ওয়েবডেস্ক প্রতিবেদন
কেরালার কান্নুরে সিপিআই(এম)-র ২৩ তম পার্টি কংগ্রেসের আয়োজন করা হয়েছে। সারা ভারতের সাধারণ প্রেক্ষিত ও রাজ্যগুলির নিজস্ব বৈশিষ্ট্য ও পর্যালোচনা করে আগামী দিনের রণকৌশল স্থির হবে এই পার্টি কংগ্রেসে। সারাদেশের মেহনতী জনগণ, গণতন্ত্রপ্রিয় মানুষজনের প্রত্যাশা রয়েছে বামেদের কাছে। সংগঠন ও রাজনীতির নির্দিষ্ট পরিষদের পাশাপাশি সেই প্রত্যাশামতো উন্নীতও হতে হয় বামপন্থীদের।
সম্মেলনের অধিবেশনের মাঝেই কেরালার দেশাভিমানী পত্রিকার তরফের পার্টির পলিটব্যুরোর সদস্য ও পশ্চিমবঙ্গ রাজ্য কমিটির সম্পাদক মহম্মদ সেলিমের সাক্ষাৎকার নেওয়া হয়েছে। পত্রিকার ইউটিউব চ্যানেলে সেই কথোপকথনের ভিডিওটি আপলোড করা হয়েছে। সাক্ষাৎকারের সংক্ষিপ্ত বঙ্গানুবাদ রাজ্য ওয়েবডেস্কের পক্ষে প্রকাশ করা হলো।
পশ্চিমবঙ্গে আন্দোলন-সংগ্রামের পরিপ্রেক্ষিত
ক্ষমতার বিরুদ্ধে মানুষের লড়াই আসলে বিস্মৃতির বিরুদ্ধে স্মৃতির সংগ্রাম ( দ্য স্ট্রাগল অফ ম্যান এগেইনস্ট পাওয়ার ইজ দ্য স্ট্রাগল অফ মেমোরি এগেইনস্ট ফর্গেটিং) মিলন কুন্দেরা উল্লেখ করেছেন।
দক্ষিণপন্থী মিডিয়া পশ্চিমবাংলায় বামপন্থীদের ঐতিহ্য ও পরম্পরাকে মানুষের চেতনা থেকে মুছে দিতে আগ্রাসী কৌশল নিয়েছে। তাদের সেই চক্রান্ত সফল হবে না।
মিডিয়া ও মেমোরি
কলকাতায় দক্ষিণপন্থী গণমাধ্যমগুলির নির্দিষ্ট ভূমিকা ব্যাখ্যা করতে গেলে বলতে হয় তারা নির্বোধের মতো এবং উদ্দেশ্যপ্রণোদিত প্রচার চালাচ্ছে। আসলে তারা নাগপুরের নির্দেশ অনুসরণ করে চলেছে। সেই নির্দেশ আরএসএস’র পরিকল্পনা। ২০২১ র বিধানসভা নির্বাচনের আগে সেই পরিকল্পনা মতোই তৃণমূল বিজেপির বাইনারির প্রচার চলেছিল। এন ও প্রচারের উদ্দেশ্য ছিল মানুষকে বিশ্বাস করতে বাধ্য করা যে বামপন্থীদের আর অস্তিত্ব নেই।
সারাদেশের মতো পশ্চিমবঙ্গ গনমাধ্যমের বড় অংশই দক্ষিণপন্থীদের নিজস্ব প্রচারযন্ত্র হিসাবেই কাজ করছে। নাগপুর থেকে আরএসএস এর নির্দেশ মতোই তারা এখনো পশ্চিমবঙ্গের রাজনৈতিক পরিমণ্ডলকে তৃণমূল – বিজেপির প্রতিদ্বন্দিতা হিসেবে তুলে ধরতে চাইছে। এই কৌশলী প্রচার অত্যন্ত জোরের সাথেই চলছে।
পশ্চিমবঙ্গের সংস্কৃতিতে বামপন্থার ঐতিহ্য
আমাদের রাজ্যে সামাজিকতার অপরিহার্য অংশ হলো বামপন্থা। এই রাজ্যে বামেদের আন্দোলন-সংগ্রামের দীর্ঘ ইতিহাস যেমন রয়েছে তেমনি সামাজিক সাংস্কৃতিক চেতনার গভীরে প্রোথিত হয়ে গেছে বামপন্থী মনন।
এই পরিবেশে বামপন্থীদের ঐতিহ্য এবং অস্তিত্ব নিশ্চিহ্ন করার সুনির্দিষ্ট লক্ষ্যেই তৃণমূল কংগ্রেসের প্রতিষ্ঠা করা হয়। সেইসব আন্দোলন-সংগ্রামের ঐতিহ্যকে রক্ষা করাই সিপিআই(এম)র জন্য সবচাইতে বড় চ্যালেঞ্জ। সারা পৃথিবীতেই দক্ষিণপন্থার আক্রমণের মুখোমুখি দাঁড়িয়ে আন্দোলন-সংগ্রামের ঐতিহ্য রক্ষা করা বামপন্থীদের জন্য অন্যতম কর্তব্য। মনে রাখতেই হবে দক্ষিণপন্থী রাজনীতি সর্বদা মানুষের স্মৃতিকে দুর্বল করে দিতে চায় – তাকে রিক্ত করতে চায়। ঠিক যেমন স্মার্ট ফোন থেকে মেমোরি মুছে ফেলা যায়।
রাজ্য রাজনীতির প্রেক্ষাপট থেকে বামপন্থীদের যোগসুত্র ছিন্ন করতে এক শক্তিশালী উদ্যোগ সংগঠিত হয়েছে। সিপিআইএমের কর্মীদের উপরে তৃণমূলী গুন্ডাদের প্রাণঘাতী হামলায় যে ষড়যন্ত্রের শুরু – প্রকৃত ঘটনা প্রকাশ্যে না এনে সম্পূর্ণ নিশ্চুপ থাকা মিডিয়ার ভূমিকাতে সেই চক্রান্তের বৃত্ত শেষ হয়।
বিপর্যয়কর নির্বাচনী ফলাফলের রেশ কাটিয়ে উঠে আমাদের পার্টি সাহসের সাথে যাবতীয় আক্রমণ প্রতিরোধ করেছে, বহুমাত্রিক দক্ষিণপন্থী আক্রমণের মুখোমুখি নিজেদের ঐতিহ্যকে সুরক্ষিত রাখতে সফল হয়েছে। রাজ্যে এখন আমরাই প্রধান বিরোধী দল। পশ্চিমবঙ্গের স্বার্থ সুরক্ষিত রাখা ও ভবিষ্যৎ নির্মাণ করাই আমাদের লক্ষ্য।
বাম্পন্থাই প্রকৃত বিকল্প, রাজ্যের মানুষ সেই বিকল্পের প্রত্যাশায় বুক বাঁধছেন।
তৃণমূল-বিজেপি বাইনারির স্বরূপ উন্মোচিত
একথা দুঃখজনক হলেও সত্যি যে রাজনীতির পরিষদ ছাপিয়ে সমাজেও আরএসএসের পরিকল্পনামতো বাইনারি ধারণা কিছুটা কার্যকর হয়েছে। সাম্প্রদায়িক মেরুকরণ ও এনআরসির আতঙ্কে সংখ্যালঘু মানুষ নিজেদের সুরক্ষিত মনে করছেন না। এই পরিস্থিতি মমতাকে বিশেষ সুবিধা পাইয়ে দিয়েছে। যদিও ধীরে ধীরে সেই পরিস্থিতির উন্নতি হচ্ছে, সম্প্রতি রাজ্যে সংখ্যালঘু মানুষের উপরে আক্রমণ ও হামলার ঘটনায় মানুষের বিভ্রান্তি কাটছে।
পুলিশের হাতে নিহত এনআরসি বিরোধী আন্দোলনের সক্রিয় কর্মী আনিস খানের ঘটনা অথবা বীরভূমে শিশুসহ মুসলমান মহিলাদের উপরে জঘন্য আক্রমণের ঘটনা সবক্ষেত্রেই তৃণমূল কংগ্রেস সংশ্লিষ্ট ঘটনায় অপরাধীদের আড়াল করতে সঠিক তদন্ত হতে বাধা দিচ্ছে – মানুষের কাছে একথা স্পষ্ট হয়ে গেছে। স্বাভাবিকভাবেই এই সকল ঘটনায় জনরোষ উত্তরোত্তর বাড়ছে।
নিরবিচ্ছিন্ন আন্দোলন সংগ্রাম গড়ে তুলেই আমরা তৃণমূল বিজেপির বাইনারি র ধারণাকে ভেঙে দিতে পেরেছি। মানুষ বুঝেছেন মমতা বন্দোপাধ্যায় মুসলমানদের পরিত্রাতা নন।
বিরোধী দল হিসেবে বিজেপির মুখোশধারী রাজনীতি
বিধানসভা নির্বাচনের এক বছরের মধ্যেই সিপিআইএম পশ্চিমবঙ্গের প্রধান বিরোধী দলে পরিণত হয়েছে। সম্প্রতি কর্পোরেশন নির্বাচনে তৃণমূলের সন্ত্রাস, রিগিং ও হামলার প্রতিরোধে উল্লেখযোগ্য সাহসিকতার পরিচয় দিয়েছে।
যেসকল বুথ / ওয়ার্ডে সিপিআইএম শক্তিশালী সেই সব জায়গাতেই তৃণমূল আক্রমণ ও হামলা চালিয়ে মানুষকে ভোট দিতে বাধা দিয়েছে। যদিও আক্রমণের মোকাবিলা করেই নির্বাচনের ফলে ভোট শতাংশের ভিত্তিতে আমরা প্রধান বিরোধী দল হিসেবে নিজেদের প্রতিষ্ঠিত করতে পেরেছি।
পশ্চিমবঙ্গে বিজেপির বিরোধী দল হিসেবে মুখোশ খসে পড়েছে। মিডিয়া, গুন্ডামি এবং টাকাপয়সা ছড়িয়েই তারা বিধানসভা নির্বাচনে কিছু আসনে জয়ী হয়েছিল। পশ্চিমবঙ্গে বিজেপি কারা? বেশিরভাগই তো তৃণমূল ছেড়ে আসা লোকজন। এদের অনেকেই নির্বাচন নিয়ে যেতেই নিজেদের পুরনো দলে ফিরেছেন। ব্যাপক অর্থবলের কারণে বিজেপির বিরুদ্ধে আমাদের লড়াই কঠিন হলেও সেই লড়াই জিততে আমরাও ক্রমাগত নতুন পথের সন্ধানে সক্রিয় রয়েছি।
* সম্পূর্ণ সাক্ষাতকারের ভিডিওটি দেখতে নিচের লিঙ্কটি ব্যবহার করুন
দেশাভিমানি পত্রিকার সাথে রাজ্য সম্পাদক মহম্মদ সেলিমের কথোপকথন