Swami Vivekananda: The Memoir

প্রাককথন

নরেন্দ্রনাথ দত্ত যিনি পরে স্বামী বিবেকানন্দ হিসাবে পরিচিত হন, ভুপেন্দ্রনাথ দত্ত তারই ছোট ভাই। ১৮৯৮ সালে এন্ট্রান্স পাস করার পরই সশস্ত্র বিপ্লবপন্থায় দীক্ষিত হন। এ পথে সক্রিয় হয়ে উঠতে তার উপর ভগিনী নিবেদিতার বিশেষ প্রভাব ছিল। ১৯০৬, যুগান্তর পত্রিকার সম্পাদকের দায়িত্ব নেন। ১৯০৭ সালে সেই পত্রিকায় রাজদ্রোহমূলক রচনা প্রকাশিত হওয়ার অপরাধে তার কারাদন্ড হয়। জেলে থাকতেই খবর পান মুক্তি পরেই তাকে পুনরায় গ্রেপ্তার করা হবে। ভগিনী নিবেদিতা তাকে গোপনে আমেরিকা পাঠিয়ে দেওয়ার বন্দোবস্ত করেন। আমেরিকার ব্রাউন বিশ্ববিদ্যালয় থেকে এম এ , পরে জার্মানির হামবুর্গ বিশ্ববিদ্যালয় থেকে নৃতত্ত্বে ডক্টরেট হয়ে দেশে ফেরেন।

বিদেশে অধ্যয়নের সময়ই মার্কসবাদ সম্পর্কে আগ্রহ, গভীর চর্চার মধ্যে দিয়ে নিজেকে মার্কসবাদী হিসাবে গড়ে নেন। জার্মানিতে প্রবাসী ভারতীয় বিপ্লবীদের সংগঠন বার্লিন কমিটির সাথে যুক্ত ছিলেন। একাধিক বিদেশী পত্রিকায় মার্কসীয় সমাজবাদ প্রসঙ্গে বহু প্রবন্ধ লেখেন। ভারতে ফিরে এসে কৃষকসভা, শ্রমিক সংগঠন ও মার্কসবাদী তত্ত্বের প্রসারে নিজেকে নিয়োজিত করেন। তার রচনা ‘ডায়ালেক্টিক্স অফ ল্যান্ড ইকোনমিক্স অফ ইন্ডিয়া’ ভারতে কৃষিব্যবস্থা সম্পর্কে জানতে আগ্রহীদের জন্য আজও অবশ্যপাঠ্য। বইটি লিখতে জরুরী তথ্য সংগ্রহের জন্য তিনি কৃষকসভার সংগঠনকেই কাজে লাগিয়েছিলেন। এছাড়াও তার লেখা ‘অপ্রকাশিত রাজনৈতিক ইতিহাস’ বইটিও কমিউনিস্ট পার্টির কর্মীদের জন্য জরুরী বইগুলির একটি।

সমাজবিজ্ঞান, নৃতত্ত্ব, ইতিহাস, সাহিত্য, ভারতীয় শিল্প ও সংস্কৃতি, আইন, অর্থনীতি, মার্কসীয় দর্শন প্রভুত বিষয়ে তিনি ছিলেন রীতিমত পন্ডিত। ভারতে কমিউনিস্ট আন্দোলনে তার অনেক অবদানের মধ্যে অন্যতম একটি হল পার্টির জন্য উপযুক্ত কর্মী খুঁজে বের করে তাদের যথাযথ ট্রেনিং-র বন্দোবস্ত করা। সরোজ মুখার্জি, বিনয় চৌধুরী, সোমনাথ লাহিড়ী- এরা প্রত্যেকেই তার সেই ট্রেনিং স্কুলের মাধ্যমে পার্টিতে ‘আসেন’।

ডঃ ভূপেন্দ্রনাথ দত্তের লেখা ‘স্বামী বিবেকানন্দ’ বইটির বিভিন্ন পাতা থেকে প্রাসঙ্গিক কতগুলি অংশ বাছাই করে এই প্রতিবেদনে একজায়গায় সাজিয়ে দেওয়া হল। মূল বইটি পড়ার উৎসাহ বাড়ানোই আমাদের উদ্দেশ্য। সাম্প্রদায়িক রাজনীতির আবহে যখন দেশের যাবতীয় ইতিহাস ও ঐতিহ্যকে গুলিয়ে দেওয়া হচ্ছে তখন প্রকৃত ইতিহাস ও ঐতিহাসিক ব্যক্তিত্বসমুহের মূল্যায়নকে মানুষের সামনে তুলে ধরার কাজটিও আমাদেরই কাজ, পার্টির কাজ।

ভূপেন্দ্রনাথ দত্ত

অত্যুজ্জ্বল ভবিষ্যতের স্বপ্ন দেখেছিলেন কলকাতারই এক যুবক সন্ন্যাসী

মায়া এবং আধ্যাত্মবাদের বদ্ধ কিনারায় নিয়ে গিয়ে বিবেকানন্দের গোটা জীবনকেই যখন দক্ষিনপন্থী, গোঁড়া, পশ্চাদপদ মতবাদের হাতিয়ার হিসাবে দেশের মানুষের বিরুদ্ধে কাজে লাগানোর দুষ্কর্ম চলছে সেই সময় ভূপেন্দ্রনাথ দত্তের লেখা এই বইটি আজকের প্রজন্মের জন্য অন্ধকারের মাঝে এক আলোকবর্তিকা হতে পারে। ভারতের এবং আরও নির্দিষ্ট করে বললে ভারতবাসীদের দুর্দশা, নিপীড়ন দেখে যার হৃদয় আর্দ্র হয়েছিল এবং যে বিবেকানন্দ সেই দুঃখের মুক্তি সন্ধানে গুহাবাসী হবার পরামর্শ না দিয়ে ফুটবল খেলে শক্তসমর্থ হবার নির্দেশ দিয়েছিলেন, সাহস করে মাথা তুলে দাঁড়ানোর কথা বলেছিলেন সেই মানুষটি ঠিক কেমন ছিলেন সেকথা আজকের প্রজন্মের কাছে স্পষ্ট হতেই হবে।

“তোমাদের সামনে একটিমাত্র সমস্যা, জনসাধারণকে তাদের অধিকার দান … তোমরা জনগনকে অর্থহীন বাজে বুকনি দিয়ে ভুলিয়ে রেখেছ”

বিবেকানন্দ গ্রন্থাবলী (ইং), ৭ম খন্ড, পৃঃ ১৫৩

উক্তিটির সাথে যার সম্যক পরিচয় নেই, তার মনে হতেই পারে একথা কি করে একজন সর্বত্যাগী সন্ন্যাসী বলতে পারে? ২০২১ সালের ভারতে এধরণের উচ্চারণমাত্র বক্তাকে বিকাশ বিরোধী বলে তকমা দিয়ে দেওয়া হবে। আজ থেকে একশো বছরেরও বেশি সময় আগে বিবেকানন্দ এই কথা বলে গেছেন, যতই চেষ্টা হোক তার নামকে ব্যবহার করে মিস্টিসিজমকে জনমানসে ছড়িয়ে দেওয়ার – বিবেকানন্দের সন্ন্যাস আজও ভারতে দারিদ্রজর্জর, নিপীড়িত মানুষের দুঃখ কষ্টের সম্যক এবং বাস্তবসম্মত মুক্তির লক্ষ্যে এক প্রেরণা। সংসার ত্যাগ করে – বাস্তবের পৃথিবী থেকে মুখ ফিরিয়ে একা একক ব্যাক্তির উন্নতিকল্পে ধর্মাচরণের স্বার্থপর, নির্লজ্জ অভ্যাসের বিরুদ্ধে এক স্পষ্ট বিপ্লব।

আবহমানকাল থেকে ভারতের যে উচ্চশ্রেণীর লোকেরা শ্রমজীবী জনগনকে শোষণ করে এসেছেন স্বামীজি তাদের কাজ এবং চিন্তাধারার তীব্র নিন্দা করেছেন। তিনি দেখিয়েছিলেন যে, তাদের কৃতকর্মের প্রতিশোধ গৃহীত হয়েছে। উচ্চ থেকে নীচ সমস্ত ভারতবাসীই এখন বিদেশী শাসকের দাসে পরিণত। ভারতীয় সমাজের এই দুরবস্থা এবং পৃথিবীর অন্যান্য দেশের সর্বহারাদের অধঃপতিত দুর্ভাগ্যের কথা স্মরণ করে তিনি ভবিষ্যদ্বাণী করেছিলেন। ‘তবুও এমন একদিন আসবে যেদিন শূদ্রত্ব বিয়েই শুদ্রশ্রেণীর জাগরন হবে… তারা প্রত্যেক সমাজেই পরিপূর্ণ কর্তৃত্ব লাভ করবে।’ ….

ভারতীয় জনগণের কানের কাছে সব সময়েইএই কথা বলা হয়ে থাকে যে, ভারতবর্ষ একটা আধ্যাত্মিক দেশ এবং আদিযুগ থেকেই ‘অহিংসা’ মন্ত্রে সে দীক্ষিত। কিন্তু রাজনৈতিক, সামাজিক এবং অর্থনৈতিক শোষণের বেলায় এই অহিংসা কোথায়? বর্তমান ভারতীয় সমাজে আধ্যাত্মিকতাই বা কোথায় সে সম্পর্কে স্বামীজি বলেছেন, “তোমরা কি দেখতে পাচ্ছ না যে সত্ত্বগুণের ধুয়া তুলে দেশ ধীরে ধীরে তমোগুণ বা অজ্ঞতার সমুদ্রে তলিয়ে যাচ্ছে।”

ইতিহাস বলে যে অনেক হিন্দু সম্রাট ও বিজয়ী বীরই ছিলেন শুদ্র। কিন্তু তাদের সম্রাটত্ব প্রাপ্তির ফলেও ভারতের শ্রমজীবী জনগণের ভাগ্যের কোন উন্নতি হয় নি। অপরপক্ষে, বংশতালিকা প্রস্তুত করে তারা নিজেদের সূর্য কিংবা চন্দ্রবংশবতংস প্রতিপন্ন করবারই চেষ্টা করেছেন। শুদ্র বা নিম্নতরশ্রেণীর ব্যাক্তিদের নিছক ব্যাক্তিগত উন্নতির দ্বারা ভারতের শোষিত ও নিপীড়িত শ্রেণীর অবস্থার কোন উন্নতিসাধন হল না। সেই বিজয়ীরা নিজেদের বাহুবলে কেবলমাত্র নিজেদের উন্নতিসাধন করেছিলেন। তারা নিজেদের শ্রেণীকে উন্নত করেন নি।

তিনি ভৎসনার সুরে বলেছেন “বেদান্তের জন্মস্থান আমাদের দেশেই যুগযুগান্ত ধরে আমাদের জনগন মোহাচ্ছন্ন আছে। তাদের স্পর্শ করা অপবিত্রতা, তাদের সঙ্গে উপবেশন করা অপবিত্রতা। অন্ত্যজ হয়ে তারা জন্মেছে, অন্ত্যজ হয়েই তারা থাকবে।” পরিশেষে তিনি কার্যসূচী দিয়ে বলেছেন, “আমি আবার তোমাদের স্মরণ করিয়ে দিতে ছাই এখানেই রয়েছে বাস্তব কাজের প্রয়োজনীয়তা এবং তার প্রথম অংশই হচ্ছে তোমাকে যেতে হবে ভারতের নিমজ্জমান লক্ষ লক্ষ জনগণের কাছে এবং তাদের তুলতে হবে হাত ধরে।”… তিনি আরও বলেছেন, “জনগণের কাছ থেকেই ভারতের একমাত্র আশা। উচ্চশ্রেনীর লোকেরা শারীরিক এবং নৈতিক উভয় দিক দিয়েই মৃত।”

বিবেকানন্দ গ্রন্থাবলী (ইং), ৫ম খন্ড, পৃঃ ৮১

ধর্মমত সম্পর্কে ১৮৯৪ সালে বিবেকানন্দের চিঠিতে উল্লেখ “আমিষাশী ক্ষত্রিয়দের কথা তুমি বলছ; আমিষ কিংবা নিরামিষ যাই হোক না কেন, হিন্দুধর্মের যা কিছু মহৎ এবং সুন্দর তারাই তার স্রস্টা! কে উপনিষদ প্রনয়ন করেছিল? রাম কে? কৃষ্ণ কে ? কে-ই বা বুদ্ধ এবং জৈন তীর্থঙ্করবৃন্দ? ক্ষত্রিয়রা যখনই ধর্মপ্রচার করেছেন তখনই তারা তা’ সর্বসাধারণের মধ্যে বিলিয়ে দিয়েছেন। ব্রাহ্মনেরা যখনই কিছু প্রনয়ন করেছেন, অন্যদের সে জ্ঞান থেকে তারা বঞ্চিত করে রেখেছেন। গীতা কিংবা ব্যাসদেবের সুত্রগুলো পাঠ করো। গিতায় সমস্ত নরনারীর জন্যই দ্বার উন্মুক্ত, জাতিবর্ণ ভেদাভেদ সেখানে নেই। কিন্তু ব্যাসদেব বেদের এমন ভাষ্য করেছেন যাতে দরিদ্র শুদ্রগন প্রতারিত হয়। ভগবান কি তোমার মতো নির্বোধ যে এক টুকরো মাংসের দ্বারা তার করুনা ধারায় গতি ব্যাহত হবে? যদি তিনি তাই হন তাহলে তাঁর মূল্য কানাকড়িও নয়!” …… সমাজ থেকে ধর্মকে দূরে থাকবার নির্দেশ প্রচার করো। তাহলেই সমস্ত অন্যায় দূর হবে”।

“আমার আন্দোলনের পরিকল্পনা” বক্তৃতায় স্বামীজি বলেছেনঃ সংস্কারকদের আমি বলবো, আমি তাদের যেকোনো জনের চেয়ে বড় সংস্কারক। তাঁরা কিছু কিছু সংস্কার করতে চান। আমি চাই আমূল সংস্কার। আমাদের পার্থক্য হলো কর্মপদ্ধতিতে।

ভারতের অভ্যন্তরে জাতীয় আদর্শ নিয়ে সংশয় রয়েছে। সৃজনশীল নব-ভারতের সুস্পস্ট ভাবাদরশ কেউ তুলে ধরতে পারছেন না। কেউ বলেন, আমরা সুদূর প্রাচীন জীবনের সমাজ ব্যাবস্থায় ফিরে যাব ; কেউ বলেন ভারতবর্ষ হবে সোভিয়েট রাশিয়ার একটি অনুকৃতি; কেউ-বা বলেন, আমেরিকার। এই বুদ্ধি বিভ্রান্তির প্রতিক্রিয়াস্বরূপ নব ভারতীয় জাতির জনক মহাত্মা গান্ধীকে জীবন বিসর্জন দিতে হল ধর্মান্ধ রাজনীতিক আততায়ীর হস্তে।

বাংলাদেশে যুব – আন্দোলন যখন ছিল প্রবল, সে সময়ে আমার তরুন সহকর্মীদের অনুরোধে ১৯২৮-২৯ খৃষ্টাব্দে তাদের কার্যে সহায়তা ও পরিচালনার উদ্দেশ্যে ইংরেজিতে সোশ্যালিস্ট বিবেকানন্দ নামে একটি ছোট্ট বই লিখেছিলাম। ১৯০২-১৯১৬ খৃষ্টাব্দে বাংলার ও বাংলার বাইরের তরুন বিপ্লবীদের প্রেরণার উৎসই ছিল স্বামীজির বিভিন্ন বানী। তাই গণসমূহের উন্নতিসাধন ও তাদের সেবাকার্যের জন্য স্বামীজি ভারতের তরুন সমাজের প্রতি যে আবেদন জানিয়ে গেছেন তা উৎসাহী তরুন কর্মীদের শ্রমিক ও কৃষক সংগঠনের কার্যেও অনুপ্রাণিত করতে পারে। এই উদ্দেশ্য নিয়েই গণ – আন্দোলন সম্পর্কে তার বানী ও উক্তিসমূহ একত্র করে উপরোক্ত নামে পুস্তকটি প্রকাশ করা হয়; উক্ত নামকরণ দেখে প্রাচীনপন্থীরা ব্যঙ্গোক্তি করেন, কারন তারা স্বামীজিকে মরমী (মিস্টিক) ও রক্ষনশীল প্রাচীনপন্থী হিন্দু বলেই মনে করতেন। কিন্তু বইটি গণ – আন্দোলনে নিযুক্ত তরুণ কর্মীদের মধ্যে চাঞ্চল্য সৃষ্টি করে। তারা স্বামীজির উক্তির মধ্যে নিজেদের কর্মপন্থার সমর্থন পেয়েছিলেন – যে রকম প্রেরণা পেতেন এর আগেকার দশকের জাতীয় বিপ্লবীরা।

স্বামীজী এই সত্যে উপনীত হয়েছিলেন যে, ভারতীয় জনগণকে যদি তাদের অধঃপতিত অবস্থা থেকে উন্নীত করা না যায় তা’হলে নবভারত গঠনের কোন আশাই আর নেই। তিনি সমস্ত চিঠিপত্রেই এই সত্যের ওপর জোর দিয়েছেন। তিনি চাইতেন সকল মানুষের মধ্যে সাম্য, সকলের সমান সুযোগ। বিদেশী সাম্রাজ্যবাদীদের দ্বারা শোষিত পুরোহিততন্ত্রের দেশে তিনি সকল মানুষের সাম্য ঘোষণা করেছিলেন। তিনি অস্বীকার করেছিলেন শ্রেণী-প্রাধান্য। তিনি বলতেন, জন্ম কিছু নয়, পরিবেশই সব। কিন্তু তাঁর এই আবেদন সেদিন ব্যর্থ হয়েছিল। আধুনিক ভারতে তিনি হলেন সোস্যাল ডেমোক্সাসীর অগ্রদূত। ভারতীয়দের মধ্যে তিনিই প্রথম নিজেকে সোস্যালিস্ট বলে অভিহিত করেছিলেন। ৩০ তিনি ছিলেন নবভারতের নবযাত্রী। কিন্তু তৎকালীন ভারতীয় বৃদ্ধিজীবীরা স্বামীজীর পরিকল্পিত নতুন সমাজ-ব্যবস্থার সার্থকতা উপলব্ধি করতে পারেন নি। কতিপয় আমূল সংস্কারবাদী বৃদ্ধিজীবী ব্যতীত বুর্জোয়া ডেমোক্সাসীর আদর্শও সকলের কাছে সুস্পষ্ট ছিল না। তাঁদের শাসক সম্প্রদায়ও তখন অন্ধকারে পথ হাতড়াচ্ছেন। তাঁদের প্রবর্তিত শিক্ষাপদ্ধতিও ছিল প্রতিক্রিয়াশীল। কোনোদিকেই আলোর কোনো ইঙ্গিত তখন দেখা যায়নি। জনসাধারণের মধ্যে রাজনীতিক চেতনা অনুপস্থিত; জাতীয়তাবাদী বুর্জোয়াদের উদারনৈতিক অংশের যে সমস্ত ব‍্যক্তি- গণের প্রচেষ্টায় জাতীয় কংগ্রেসের প্রতিষ্ঠা তাঁদেরও নিজেদের আদর্শ সম্পর্কে একটা খুব সুস্পষ্ট স্বচ্ছ ধারণা ছিল না। অবশ্য পরবর্তীকালে তাঁরা বুর্জোয়া- গণতান্ত্রিক রাষ্ট্র চেয়েছিলেন। কিন্তু তার অর্থ তাঁদের কাছে পরিষ্কার ছিল না। এমন কি, এখনও আমাদের বুদ্ধিজীবী সম্প্রদায়ের অধিকাংশের কাছেই বুর্জোয়া গণতান্ত্রিক বিপ্লবের কার্যক্রম সুস্পষ্ট নয়। তাই আজ জাতীয় পার্লামেন্টে যে- কোন সামাজিক অর্থনীতিক পরিবর্তনকামী আইনেরই বিরোধিতা আমরা প্রত্যক্ষ করছি। এখনই যদি এরূপ দৃষ্টিভঙ্গি বর্তমান থাকে, তাহলে অর্ধশতাব্দী পূর্বে জনসাধারণের মন কিরূপ সংস্কারাচ্ছন্ন অন্ধকার ছিল তা সহজেই অনুমেয়! তমসাচ্ছন্ন দেশ ভারতবর্ষে স্বামী বিবেকানন্দ যথাসময়ের অনেক আগেই জন্মেছিলেন।

কার্ল মার্কস বলেছেন, যেখানে সমৃদ্ধিশালী বুর্জোয়া সমাজের অস্তিত্ব আছে সেখানে সর্বহারা শ্রেণীরাও সমৃদ্ধিশালী হয়। সমাজের এরূপ প্রত্যেক শ্রেণীর সংস্কৃতি ও প্রগতি পরস্পর সংশ্লিষ্ট। অর্ধ শতাব্দী পূর্বে পাশ্চাত্যের জনসাধারণের অবস্থাও খুব উন্নততর ছিল না। পশ্চিম ইউরোপের জনগণের মধ্যেও শ্রেণী-চেতনা পূর্বে খুব অল্পই বর্তমান ছিল। সোস্যাল ডেমোক্র্যাসীর তখন সংস্কারের যুগ। ইংলণ্ড তার বিস্তৃত সাম্রাজ্য শোষণের ফলে উদ্ভূত উদ্বৃত্ত মূল্যের মুনাফা ভোগে নিমগ্ন। ফ্রান্সও সাম্রাজ্য প্রসারে ব্যস্ত। সে সময়ে একমাত্র জার্মানীই শিল্পনৈতিক শক্তি হিসেবে নিজেকে গড়ে তুলছিল। তাই প্রাচীন সমাজ- ব্যবস্থার বিরুদ্ধে বৃদ্ধিজীবীদের বিদ্রোহের প্রথম সূত্রপাত হল জার্মানীতে।

রাশিয়া সে সময়ে জার-শাসিত কৃষিপ্রধান দেশ। বৃদ্ধিজীবীরা সেই সামন্ততান্ত্রিক বেড়াজাল ভেদ করে আধা-বর্ব’র সভ্যতার অধ্যায় থেকে মুক্তির পথ সন্ধান করছিল।’ তাই সেখানে বুদ্ধিজীবী মহলে ক্রমাগত এক অসন্তোষ পুঞ্জীভূত হচ্ছিল। কিন্তু সে আলোড়ন বৈষয়িক ক্ষেত্রে তখনও প্রতিফলিত হয়নি। কতিপয় সন্ত্রাস- বাদী প্রচেষ্টাতেই তরুণ দেশপ্রেমিকদের কার্যক্রম নিবন্ধ ছিল। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র ছিল তখন তার প্রচুর সম্ভবনাময় আত্মকেন্দ্রিক এক সমৃদ্ধিশালী দেশ। সংস্কার- পন্থী আদর্শবাদী চিন্তানায়ক ছিলেন এমার্সন ও ওয়াল্ট হুইটম্যান।

এশিয়ার অবস্থা তখন আরও শোচনীয়। তুরস্ক তার ধর্মীয় সামন্ততান্ত্রিক রাষ্ট্র-কাঠামো নিয়ে ‘ইউরোপের রুগ্ন মানুষ’ রূপে পরিগণিত। জাপান বহু শতাব্দী সামন্ততান্ত্রিক সামরিকশ্রেণীর শাসনে আবদ্ধ থেকে সমরবাদী জার্মানীর পদাঙ্ক অনুসরণ করতে লাগল। স্বৈরাচারী মানুদের দ্বারা শাসিত চীন পাশ্চাত্যের লুব্ধ গৃধিনীদের করতলগত। স্বামীজীর ভাষায় তখন ‘চীন এক অসংবন্ধ জনতা। ৩৩ কিন্তু স্বামীজী লন্ডনে যাবার সময়েই এই নিদ্রিত জাতির সুপ্তি- ভঙ্গের প্রথম লক্ষণ বহির্বিশ্বে গিয়ে পৌঁছল। লন্ডনস্থ চীনা দূতাবাসে অন্তরীণ এক চীনা বিপ্লবীকে উদ্ধার করে আনলো লন্ডনের পুলিশ। তিনিই হলেন সুন্ ইয়াৎ সেন।

আমেরিকায় সাদর অভ্যর্থনা লাভ করে স্বামীজীর এই ধারণা হয়েছিল যে, আমেরিকাই সেই দেশ যেখানে প্রাচ্য ও পাশ্চাত্যের সম্মিলন সম্ভব হবে। কিন্তু রোমাঁ রোলাঁর ভাষায়, তিনি এ-বিষয়ে মোহমুক্ত হয়েছিলেন। তারপর তাঁর দৃষ্টি নিবন্ধ হল রাশিয়া এবং চীনের ওপর, ব্যক্তিগতভাবে রাশিয়াকে দেখবার জন্য তিনি সেখানে যেতে চেয়েছিলেন। কিন্তু দ্বিতীয়বার ইউরোপ পরিভ্রমণে গিয়ে তিনি আর সে সংকল্প সিদ্ধ করতে পারেননি।

ভারতীয় চিন্তাজগতে আমরা এক ধরণের রহস্যবাদ থেকে যাচ্ছি অন্য এক রহস্যবাদে, এক কুসংস্কার থেকে অন্য কুসংস্কারে, এক ধরণের ধর্মোন্মত্ততা থেকে আরেক ধরণের ধর্মোন্মাদনায়, এক গোঁড়ামি থেকে ওপর গোঁড়ামিতে। ভারতের সমাজের কাঠামোতে প্রতিনিয়তই যে বস্তুবাদী পরিবর্তন সাধিত হচ্ছে সে সম্পর্কে কেউ সচেতন নন। বেদান্তের দেশে জ্ঞানবাদ কেউ বুঝল না! তাই সকলেই সনাতনের বুলি আওড়াচ্ছেন।

ভারতীয় জাতীয়তাবাদ-এর নামে যে সমস্ত ভারতীয় জাতীয়তাবাদী স্বামীজির নাম ব্যবহারের সুযোগ নিয়ে থাকেন তারা ভারতের সমস্যাবলী সম্পর্কে স্বামীজির বক্তব্য স্মরণে রাখবেন; অভিজাতশ্রেনীর দ্বারা ভারতীয় জনগণের শোষণ ব্যবস্থাকে স্বামীজি তীব্র ভাষায় নিন্দা করেছেন এবং যারা জনতাকে পদদলিত রাখতে যুক্তিতর্কের অবতারনা করেছেন তাদের বক্তব্যকে তিনি ‘দানবীয় ও বর্বর’ আখ্যা দিয়েছিলেন। তিনি বলেছিলেন, “দেশপ্রেমিক হবার প্রথম সোপান হল ক্ষুধার্ত জনগণের প্রতি সহমর্মিতা।” তিনি সুস্পস্ট ভাষায় ব্যক্ত করেছিলেন “কারো জন্য বিশেষ সুবিধা থাকবে না, সকলের সমান সুযোগ। তরুণ সমাজকে এই সামাজিক জাগরনের বানী, সাম্যের বানী প্রচার করতে হবে”।

ওয়েবডেস্কের পক্ষে প্রাককথন সৌভিক ঘোষ

ব্যবহৃত ছবি সোশ্যাল মিডিয়া সুত্রে সংগৃহীত

Spread the word

Leave a Reply