সৌভিক ঘোষ
‘হাতো কি লকিরোঁ পে মত জা অ্যায় গালিব
নসিব উনকে ভি হোতে হ্যাঁয়
জিনকে হাত নেহি হোতে‘
সর্বকালের অন্যতম শ্রেষ্ঠ উর্দু কবি মির্জা গালিবের ন্যায় নিয়তিবাদী ভারতীয় উপমহাদেশে আরেকজন মহান ব্যাক্তিত্ব ছিলেন যদিও কিছুটা ভিন্ন ঐতিহাসিক পর্বে হলেও রাজনৈতিক কর্তব্য সমাধানের নিরিখে মির্জার তুলনায় অনেক বেশি বাস্তববাদী ছিলেন – সেই মানুষ মোহনদাস করমচাঁদ গান্ধী। আমরা যাকে আজও মহাত্মা বলেই চিহ্নিত করে চলেছি। নিজস্ব চিন্তনের ভগবৎমার্গের তুলনায় গান্ধী থেকে ধীরে ধীরে মহাত্মা হয়ে উঠতে অনেক বেশি কার্যকরী ভূমিকা পালন করেছিল ব্রিটিশ শাসনে নিপীড়িত, অত্যাচারিত – দুর্দশাগ্রস্থ নিরক্ষর, গরীব ভারতবাসীদের জাতীয় রাজনীতিতে প্রাসঙ্গিক করে তুলতে গান্ধীর রাজনৈতিক কর্মকাণ্ড। কিন্তু গান্ধী নিজের সেই ভূমিকাকে কখনও বেশি গুরুত্ব দেন নি, বরং বারে বারে ঈশ্বরের ইচ্ছানুযায়ীই যে তিনি সবকিছু করছেন এমন মন্তব্য করেছেন। গান্ধীর জীবনের সবচেয়ে বড় দ্বন্দ্ব সেখানেই – আবার একইসাথে মহাত্মার জীবনের সবচাইতে বড় সাফল্যও একই কারনে। সামাজিক মানুষ একে অন্যের উপরে চরম অত্যাচার করছে, লুঠ করছে – গান্ধীর কাছে এসব কোনদিনই রাজনৈতিক সমস্যা ছিলই না। তিনি একে নৈতিকতার অধঃপতন হিসাবেই দেখতে চেয়েছেন, আধুনিক সভ্যতার কুপ্রভাব বলেই মনে করেছেন – সেই অনুযায়ীই সমাধানের রাস্তা খুঁজেছেন। আর তাই যতবার একজন মহাত্মা হিসাবে সামাজিক অন্যায়সমূহের বিরুদ্ধে মানুষকে একজোট করতে চেয়েছেন, এদেশের মানুষ কিছুমাত্র সন্দেহ না করে তার সাথে পা মিলিয়েছেন, কিন্তু নিজস্ব ধারণা অনুযায়ী যখনই এইসব অন্যায়ের গোড়ায় সনাতন আদর্শের মানবচরিতকে লক্ষ্যবস্তু করে তুলেছেন, চেয়েছেন আত্মশুদ্ধির দ্বারা নিজেদের হৃদয়কে নিষ্কলুষ করে সব মানুষ এক হয়ে যাক; প্রতিবারই লড়াইতে গান্ধী একলা হয়ে পড়েছেন, হেরে গেছেন। দেশের মানুষ মহাত্মাকে জিতিয়েছেন – গান্ধীকে পরাজিত করেছেন। বস্তুবাদের আলোকে তাই গান্ধী এমনই এক দ্বন্দ্বজর্জর ঐতিহাসিক চরিত্র – মহাত্মা হয়ে ওঠার পরে পরাজিত হওয়া ছাড়া যার আর কোন সুযোগ ছিল না। সেই গল্প এই লেখার বিষয়বস্তু নয়। আমরা গান্ধীকে দেখতে চেয়েছি পরখ করে নিতে তার নিজস্বতায় ভর করেই। গোটা জীবনটা যে মানুষটি ঈশ্বরের ইচ্ছাই সত্য, ধর্মকেই প্রকৃত কর্ম বলে প্রতিষ্ঠা করতে চাইলেন তাকে খুন হতে হল ঈশ্বরেরই নামে, ধর্মেরই নামে –গান্ধীকে খুন করতে গুলি চালালেন যিনি তার নামেও ‘রাম’। এহেন জীবনের শেষ কয়েকটা দিন আমাদের বারে বারে ভাবতে বাধ্য করে – এই পাপ কার? কাদের?
অশান্ত ভারতবর্ষ
দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ শেষ হওয়ার সাথেই এক নতুন পৃথিবীর স্পষ্ট চেহারা ফুটে ওঠে। বোঝা যায় এতদিনকার সাম্রাজ্যবাদী শাসন ব্যবস্থা অচল হয়ে গেছে। উপনিবেশ গুলির স্বাধীনতা অবশ্যম্ভাবী। মুক্তির সেই শঙ্খনিনাদ ভারতবর্ষ ও শুনতে পায়। কিন্তু সেই হর্ষধ্বনি একা বাজলো না – সাথে যুক্ত হলো বহুযুগ একসাথে থাকা ভারতীয়দের একে অন্যের থেকে দূরে সরে যাওয়ার প্রবল আসক্তির নির্ঘোষ।
অবিভক্ত পাঞ্জাব ও বাংলা সারাদেশে প্রথম বিভাজনের প্রকৃত চেহারা ফুটিয়ে তুলল। ক্ষমতাধর সমস্ত রাজনৈতিক গোষ্ঠীই কম বেশি উপলব্ধি করলো দেশের স্বাধীনতা দেশভাগ ব্যতিরেকে আর সম্ভব নয়। গোটা দেশ যখন এই সত্যকে প্রায় মেনে নিয়েছে তখন একা একজন মানুষ পাহাড়ের মত সেই নিশ্চিত ভবিতব্যের রাস্তায় বাধা হয়ে দাঁড়ালেন – তিনি মহাত্মা গান্ধী। জীবনের সায়াহ্নে এসে মহাত্মা যেন আর একবার নিজের সর্বশক্তি ফিরে পেলেন এবং দৃপ্ত কণ্ঠে ঘোষণা করলেন দেশভাগের ফলে ভারতবর্ষের মৃত্যু অনিবার্য – হিন্দু এবং মুসলমান যদি একত্রে শান্তিতে বসবাস করতে না পারে তবে সেই স্বাধীনতা মূল্যহীন। এতটা বলার সাহস সেদিন সারা দেশে আর কারোর ছিল না।
বাংলাদেশে সাম্প্রদায়িক হিংসা ছড়িয়ে পড়তে শুরু করল। হাজার ১৯৪৬সালের ১৩ই অক্টোবর প্রকাশ্য রাস্তায় খুন হওয়া শুরু হয়। তখন ও লর্ড ওয়াভেল বিশ্বাস করছেন সাংবিধানিক সরকারই এই নৈরাজ্য দমনে যথেষ্ট হবে। গান্ধী ভাইস রয় আশ্বাসে আস্থা রাখেন নি, নিজের দেশকে তিনি ব্রিটিশ শাসকের তুলনায় অনেক বেশি ভালো চিনতেন। তিনি বুঝতে পেরেছিলেন এই হিংসা দমন করার ক্ষমতা কিংবা সদিচ্ছা কোনোটাই ব্রিটিশ সরকারের নেই।
নভেম্বর মাসে গান্ধী কলকাতায় এলেন – বাংলার সরকার তার জন্য এক বিশেষ ট্রেনের বন্দোবস্ত করে। আসার আগে নিজের ঘনিষ্ঠ বৃত্তে গান্ধী জানিয়েছিলেন তিনি যা করতে চলেছেন সেই লক্ষ্যে সফল হত্তয়া তার জীবনের কঠিনতম পরীক্ষা। আরো একবার “করো অথবা মরো” স্লোগানকে পরীক্ষা করতে চলেছেন – তফাৎ শুধু এই যে এবার তার সাথে আর কেউই মরতে রাজি নন। দেশের দুই প্রধান সম্প্রদায়ের মধ্যে চিরস্থায়ী ভেদনীতি কার্যকরী হলেও মহাত্মা স্রোতের বিরুদ্ধে হেঁটে ভারতবর্ষের হৃদয়কে প্রতিষ্ঠা করতে চেয়েছিলেন।
কলকাতায় কয়েকটা দিন কাটিয়েই তিনি নোয়াখালী চলে গেলেন। সেখান থেকে দক্ষিণ প্রান্তে আরো ৮০মাইল দূরের চন্ডিপুরে গিয়ে হাজির হলেন। সাম্প্রদায়িক দাঙ্গায় চন্ডিপুর তখন জনশূন্য, বাড়ির উঠোনগুলিতে লাশের স্তুপ, দরজার গোড়ায় রক্তের দাগ সর্বত্র। গান্ধী ঘোষণা করলেন ‘ঈশ্বর ছাড়া আর কাউকেই ভয় পাওয়া উচিত নয়’। প্রস্তাব দিলেন গ্রামের সুরক্ষায় একজন হিন্দু এবং আর একজন মুসলমান কে একযোগে সক্রিয় হতে হবে। যদিও বুঝলেন একথা আর খাটবে না। সারাজীবন তিনি শ্রেণী সংঘর্ষের তত্ত্বকে নাকচ করে এসেছেন, রক্তস্নাত চন্ডিপুর তাকে মেনে নিতে বাধ্য করল সেখানকার হিন্দুদের আসল পরিচয় তারা ধনী মধ্যবিত্ত, জমিদার অন্যদিকে মুসলমানেরা গরীব শ্রমজীবী। মহাত্মা উপলব্ধি করলেন মানুষকে বাঁচাতে প্রার্থনা ছাড়া তার আর কিছুই করার নেই। তাই নিজেকেই সেই প্রার্থনার আহুতি হিসাবে উৎসর্গের সিদ্ধান্ত নিলেন। আজ আর কেউ তার স্বপ্নের ভারতবর্ষের হৃদয় খুঁজে পেতে আগ্রহী নয় – আজ তিনি সর্বৈব একা।
তিনি যা চাইছেন তাতে কোনো মুসলমান তাকে খুন করতে চাইবে না – যদি আক্রান্ত হন তবে সেই কাজ হিন্দুরাই করবে, গান্ধীর কথাবার্তায় সেই ইঙ্গিত ছিল। নোয়াখালীতে তখন শীতকালীন ঠান্ডা – তবু মানুষের রক্তে গরমি কমছে না।
নোয়াখালীতে মুসলমানেদের হাতে যা হয় সেই একই ঘটনার পুনরাবৃত্তি বিহারে হিন্দুরা শুরু করে। খান আবদুল গফফর খান কে সাথে নিয়ে গান্ধী বিহারের উদ্দেশে রওনা হলেন। ততদিনে ভারতের ভাইসরয় বদল হয়েছে, ওয়াভেল ফিরে গেছেন – অপেক্ষাকৃত তরুণ লর্ড মাউন্টব্যাটেন বিংশ শতাব্দীর সবচেয়ে বড় রাজনৈতিক সমস্যার সমাধানে ভারতে এসে পৌঁছেছেন।
১৯৪৭ সালের ২২ শে মার্চ মাউন্টব্যাটেন দিল্লিতে আসেন এবং সাথে সাথেই গান্ধীর সাথে দেখা করতে চান। গান্ধীর তখনও বিহারে, প্লেনে ছড়ায় তার প্রবল আপত্তি – উত্তর দিলেন তিনি গরীব ভারতীয়দের মতই ট্রেনে চড়ে দিল্লি যাবেন।
মোহাম্মদ আলী জিন্নাহ সেই সময় পৃথক দেশ সংক্রান্ত দাবিতে অভূতপূর্ব অনড় মনোভাব নিয়েছেন। পৃথক পাকিস্তানের অন্য কোনো বিকল্প ই তার মনঃপুত নয়। কলকাতা, নোয়াখালী হয়ে বিহার সর্বত্রই দাঙ্গা রুখতে ব্যর্থ মহাত্মা আলোচনার টেবিলের একদিকে জিন্নাহ আরেকদিকে মাউন্টব্যাটেনকে নিয়ে সমাধানে ব্রতী হলেন। শেষ চেষ্টা হিসেবে তিনি জিন্না কে গোটা ভারতের প্রধানমন্ত্রী হওয়ার প্রস্তাব দিলেন। জিন্নাহ সেই প্রস্তাব তাচ্ছিল্যের সাথে ফিরিয়ে দেন। আবার আরেকদিকে কংগ্রেসও তার এহেন প্রস্তাবে কিছুতেই রাজি হয় নি। বন্ধু এবং শত্রু উভয়পক্ষের থেকেই প্রত্যাখ্যান ছাড়া মহাত্মার আর কিছুই জুটলো না। অসুস্থ, কাঁপা হাতের হিন্দি হরফে শান্তিচুক্তির নিচে সই করলেন – একই কাগজে এম কে গান্ধী লেখা স্বাক্ষরের ঠিক পাশেই জিন্নাহর সাক্ষর ছিল দৃঢ় এবং স্পষ্ট।
এরকম স্বাধীনতা সম্পর্কে গান্ধী নিজের যাবতীয় উৎসাহ হারিয়ে ফেলেছিলেন। নিজেকে ব্যস্ত রাখলেন হরিজন পত্রিকা ব্রহ্মচর্য এবং অহিংসা নিয়ে নতুন দিশা দেখানোয়। যদিও তিনি উপলব্ধি করেছিলেন দেশের সংকটে ভারতবাসী ব্রহ্মচর্য কিংবা অহিংসা কোন কিছুতেই আগ্রহী নয়, তারা তখন নিজেদের জীবন বাঁচাতে যেকোনো মূল্য চোকাতে প্রস্তুত হচ্ছেন। সেই মূল্যই হল দেশভাগ।
অশান্ত ভারতে শান্তি প্রতিষ্ঠায় মহাত্মা শেষবারের মতো রওনা হলেন ভূস্বর্গে। সেই প্রথম এবং শেষবারের জন্য তিনি কাশ্মীরে গেলেন।
শেষের শুরু
শেখ আব্দুল্লাহ দীর্ঘজীবী হোন! গান্ধীজী দীর্ঘজীবী হোন! পাকিস্তান দীর্ঘজীবী হোক! কাশ্মীরে পৌঁছে গান্ধী তিনটি স্লোগানই শুনলেন। সাংবাদিকরা কাশ্মীরের কোন পক্ষে যাওয়া উচিত জানতে চাইলে উত্তর দিলেন ” একমাত্র কাশ্মীরিদের সম্মিলিত অভীপ্সাই তা ঠিক করবে” । এই সময়ে সারা দেশে এমন একটি ও জায়গা তিনি নিজের জন্য খুঁজে পাচ্ছিলেন না যেখানে আর যাওয়ার প্রয়োজন নেই। সবশেষে তিনি বাংলায় ফিরে যাওয়ার সিদ্ধান্ত নেন। বেনারস সেখান থেকে পাটনা হয়ে পুনরায় নোয়াখালী পৌঁছান তিনি। ৪৬ সালের “ডাইরেক্ট একশন ডে” থেকে কলকাতার পরিস্থিতি ক্রমশ জটিল হয়ে উঠছিল, নোয়াখালী যাওয়ার আগে কলকাতায় এসে পৌঁছালে সেখানকার কর্তাব্যক্তিরা গান্ধীকে কলকাতাতেই আরো কিছুদিন থেকে যাওয়ার অনুরোধ করেন। কলকাতার প্রশাসনিক ব্যবস্থা ততদিনে সম্পূর্ণ বিধ্বস্ত, সুরাবর্দী হিন্দুদের চোখে মহাপাতক বিশ্বাসঘাতক। সুরাবর্দী কে সাথে নিয়েই গান্ধী আরো দুদিন কলকাতায় রয়ে গেলেন। সেই সময় কলকাতায় মুসলমানেরা সংখ্যায় কম, তাদের মনে প্রবল আশঙ্কা – স্বাধীনতা উদযাপন হিন্দুদের জন্য আক্রমণের অজুহাত হবে – নোয়াখালীতে মুসলমানেরা নিজেদের সংযত করুন, শান্তি বজায় রাখুন এই শর্তে গান্ধী কলকাতায় রয়ে গেলেন। তার শর্ত মেনে নেওয়া হলে সারা দেশে দাঙ্গা রুখতে এর চাইতে বেশি নিশ্চায়ক কিছু রয়েছে বলে তার মনে হয় নি। তিনি সুরাবর্দী কে প্রস্তাব পাঠালেন কার সাথে এক ছাদের তলায় থাকার, সুরাবর্দী এই প্রস্তাবে কিছুটা দ্বিধান্বিত ছিলেন। গান্ধী তাকে নিজের মেয়ের সাথে আলোচনা করতে পরামর্শ দিলেন। তারা দুজনেই জানতেন এভাবে কলকাতার বুকে একসাথে থাকা তাদের দুজনেরই মৃত্যুর কারণ হিসেবে যথেষ্ট সম্ভাবনাময়। তবু গান্ধী সেই পরিকল্পনাতেই স্থিত রইলেন। বেলেঘাটা খালের পাশে হায়দারী ম্যানশন নামের একটি বাড়িতে দুজনের থাকার ব্যবস্থা হল। কিছুদিন আগেই সেই খালের এক পাশে মিঞা বাগান নামক এলাকাটি হিন্দু দাঙ্গাবাজদের হাতে সম্পূর্ণ ধ্বংস হয়ে গিয়েছে। ১৩ই আগস্ট বিকালের দিকে হায়দারী ম্যানশন ঘেরাও শুরু হলো। ইঁট, পাথর এসে পড়তে শুরু করলো কাচের জানলাগুলির উপরে, ঘেরাওকারিরা জানতে চায় কেন গান্ধী এখন এসেছেন, হিন্দুদের উপরে আক্রমণের সময় তার দেখা পাওয়া যায় নি কেন? উন্মত্ত জনতার ভিড় এই প্রশ্নের উত্তর চায়।
উত্তেজনার সেই মুহূর্তে গান্ধীর শেষ কথা ছিল “আপনারা আমাকে জোর করে এখান থেকে বের করে দিতে চাইছেন, এ ধরনের বল প্রয়োগের বিরুদ্ধেই আমি সারাজীবন কাজ করেছি। যেকোনো গাজয়ারির সামনে মাথা নোয়াবার চরিত্র যে আমার নয় আপনারা সেকথা জানেন। আমাকে আমার কাজ করতে বাধা দিতে পারেন, আমাকে জেলে ঢোকাতে পারেন কিংবা খুনও করতে পারেন। আমি নিজের সুরক্ষার জন্য পুলিশ কিংবা মিলিটারির সাহায্য চাইবো না।”
ভিড় থেকে আওয়াজ উঠলো গান্ধী হিন্দুদের শত্রু।
তিনি জবাব দিলেন ‘হিন্দু পরিবারে জন্মগ্রহণ করে, সারাজীবন নিজস্ব কায়দায় হিন্দু ধর্মের মূল্যবোধ গুলির চর্চা করে চলেছেন যিনি সেই মানুষটি কিভাবে হিন্দুদের শত্রু হবেন? এমন অভিযোগ তোলা কি হিন্দুদের আরো বেশি করে অসহনশীল প্রমাণ করছে না?’
মনুবেন সেই সন্ধ্যার স্মৃতিচারণ করেছেন এই বলে ‘এই বৃদ্ধ মানুষটি এক জাদুকর, উন্মত্ত জনতাকে শুধুমাত্র কথা বলেই শান্ত করে দিতে পারতেন। সেদিনও তার অন্যথা হয় নি, যারা খুন করতে উদ্যত ছিল তারা আত্মসমালোচনা করে ফিরে যেতে বাধ্য হল’।
তখন প্রায় রাত আটটা বেজে গেছে, কয়েক ঘণ্টার উত্তেজনা স্তিমিত হয়ে এলেও গান্ধী ভয়ানক ক্লান্তি অনুভব করলেন। ভারতবাসী অহিংসা কোনোদিনই গ্রহণ করেনি, করলেও তার চর্চা করেনি – এই দেশ তাকে মহাত্মা মেনেছে ঠিকই কিন্তু তার মাহাত্ম্য আদৌ স্বীকার করেনি। তিনি ব্যর্থ হয়েছেন।
কলকাতায় দাঙ্গা ক্রমশ ছড়িয়ে পড়লো, বাংলা প্রদেশের তৎকালীন গভর্নর রাজা গোপালাচারি গান্ধীকে বোঝাতে চাইছেন এসব যা হচ্ছে তাকে মূলত গুন্ডা-বদমায়েশদের কাজ। গান্ধী নিজের অবস্থানে অনড় – তিনি জানতেন গুন্ডাদের পিছনে কাদের হাত রয়েছে। গান্ধী নিজের একমাত্র অস্ত্র অনশন শুরু করলেন। চারদিন বাদে হিন্দু গুন্ডাদের তরফে একটি প্রতিনিধিদল তার কাছে উপস্থিত হল, মহাত্মা অনশন ভঙ্গ করুন এই আর্জি নিয়ে। অনশনরত অসুস্থ গান্ধীর সামনে এসে নিজেদের হাতের অস্ত্র সমর্পণ করে তারা ক্ষমা প্রার্থনা করে। গান্ধীর বক্তব্য যদি তারা মুসলমানদের সুরক্ষা দিতে সমর্থ হয় তবেই তাদের আর্জি শুনবেন নাহলে কিছুতেই নয়। তিনি তখনও দোষে গুনে মানুষের ভিতর থেকে মহান হৃদয়ের মানুষকে টেনে বের করে আনার চেষ্টা করে যাচ্ছেন। পরিস্থিতি যতই জটিল হচ্ছে গান্ধী ততবেশি অসম্ভব দাবি করছেন, তার এহেন দাবিসনদ বাস্তববাদী রাজনীতির চোখে যতই অদ্ভুত প্রতিভাত হোক না কেন একথা মেনে নিতেই হয় গান্ধী মানুষের মধ্যে ঈশ্বরের অস্তিত্বে আস্থাশীল ছিলেন বলেই খুন করনেওয়ালাদের থেকে খুনোখুনি রুখে দেবার কার্যকরী শপথ আশা করেছিলেন। দেশ পরিচালনার আধুনিকমনস্কতার দৃষ্টিতে গান্ধীর আচরণ বোকামি প্রতিপন্ন হলেও এমন প্রত্যাশা করার মত হিম্মত যে সারা দেশে একমাত্র গান্ধীর ই ছিল একথাও মেনে নিতেই হয়। তার মহাত্মা উপাধি সেখানেই স্বার্থক। কলকাতার প্রশাসন শেষ অবধি মানুষের সুরক্ষা সম্পর্কে যথাযথ লিখিত আশ্বাস দিলে গান্ধী নিজের অনশন ভঙ্গ করলেন। সুরাবর্দি তাকে এক গ্লাস লেবুর জল পান করতে সাহায্য করলেন। শেষবারের মতো কলকাতা ছেড়ে চলে যাবার আগে ফুলের মালা পরিয়ে ঘিয়ের প্রদীপ জ্বেলে তার আরতীর পরিকল্পনা ছিল – মূলত কম বয়সী কিছু মেয়ে এই কাজ করতে আসে। মহাত্মা তাদের বাধা দিলেন এবং জানালেন ‘যেখান থেকে হোক আলো জ্বালানোর সমস্ত রসদটুকু সংগ্রহ করো, গরিবদের কাছে যাও – তাদের অন্ধকার দুর করো।’ গরীব, দুঃখী দেশবাসীদের জাতীয় রাজনীতির আঙিনায় টেনে নিয়ে এসে যিনি ভারতীয় রাজনীতির চরিত্র পাল্টে দিয়েছিলেন সেই মহাত্মা আরো একবার মানুষকে মানুষ হবার বার্তা দিয়ে গেলেন।
এবার গন্তব্য দেশের রাজধানী দিল্লি।
ততদিনে মহাত্মা হিন্দু সাম্প্রদায়িকতার চোখে এক নম্বর শত্রুতে পরিণত হয়েছেন আবার মুসলমানদেরও একটি অংশ তার প্রতি প্রবল অনাস্থা প্রদর্শন শুরু করেছে – দিল্লিতে বহু জায়গায় তাকে উদেশ্য করে ‘গান্ধী মূর্দাবাদ’ স্লোগান উচ্চারিত হচ্ছিল – তারা সকলেই হিন্দু ছিলেন না।
গান্ধী এসবের অর্থ বুঝেছিলেন।
দিল্লিতে তখন নরকের পরিস্থিতি। পাঞ্জাবের দিক থেকে প্রতিদিন মানুষ খুন হবার খবর আসছে, গোটা দিল্লি শহর জুড়ে উদ্বাস্তু মানুষের ভিড়। এরা বেশিরভাগই পাকিস্তান সীমান্ত পেরিয়ে নিজেদের পরিবার পরিজন হারিয়ে এসেছেন। আর্থিক দিক থেকে সর্বস্বান্ত তো হয়েইছেন কিন্তু এদের বুকে যে আগুন জ্বলছে তার প্রধান কারণ সাম্প্রদায়িক হিংসা। পাকিস্তান এবং ভারতের মধ্যে তখন যুদ্ধ পরিস্থিতি। যুদ্ধ বাঁধলে দেশের মধ্যে থাকা মুসলমানেরা বিশ্বাসঘাতকতা করতে পারে – এই ছিল বল্লভ ভাই প্যাটেলের অবস্থান। নেহরু শান্তিকামী হলেও পাকিস্তানের প্রসঙ্গে যুদ্ধ সম্ভাবনায় যেকোনো মূল্যে জবাব দিতে প্রস্তুতি নিচ্ছেন। নিজস্ব কায়দায় আঁধার চিরে এগিয়ে যাওয়ার চেষ্টা করলেও গান্ধীর জীবনে এই পর্বটি কিছুটা অদ্ভুত। তিনি সারাজীবন নিজের সিদ্ধান্তে অটল – অনড় থেকেছেন, নিজের অবস্থান, নিজের মত ও পথ সম্পর্কে সেই দৃঢ়তাই তাকে ঐতিহাসিক চরিত্র দিয়েছে। ১৯৪৭ সালের শেষদিকে তার চিন্তাভাবনায় অভাবনীয় কিছু পরিবর্তন লক্ষ্য করা যায়। কখনো তার মনে হয় তিনি ভারত ও পাকিস্তানের সীমান্ত গিয়ে বসবাস শুরু করলে দু’দেশের বিরোধ মিটে যাবে। কখনো তিনি একশো পঁচিশ বছর অবধি বাঁচবেন বলেন আবার কখনো জাতিদাঙ্গার বলি হত্তয়া মানুষের মৃত্যুর জন্য নিজেকেই দায়ী করতে থাকেন। নতুন দেশ, সেই দেশের প্রশাসক হিসাবে নিজের একদা রাজনৈতিক ছাত্র এবং সহযোদ্ধাদের ভূমিকা তিনি কিছুতেই মেনে নিতে পারছিলেন না, আবার পরিস্থিতির চাপে তাকে চুপ করেও থাকতে হচ্ছিল। মনে হয় পথ খুঁজে না পাওয়ার সেই দ্বন্দই গান্ধীকে কিছুটা বিহ্বল করে তোলে – নাহলে সারাজীবন দেশের মুক্তিকামিতায় ঈশ্বরেচ্ছায় পথ চলে গান্ধী বলতে শুরু করেছিলেন “নিশ্চিত আমার কাজে কিছু ভয়ানক ত্রুটি হয়েছে, আশা করি ঈশ্বর এবার আমাকে সেই পাপ থেকে মুক্ত করবেন, খুব বেশিদিন আমাকে আর এই যন্ত্রণা সহ্য করতে হবে না”। ব্যার্থতার সেই যন্ত্রণা উপশমের উদ্দেশ্যেই শেষবারের মতো গান্ধী অনশন শুরু করলেন – প্রত্যেকেই তার স্বাস্থ্য সম্পর্কে চিন্তিত। গান্ধী নির্বিকার – পাকিস্তানের প্রাপ্য অর্থ তাদের হাতে তুলে দিতে চাইছেনা ভারত সরকার, কথার খেলাপের থেকেও গান্ধীর বুকে যা সবচেয়ে বেশি লাগল তা হল এতে দুইদেশের পুনরায় এক হবার যেটুকু সম্ভাবনা রয়েছে (তিনি তখনও স্বপ্ন দেখছেন ভারত এবং পাকিস্তান নিজেদের ভুলের প্রায়শ্চিত্ত করবে এবং এক হবে) তা ধ্বংস হয়ে যাবে। গান্ধী এতকিছুর পরেও পাকিস্তানের স্বার্থরক্ষা করছেন এই মনোভাবে অটল একদল মানুষ স্থির করলেন মহাত্মার বেঁচে থাকার প্রয়োজন ফুরিয়েছে। সেই লক্ষ্যে সক্রিয় হলেন কিছুজন – স্বাধীন ভারতের ইতিহাসে এরাই প্রথম সন্ত্রাসবাদী।
তথ্যসুত্রঃ
১) দ্য অ্যাসাসিনেশন অফ মহাত্মা গান্ধী, ট্রায়াল অ্যান্ড ভার্ডিক্ট ১৯৪৮-৪৯
দ্য হিন্দু, হিস্টোরি সিরিজ
২) দ্য লাইফ অ্যান্ড ডেথ অফ মহাত্মা গান্ধী, রুপা পাবলিকেশন্স ইন্ডিয়া প্রাইভেট লিমিঃ
রবার্ট পেইন
৩) গান্ধীজ প্যাশন, দ্য লাইফ অ্যান্ড লিগ্যাসি অফ মহাত্মা গান্ধী
স্ট্যানলি উলপার্ট