গে যার কথা অনিবার্য ভাবে শুরুতেই আসবে- তিনি মহান চিন্তানায়ক কার্ল মার্কস এবং তাঁর বন্ধু ফ্রেডরিক এঙ্গেলস। মার্কসের চিন্তার উপর দাঁড়িয়েই নভেম্বর বিপ্লবের বিশাল কর্মকান্ড। মার্কসের চিন্তার সূত্রটা কি? লেনিন সংক্ষেপে বলেছিলেন মার্কসের চিন্তার উৎস মূলত তিনটি-জার্মান দর্শন, ইংল্যান্ডেরঅর্থনীতি এবং ফরাসি কাল্পনিক সমাজতান্ত্রিক ভাবনার রচনাগুলি। মার্কসবাদের তিনটি উপাদান- মার্কসীয় দর্শন, মার্কসীয় অর্থনীতি, মার্কসীয় সমাজতন্ত্র ও বিপ্লবের তত্ত্ব। মার্কসবাদ এর তিনটি উৎস ও তিনটি উপাদান প্রবন্ধে লেনিন এইভাবেই ব্যাখ্যা করলেন। মার্কসের মৌল চিন্তার উপলব্ধিতে তাঁর তিনটি আবিষ্কার গুরুত্বপূর্ণ – প্রথমতঃ দ্বন্দ্বমূলক ও ঐতিহাসিক বস্তুবাদ যেখানে দেখালেন বস্তুজগতের সাথে মানুষের ইতিহাসেরও দান্দ্বিক বিকাশ ঘটে। প্রাচীন সময় থেকে বিবর্তিত হয়ে আজকের পুঁজিবাদী সমাজ- অনিবার্য পরিণতি সমাজতন্ত্রে। দ্বিতীয়ত, শ্রেণীসংগ্রামই ইতিহাসের মূল চালিকাশক্তি হিসেবে সমাজকে এগিয়ে নিয়ে চলেছে। তৃতীয়, উদ্বৃত্ত মূল্যের সূত্র। উদ্বৃত্ত মূল্যের থেকেই পুঁজি, মুনাফা, ব্যক্তিগত সম্পত্তি। সামাজিক শ্রম ও ব্যক্তিগত ভোগের মধ্যেকার যে অবিরাম সংঘাত সেটাই আত্মপ্রকাশ করছে শ্রমিক বনাম মালিকের দ্বন্দ্বের মধ্য দিয়ে। আজ থেকে ১৭৫ বছর পূর্বে লিখিত “কমিউনিস্ট ইশতেহারে” এই শ্রেণীবিরোধের প্রসঙ্গটি সুন্দরভাবে উপস্থাপিত হয়েছে।
মার্কস -এঙ্গেলসের এর কর্মকাণ্ডের প্রভাব পড়তে থাকে ইউরোপের সব দেশেই-রাশিয়াতেও এসে পড়ে উনবিংশ শতাব্দীর শেষের দিকে। সে সময় রাশিয়ার সামাজিক-অর্থনৈতিক চরিত্র ছিল অর্ধেকটা ইউরোপ, অর্ধেকটা এশিয়া। রাশিয়াতে মূলত ১৮৮০ থেকে পুঁজিবাদের অভ্যুদয় হয় মূলত খনি ও রেলওয়েতে, এখানে শ্রমিকশ্রেণীর আবির্ভাব হয়। রাশিয়ায় জারতন্ত্রে কৃষকরা শুধু শোষিতই না কার্যত দাসত্বের জীবন যাপন করত। সে সময় শ্রমিকদের মধ্যে বিতর্ক- আলোচনায় নারদনিক মতাবলম্বীদের প্রভাব ছিল- তারা সন্ত্রাসবাদি পথে বিশ্বাসী ছিল । এই মতবাদের অনুসারী লেনিনের দাদার ফাঁসি হয়। লেনিন অনুভব করেছিলেন এই পথে সমাধান হবে না, রাস্তা খোঁজার জন্য তিনি রাজনৈতিক আলোচনার কেন্দ্রগুলোতে যেতেন। এরকম একটি কেন্দ্র ছিল প্লেখানভের যিনি রাশিয়ায় মার্কসবাদের আলোচনার সূত্রপাত করেছিলেন। লেনিন উৎসাহিত হলেন-ভাবতে শুরু করলেন রাশিয়াতে কেন বিপ্লব হতে পারে? তত্ত্ব ও প্রয়োগের এক জৈবিক অনুশীলনে নিজেকে উৎসর্গ করলেন কমরেড লেনিন। রাশিয়ায় কিভাবে পার্টি গড়ে উঠবে তার মতাদর্শগত ভিত্তির জন্য রচনা করলেন ‘কি করিতে হইবে’ আর সাংগঠনিক কর্মকৌশল এর ভিত্তি তৈরি ও সংগঠন মজবুত করতে কি কি শর্ত পূরণ প্রয়োজন তার জন্য লিখলেন- ‘এক পায়ে এগিয়ে দুই পা পিছিয়ে।’রাশিয়ায় সে সময় শ্রমিকদের আন্দোলন হচ্ছে, স্ট্রাইক হচ্ছে ও ডুমা নিয়ে বিতর্ক হচ্ছে-দেশের অভ্যন্তরে ঘটনার সমাহারে দ্রুত এগিয়ে যাচ্ছিল। ঝোড়ো পরিস্থিতির চূড়ান্ত চেহারা নিল ১৯১৭ সালে দুই পর্যায়ের বিপ্লবে-প্রথম হলো গণতান্ত্রিক বিপ্লব ফেব্রুয়ারি মাসে -জার সাম্রাজ্যের অবসান হলো, উদ্যোগ ছিল মূলত শ্রমিক শ্রেণীর কিন্তু নেতৃত্ব পেল কিছু বুর্জোয়া বা সংশোধনবাদী দল যেমন মেনশেভিকরা- কেরেনস্কি সরকার প্রতিষ্ঠিত হয়। কিন্তু লেনিনের নেতৃত্বে বলশেভিক পার্টি সঠিকভাবে ফেব্রুয়ারি বিপ্লবের সীমাবদ্ধতা ও অসম্পূর্ণতাকে চিহ্নিত করতে সক্ষম হলেন। লেনিনের চিন্তায় আগের দুটো ব্যর্থ বিপ্লবের অভিজ্ঞতা ছিল।
প্যারি কমিউনের নেতাদের চিন্তাধারার অস্পষ্টতা- ক্ষমতা দখল করার পর সেই রাষ্ট্রক্ষমতার যন্ত্রটাকেই অটুট রেখে দেওয়া আর ১৯০৫ সালে রাশিয়ায় শহরে শ্রমিকরা যখন অভ্যুত্থান করল কৃষকরা পাশে দাঁড়ায় নি। শ্রমিক এবং কৃষককে একসঙ্গে দাঁড় করানোটা খুবই জরুরী ছিল। লেনিন নিজে এর মূল্যায়ন করলেন ‘গ্রামের গরীবদের প্রতি’ বইটিতে। এপ্রিল মাসে লেনিন বিদেশ থেকে ফিরে স্লোগান দিলেন: সোভিয়েতের হাতে ক্ষমতা আসুক আর “এপ্রিল থিসিসে”র মাধ্যমে উপস্থিত করলেন কিভাবে গনতান্ত্রিক বিপ্লব থেকে সমাজতন্ত্রের বিপ্লবের দিকে অগ্রসর হতে হবে। সোভিয়েত হবে মিলিতভাবে শ্রমিক, সৈনিক এবং কৃষকদের।রুটি -জমি- শান্তির ভাবনা জনগণের মধ্যে এমনভাবে গেঁথে গেল এবং যে শক্তি সঞ্চয় করল তার সামনে কেউ দাঁড়াতে পারল না। জয় যুক্ত হলো শোষিত জনতার সংগঠিত শক্তি। ইউরোপের পিছনের উঠোনে, একটি পশ্চাৎপদ দেশে বিশ্বের প্রথম সমাজতান্ত্রিক রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠিত হল নভেম্বর মাসে। শিশু সমাজতান্ত্রিক রাষ্ট্রকে ধ্বংস করার ভয়ংকর চক্রান্ত চলেছে।প্রতিবিপ্লবীরা সংগঠিত হয়ে শ্বেতবিপ্লবের নামে সরকারকে উৎপাটিত করার তৎপরতা চালিয়েছে। বারটি সাম্রাজ্যবাদী দেশ প্রত্যক্ষভাবে এই প্রতিবিপ্লবী শক্তিকে সমস্ত ধরনের মদত জুগিয়েছিল। বলশেভিকরা শ্রমিক, কৃষক ও বিরাট অংশের সেনাবাহিনী এবং জনগণের সাহায্যে এই অশুভ শক্তিকে পরাস্ত করে সমাজতন্ত্র গড়ে তোলার কঠিন সংগ্রাম পরিচালনা করতে হয়েছে। নয়া অর্থনৈতিক নীতি (নেপ) চালু করা হয়েছিল। লেনিনের মৃত্যুর পর স্তালিন শুরু করলেন “স্টাখানোভাইট আন্দোলন”-মূল কথা হলো উৎপাদন পদ্ধতিকে উন্নত করতে হবে, শ্রমিককে সৃজনশীল হতে হবে, উৎপাদনে গতি আনতে হবে। ১৯৪১ সালের মধ্যে একটা পশ্চাৎপদ দেশ পৃথিবীর দ্বিতীয় শিল্পোন্নত ও সামরিক শক্তিধর রাষ্ট্র হয়ে দাঁড়ালো। সমাজতান্ত্রিক রাষ্ট্র ও সোভিয়েত ইউনিয়নের প্রতিষ্ঠা সমাজ অর্থনীতির ক্ষেত্রে ছিল এক বিরাট অগ্রগতি-অর্জিত হয়েছিল পূর্ণ কর্মসংস্থান, সর্বজনীন ও নিখরচায় শিক্ষা,স্বাস্থ্য পরিষেবা,আবাসন, মেয়েদের সমানাধিকার।
১৯৩২ সালে ‘নিউ ইয়র্ক টাইমস’ পত্রিকার সাংবাদিক ওয়াল্টারর ডুরান মন্তব্য করেছিলেন, সমাজতন্ত্রের কাঠামো নির্মাণের কাজটি সোভিয়েতে শেষ হয়েছে। ‘ম্যাঞ্চেস্টার গার্ডিয়ান’ পত্রিকা ২০ শে ফেব্রুয়ারি ১৯৩৬ এর সম্পাদকীয় লিখতে বাধ্য হলেন- সংশয়ী পৃথিবীকে স্বীকার করতেই হবে যৌথ মালিকানা রাশিয়াতে ভালোভাবেই প্রতিষ্ঠিত। ১৮৪৫ সালে দি জার্মান আইডিওলজি বইতে মার্কস ফয়েরবাখ সম্পর্কে লেখায় একটা বাক্য লিখেছিলেন -“দার্শনিকরা নানাভাবে এই জগৎটাকে ব্যাখ্যা করেছেন, কিন্তু আসল কথা হলো একে পরিবর্তন করা।”নভেম্বর বিপ্লবে একটা সম্পূর্ণ নতুন অর্থনৈতিক শাসন ব্যবস্থা তৈরি হলো যার চালক হল নিপীড়িতরা। ১৯৩০ সালে রবীন্দ্রনাথ রাশিয়া ভ্রমণের অভিজ্ঞতা ‘রাশিয়ার চিঠি’তে উল্লেখ করেছিলেন-“আমি নিজের চোখে না দেখলে কোনমতেই বিশ্বাস করতে পারতুম না যে অশিক্ষা ও অবমাননার নিম্নতম তল থেকে আজ কেবলমাত্র ১০ বছরের মধ্যে লক্ষ লক্ষ মানুষকে এরা শুধু ক খ গ ঘ শেখায়নি, মনুষ্যত্বে সম্মানিত করেছে।”রবীন্দ্রনাথ বলেছিলেন রাশিয়াতে কোথাও “ধনগরিমার ইতরতা” দেখেননি।এটাতো ঘটনা নভেম্বর বিপ্লব পরবর্তী সময়ে বিংশ শতাব্দীর ইতিহাস মূলত সমাজতন্ত্র প্রতিষ্ঠার দ্বারাই নির্ধারিত হয়েছিল।পৃথিবীর বিভিন্ন দেশে কমিউনিস্ট পার্টি গড়ে উঠেছিল।ফ্যাসিবাদকে পরাস্ত করতে সোভিয়েতের লাল ফৌজের নির্ণায়ক ভূমিকার ফলস্বরূপ পূর্ব ইউরোপে সমাজতান্ত্রিক দেশসমূহে আবির্ভাব অন্যদিকে ঔপনিবেশিকতা বিরোধী সংগ্রামকে অনুপ্রাণিত করেছে। ১১ টি সাম্রাজ্যবাদী দেশ সে সময়ে ১০৭ টি দেশকে শৃঙ্খলিত করে রেখেছিল -নভেম্বর বিপ্লব পরবর্তীতে সমস্ত দেশই সাম্রাজ্যবাদের শৃংখল মুক্ত।সমাজতান্ত্রিক সমাজ কি হবে, তার চরিত্র, দৃষ্টিভঙ্গি কি, কেমন ভাবে এই ব্যবস্থা রূপান্তরিত হবে সাম্যবাদে- মার্কসীয় শিক্ষার উপর ভিত্তি করে গড়ে ওঠা লেনিনীয় ভাষ্য মার্কসবাদকে আরও এগিয়ে নিয়ে গেছে। মার্কসীয় তত্ত্বচর্চা প্রকৃতপক্ষে একটি পুনর্নির্মাণ প্রক্রিয়া -এর উদ্দেশ্য হল বিপ্লবী কর্মকাণ্ডের প্রয়োগে সাহায্য করা। লেনিনের মৌলিক এবং সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ অবদান, সাম্রাজ্যবাদকে বোঝার ক্ষেত্রে মার্কসবাদী জ্ঞান উপলব্ধিকে তিনি আরো বিকশিত করেছিলেন এবং বিষয়টিকে বিপ্লবী রণীতির অঙ্গীভূত করেছেন।
লেনিন লক্ষ্য করেছিলেন পুঁজি যে নীতিতে সংহত এবং কেন্দ্রীভূত হয়, সেই নীতির ফলেই একচেটিয়া পুঁজিবাদের সৃষ্টি হয় এবং সেই অন্তর্নিহিত গতির কারণে সাম্রাজ্যবাদ দুনিয়াকে পুঁজিবাদী শোষণের আওতার মধ্যে এনে ফেলে। প্রথাগত মার্কসীয় ধারণা ছিল সমাজতান্ত্রিক বিপ্লব অগ্রসর পুঁজিবাদী দেশেই সম্ভব। এটা ছিল ‘Errors of Expectation’.লেনিন এই চলতি ধারণার ছক ভেঙে বেরিয়ে এসে দেখালেন সাম্রাজ্যবাদের পর্বে পুঁজিবাদের অসম বিকাশ এমন একটা দেশে তা পশ্চাদপদ হলেও, সেখানে সমাজতান্ত্রিক বিপ্লব সফল হওয়ার সম্ভাবনা তৈরি করবে। লেনিন দেখিয়েছিলেন সাম্রাজ্যবাদী শৃংখলের দুর্বলতম গ্রন্থি ভেঙে ফেলার সম্ভাবনাই বেশি। প্রথম বিশ্বযুদ্ধ শুরুর পর জারের রাশিয়াই ছিল সেই দুর্বলতম গ্রন্থি। নভেম্বর বিপ্লবের আলোকে উদ্ভাসিত হয়ে উঠল আরো কয়েকটি পশ্চাৎপদ দেশ- চীন, ভিয়েতনাম, উত্তর কোরিয়া, কিউবায় বিপ্লব হল। বিপ্লব ঘটেনি অগ্রসর পুঁজিবাদী দেশে। সাম্রাজ্যবাদ সংক্রান্ত বিশ্লেষণ থেকেই উৎসারিত হয়েছিল নভেম্বর বিপ্লবের নানাবিধ পথপ্রদর্শনকারী রণনীতি–পাশ্চাৎপদ অর্থনীতিকে সমাজতন্ত্রে উত্তরণ ঘটানোর জন্য লেনিন একদেশেই সমাজতন্ত্রের ধারণাকে কেন্দ্র করে বিপ্লবের স্তরের তত্ত্ব উপস্থিত করলেন- বিপ্লবের গণতান্ত্রিক স্তরকেও সমাজতান্ত্রিক স্তরে উত্তরণ; পুঁজিবাদী- জমিদারতন্ত্রের বিরুদ্ধে সংগ্রামে শ্রমিক- কৃষক মৈত্রীর রণনীতি; জাতীয় প্রশ্নে মার্কসবাদী দৃষ্টিভঙ্গি যার মধ্যে অন্তর্ভুক্ত ছিল জারের রাশিয়ায় নিপীড়িত জাতিগুলির স্বাধীনতা অর্জনের অধিকার; নভেম্বর বিপ্লব সামনে এনেছিল নতুন ধরনের পার্টি সংক্রান্ত লেনিনীয় ধারণাকে, এনেছিল বিপ্লবী সংগঠনের তত্ত্ব ও অনুশীলনকে।
আজকের বিশ্ব পরিস্থিতি কি?
৩২ বছর আগে বাহ্যিক ও অভ্যন্তরীণ দুকারণে সোভিয়েতের পতন হয়েছে।অনেকে মনে করেন সোভিয়েতের পতন সমাজতন্ত্র ও মার্কসবাদের মৃত্যু ঘন্টা বাজিয়ে দিয়েছে। মানবজাতির ভবিষ্যৎ পুঁজিবাদের অন্তহীনপর্ব। সোভিয়েতের পতন মানে যেমন সব শেষ হয়নি আবার কিছুই হয়নি সেটাও ঠিক নয়। আমাদের অনেক দূর পিছিয়ে দিয়েছে। সাম্রাজ্যবাদের দিকে ঝুঁকে আছে বিশ্ব পরিস্থিতি। কিন্তু এতে সাম্রাজ্যবাদ ও সমাজতন্ত্রের মধ্যে কেন্দ্রীয় দ্বন্দ্বটি নিরসন হয়নি। চীনের সঙ্গে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের ক্রমবর্ধমান সংঘাত সাম্রাজ্যবাদ ও সমাজতন্ত্রের মধ্যে দ্বন্দ্ব আরো শানিত হচ্ছে-এক নতুন ধরনের ঠান্ডা যুদ্ধের উদ্ভব হয়েছে। প্রথম ঠান্ডা যুদ্ধের পর্বে সোভিয়েত কখনোই আমেরিকার অর্থনৈতিক শক্তির কাছাকাছি পৌঁছাতে পারেনি। সোভিয়েতের অর্থনৈতিক শক্তি সর্বোচ্চবিন্দুতে পৌঁছায় ১৯৭৫ সালে- মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের জিডিপির ৪৪.৪% ছিল সোভিয়েতের জিডিপি। আর এখন চীনের আনুমানিক জিডিপি আমেরিকার ৭৫% জিডিপির সমান।মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র অত্যন্ত উদ্বিগ্ন যে উন্নত প্রযুক্তির নির্দিষ্ট কিছু ক্ষেত্রে চীন দ্রুত এগিয়ে যাচ্ছে। চীনা কোম্পানিগুলি যাতে সেমিকন্ডাক্টর প্রযুক্তি এবং অত্যন্ত উচ্চমানের চিফ যোগাড় করতে না পারে সেজন্য নতুন নিষেধাজ্ঞা ও নিয়ন্ত্রণবিধি জারি করেছে বাইডেন প্রশাসন।
মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র ও তাদের মিত্রশক্তির আধিপত্যকে সংহত করতে দেখা যাচ্ছে বেশ কিছু আগ্রাসী যুদ্ধ-সার্বিয়ায় বোমাবর্ষণ, আফগানিস্তান ও ইরাক, লিবিয়া, সিরিয়া, বর্তমানে প্যালেস্টাইনে বর্বরোচিত আক্রমণ।ইউক্রেন সংঘাতের পিছনেও রয়েছে ন্যাটোর পরিকল্পনা। কিছু ক্ষেত্রে সাম্রাজ্যবাদীদের অন্তর্দ্বন্দ্ব বিদ্যমান।এখন সাম্রাজ্যবাদী ব্যবস্থা ওপর আধিপত্য করে আন্তর্জাতিক লগ্নিপু্ঁজী যা লেনিনীয় বর্ণনা থেকে চরিত্রগতভাবে কিছু পার্থক্য রয়েছে। মুনাফার সর্বোচ্চকরনের ক্ষুধা মেটাতে অর্থনীতির ফাটকা কারবারের দিকে স্থানান্তকরণকে বলা হচ্ছে ‘ফাইন্যান্সিয়ালাইজেশন অব ইকনমি’। নেটওয়ার্থ অনুযায়ী পৃথিবীর এখন সবচেয়ে ধনী সাত সংস্থা (গুগল, ফেসবুক, আ্যপল, আমাজন, মাইক্রোসফট, আলীবাবা, টেনসেন্ট) উৎপাদনে অংশগ্রহণ না করেই মুনাফার পাহাড় তৈরি করছে- বলা হচ্ছে প্ল্যাটফর্ম নির্ভর অর্থনীতি। আগে পুঁজির প্রধান রূপ ছিল স্টেক-হোল্ডার ক্যাপিটালিজম বৃহৎ শিল্পে কেন্দ্রীভূত পুঁজি। এখন শেয়ার হোল্ডার ক্যাপিটালিজম। সম্প্রতিক সময়ে লগ্নিপুঁজির রূপ ও কর্পোরেট সংগঠন বিরাট ভাবে পরিবর্তিত হয়েছে। আমাদের পার্টি ১৯৯২ সালে চতুর্দশ কংগ্রেসে “কিছু মতাদর্শগত বিষয় সম্পর্কে প্রস্তাব” এবং ২০১২ সালে বিংশতিতম কংগ্রেসে “কয়েকটি মতাদর্শগত বিষয় সম্পর্কে প্রস্তাব” গ্রহণের মাধ্যমে তাত্ত্বিক বোঝাপড়া সময়োপযোগী ও সমৃদ্ধ করার চেষ্টা করেছে।
সোভিয়েতের পতনের পর যারা পুঁজিবাদের চূড়ান্ত বিজয়োল্লাশ করেছিলেন আজকের পুতিনের রাশিয়া ও পূর্ব ইউরোপের দেশগুলোর সংকট, খন্ডিভবন ও সংঘাতের মধ্যে তারা কি গণতন্ত্র ও সভ্যতার অগ্রগতি দেখতে পাচ্ছেন? ১৯৯৭-৯৮এ ‘এশিয়ান ব্যাঘ্রদের’ পতন ও ২০০৮ সালের অর্থনৈতিক বিপর্যয় থেকে এখনও নিজেকে মুক্ত করতে না পারা পুঁজিবাদের চরম ব্যর্থতা প্রমাণ করে না? নানা প্রতিষ্ঠানের পূর্বাভাস পুঁজিবাদ এক দীর্ঘস্থায়ী মন্দার কবলে পড়তে চলেছে। আয় ও সম্পদের বৈষম্য ক্রমাগত বাড়ছে। বিশ্ব জনসংখ্যার মাত্র ১০%, তারাই পৃথিবীর মোট সম্পদের ৭৬% এর মালিক। জনস্বার্থে নয় পুঁজিবাদের স্বার্থেই আন্তর্জাতিক লগ্নিপুঁজির কার্যধারাকে কতটা গতিশীল রাখা যায় সেই লক্ষ্যেই রাষ্ট্রের কার্যধারার পরিবর্তন হয়েছে। আমাদের মত দেশেও নয়া উদারনীতির সাথে যুক্ত হওয়ার পর স্বনির্ভরতার প্রশ্ন হয়েছে গৌণ। কৃত্রিম বাজারে ঋণপুষ্ট খরচ বাড়িয়ে সংকট মুক্তির চেষ্টা মুখ থুবড়ে পড়ছে উন্নত দেশগুলিতে-মন্দা, বেকারি বাড়ছে। উন্নয়নশীল দেশগুলিও বড়সড় ঋণসংকটে ভুগছে। মার্কিন সাম্রাজ্যের আগ্রাসী মনোভাব উন্নয়নশীল দেশের সঙ্গে সাম্রাজ্যবাদের দ্বন্দ্ব প্রভাবিত করছে।সংকটের বর্তমান পর্যায় থেকে বেরিয়ে আসতে শ্রমজীবী জনতার ঘাড়ে অভূতপূর্ব ব্যয়সংকোচ পদক্ষেপ চাপিয়ে দেওয়া হচ্ছে আয়ের বর্তমান স্তর ও জীবন ধারণের প্রয়োজনগুলি কেউ নস্যাৎ করা হচ্ছে। শিক্ষা, স্বাস্থ্য সহ কৃষিতে ভর্তুকি- কৃষি উৎপাদনের সামর্থ্য বৃদ্ধি করা, গরীব মানুষের সামর্থ্য বৃদ্ধি করা, শিল্প উৎপাদনে অগ্রগতির প্রচেষ্টা, আভ্যন্তরীণ বাজার তৈরীর কাজগুলি রাষ্ট্র ক্রমাগত বাতিল করছে। চাহিদা বাড়ানোর ক্ষেত্রে রাষ্ট্রের ভূমিকা গুরুতরভাবে হ্রাসের কারণে অতি উৎপাদন ও ভারসাম্যহীনতা, বেকারি, ছাঁটাই, মজুরি হ্রাস সমস্ত দেশকে আরো বেশি করে গ্রাস করছে।
বিশ্ব পুঁজির বাধাহীন কার্য পরিচালনার জন্য দেশগুলির অর্থনৈতিক ও রাজনৈতিক সার্বভৌমত্ব বিলুপ্তিকরন প্রয়োজন। আর এসব সম্ভবপর নয় যদি না জনগণের রাজনৈতিক ক্ষমতা হ্রাস করা যায়, গণতন্ত্রকে দুর্বল করা যায়। একদিকে আন্তর্জাতিক বিনিয়োগকারীদের খামখেয়ালিপনাকে সন্তুষ্ট করা অন্যদিকে দেশের জনগণের ইচ্ছার প্রতি মর্যাদা দান -পারস্পরিক বিপরীত ধর্মী এই আকাঙ্ক্ষা মেটানো অসম্ভব হয়ে পড়ছে। শ্রম ও পুঁজির মধ্যেকার মূল দ্বন্দ্ব তীব্রতর হচ্ছে। নয়া উদারনীতির এই সংকট পর্বে দক্ষিণপন্থী স্বৈরাচারী শক্তি পরিস্থিতির সুযোগ নিতে চাইছে। সামগ্রিকভাবে দক্ষিণ পন্থার অভিমুখে ভারসাম্য ঝুঁকে পড়া সত্ত্বেও কিছু ব্যতিক্রমী অবস্থান লক্ষ্য করা যাচ্ছে লাতিনা আমেরিকায়- ব্রাজিল, চিলি, কলম্বিয়া। লাতিন আমেরিকায় এক নতুন চেহারায় সমাজতন্ত্রের জন্য দীর্ঘস্থায়ী সংগ্রাম গড়ে ওঠার সম্ভাবনা দেখা যাচ্ছে।আমাদের দেশেও গত ১০বছরে কর্পোরেট- হিন্দুত্ববাদের শাসনে অর্থনৈতিক সার্বভৌমত্ব, ধর্মনিরপেক্ষ গণতন্ত্র, যুক্তরাষ্ট্রীয় কাঠামো, সামাজিক ন্যায় বিচার আক্রান্ত। পুঁজি ও শ্রমের মধ্যে বহমান শ্রেণীসংগ্রাম যা সংকট বৃদ্ধির সঙ্গে সঙ্গে তীব্র থেকে তীব্রতর হচ্ছে ও হবে।
এখন বিশ্বে চারটি প্রধান সামাজিক দ্বন্দ্ব বিদ্যমান যেগুলি মীমাংসা করা সম্ভব কেবল পুঁজিবাদকে অতিক্রম করে এবং সমাজতন্ত্র প্রতিষ্ঠায়। প্রশ্ন মুষ্টিমেয় পুঁজিপতির হাতে পৃথিবীকে ছেড়ে দেওয়া হবে নাকি এদের হাত থেকে ক্ষমতা কেড়ে নেওয়ার লড়াই চলবে? আমাদের সময়ে এক নতুন ক্রান্তিকালের পর্বে নভেম্বর বিপ্লবের বিপ্লবী উত্তরাধিকার সাহায্য করবে সমাজতন্ত্রের জন্য এই লড়াইতে নতুন শক্তি সঞ্চারিত করতে।আমাদের দেশেও বামপন্থীদের সামনে বিপুল সম্ভাবনার দ্বার উন্মোচিত- পুঁজিবাদী সংকট, সাম্প্রদায়িকতা,জাতপাতের ভেদাভেদ, বিরুদ্ধ মতকে নিয়ন্ত্রণ ইত্যাদির বিরুদ্ধে জনগণকে সমবেত করা ও সমাজতান্ত্রিক বিকল্পকে জীবন্ত রূপে তুলে ধরার প্রধান হাতিয়ার হচ্ছে নভেম্বর বিপ্লব ও কমিউনিস্ট ইশতেহার। পুঁজি সম্পর্ক ও তার থেকে মানুষের মুক্তির আকাঙ্ক্ষা হয়তো হোঁচট খাচ্ছে নানা ভাবে- নানা সময়ে,কিন্তু থেমে যাচ্ছে না।যত ধাক্কায় আসুক না কেন মানুষই ইতিহাস রচনা করবে।
রবীন্দ্রনাথের কথায়–“ক্ষুধাতুর আর ভুরিভোজীদের নিদারুণ সংঘাতে/ ব্যাপ্ত হয়েছে পাপের দুরদহন/ সভ্যনামিক পাতালে জমেছে লুটের ধন/ যদি এ ভুবনে থাকে আজও তেজ কল্যাণশক্তির/ ভীষণ যজ্ঞে প্রায়শ্চিত্ত পূর্ণ করিয়া শেষে/ নতুন জীবন নতুন আলোকে জাগিবে নতুন দেশে।”জয় হবেই। ভবিষ্যৎ সমাজতন্ত্রের।