Site icon CPI(M)

The Bridge, The Brigade

Brigade-2025-Cover-III-Chandan-Das

চন্দন দাস

আরোহী খাতুন এবং বৃষ্টি দাসের জন্য এবারের ব্রিগেড। 

দুই মেয়ের মাঝে বিপন্ন এক সেতু। সেই সেতু ভেঙে, দুমড়ে দু’জনের মাঝে চিরস্থায়ী কাঁটাতার পুঁতে দেওয়ার আয়োজন করেছে গডসে আর জিন্নাহ’র উত্তরসূরীরা। তাদের দোসর সরকারি টাকায় মন্দির বানানোর ঠিকাদার— তৃণমূল। তাদের কাঁটাতারের শাল বল্লার খুঁটিতে আগুন দিতে হবে। আরোহী আর বৃষ্টির মাঝে চিরকালীন সেতুর দুদিকে, আশেপাশে দাঁড়াতে হবে মেহনতিদের পোক্ত কাঁধের ভরসায়।

সেই সেতুর উপর দেশের দিনযাপন। রক্ষা তাকে করতেই হবে। এবারের ব্রিগেডের লক্ষ্য তাই।   

সুতির কাশিমনগরের ইজাজ আহম্মেদের মেয়ে আরোহী। আরোহী এখনও স্কুলে যেতে শুরু করেনি। মায়ের কোলে অনেকটা সময় তার দিন কাটে। তাঁর বাবা পুলিশের গুলিতে খুন হয়েছেন। শরীর ফুঁড়ে দেওয়া সেই বুলেট পুলিশ নিয়ে গেছে। কিন্তু জঙ্গিপুরের হাসপাতালে ছটফট করতে থাকা আরোহীর যুবক বাবার জন্য রক্তের বন্দোবস্ত পুলিশ করেনি।

পুলিশের রক্ত এখন ঠান্ডা। তৃণমূলের খাঁচায় তার ফনা দোলে। কিন্তু আরোহীর মা, বছর আঠারো-উনিশের সালমা বিবির চোখের লোনা জলে আগুন ধরা আছে।

ব্রিগেড এবার সেই আগুন ধারণ করুক।

বৃষ্টি তত ছোট নয়, আরোহীর মতো। তবু সে-ও শিশু। সে-ও কণ্যা। বৃষ্টি ক্লাস ফাইভে পড়ে। আরোহী ‘বাবা’ কিংবা ‘আব্বা’, যাই হোক, স্পষ্ট ডাকতে শেখেনি। বৃষ্টি তা পারে। পারতো। ‘বাবা’ ডাক বৃষ্টির জীবনে পাস্ট টেন্স হয়ে গেছে। সামশেরগঞ্জের জাফরাবাদ থেকে বারবার পুলিশকে ফোন করা হয়েছে। পুলিশের অফিসাররা ফোন ধরেননি। গত শনিবারের ঘটনা। সেদিন সকালে একদল দুষ্কৃতী পুলিশ আসবে না নিশ্চিত জেনে বৃষ্টিদের বাড়ির দরজা ভেঙে তার দাদু হরগোবিন্দ দাস এবং বাবা চন্দন দাসকে টেনে নিয়ে গেছে বাড়ির উলটোদিকের খোলা জায়গায়। দুজনকে সেই দুষ্কৃতীরা খুন করেছে। গাছের নিচে রক্ত ছিটকে ছিটকে পড়েছে।

বিজেপি ‘লাশ’ পেয়েছে। ‘হিন্দু খতরে মে হ্যায়’—আওয়াজ ফের উঠেছে। পুলিশের জন্য। পুলিশ তাহলে কার পোষাক পড়েছে? জঙ্গিপুর বলছে—পুলিশ তৃণমূল আর বিজেপি, দুইয়ের হয়েই ‘খেলছে।’

বৃষ্টির বাবা খুন হয়েছেন। খুন করেছে দুষ্কৃতীরা। দুষ্কৃতীদের কোনও ধর্ম নেই, ঘাতক হওয়া ছাড়া। ব্রিগেডের ধর্ম আছে। বরাবর ছিল—প্রতিবাদের অঝোর ধারায় বিভাজন ধুইয়ে দেওয়াই সেই ময়দানের ঐতিহ্য।

ব্রিগেড ধারক হোক একতার, সংগ্রামের—বিভাজনের বিরুদ্ধে। ব্রিগেড বৃষ্টি এবং  আরোহীর জন্য সোচ্চার হোক। হিন্দু আর মুসলমানের নামে ভেদাভেদের ধান্দার বিরুদ্ধে ২০শে এপ্রিলের ব্রিগেডে একত্রিত হোক জনতার সংহতি। কারণ— সময়ের দাবি তাই। ২৫, ৭৫২জন শিক্ষক, শিক্ষাকর্মীর চাকরি হারানোর যন্ত্রণা আর সরকারি ব্যর্থতা, তৃণমূলের চুরি যখন ভুলিয়ে দেওয়ার চেষ্টা হয়েছে খুনীদের ধর্মীয় পরিচয়ে, তখন ব্রিগেডেই চিৎকার করে বলতে হবে—মানুষ বিপন্ন, জীবন-জীবিকা বিপন্ন। কাজ দাও।

মেহনতিদের চারটি সংগঠন সেই সমাবেশের আহ্বান জানিয়েছে। সিআইটিইউ, কৃষক সভা, খেতমজুর ইউনিয়ন এবং বস্তি ফেডারেশন এই ব্রিগেড সমাবেশের আয়োজক। আয়োজক তারাই আছেন। কিন্তু মেহনতিদের ঘিরে সমাজের সব অংশের মানুষের হাজির থাকার ডাক দিয়েছে সময়। সময়ের দাবিই আজকের দাবি।

যেখানে পুলিশের গুলিতে লুটিয়ে পড়েছিলেন একুশ বছরের ইজাজ আহম্মেদ, সেই সাজুর মোড়ের কাছেই বাসুদেবপুর। ইজাজের রক্তে লাল হয়েছিল জাতীয় সড়ক। সেই জাতীয় সড়কের ধারে, বাসুদেবপুরে, লাল রঙের দেওয়াল লিখন হয়েছিল হাঙ্গামার আগে—‘২০শে এপ্রিল ব্রিগেড চলো।’ রমজানের জন্য ইজাজের পাড়া, কাশিমনগরের অনেক যুবক ফিরে এসেছেন ভিন রাজ্যের কাজ থেকে ছুটি নিয়ে। সমর্থ দাস রয়ে গেছেন তামিলনাডুতে। তিনি জাফরাবাদে নিহত চন্দন দাসের ভাই। তিনিও ইজাজের বন্ধুদের মতো পরিযায়ী শ্রমিক। তাঁর ফেরার কথা ছিল আগামী শারদীয়ার আগে। তাঁকে এখনই ফিরতে হচ্ছে— বাবা, ভাইয়ের খুন হয়ে যাওয়ার সংবাদ পেয়ে।

ইজাজের বন্ধুরা, কাশিমনগরের যুবকরা আর জাফরাবাদের বাঙালিপাড়ার সমর্থ দাসের মধ্যে প্রভেদ কিছুই নেই। রক্তের রঙ এক, ব্লাড গ্রুপও মিলে যেতে পারে। আর পশ্চিমবঙ্গে কাজ না পেয়ে তাঁরা সবাই ভিনরাজ্যের শস্তা শ্রম।

এবারের ব্রিগেড কাজের দাবিতে। এবারের ব্রিগেড ইজাজের বন্ধু আর সমর্থ দাসের পরিবারের মধ্যে মাথা তুলতে থাকা কাঁটতার উপড়ে দেওয়ার লক্ষ্যে। শ্রমজীবীদের দাবি, যুবকের কাজের দাবি আর সাম্প্রদায়িকতার মাথা এখনই ভেঙে দেওয়ার তাগিদে এবারের ব্রিগেড সমাবেশ।

হাঙ্গামা হয়েছে জঙ্গিপুরে। ৩জন নিহত হয়েছেন। লুট, তান্ডব করেছে দুষ্কৃতীরা। ঘটনার চেহারা দেওয়া হয়েছে ধর্মীয় মোড়কে। ধর্মীয় পরিচয়ের ভিত্তিতে ভাগাভাগির অঙ্ক জঙ্গিপুরে আটকে থাকেনি। ছড়িয়েছে মুর্শিদাবাদে, লাগোয়া মালদহে। পরিবেশ বলছে এই মেরুকরণ ছড়াচ্ছে সারা বাংলায়— কোচবিহার কিংবা গোসাবা, বাইরে নয় কোনও এলাকা।

এই মেরুকরণের হিসাবকে চ্যালেঞ্জ জানাতে হবে। পাল্‌টা জবাব দিতে হবে। দায়িত্ব সেই ব্রিগেডের। ব্রিগেডকে জিততে হবে। জিততেই হবে।

চারটি সংগঠনের পক্ষ থেকে ব্রিগেড সমাবেশ আয়োজনের ঘোষণা করা হয়েছিল বেশ কয়েক মাস আগে। এর মাঝে রামনবমী হয়েছে। রামনবমীর মিছিলের আগে থেকেই উত্তেজনা ছড়িয়েছিল রাজ্যের বেশ কিছু এলাকায়। তার মধ্যে হুগলী, হাওড়া, পশ্চিম বর্ধমানের শিল্পাঞ্চলের কিছু এলাকায় উত্তেজনার মাত্রা ছিল কিছু বেশি। রামনবমীর আগে উলুবেড়িয়ায় আরএসএস-এর স্কুলে বিজেপি’র নেতাদের সঙ্গে বৈঠক করেছিলেন সঙ্ঘের নেতারা। সেখানে রাজ্যের সমাজকে হিন্দু এবং মুসলমানে শক্তপোক্ত ভাবে ভেঙে ফেলার নকশা আলোচিত হয়েছিল। সঙ্ঘের অখিল ভারতীয় প্রতিনিধি সভার বৈঠক হয়েছে ব্যাঙ্গালোরে তার পর, গত মার্চে। সেখানে হিন্দু যুবকদের কাজের অভাব নিয়ে আলোচনা হয়নি। প্রস্তাব নেওয়া হয়েছে ‘বাংলাদেশে হিন্দুদের উপর অত্যাচারে উদ্বেগ’ জানিয়ে।

দেশভাগের যে ক্ষত মুছতে দেওয়া হয় না আমাদের দেশে, সেই আঘাত নিয়ে বাঙালিরা বেঁচে আছেন শিল্পাঞ্চলে, গ্রামে, কলোনী এলাকায়, বস্তিতে। আবার মুর্শিদাবাদ, মালদহের সীমান্ত এলাকা থেকে রাজ্যের শিল্পাঞ্চল, কলোনীগুলিতে, শহরের বস্তিতে কিংবা গ্রামগুলিতে প্রতিদিন শ্রমজীবী, কৃষিজীবী, কর্মহীন কিংবা চুক্তিতে কাজ করতে বাধ্য হওয়া যুব, ছাত্ররা লড়াই করছেন টিকে থাকার। সেই লড়াইয়ে ধর্মের ভেদাভেদ নেই। সেই লড়াই রক্তের মতো—এক, অবিভাজ্য। সঙ্ঘ এবং কিছু ইসলামের নামে ভুল বোঝানো মৌলবাদী শক্তি এখনই ফের ‘৪৬-এর ক্ষত’ জাগিয়ে তোলার পক্ষে। বিপরীতে সব মেহনতি এবং কর্মক্ষমদের ঐক্যবদ্ধ লড়াই দাবি করছে দেশ। সেই লড়াই কেন্দ্রীয় সরকার এবং রাজ্য সরকারের আর্থিক নীতিগুলির বিরুদ্ধে। ‘৪৬-এর ক্ষত’ সেই লড়াইকে ভাঙতে চায় মোদী, মমতা ব্যানার্জির শাসন টিকিয়ে রাখতে।

অর্থাৎ মুখোমুখি দেশের স্বার্থ এবং আদানি, আম্বানিদের স্বার্থ।

দেশের জন্য ব্রিগেড সমাবেশ। ধান্দার জন্য জঙ্গিপুরের আগুন। লড়াই এখন দুটি পক্ষের। ময়দান? সেই ঐতিহাসিক ব্রিগেড প্যারেড গ্রাউন্ড।

Spread the word