আর এস এস নিষিদ্ধ হয় কেন ?
ওয়েবডেস্ক প্রতিবেদন
আজকের ভারতে নতুন প্রজন্মের অনেকের কাছেই এই তথ্য অজানা যে গান্ধীজির হত্যাকারী নাথুরাম গডসে রাষ্ট্রীয় স্বয়ংসেবক সংঘের সদস্য ছিল। এই না জানার কারণ শুধু ইতিহাস সম্পর্কে নতুন প্রজন্মের উদাসীনতাই নয়, স্বাধীন ভারতে জনজীবনের চর্চায় ১৯৪৬-৪৭ এর সাম্প্রদায়িক বাতাবরণ সম্পর্কে একটা ধারনা গড়ে উঠেছিল যে আধুনিক ভারতবাসী ঐ একই ভুল দ্বিতীয়বার করবে না। এমন ধারণা করে নেওয়াটাই আধুনিক ভারতে সবচেয়ে বড় রাজনৈতিক ভ্রান্তি যার খেসারত হিসাবে আজ গোটা দেশের সর্বত্র আরো একবার সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতির সচেতন চর্চা করতে হচ্ছে। ইতালির ফ্যাসিস্ট নায়ক বেনিতো মুসোলিনির দ্বারা অনুপ্রাণিত হয়েই যে এদেশে রাষ্ট্রীয় স্বয়ংসেবক সংঘ গড়ে তোলা হয়েছিল একথাও অনেকে মনে রাখেনি অথবা এই প্রসঙ্গে পরবর্তী প্রজন্মকে সচেতন করতে শেখায় নি। ব্রিটিশ ভারতের বিখ্যাত পত্রিকা ‘ কেশরী ‘ – তে ১৯৩৫ সালেও ফ্যাসিবাদ এবং মুসোলিনির নামে প্রশংসা প্রচারিত হত। হিন্দুদের দেশ কেমন হবে ব্যাখ্যা করতে ” This can only be achieved by inserting purely Hindu interest, and not by an Indian Propaganda. The consciousness must arise in the mind of each Hindu that he is a hindu, and not marely an Indian and when it does arise the newly awakened force is bound to bring its result. ” – অবধি সেখানে পাওয়া যায়। আজ হিন্দু আবেগে আঘাতের অজুহাত খাড়া করে যখন তখন যে কারোর উপরে আক্রমণ নেমে আসছে, এই পরিস্থিতিতে দুর্বৃত্তের অতীতকে জেনে রাখা শুধুই সচেতনতাই নয়, একটি অবশ্য কর্তব্য।
নিজেদের রাজনৈতিক স্বার্থে আরএসএস আজ যে ব্যক্তির নাম আর মুখে আনে না সেই বি এস মুঞ্জে ১৯৩১ সালে ইউরোপ সফরে গিয়ে ইতালিতে ফ্যাসিস্ট ক্যাম্পগুলি দেখেন এবং তাদের কাজকর্মে উৎসাহিত হয়ে ভারতের বুকেও একই কায়দায় সংগঠন গড়ে তোলার পরিকল্পনা নেন। মনে রাখতে হবে ইতিমধ্যেই, ১৯২৫ সালে আর এস এস প্রতিষ্ঠিত হয়েছে। বিদ্যাভারতী নামের আড়ালে আরএসএস পরিচালিত স্কুলগুলিতে সেই আদর্শই শেখানো হয়।
ভারতের বুকে আরএসএস এর সাংগঠনিক প্রভাব বৃদ্ধি পেতে শুরু করে স্বাধীনতা আন্দোলনের এক নির্দিষ্ট সময়ে, বলা যায় ক্রান্তিকালে। কংগ্রেসের লাহোর অধিবেশনে যখন পূর্ণ স্বরাজের প্রস্তাবনা হয় তারপর থেকেই সারাদেশে আরএসএস নিজের সংগঠন বৃদ্ধি করতে তৎপর হয়। এই প্রসঙ্গে মনে রাখা প্রয়োজন এবং মহাত্মা গান্ধীর বিভিন্ন রচনায় তার উল্লেখও রয়েছে, তখনকার ভারতে ২৬শে জানুয়ারি দিনটি স্বাধীনতা দিবস হিসাবে পালন করা হতো। আজ যাকে বীর উপাধিতে ভূষিত করার লক্ষ্যে একটি রাজনৈতিক শক্তি প্রাণপাত করে চলেছে সেই বিনায়ক দামোদর সাভারকর ১৯৩৮ সালে আন্দামানে কারাগার থেকে মুক্তি পেতে ব্রিটিশ সরকারের কাছে পাঠানো মুচলেকায় উল্লেখ করেন ” একটি জাতি গঠিত হয়, সেদেশের বসবাসকারী সংখ্যাগরিষ্ঠ জনগোষ্ঠীর দ্বারা। জার্মানিতে ইহুদিদের থাকবার কি কোনো প্রয়োজন রয়েছে? সংখ্যালঘু বলেই সেখান থেকে তাদের কে তাড়িয়ে দেওয়া হয়েছে।… যদি সরকার বাহাদুর তাদের নানা রকমের দয়া এবং গভীর বদান্যতার দ্বারা আমাকে মুক্তি দেন তাহলে আমি সাংবিধানিক উন্নয়ন এর একজন আত্মমগ্ন প্রবক্তা ভিন্ন অন্য কিছুই নয় এবং উন্নয়নের সর্বোচ্চ শর্ত হলো ইংরেজদের প্রতি প্রশ্নহীন আনুগত্য – এই কথাটাই জীবন দিয়ে দেখাবো।… সরকার যে রকম ভাবে চাইবে, আমিই সেই রকম ভাবেই সরকারকে সেবা করতে প্রস্তুত আছি। আমার এই পরিবর্তন হলো আমার বিবেকের সিদ্ধান্ত। আমার স্থির বিশ্বাস, ভবিষ্যতেও আমার আচরণ এই রকমই থাকবে। এর ফলে যে সুবিধাগুলো পাওয়া যাবে, সেই সুবিধা গুলো আমাকে জেলে আটকে রাখলে কোন অবস্থাতেই পাওয়া যাবে না। এক্ষেত্রে একমাত্র মহামান্য সরকার বাহাদুরই দয়া পরবশ হতে পারেন। পিতৃসুলভ সরকারের দরজায় না ফিরলে একজন অবোধ অনুতপ্ত সন্তান আর কোথায় ফিরবে? ”
সহজেই বোঝা যায় এহেন ব্যক্তিকে যারা মাথায় করে রাখে তাদের রাজনীতির চরিত্র কেমন হবে। বাজারে আনন্দ ফেরি করার লক্ষ্যে সাহিত্য সৃষ্টিকারীদের হাল আমলের গবেষণায় সাভারকোরের এই মুষিকভব সুলভ মুচলেকা এক গভীর প্রজ্ঞাসম্বলিত রাজনৈতিক কুটবুদ্ধি হিসাবে চিহ্নিত হচ্ছে আজকাল, তাদের উদ্দেশ্যে একটাই কথা বলার – এই একই প্রকৃতির বুদ্ধি ভগৎ সিং, সুখদেও এবং রাজগুরুর হলো না! যতীন দাস অনশনে, অত্যাচারে প্রাণত্যাগ করলেন তবু তার মাথায় এমন চিন্তা এলনা! আন্দামান জেলে ব্রিটিশের চাবুক আরো অনেক অনেক বিপ্লবীর শরীরকে যন্ত্রণা দিয়েছে, মুক্ত হবার পরে তারা ভারতের কমিউনিস্ট পার্টিতে যুক্ত হলেন – তাদের কারোরই বুদ্ধি সাভারকরের ন্যায় শাণিত ছিল না?
আর এস এস ভারতকে প্রথম থেকেই হিন্দু রাষ্ট্র হিসাবে ব্যাখ্যা করেছে, সেই আদর্শেই তাদের সংগঠন, তাদের কর্মসূচি। তারা দেশের সংবিধানকে ধর্মীয় বিশ্বাসের ভিত্তিতে গড়ে তোলার দাবী জানিয়েছিল, এখনও মনুবাদের ন্যায় এক অতি সংকীর্ণ, পশ্চাৎপদ ধ্যানধারণা নিয়েই তাদের দিনযাপন চলে। আজ যখন দেশের একটি নির্দিষ্ট সম্প্রদায়ের মানুষকে চিহ্নিত করে প্রতিনিয়ত হয় কারাগারে নয়তো দেশের বাইরে পাঠিয়ে দেওয়ার হুমকি দেওয়া চলছে তখন জেনে রাখা ভালো ১৯৩৯ সাল নাগাদ সাভারকর বলেছিলেন ” ভৌগলিক পরিসীমার উপরে কোন অবস্থাতেই জাতিত্ব নির্ভর করে না। সাধারণ ভৌগোলিক পরিসীমার থেকেও ভাব, ধর্ম, ভাষা ও সংস্কৃতির ঐক্যের উপরে জাতিত্ব অনেকখানিই নির্ভর করে। ঠিক এই কারণেই কোনো অবস্থাতেই জার্মান এবং ইহুদিকে এক জাতি হিসেবে পরিগণিত করতে পারা যায় না”।
১৯৪৮ সালে গান্ধীকে হত্যা করার পরে লাল কেল্লায় বিশেষ আদালতে নাথুরাম গডসের বিচার চলাকালীন এই সাভারকর হত্যার অপরাধে যুক্ত থাকার অভিযোগে থেকে নিজেকে আলাদা করে নেন। বলাই বাহুল্য সেদিনও তার গভীর রাজনৈতিক প্রজ্ঞাসম্বলীত কুটবুদ্ধি তাকে রক্ষা করতে সক্ষম হয়।
পরাধীন ভারতে ব্রিটিশ সরকার আর এস এস কে একবার নিষিদ্ধ করেছিল, আর স্বাধীন ভারতে এখনও অবধি তিনবার তারা নিষিদ্ধ সংগঠন হিসাবে চিহ্নিত হয়েছে। প্রথমবার গান্ধী হত্যার পরে তৎকালীন স্বরাষ্ট্র মন্ত্রী সর্দার বল্লভ ভাই প্যাটেল আর এস এসকে নিষিদ্ধ ঘোষণা করেছিলেন। ১৯৪৮ সালের ৪ঠা ফেব্রুয়ারি ভারত সরকারের স্বরাষ্ট্র দপ্তর ঘোষণা করে ” দেশের অভ্যন্তরে যে শক্তি ঘৃণা ও হিংসার ব্রত নিয়ে কাজ করে চলেছে এবং যাদের কৃতকর্মের ফলে দেশমাতৃকার সুনাম নিন্দিত হচ্ছে সেই শক্তিকে গোড়া থেকে উপড়ে ফেলতে সরকার সিদ্ধান্ত নিয়েছে। এই লক্ষ্যেই ভারত সরকার দেশের সর্বত্র রাষ্ট্রীয় স্বয়ংসেবক সংঘকে নিষিদ্ধ সংগঠন হিসাবে ঘোষণা করছে”। ১৯৪৮ সালেই সর্দার প্যাটেল সংঘের অন্যতম নেতা এম এস গোলওয়ালকর কে চিঠি লিখে জানিয়েছিলেন “আর এস এস নিজেদের লক্ষ্য হিসাবে যা কিছু ঘোষনা করে সেই হিন্দুদের ঐক্য স্থাপন করা এবং তাদের একজোট করে নিরপরাধ এবং অসহায় মানুষ, মহিলা এমনকি শিশুদের উপরেও হামলা চালিয়ে প্রতিশোধ নেবার মধ্যে অনেক ফারাক রয়েছে। কংগ্রেসের বিরোধিতা করার ক্ষেত্রে তারা ব্যক্তিগত কুৎসা, মিথ্যভাষণ এবং সত্যের অপলাপে এমন ইতর পর্যায়ে পৌঁছেছেন যার ফলে জনমানসে এক অস্থিরতা তৈরি হয়েছে। এই অস্থিরতার চরম মূল্য দিতে গান্ধীজিকে নিজের প্রাণ বলিদান হল। এর পরে সরকারের তরফে আর এতটুকুও সহানুভূতি আশা করা যায় না। যতই মতভেদ থাকুক না কেন এই সংগঠনের সদস্যরা গান্ধী হত্যার দিনে আনন্দ করতে মিষ্টান্ন বিলি করেছে… এই অবস্থায় ভারত সরকার নিষ্ক্রিয় থাকতে পারে না। তাই রাষ্ট্রীয় স্বয়ং সেবক সংঘকে নিষিদ্ধ করা হলো। সেই ঘোষণার ছয় মাস অতিবাহিত হবার পরে সরকার আশা করে এইসব জঘন্য ঘটনার থেকে শিক্ষা নিয়ে আর এস এস – এর সদস্যরা নিজেদের সঠিক পথে চালিত করবেন। যদিও আমার বিশ্বস্ত সূত্র থেকে আমি যেসব খবর সংগ্রহ করেছি তাতে স্পষ্ট যে আর এস এস নিজেদের কৃতকর্মের থেকে এতটুকুও শিক্ষা নিতে অপারগ। ” এর পরে এম এস গোলওয়ালকর আরো দুইবার সর্দার প্যাটেলের সাথে দেখা করেন, দেশের প্রধানমন্ত্রী জহরলাল নেহরুকে চিঠি লিখে জানান তাদের সংগঠনের উপর থেকে নিষেধাজ্ঞা প্রত্যাহার করা হলে আর এস এস নিজের সদস্যের যথাযথ পথ বেছে নিতে অনুরোধ করবে। সর্দার প্যাটেল তখন সেই কুমিরের কান্নায় ভোলেন নি। ১৯৪৯ সালের ১১ই জুলাই সেই নিষেধাজ্ঞা প্রত্যাহৃত হয়। ততদিনে আর এস এস নিজেকে জাতীয় পতাকার প্রতি শ্রদ্ধাশীল, দেশের সংবিধানের প্রতি আস্থাশীল এক সাংস্কৃতিক সংগঠন হিসাবে ব্যাখ্যা করতে শুরু করেছে।
আজ ৪৩০ মিলিয়ন ডলার খরচ করে ৬০০ ফুট উচ্চতার মূর্তি বসানো হচ্ছে সরকারি খরচে… সর্দার প্যাটেল কে লৌহ পুরুষ হিসাবে আখ্যায়িত করা হচ্ছে, এসবের উদ্দেশ্য স্পষ্ট – যাতে সবাই ভুলে যায় এই লৌহ পুরুষই স্বাধীন ভারতে আর এস এসকে নিষিদ্ধ করার হিম্মত দেখিয়েছিলেন। আর এস এস বারে বারে ভুল করে, প্রকৃত ইতিহাস কেউ কেউ হয়ত ভুলে যায়, সবাই নয়।
স্বাধীন ভারতে আরো দুবার রাষ্ট্রীয় স্বয়ং সেবক সংঘ নিষিদ্ধ হয়। একবার জরুরী অবস্থার সময়ে, আর শেষ ১৯৯২ সালে বাবরি মসজিদ ধ্বংস করার পরে। আজকের ভারতে যতই আচ্ছে দিনের ঝুটা স্বপ্ন দেখানো চলুক না কেন, আসলে তো সত্যি এই যে অযোধ্যায় রামমন্দির ছিল এমন প্রমাণ নেই, কিন্তু এদেশের ইতিহাসের নিদর্শন, মসজিদটিকে ধ্বংস করা হলো। কমরেড জ্যোতি বসু আর এস এস – বিজেপি কে বর্বর বলতেন, একথা অনেকই জানেন। কথাটা অসম্পূর্ণ। তিনি যা বলেছিলেন তা হল ” মন্দির, ধর্ম এসব এদেশে নতুন কোনো ব্যাপার নয়। এদেশে হাজার হাজার মন্দির রয়েছে, আরো একটা মন্দির গড়ে উঠতেই পারে। কিন্তু মন্দির গড়ে তোলার জন্য মসজিদ ভাঙ্গা হলে সেটা ধর্ম নয়, সেটা হল সাম্প্রদায়িকতা “। বাবরি মসজিদ ধ্বংস হবার পরে বিজেপি একবার ভারতের ক্ষমতায় বসে, সেই সরকারের প্রধানমন্ত্রী অটলবিহারী বাজপেই সেদিন জ্যোতি বসুর মন্তব্যের উত্তর দিতে পারেন নি। আজকের ভারতে যারা এইসব লজ্জাজনক ঘটনাকে ছোট করে দেখছেন, অন্যদেরও সেভাবেই বিচার করতে উৎসাহ দিচ্ছেন, মিথ্যা অজুহাত এবং শয়তানের যুক্তি হাজির করছেন তাদের আর যেই ক্ষমা করুক, ভারতের ইতিহাস ক্ষমা করবে না।
আর এস এস ভিন্নস্বর, ভিন্নমত কে ভয় পায়। তাই তারা সবার আগে ভারতের অন্যতম বৈশিষ্ট্য বৈচিত্রের মধ্যে ঐক্যের ধারণাকে আক্রমণ করে। বিভিন্ন ভাষা, বহুবিধ আস্থা এবং যুগের পরে যুগ ধরে বিভিন্ন দার্শনিক মতবাদ যে দেশে সহাবস্থান করেছে এবং সবশেষে মানবতার সমুদ্রে এসে মিলিত হয়েছে সেই দেশেরই নাম ভারত। এমন দেশ আর এস এস এর মত সংকীর্ণ, মানবতা বিরোধী এবং ফ্যাসিস্ট সংগঠনের দেশ হতে পারে না। এদেশের বুকে দেশবিরোধী যদি সত্যিই কেউ থাকে তবে সেই তালিকায় রাষ্ট্রীয় স্বয়ং সেবক সংঘ প্রথম স্থান পাবে, এটাই তাদের ইতিহাস, এটাই তাদের ভবিতব্য।
ওয়েবডেস্কের পক্ষেঃ সৌভিক ঘোষ
তথ্যসুত্রঃ
১) India Wins Freedom: Maulana Abul Kalam Azad
২) Beyond Doubt- A Dossier on Gandhi’s Assacination: Compiled and introduced by Teesta Setalwad
৩) হিন্দু সাম্প্রদায়িকতার বিবর্তন – ডঃ গৌতম রায়
৪) আর এস এস ও হিন্দুত্বঃ এ জি নুরানি