ওয়েবডেস্ক প্রতিবেদন
‘পৃথিবীর ৮৭টি দেশে কমিউনিস্ট পার্টি আছে।
এই সকল পার্টির সভ্য সংখ্যা তিন কোটি ষাট লক্ষেরও বেশি।
… এঁরা পরস্পর আন্তর্জাতিক ভ্রাতৃত্ব বন্ধনে আবদ্ধ।
আমরা প্রত্যেকে প্রত্যেকের পরম আত্মীয়। আমাদের এই ভ্রাতৃত্ব বন্ধনের নাম মজুর শ্রেণীর আন্তর্জাতিকতা। এই জাতীয় ভ্রাতৃত্ব বন্ধন কমিউনিস্টদের ভিতরে ছাড়া আর কারুর ভিতরে নেই।
এই বিপ্লবী গৌরবের অধিকারী একমাত্র কমিউনিস্টরাই।’
১৯৬৪’র শরৎকাল নাগাদ উপরের কথাগুলি লিখেছিলেন মুজফ্ফর আহ্মদ। আজও আমাদের দেশে ‘কমিউনিস্ট প্রাইড’ সম্পর্কে দক্ষিণপন্থী রাজনীতির কুৎসা’র অন্ত নেই, এমনকি এক অংশের কমরেডদের মধ্যেও এই প্রসঙ্গে জরুরী অনুভবের অভাব রয়েছে। কাকাবাবু এই সমস্যাকে উপলব্ধি করেছিলেন, মোকাবিলা করেছিলেন।
সেই সময়কার নির্দিষ্ট প্রেক্ষিত মনে রাখতে হবে। কিছুদিন আগেই সীমান্তবিরোধের অজুহাতে দেশজুড়ে উগ্র জাতীয়তাবাদের ঝড় বইয়ে দেওয়া হয়েছে। সেই ঝড়ের সুযোগে কমিউনিস্ট পার্টির নেতা-কর্মীদের জেলে ঢোকানো হয়েছে। ঐ সময়েই জ্যোতি বসু বলেছিলেন আমাদের জেলে ঢুকিয়ে বা গুলি করে মারলে যদি দেশের ভালো হয় তবে তাই হোক। ইংরেজ শাসনে নির্ধারিত সীমান্তসমস্যা আজও মেটেনি। মোদী শাসনে নতুন করে সেই পরিস্থিতির আঁচ পাওয়া গেছে। দেশের প্রধানমন্ত্রীকে নিজেদের মুখরক্ষায় বলতে হয়েছে সীমান্ত পেরিয়ে কেউ অনুপ্রবেশ করেনি। এই একটা বিষয়ে অন্তত কংগ্রেসের সাথে তার কথা মিলেছে। দেং জিয়াও পিং’র সামনে দাঁড়িয়ে রাজীব গান্ধীও এমনই কিংকর্তব্যবিমুঢ় ছিলেন।
নির্দিষ্ট রাজনৈতিক লক্ষ্যেই জনমানসে উগ্র জাতীয়তাবোধের প্রচার করা হয়। আমরা জানি ‘মানুষ যখনই চায় বস্ত্র ও খাদ্য; সীমান্তে বেজে ওঠে যুদ্ধের বাদ্য’। এই অবস্থায় প্রকাশ্যে আন্তর্জাতিক শ্রমিক সংহতির পক্ষে অবস্থান নেওয়া যে কতটা কঠিন যারা মানুষের মধ্যে রাজনীতির কাজ করেন তারা জানেন। আমাদের দেশে কমিউনিস্টদের বারে বারে এমন পরীক্ষার মুখে পড়তে হয়েছে।
আমরা কাকাবাবুর ১৩৪-তম জন্মদিবস পালন করছি। কমিউনিস্টরা জন্মদিন পালন সম্পর্কে উদাসীন থাকেন। কাকাবাবুও সেই অবস্থানে ততটাই দৃঢ় ছিলেন। তাহলেও পার্টি প্রতি বছর এই আয়োজন করে। ইতিহাস এবং সেই ইতিহাস নির্ধারিত কিছু ব্যাক্তির নির্দিষ্ট ভুমিকা’র কথা প্রচারের জন্যই এমনটা করতে হয়, এটাও পার্টিরই কাজ। আজকের প্রজন্মের জেনে রাখা উচিত মুজফ্ফর আহ্মদ বেঁচে থাকাকালীনই তাঁর জন্মদিন পালনের সিদ্ধান্ত হলে যিনি সেই সিদ্ধান্তের আগাগোড়া বিরোধিতা করেছিলেন তিনিই কাকাবাবু। এই নিয়ে বিতর্কের কেন্দ্রেও তিনি, বিতর্কের বিরোধীপক্ষেও তিনিই। শেষে তাকে নিরস্ত করতে হয় ‘পার্টি সিদ্ধান্ত নিয়েছে’ বলে। নিজের জীবনের গোটা কুড়ি বছর কারাগারে কাটানো বিপ্লবী তখন থেমে যান। ‘পার্টি সিদ্ধান্ত নিয়েছে’ বলেই।
ভারতের বুকে যারা নিজেদের অনেক ঘাম, রক্তের বিনিময়ে ঐ ‘পার্টি’ গড়ে তুলেছেন, মুজফ্ফর আহ্মদ তাদেরই একজন। নিজের অভিজ্ঞতায় বুঝেছিলেন এদেশে ‘প্রলেতারিয়েত’ এমনকি ‘শ্রমিক’ বললেও যতজন বুঝবেন ‘মজুর’ বা ‘মজদুর’ বললে উপলব্ধি করবেন তার চেয়ে অনেক বেশি জন। পার্টির সর্বক্ষণের কমরেডরা তো বটেই, সাধারণ সদস্যদেরও অনেকেই সেই যুগে হয় পুলিশের গুলিতে কিংবা অনাহারের যত্নে মারা যেতেন, সেইসব বাধা পেরোলে যক্ষ্মায়। কমরেডদের গড়ে তোলার পাশাপাশি তাদের জীবনরক্ষায় চিন্তিত কাকাবাবুরই পরিকল্পনা ছিল ‘রেড এইড কিওর হোম’ প্রতিষ্ঠার। সেই পরিকল্পনাই আরও কিছুদিন পরে পিপলস রিলিফ কমিটি’তে রূপান্তরিত হয়। আজকের ‘রেড ভলান্টিয়ার’রা মনে রাখুন কোন উত্তরাধিকার তাদের কাঁধে রয়েছে।
পার্টিতে সর্বক্ষণের কর্মী মানে ঠিক কি সেকথা বুঝতে তার জীবনকাহিনী আজও আদর্শ।
‘এখন আমাদের কমরেডরা কমিউনিস্ট পার্টির সর্বসময়ের কর্মী হন। তাঁরা শুনে আজ আশ্চর্য হবেন যে ১৯১৮ সালের শেষাশেষিতে আমি “বঙ্গীয় মুসলমান সাহিত্য সমিতি”র সবসময়ের কর্মী হয়েছিলেম। পুরো ১৯১৯ সাল এবং ১৯২০ সালের মার্চ এপ্রিল পর্যন্ত সমিতির সব-সময়ের কর্মী আমি ছিলেম। তারপরে “নবযুগ” কাগজ পরিচালনা করার সময় আমি সর্বসময়ের কর্মীর মতোই কাজ করেছি, যদিও কোনো রাজনীতিক পার্টি সভ্য আমি তখন ছিলেমনা। ১৯১৮ সালের শেষাশেষিতে আমার যে সবসময়ের কর্মীর জীবন আরম্ভ হয়েছিল সেই জীবন আমার আজও অর্থাৎ ১৯৬৭ সালে এই কয়েক ছত্র লেখার সময়ও, চলেছে।
আমার জীবনের পেশা কি হবে, সাহিত্য না রাজনীতি এই নিয়ে আমি পুরো ১৯১৯ সাল ভেবেছি। সত্য কথা বলতে, আমার মনের ভিতরে সাহিত্য ও রাজনীতির দ্বন্দ্ব চলছিল। কবি আমি ছিলেম না। গল্প লেখক বা উপন্যাসিক হওয়ার স্বপ্ন আমি কোনদিন দেখিনি। সেই ভাষা কোনদিন আমার আয়ত্তে ছিলনা। আমার প্রবল বাসনা ছিল যে আমি একজন প্রবন্ধকার হব। আমার পরবর্তী জীবনেও, অর্থাৎ রাজনৈতিক জীবনে তা হবার পথে কোন প্রতিবন্ধক ছিল বলে আমার মনে হয় না। তবু আমি প্রবন্ধকারও হতে পারিনি, যদিও আমি খবরের কাগজ চালিয়েছি।
আমার মনে যে সাহিত্য ও রাজনীতির দ্বন্দ্ব চলছিল তাতে শেষ পর্যন্ত জয় হল রাজনীতির। একটা কিছুতেই যে নিজেকে বিলিয়ে দেব সে তো আগেই স্থির করেছিলেম। সেই জন্যই তো আমি” বঙ্গীয় মুসলমান সাহিত্য সমিতি”র সবসময়ের কর্মী হতে পেরেছিলেম। ১৯২০ সালের শুরুতে আমি স্থির করে ফেললাম যে রাজনীতি হবে আমার জীবনের পেশা। আমি রাজনৈতিক সভা সমিতি ও মিছিলে যোগ দেওয়া শুরু করেছিলেম ১৯১৬ সাল হতে।’
আমার জীবন ও ভারতের কমিউনিস্ট পার্টি, পৃষ্ঠা ৩৯: এনবিএ ত্রয়োদশ মুদ্রণ।
কাজী নজরুল ইসলামের সাথে একযোগে পত্রিকা সম্পাদনা করেছেন। নজুরুলের স্মৃতিতে তার লেখাটি সাহিত্যের দুনিয়ায় অমুল্য সম্পদ। ব্রিটিশ পুলিশ গোয়েন্দাদের লুকিয়ে বিদেশ থেকে ‘কমিউনিস্ট সাহিত্য’ আনিয়ে নিজে পড়েছেন, অন্য কমরেডদের পড়িয়েছেন। আত্মগোপন থাকার সময় কমিউনিস্ট কর্মীদের আচরণ কেমন হতে হবে বারে বারে সেইসব হাতে-কলমে শিখিয়ে গেছেন। জেলে কমিউনিস্ট কর্মীদের ‘রাজনৈতিক বন্দী’র মর্যাদা দিতে শাসককে বাধ্য করেছেন। অন্য সেলে থাকা কমরেডদের জন্য জরুরী কিছু সামগ্রী, এমনকি বিড়ি’র বন্দোবস্ত অবধি করেছেন, সেই সব হাতে পেয়ে কমরেডরা জানতে পেরেছেন কাকাবাবুও ঐ জেলেই রয়েছেন।
পার্টির পত্র-পত্রিকা ছাপার ব্যবস্থা করেছেন। বঙ্গীয় মুসলমান সাহিত্য সমিতিতে কাজ করতে গিয়ে ছাপাখানার কাজ শিখেছিলেন নিজের উদ্যোগে। সেই অভিজ্ঞতাই ‘ন্যাশনাল বুক এজেন্সি’ প্রতিষ্ঠায় কাজে লাগে। তারই একনিষ্ঠ মনোভাবে গড়ে উঠেছে গনশক্তি প্রেস। ছাপাখানার কাজে যুক্ত কমরেডরা ছাড়াও যারা নিয়মিত পার্টির কাজে প্রবন্ধ, প্রতিবেদন লেখেন তাদের সুবিধার্থে গনশক্তির ডায়েরির প্রথম পাতায় প্রুফ সংশোধনের নিয়মাবলী ছাপানোর বন্দোবস্ত করেছিলেন। আজও সেই পাতাটি ডায়েরিতে ছাপা হয়। বিভিন্ন কমরেডদের জন্য নির্দিষ্ট দায়িত্ব বণ্টনের বিষয়ে অসাধারণ দক্ষতা ছিল। যেকোনো সমস্যার সমাধানে ধৈর্য ধরে অনেকক্ষণ শুনতেন বক্তাদের না থামিয়েই, পৌঁছে যেতেন সমস্যার গোড়ায়- সহজেই সমাধান নির্ধারিত হত। পার্টির কাজে আজও এই পদ্ধতি মনে রাখতে হয়।
দীর্ঘ অভিজ্ঞতায় বুঝেছিলেন এদেশের জনমানসে জাঁকিয়ে রয়েছে সামন্তবাদী-পশ্চাৎপদ চিন্তাভাবনা। তাই মেধাশক্তির ঝনঝনার চাইতে শ্রমিক-কৃষকদের মধ্যে পড়ে থেকে কাজকে বেশি গুরুত্ব দিতেন। নতুন কমরেডরা তার কাছে কাজ বুঝে নিতে এলে নির্দেশ দিতেন শ্রমিক অথবা কৃষক ফ্রন্ট কোনও একটি বেছে নিতে। ফ্রন্ট নির্ধারিত হলে তাদের চলে যেতে হত গরীব মানুষের কাছে, শ্রমজীবীদের পাশে থেকেই কাজ শিখতে হত, কাজ করতে হত। কমিউনিস্ট পার্টিতে বিভিন্ন কারনে মানুষ যুক্ত হন। তাদের সকলের চিন্তাভাবনা, পরিকল্পনা এক থাকে না অথচ অভিন্ন একটি লক্ষ্যে কাজ করতে হয়। এমন অবস্থায় একদিকে সংগঠনের পরিসর বৃদ্ধি আরেকদিকে উপযুক্ত কমরেড গড়ে তোলার নেতৃত্বের বাড়তি দায়িত্ব পালন করতে হয়। এই কাজে মুজফ্ফর আহ্মদের নিজস্ব পদ্ধতি ছিল।
ডঃ ভুপেন্দ্রনাথ দত্ত চিঠি লিখে জানিয়েছিলেন ‘আপনার কাছে দুটি হীরার টুকরো পাঠালাম’। সেই চিঠি সমেত কলকাতায় আবদুল হালিমের কাছে যাতায়াত শুরু করল ততদিনে পুলিশের খাতায় ‘সন্ত্রাসবাদী’ বলে চিহ্নিত দুই যুবক। কথা বলার মাঝেই তারা দুজনেই খেয়াল করলেন বারান্দার চেয়ারে কোট প্যান্ট পরে আরেকজন বসে থাকতেন। তিনি কথা বলতেন খুবই কম, চুপচাপ আলোচনা শুনতেন – তার দিকে দুই বন্ধুর চোখ যেত, সেই মানুষটি দুই চোখ দিয়ে সামনে বসা মানুষের ভিতর অবধি চিনে নেওয়ার দৃষ্টিশক্তি অর্জন করেছিলেন। হালিম সাহেবের কাছে বসেই দুই বন্ধু জানলেন, চিনলেন পৃথিবী বিখ্যাত ‘মিরাট ষড়যন্ত্র মামলা’য় অভিযুক্ত বিপ্লবীদের অন্যতম ব্যক্তিটিকে, মুজফফ্র আহ্মদ। চুপচাপ থেকেও কাকাবাবু সঠিকভাবেই চিনেছিলেন আগামী দিনে পার্টির দুই নেতৃত্ব, সরোজ মুখোপাধ্যায় এবং বিনয় চৌধুরীকে।
মিরাট ষড়যন্ত্র মামলা। একটি মাত্র তথ্যেই সকলে বুঝবেন এর ঐতিহাসিক গুরুত্ব। ব্রিটিশ আদালত মিরাট মামলায় অভিযুক্তদের আলাদা আলাদা করে যতদিনের কারাদণ্ডের শাস্তি দিয়েছিল সেইসব যোগ করলে হয় ৪১৪ বছর। ১৯২৩-২৪ সালে নর্থ-ইস্ট ফ্রন্টিয়ার এলাকায় পেশোয়ার কমিউনিস্ট ষড়যন্ত্র মামলা এবং ১৯২৪ সালে কানপুর কমিউনিস্ট ষড়যন্ত্র মামলা দায়ের হয়। ১৯২৮ সালের ডিসেম্বর মাসের শেষ সপ্তাহে কলকাতায় সারা দেশে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা অনেকগুলি গোষ্ঠী একত্রে ওয়ার্কার্স অ্যান্ড পিজ্যান্টস পার্টি গড়ে তোলে। অল ইন্ডিয়া ট্রেড ইউনিয়ন কংগ্রেসেও তখন কমিউনিস্টদের প্রভাব অনেকটাই বেড়েছে। আসন্ন কমিউনিস্ট বিপ্লবের ভয়ে ব্রিটিশ সরকার প্রমাদ গুনেছিল। এই বিপদ থেকে মুক্তি পেতেই তারা ১৯২৯ সালে মিরাট ষড়যন্ত্র মামলা দায়ের করেছিল। ভারতে কমিউনিস্ট আন্দোলনকে ধ্বংস করতে চেয়েই এই মামলা হয়েছিল, কিন্তু ফল হয় একশো আশি ডিগ্রি বিপরীত। এই মামলায় অভিযুক্ত কমিউনিস্ট নেতৃত্ব আদালতের কাঠগড়াকেই পার্টির কাজের প্রচার এবং প্রসারের মঞ্চ হিসাবে ব্যবহার করেন। তারা সিদ্ধান্ত নেন পার্টির পক্ষে কেউ নিজের বক্তব্য আলাদা করে না জানিয়ে সম্মিলিত একটি সাধারণ বক্তব্য তুলে ধরা হবে। সেই বক্তব্যই হবে আদালতের সামনে তাদের জবাব, দেশবাসীর সামনে তাদের কর্মসূচী। গোটা দেশে কমিউনিস্টদের খবর ছড়িয়ে পড়ে। ব্রিটিশ ভারতে কমিউনিস্ট পার্টির প্রচারের কাজ, বিস্তারের কাজ সরকারী বিধিনিষেধের কারনেই বাধাপ্রাপ্ত হচ্ছিল, ক্ষতিগ্রস্থ হচ্ছিল – সরকারী প্রাঙ্গণকে সেই উদ্দেশ্যেই অসাধারণভাবে ব্যবহার করলেন কমিউনিস্ট বিপ্লবীরা। ফ্যাসিস্ত বাহিনীর হাতে বন্দী হয়ে একই কায়দায় জর্জি দিমিত্রভ নিজের বক্তব্য প্রচার করেছিলেন। বিচারাধীন বন্দী হিসাবে আদালতে দাঁড়িয়ে কিউবা বিপ্লবের নেতা ফিদেল কাস্ত্রোও লড়াইয়ের একই পদ্ধতি ব্যবহার করেছেন।
মিরাট ষড়যন্ত্র মামলা চলাকালীন কমিউনিস্ট বিপ্লবীরা আদালতের সামনে যে সাধারণ বক্তব্য তুলে ধরেছিলেন তাকেই “Communists Challange Impearialism From The Dock” শিরোনামে ইংরেজিতে বই প্রকাশ করে ন্যাশনাল বুক এজেন্সি। এলাহাবাদ হাইকোর্টের বিচারপতি ডঃ স্যার শাহ সুলেইমান এবং বিচারপতি জে ইয়ং’র রায়ের ভিত্তিতে ১৯৩৩ সালের ৩রা অগাস্ট ভারতের প্রধান বিচারপতি মিরাট ষড়যন্ত্র মামলার রায় ঘোষণা করেন। সেই রায়ে মুজফ্ফর আহ্মদকে যাবজ্জীবন দ্বীপান্তরের শাস্তি ঘোষণা করা হয়। এস এ ডাঙ্গে, ফিলিপ স্প্রাট, এস ভি ঘাটে, কে এন যোগলেকর এবং আর এস নিম্বকরের ১২ বছরের জন্য দ্বীপান্তরের শাস্তি হয়। বি এফ ব্রাডলে, এস এস মিরজকর, শওকত উসমানীর ১০ বছরের জন্য দ্বীপান্তর, মির আবদুল মজিদ, সোহন সিংহ যশ, ধরনীকান্ত গোস্বামীর ৭ বছরের জন্য দ্বীপান্তর, অযোধ্যা প্রসাদ, গঙ্গাধর অধিকারী, পূরণ চাঁদ যোশী এবং এম জি দেশাইয়ের ৫ বছর দ্বীপান্তর ঘোষিত হয়। গোপেন্দ্র চক্রবর্তী, গোপাল চন্দ্র বসাক, এইচ এল হাচিনসন, রাধারমণ মিত্র, এস এইচ ঝাবওয়ালা এবং কেদারনাথ সেহ্গলকে ৪ বছরের জন্য সশ্রম কারাদন্ড দেওয়া হয়। শামসুল হুদা, এ এ আল্ভে, জি আর কাসলে, গৌরি শংকর এবং লক্ষণরাও কদমকে ৩ বছরের জন্য সশ্রম কারাদন্ডের আদেশ দেওয়া হয়।
১৯৬৬ সালের ১২ই ডিসেম্বর বইটির মুখবন্ধে মুজফ্ফর আহ্মদ লিখছেন ‘এই মামলার পরে ৩৫ বছর কেটে গিয়েছে। আদালতে দাঁড়িয়ে কমিউনিস্টদের সেইদিনের বক্তব্য আজ বইয়ের চেহারায় পড়া যায়। ভারতীয়রা তো বটেই, পৃথিবীর অন্যান্য দেশের মানুষজনও বইটি আগ্রহের সাথে পড়বেন বলেই আমার একান্ত বিশ্বাস। ভারতে আজকের প্রজন্মের কমিউনিস্টদের জন্য বইটি একটি প্রয়োজনীয় দলীল যা অধ্যয়ন করলে তারা বুঝবেন ৩৫ বছর আগে মিরাটে জেলে বন্দী থাকাকালীন কমিউনিস্টরা কি করেছিলেন, কি ভেবেছিলেন।’
কমরেড সরোজ মুখোপাধ্যায় কাকাবাবুর জন্মশতবর্ষে স্মৃতিচারণা করতে গিয়ে লিখেছেন ‘বঙ্গোপসাগরের একটি দ্বীপ সন্দ্বীপ (অধুনা বাংলাদেশ) শহরে জন্মগ্রহণ করেছিলেন ১৮৮৯ সালের ৫ই আগস্ট। তার পিতা আইন ব্যবসায়ী মনসুর আলী। মার নাম চুনা বিবি। সন্দীপ কার্গিল হাইস্কুলে তিনি ভর্তি হন। ষোল বছর বয়সের সময় তার বাবা মারা যান। আবার তিনি কার্গিল হাই স্কুলে ভর্তি হন নিচের ক্লাসে। তার ইংরেজি ভাষা শেখার খুব ঝোঁক হয়। নোয়াখালী জেলা স্কুলে পড়ার সময় কলকাতায় আসেন।
হুগলি মহসিন কলেজ ও পরে বঙ্গবাসী কলেজে আই এ পড়তে পড়তে চাকরিতে প্রবেশ করেন কমরেড মুজফফর আহমদ। রাইটার্স বিল্ডিং-এর ছাপাখানা ও পরে হোম ডিপার্টমেন্টের অধীন বাংলা তর্জমা অফিসে কাজ করতে থাকেন। ১৯১৮ সাল পর্যন্ত কোন না কোন লোকের বাড়িতে গৃহশিক্ষকের কাজও তিনি করেছেন। কলকাতার মুনশী আলিমুদ্দিনের চাঁদনীর বাড়িতে তিনি তিন বছর ছিলেন। বিখ্যাত মুনশী আলিমুদ্দিনের নামেই আলিমুদ্দিন স্ট্রিটের নামকরণ হয়েছে। মার্কসবাদী কমিউনিস্ট পার্টির রাজ্য দপ্তর বর্তমানে এই রাস্তার উপরেই অবস্থিত। এই সময়েই তিনি বঙ্গীয় মুসলমান সাহিত্য সমিতির সহকারি সম্পাদক হয়ে সব সময়ের কর্মী ছিলেন। ১৯১৬ সাল থেকেই তিনি বিভিন্ন রাজনৈতিক মিছিল ও সভা-সমিতিতে যোগ দিতেন। মৃত্যুর দিন পর্যন্ত অর্থাৎ ১৯৭৩ সালের ১৮ই ডিসেম্বর পর্যন্ত তিনি পার্টির সব সময়ের কর্মী ছিলেন।’
দেশের স্বাধীনতা অর্জনের আগে গোপনে কমিউনিস্ট পার্টির কাজ করার সময়কার কথা। এদেশে কমিউনিস্ট পার্টি’কে স্বাধীনতার আগে-পরে নিষিদ্ধ করা হয়েছে। নিজের জীবনকালে এমন অবস্থায় প্রতিবার পার্টি গঠনে ঝাঁপিয়েছিলেন মুজফ্ফর আহ্মদ। নানা জায়গায় বিভিন্ন সময়ে পুরানো দিনের পার্টি সম্পর্কে আলাপ, আলোচনায় এই প্রবন্ধের লেখক নিজের কানে সেইসব কাহিনী শুনেছে। যাদের থেকে শুনেছে তারা পার্টি সম্পর্কে মিথ্যা বলতে শেখেন নি। এরকম দুটি গল্পেই এই লেখা শেষ হোক।
‘রাতের দিককার শহরতলী এলাকা। সতর্ক দু’জন রাস্তার আলো কিছুটা এড়িয়ে এগিয়ে চলেছেন। পিছনে পুলিশ লেগেছে, জানেন দুজনেই। এত রাতে তারা একজনের বাড়িতে গিয়ে উঠবেন, রাতটুকু সেই বাড়িতেই কাটাতে হবে। পরের দিন তারা চলে যাবেন আরেকটি জায়গায় – মিটিং আছে। কিছুটা এগিয়ে মোড়ের মাথায় একটি পানের দোকান দেখে দাঁড়িয়ে গেলেন একজন, তার বয়স সাথী কমরেডের থেকে কিছুটা বেশি। দোকান থেকে দুটি পান কিনে তার একটি মুখে দিতে নির্দেশ দিলেন সঙ্গীটিকে। সকাল থেকে কিছুই প্রায় খাওয়া হয় নি, এমন অবস্থায় পান চিবোনোর কথায় কিছুটা আশ্চর্য হলেও পার্টির নির্দেশ ছিল ওনার কথা মতো চলতে। নির্দিষ্ট ঠিকানায় পৌঁছে দরজায় ‘নক’ করা হল পূর্বনির্ধারিত কায়দায়। বাড়ির মালিকটি দরজা খুলে তাদের দেখেই চিনলেন, আপনারা আসবেন বলেই বসে আছি- এদিকে রান্না করা খাবার শেষ! খুবই দুশ্চিন্তায় ছিলাম সেই নিয়ে! যাক, আপনারা খেয়েই এসেছেন তাহলে! বয়সে ছোট কমরেডটি এইবার বুঝলেন কেন কাকাবাবু খালি পেটেও মুখে পান দিতে বলেছিলেন। তারা পুলিশের চোখে ধুলো দিয়ে পার্টির কাজে একজনের বাড়িতে রাতে আশ্রয় নিতে চলেছেন, উপযুক্ত সার্ভিসের সুযোগ রয়েছে এমন কোন হোটেলে উঠছেন না।’
দ্বিতীয়টি কমরেড মুজফ্ফর আহ্মদের লেখা থেকেই সংগ্রহ করা যায়। কমিউনিস্ট পার্টির কাজে কমরেডদের সামনে এমন কিছু নির্দিষ্ট মুহূর্ত আসে যখন ঐতিহাসিক দায়িত্ব পালন করতে হয়। আমাদের দেশে দু’বার পার্টি ভেঙেছে, প্রথমবার সেই লড়াই ছিল সময়োপযোগী করার নামে কমিউনিস্ট পার্টিকে জাতীয়তাবাদী রাজনীতির লেজুড়ে পরিণত করার বিরুদ্ধে সংগ্রাম। পরেরবার জনগণের শক্তিতে আস্থা হারিয়ে নিজেরাই বিদ্রোহে ফেটে পড়ার সংকীর্ণতায় পা জড়িয়ে ফেলেন কিছুজন। কমিউনিস্ট পার্টির কাজে এমন ঘটনা নতুন কিছু না। লেনিনকেও একই সমস্যার সমাধান করেই এগোতে হয়েছিল, মাও সে তুং কেও। সমস্যা হল এধরণের পরিস্থিতিতে অনেকেই ব্যক্তিগত সম্পর্ককে পার্টির স্বার্থের উর্ধে স্থান দিয়ে বসেন। সামনে যেই থাকুক, ভুল রাজনীতিকে উপযুক্ত পথেই বিরোধিতা করতে হবে- এই কাজ কঠিন। সেই রাজনৈতিক-সাংগঠনিক অবশ্যকর্তব্যকেই পুনঃস্মরণ করিয়ে দিতে কলম ধরেন তিনি। এমনই একটি লেখায় তার স্পষ্ট বক্তব্য ছিল যারা ভুলপথে এগোচ্ছেন তাদের মধ্যে আমাদের কোনও বন্ধুও থাকতে পারে, মনে রাখতে হবে এমন বন্ধুত্বের চাইতে পার্টির আদর্শ বড়। মতাদর্শনিষ্ঠার এই অনুশীলন আজও প্রাসঙ্গিক।
ওয়েবডেস্কের পক্ষেঃ সৌভিক ঘোষ