Adani Cartoon

The Mission, The Target: The Reason

বাদল সরোজ

‘অপারেশন কাগার’ আদানি ও কর্পোরেটদের জন্য লাল গালিচা বিছানোর উদ্যোগ।

গত ২১ মে, বস্তারের নারায়ণপুর জেলার মাড় অঞ্চলের গুণ্ডেকোট জঙ্গলে সশস্ত্র বাহিনীর সঙ্গে সংঘর্ষ চলাকালীন মাওবাদীদের শীর্ষ নেতৃত্ব নিহত হয়। মাওবাদীদের পক্ষ থেকে প্রকাশিত বিবৃতিতে জানানো হয়, ঐ সংঘর্ষে মোট ২৭ জনের মৃত্যু হয়েছে। মৃতদের মধ্যে মাওবাদীদের সাধারণ সম্পাদক নম্বলা কেশব রাও ওরফে বাসব রাজু (৭৪ বছর বয়স) সহ কয়েকজন যুবতী ও মহিলাও রয়েছেন। ঐ বিবৃতিতে দাবি করা হয়, বাসব রাজুকে সশস্ত্র বাহিনী জীবিত অবস্থাতেই গ্রেপ্তার করেছিল, পরে হেফাজতে থাকাকালীনই তার মৃত্যু হয়।

সশস্ত্র বাহিনী জানিয়েছে ২১ এপ্রিল থেকে শুরু হওয়া অভিযান ‘অপারেশন কাগার’ চলাকালীন ২১ মে মাওবাদী নেতৃত্বকে ‘বিনাশ’-এর কাজটি সফলভাবে সমাপ্ত হয়েছে।

একই অঞ্চলে, একটি পাহাড়ে এর ১০ দিন আগে ৩২ জনকে হত্যা করা হয়েছিল। সেই ঘটনাতেও মৃতদের মাওবাদী বলেই দাবি করা হয়। ‘দাবি করা হয়’ বলা প্রয়োজন কারণ ২০২৪’র জুন মাস থেকে এখনও পর্যন্ত প্রায় ৩৫০ জন মাওবাদীর নিহত হয়েছে বলে দাবি করা হয়েছে। এদের মধ্যে ২০২৫ সালের প্রথম ৩ মাসেই ১৪০ জন নিহত হয়েছে অথচ এদের অধিকাংশেরই মাওবাদী হওয়ার বিষয়টি প্রমাণিত হয়নি। একথাও মনে রাখতে হবে যে মাওবাদী বলে কাউকে বিনা বিচারে হত্যা করা বৈধ হতে পারে না।

মাওবাদীদের বিবৃতিতে বলা হয়েছে, সাধারণ সম্পাদক সহ অন্য অনেকের মৃত্যুর ঘটনা তাদের দলেরই কিছু সদস্যের ‘বিশ্বাসঘাতকতা’র ফল। এই বিশ্বাসঘাতকদের মধ্যে ইউনিফায়েড কমান্ডের একজন সদস্য সহ আরও কয়েকজন শীর্ষস্থানীয় এমন সব নেতারা রয়েছেন যারা বাসব রাজুর ঘনিষ্ঠ ছিলেন। বলা হয়েছে সশস্ত্র বাহিনীর ঘেরাওয়ের সময় তারা বাসব রাজুকে ফেলে রেখে বাহিনীর সঙ্গেই মিলে যায়।

এই এনকাউন্টারের প্রকৃত উদ্দেশ্য

এহেন সংঘর্ষ ও তথাকথিত এনকাউন্টারগুলি অত্যন্ত নিন্দনীয়, বিশেষত যেসব ক্ষেত্রে বাস্তবে কোনও সংঘর্ষই ঘটেনি। মাওবাদীদের পক্ষ থেকে ইতিমধ্যেই ‘সিজফায়ার’-র ঘোষণা করা হয়েছিল। গত ৪০ দিন ধরে কোনও বড় ধরনের ঘটনাও ঘটেনি। তাদের পক্ষ থেকে একাধিকবার আলোচনার আবেদনও জানানো হচ্ছিল। মাওবাদীরা ছাড়াও অনেক রাজনৈতিক দল, সংগঠন, নাগরিক, এমনকি তেলেঙ্গানার নারী ও শিশু কল্যাণ মন্ত্রী সীধক্কা’ও আলোচনার মাধ্যমে সমাধানের প্রস্তাব দিয়েছিলেন।

এর পাশাপাশি আরেকটি কারণও ছিল। মাওবাদীরা ইতিমধ্যেই যথেষ্ট দুর্বল হয়ে পড়েছিল। এটি কোনও গোপন বিষয় নয়, সকলেরই জানা। এমন পরিস্থিতিতে তাদের সঙ্গে আলোচনার মাধ্যমে পথ খোঁজার চেষ্টা করলে মাথায় কোনও আকাশ ভেঙে পড়ত না। তাদের পথ নিয়ে মত পার্থক্য থাকতে পারে, কিন্তু তারা ভারতেরই নাগরিক। যে কোনও গণতান্ত্রিক দেশের উচিত আলাপ-আলোচনার মাধ্যমেই সমাধানের চেষ্টা করা— এমনটা অতীতেও হয়েছে।

আলাপ-আলোচনার মাধ্যমে সমাধান বের করে আনার অসংখ্য উদাহরণ ভারতেই রয়েছে। আসাম, মিজোরাম, নাগাল্যান্ড, ত্রিপুরা সহ সমস্ত উত্তর-পূর্বাঞ্চলীয় রাজ্যগুলি ছাড়াও স্বাধীনতার পর জম্মু-কাশ্মীর থেকে পাঞ্জাব পর্যন্ত, এমনকি পশ্চিমবঙ্গের গোর্খা-প্রধান অঞ্চল সহ বহু জায়গায় আজ পরিস্থিতি যেভাবে নিয়ন্ত্রণে এসেছে তা বন্দুকের নলের জোরে ঘটেনি, আলোচনার টেবিলে বসেই সম্ভব হয়েছে। অনেক ক্ষেত্রেই দীর্ঘ দশক ধরে ধৈর্যের সঙ্গে চলা আলোচনার সুবাদেই এই সাফল্য অর্জিত হয়েছে।

মোদি সরকারের স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী অমিত শাহ এবং ছত্তিশগড়ের মুখ্যমন্ত্রীর তরফে আলোচনায় না বসার বিবৃতি কার্যত নিখাদ ফ্যাসিবাদী মানসিকতারই প্রতিফলন।

সেই ফ্যাসিস্ত মনোভাব থেকেই ৮০০ বর্গ কিলোমিটার এলাকাজুড়ে সিআরপিএফ, বিশেষ কোবরা ইউনিট, ডিআরজি, এসটিএফ, ছত্তিশগড় ও তেলেঙ্গানার পুলিশ— সব মিলিয়ে মোট ২৪ হাজার সশস্ত্র বাহিনীকে অপারেশন কাগারের জন্য মোতায়েন করা হয়। এ অভিযান শেষ হওয়ার পর ঐ এলাকায় ৬১২টি থানা স্থাপনের কথাও বলা হয়েছে।

এতেই স্পষ্ট বোঝা যায় উদ্দেশ্য হিসাবে যা বলা হয়েছে, তা আসল লক্ষ্য নয়। আসল লক্ষ্য অন্য কিছু যা ইচ্ছাকৃতভাবেই গোপন রাখা হয়েছে।

মাওবাদীদের মোকাবিলা আসলে অজুহাত। বস্তার ও সেখানকার আদিবাসীদের সাথে বসে গণতান্ত্রিক উপায়ে সমাধান খোঁজা নরেন্দ্র মোদির নেতৃত্বাধীন কেন্দ্রীয় সরকারের মনোভাব নয়। সুস্থির রাজনৈতিক পরিবেশ প্রতিষ্ঠার বদলে আদানি সহ অন্যান্য কর্পোরেটদের লুটের পথ প্রশস্ত করতে লাল কার্পেট বিছিয়ে দেওয়াই তাদের লক্ষ্য। বস্তারের মতো প্রাকৃতিক সম্পদে সমৃদ্ধ অঞ্চলগুলির উপর কলম্বাসের মতো মনোভাব নিয়ে ঐ সকল এলাকায় দীর্ঘ যুগ ধরে বসবাসকারী আদিবাসী ও বনবাসীদের উৎখাত করে খনিজ, জঙ্গল, জল সহ বিপুল সম্পদের শোষণ করাই তাদের লক্ষ্য।

গত কয়েক বছরের ঘটনাপ্রবাহ দেখলেই বোঝা যায়, আদানি প্রভৃতি কর্পোরেটদের স্বার্থে অবুঝমাড় সহ ঘন জঙ্গল এলাকা খালি করানো, সেখানে চার ও ছয় লেনের সুপার এক্সপ্রেস হাইওয়ে নির্মাণ এবং এর জন্য জমি দখলের কাজ সহজে করতে আড়াই কিলোমিটার অন্তর সশস্ত্র বাহিনীর ক্যাম্প বসানোর বিরুদ্ধেই এখন বস্তারের মূল লড়াই। আদিবাসীরা হাতে অস্ত্র তোলেনি, শান্তিপূর্ণ উপায়েই আন্দোলন করছিল। বহু উসকানির পরেও, এমনকি অহেতুক গুলিচালনা ও হত্যার পরেও তারা শান্তির পথ ছাড়েনি। বিজাপুর ও সুকমার মাঝে সিলগের অঞ্চলে এ প্রতিরোধ আন্দোলন গত চার-পাঁচ বছর ধরে টানা চলছে।

২০২১ সালের ২৬ নভেম্বর তৎকালীন ছত্তিশগড় কৃষক সভার সভাপতি সঞ্জয় পরাতে-র সঙ্গে, পরে আরও একবার সর্বভারতীয় কৃষক সভার প্রতিনিধি হিসেবে আমি নিজেই ঐ আন্দোলনে অংশগ্রহণ করি। সে অভিজ্ঞতা এখনো টাটকা। আড়াই কিলোমিটার অন্তর সিআরপিএফ ক্যাম্প বা পুলিশ ছাউনি না করে স্কুল ও হাসপাতাল তৈরি করা হোক, যাতে ম্যালেরিয়া ও অপুষ্টিজনিত হাজারো প্রতিরোধযোগ্য মৃত্যু কমানো যায়, যাতে তাদের সন্তানরা পড়াশোনা করতে পারে। এইসব দাবীতে গভীর জঙ্গলের মধ্যে হাজার হাজার আদিবাসী একত্রিত হয়।

খনিজ ও বনসম্পদের নিষ্ঠুর শোষণ করে বস্তারকে আদিবাসী শূন্য করার এ প্রয়াসে চার ও ছয় লেন বিশিষ্ট হাইওয়ের সাথে আদিবাসীদের গ্রামে ছোট ছোট রাস্তা নির্মাণ করা জরুরি।

কিন্তু আদিবাসীদের কথা শোনার বদলে একেবারে অকারণে সিআরপিএফ এসে চারজন নিরীহ আদিবাসীকে গুলি করে মারে। ১৭ মে ২০২১-এ পুলিশের গুলিতে চার তরুণ শহিদ হন – উয়কা পান্ডু, কোবাসি ভাগা, উরসা ভীমা, মিডিয়াম মাসা এবং এক গর্ভবতী তরুণী পূনম সোমলি ও তার গর্ভস্থ সন্তান। এদের কারোর সঙ্গেই মাওবাদীদের কোনও সম্পর্ক আজ পর্যন্ত প্রমাণ হয়নি। সেই সময় পুরো বস্তার অঞ্চলে এরকম ৩২টি আন্দোলন চলছিল।

ভুয়ো সংঘর্ষ: তদন্ত কমিশনের রিপোর্টেও কোনও পদক্ষেপ হয়নি

সিলগের-এর ঘটনায় মৃত্যুর একটি ঘটনা উল্লেখ করা যেতে পারে। বিজেপি শাসনের সময় বস্তারে এমন কত অন্যায় অত্যাচার ঘটেছে তার হিসাব নেই। নারীদের উপর নৃশংস অত্যাচার ও ধর্ষণের কোনও গননাই সম্ভব নয়। শুধু দুটি হত্যাকাণ্ডের ঘটনা দেখলেই যথেষ্ট হবে, যেগুলির তদন্তে গঠিত কমিশনও এ সত্য স্বীকার করেছে যে, নিহতরা মাওবাদী ছিল না, তারা নিরপরাধ আদিবাসী গ্রামবাসীই ছিল।

২০১২ সালের ২৮ জুন রাতে বিজাপুর জেলার সারকেগুড়া গ্রামে ১৭ জন আদিবাসী গ্রামবাসীকে নিরাপত্তাবাহিনী মাওবাদী বলে গুলি করে মারে, তখনও সেখানে বিজেপিরই শাসন ছিল। সেই সময় গ্রামবাসীদের দিক থেকে কোনও গুলি চলে নি। গ্রামবাসীদের মতে নিহতরা আদৌ নকশালপন্থী ছিল না। বীজ বোনার আগে একটি স্থানীয় উৎসব ‘বীজ পন্ডুম’ উদযাপন চলছিল। এ হত্যাকাণ্ড নিয়ে তৎকালীন রাজ্য সরকার একটি এক সদস্যের তদন্ত কমিশনও গঠন করে। বিচারপতি বিজয় কুমার আগরওয়াল সে কমিশনের সভাপতি নিযুক্ত হন। প্রায় সাত বছর শুনানির পর তার রিপোর্ট মুখ্যমন্ত্রীর হাতে তুলে দেওয়া হয়। সে রিপোর্টেও বলা হয়েছে নিহতরা কেউই নকশাল নয় – নির্দোষ গ্রামীণ আদিবাসী ছিলেন। পুলিশ ও নিরাপত্তাবাহিনী কোনরকম উসকানি বা কারণ ছাড়াই তাদের মেরে দেয়।

২০১৩ সালের ১৭-১৮ মে’র রাতে বিজাপুর জেলার এডসমেটা গ্রামে একই ধরনের হত্যাকাণ্ড ঘটে। সেখানেও গ্রামবাসীরা ‘বীজ পন্ডুম’ উৎসব পালন করছিল। নকশাল দমন অভিযানে বের হওয়া নিরাপত্তা বাহিনীর সদস্যরা তাদের মাওবাদী ‘ভেবে’ গুলি চালাতে শুরু করে। এই ঘটনায় চারজন নাবালক সহ মোট আটজন নিহত হয়। এই ঘটনার তদন্তের দায়িত্বে ছিলেন মধ্যপ্রদেশ হাইকোর্টের প্রাক্তন বিচারপতি বিচারপতি ভি কে আগরওয়াল। তদন্ত রিপোর্টে বলা হয়, ‘এমন হতে পারে যে এডসমেটা গ্রামের কাছে এক জায়গায় আগুন জ্বালিয়ে তার চারপাশে জড়ো হওয়া লোকজনকে দেখে সম্ভবত ভুলবশত নিরাপত্তা বাহিনী তাদের মাওবাদী সংগঠনের সদস্য মনে করে এবং আতঙ্কিত হয়ে গুলি চালিয়ে দেয়।’ ঐ তদন্ত কমিশন এ সিদ্ধান্তে পৌঁছায় যে ‘নিহতদের সকলেই ছিলেন গ্রামবাসী এবং তাদের সঙ্গে মাওবাদীদের কোনও সম্পর্ক ছিল না।’

মনে রাখা জরুরী, এই দুটি হত্যাকাণ্ডের সময়ই ছত্তিশগড়ে বিজেপি ক্ষমতায় ছিল। তখন বিরোধী দল কংগ্রেস এই ঘটনাগুলি নিয়ে সরব হয়, রাজনৈতিক ইস্যু হিসাবে ব্যবহারও করে। কিন্তু তদন্ত কমিশনের রিপোর্ট প্রকাশিত হওয়ার সময় কংগ্রেস রাজ্যের ক্ষমতায় এসে যায়। তা স্বত্বেও ঐ সমস্ত রিপোর্টের ভিত্তিতে আজ পর্যন্ত কোনও কার্যকর পদক্ষেপ নেওয়া হয়নি। দোষীদের শাস্তি দেওয়া বা নিহত নিরপরাধদের পরিবারকে ক্ষতিপূরণ দেওয়ার মতো কোনও দিকেই সরকার নজর দেয়নি। কারণ পুরো বিষয়টিই আদানি-সংক্রান্ত ঘটনা, কংগ্রেস সরকারের মুখ্যমন্ত্রী গোটা দেশের এমনকি নিজের দলের নেতা রাহুল গান্ধীর বিরোধিতাকেও অগ্রাহ্য করেছিলেন। তিনিই হসদেওর জঙ্গল আদানিকে দিয়ে দিচ্ছিলেন।

একসময় ‘নকশালপন্থী’ এবং এখন ব্যবহৃত ‘মাওবাদী’ শব্দ আসলে একটা অজুহাত। এসবের আসল উদ্দেশ্য হল স্থানীয় আদিবাসী জনসাধারণকে ভয় দেখিয়ে, দমন করে এমন অবস্থায় নিয়ে যাওয়া যাতে তারা কোনও প্রতিবাদ না করতে পারে। আজ ‘কাগার’ শিরোনাম যুক্ত অভিযানের নাম করে এসব চলছে। এর আগে অভিযানের কোনও নাম ছাড়াই নকশালপন্থী বা মাওবাদী তকমা দিয়ে আদিবাসীদের উপর গুলিবৃষ্টি চলেছে।

এই দমননীতির বিরুদ্ধে মুখ খুলতে যাওয়া কণ্ঠকেও বর্বর কায়দায় চুপ করিয়ে দেওয়া হয়েছে। সোনি সোরির সঙ্গে ঘটে যাওয়া নৃশংস ঘটনা, গত বছর সাংবাদিক মুকেশ চন্দ্রাকরের নির্মম খুন এবং এক সৎ সাংবাদিক কমল শুক্লার উপর একের পর এক হামলা — এসবই তার জ্বলন্ত উদাহরণ।

মাওবাদ: দেউলিয়া নীতি রাজনৈতিক সুবিধাবাদের ইতিহাস

মাওবাদীদের রাজনৈতিক অবস্থান, বিচার বিবেচনার দৃষ্টিভঙ্গি ও তার নিরিখে গড়ে তোলা ওদের রণনীতি ও রণকৌশলের সঙ্গে সহমত হওয়ার কোনও প্রশ্নই ওঠে না। ওদের দেউলিয়া রাজনৈতিক বোঝাপড়া যে কতবার, কতরকম খেলা দেখিয়েছে তার ইয়ত্তা নেই। এমনকি যাদের বিরুদ্ধে ওরা সংগ্রাম করছেন বলে দাবী করে, তাদেরই হাতের পুতুল হিসাবে ব্যবহৃত হয়ে সারা দেশজুড়ে বাম ও গণতান্ত্রিক আন্দোলনকে যেভাবে ক্ষতিগ্রস্থ করেছেন তারও উদাহরণ কম নেই।

১। তৃণমূল কংগ্রেস ও বিজেপির সঙ্গে মিলে পশ্চিমবঙ্গে বুদ্ধদেব ভট্টাচার্যের নেতৃত্বে এগিয়ে চলা বামফ্রন্ট সরকারের বিরুদ্ধে তথাকথিত ‘মুক্তিযুদ্ধ’ চালিয়েছে এরাই। ঐ ‘বিপ্লব’ সমাধা হলে মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়’কে এই মাওবাদীরাই মুখ্যমন্ত্রী হিসাবে দেখতে চেয়েছিল। অবশ্য নির্বাচনে জয়ী হওয়ার পরে মমতা বন্দ্যপাধ্যায় এদের মুখ্য নেতা কিষানজীকে এনকাউন্টারের নির্দেশ দেন। 

২। ২০১৩ সালের ২৫ মে বস্তারের ঝিরম ঘাটি’তে ছত্তিশগড় রাজ্য কংগ্রেসের নেতৃত্বকেই সাফ করে দেওয়া হয় এবং সেই অবস্থার সুযোগ নিয়ে রমণ সিংহের নেতৃত্বে তৃতীয়বারের জন্য বিজেপি’র সরকার প্রতিষ্ঠিত হয়। 

৩। ২০০৩ সালে এই নারায়ণপুরেই, ছত্তিশগড় বিধানসভা নির্বাচনের সময় বিজেপি’র সঙ্গে রফা করে নির্বাচনী বুথের বাইরে মাওবাদীরা সশস্ত্র পাহারা বসায়, ঐ আসনে অল্প ব্যবধানে সিপিআই(এম) প্রার্থী সঞ্জয় পরাতে’কে পরাজিত হতে হয়। 

৪। লোকসভা নির্বাচনের সময় ছত্তিশগড়ে কখনও এদিকে কখনও ওদিকে’র হয়ে ভোট ঘুরিয়ে দেওয়ার রেকর্ড করে ফেলেছে এরা।

এসব স্বত্বেও রাজনৈতিক সমাধান খোঁজাই সঠিক পন্থা, তার বদলে সহজ রাস্তা হিসাবে এমন নরসংহার অভিযানে কোনও ফলই মেলে না। একটি ভ্রান্ত রাজনৈতিক পন্থাকে আরেকটি সঠিক রাজনীতির জোরেই আটকানো যায়।

১৯৭৭ সালে পশ্চিমবঙ্গে জ্যোতি বসুর নেতৃত্বে প্রতিষ্ঠিত প্রথম বামফ্রন্ট সরকার ঠিক সেই কাজই করে দেখিয়েছিল। বামফ্রন্ট সরকারের প্রথম সিদ্ধান্তই ছিল সমস্ত রাজনৈতিক বন্দিদের মুক্তি দেওয়া। ঐ সিদ্ধান্তে সেই সমস্ত নকাশালপন্থীরাও মুক্তি পেয়েছিলেন, যারা আগের পাঁচ বছর যাবত সিদ্ধার্থ শংকর রায়ের আধা-ফ্যাসিস্ত সন্ত্রাসের বলি ১২০০ সিপিআই(এম) কর্মীর খুনের ঘটনায় প্রত্যক্ষ বা পরোক্ষভাবে মদত দিয়েছিলেন। এর প্রায় আড়াই দশক পরে ঐ দিশাহীন রাজনীতি নকশালবাড়ি সহ গোটা পশ্চিমবঙ্গ থেকেই কার্যত উধাও হয়ে যায়। অবিভক্ত অন্ধ্রপ্রদেশেও রাজনৈতিক বন্দিদের মুক্তি দেওয়ার কাজ কিছু দূর এগোয়। নাগি রেড্ডি থেকে শুরু করে বাসব রাজুর নিজেদের এলাকাতেই ওদের রাজনীতি অকেজো হয়ে পড়ে, উবে যায়।    

মৃতদেহের প্রতি অমানবিক আচরণ ফুলকপিতে লুকিয়ে রাখা সংকেত

একমাস ধরে চলার পরে ২১ মে চূড়ান্ত পর্যায়ে পৌঁছানো ‘অপারেশন কাগার’-র লক্ষ্য ও উদ্দেশ্য কোনও রাজনৈতিক সমাধানের দিকে নির্দেশ করছে না। সংঘর্ষের পর নিহতদের মৃতদেহ ঘিরে উৎসবের ন্যায় পরিবেশ তৈরি করা এক অমানবিক মানসিকতারই বহিঃপ্রকাশ। মৃতদেহগুলিকে তাদের পরিবারের হাতে শেষকৃত্যের জন্য না দেওয়া, সেই অমানবিকতারই চূড়ান্ত সীমা। এ চিন্তাধারা কতদূর বিকৃত হতে পারে তার নিদর্শন দেখিয়েছে বিজেপির কর্ণাটক শাখা। মাওবাদীদের মৃত্যু সংবাদ প্রচারের সময় হাতে ফুলকপি ধরা অবস্থায় নকশালপন্থীদের কবরের উপর দাঁড়ানো অমিত শাহ-র একটি ব্যঙ্গচিত্র (মিম) প্রকাশ করেছে তারা। মনে রাখা দরকার, ১৯৮৯ সালে ভাগলপুর দাঙ্গায় নিহত মুসলমানদের কবর দিয়ে সেই জমির উপর ফুলকপি চাষের একটি ব্যঙ্গচিত্র (মিম) তৈরি করা হয়েছিল।

‘অপারেশন কাগার’-র সঙ্গে এমন তুলনা নিছক কোনও ব্যঙ্গচিত্র (মিম) নয়। আসলে এ হল মাওবাদীদের নিকেশ করার অজুহাতে গোটা বস্তারে আদানির মুনাফার ফসল ফলানোর এক ঘোষণা। একেই নয়া-ফ্যাসিবাদ বলে। ২০২৬ সালের এপ্রিলের মধ্যে দেশকে নকশালবাদ ও ঐ চিন্তাধারা থেকে মুক্ত করতে অমিত শাহ’র ঘোষণা বস্তারের কার্যেগুট্টা ও কালী পাহাড়েই আটকে থাকবে না। নয়া-ফ্যাসিবাদ মনে করে বিজেপি, কর্পোরেট ও তাদের মনুবাদী হিন্দুত্বকে যারাই প্রশ্ন করবে তারা সকলেই ‘আরবান নকশাল’।

এটা স্পষ্ট যে, এমন কু-উদ্দেশ্যের বিরুদ্ধে লড়ার মানসিকতা জনগণের মধ্যে তৈরি করতেই হবে বিশেষত যারা আইনানুগ শাসন, গণতন্ত্র ও সংবিধানকে রক্ষা করা প্রয়োজন বলে মনে করেন।

Spread the word

Leave a Reply