দীপ্তজিৎ দাস
‘নাগিনীরা চারিদিকে ফেলিতেছে বিষাক্ত নিঃশ্বাস,
শান্তির ললিত বাণী শোনাইবে ব্যর্থ পরিহাস’
শান্তির ললিত বাণীর অভিলাষ মানুষের সর্বদা।সমাজবদ্ধ মানুষ বিভক্ত হয় স্বার্থান্বেষীদের ছলে। ধরণীর বুকে জ্বলে ওঠে যুদ্ধের লেলিহান শিখা। নিজ সহচরের রক্তে হাত রাঙায় মানুষ। যুদ্ধোন্মাদনা জাতির জীবনে ডেকে আনে অভিশাপ। আগ্রাসনের চোরাবালিতে বসে যায় অগ্রগতির চাকা।সাম্প্রতিক কালে দুই স্বৈরশাসকের গদির লড়াইয়ের শিকার হয়ে যুদ্ধ বিধ্বস্ত সুদান। লোহিত সাগরের তীরে কালো মানুষের মাটি আজ লোহিত বর্ণ মানুষের রক্তে।
বর্তমান যুদ্ধ পরিস্থিতি
সামরিক বাহিনী ও আধাসামরিক বাহিনীর ক্ষমতা দখলের লড়াই ডেকে এনেছে অযাচিত যুদ্ধ পরিস্থিতি।বর্তমান সুদানে সামরিক সরকারের প্রধান সামরিক বাহিনীর (Sudan Armed force) কমান্ডার আবদেল ফাত্তাহ আল বুরহান।অন্যদিকে তার ডেপুটির পদে আসীন আরএসএফ (Rapid support force) এর প্রধান মুহাম্মদ হামদান দাগালো ওরফে হেমেডটি।দুই বাহিনীর ক্ষমতার অলিন্দে নিজেদের প্রভাব বাড়ানোর নিকৃষ্ট প্রয়াসে বেজে উঠেছে যুদ্ধের দামামা। গত ১২ই এপ্রিল সামরিক বাহিনীর খার্তুমের বায়ুসেনা ঘাঁটি প্রায় একশো সমরযান দিয়ে ঘিরে ফেলে আরএসএফ। ১৫ই এপ্রিল থেকে উভয়পক্ষের মধ্যে শুরু হয় গুলির লড়াই।শুরুতে আরএসএফ রাষ্ট্রপতি ভবন,সেনাপ্রধানের ভবন,খার্তুম বিমানবন্দর দখলের দাবি করে। পরে বুরহান শিবির পাল্টা প্রত্যাঘাতের কথা জানান দেয়।বারংবার বিভিন্ন বৈদেশিক শক্তির হস্তক্ষেপে যুদ্ধ বিরতির কথা ঘোষণা করলেও তা বাস্তবায়িত হয়নি।ধীরে ধীরে বারুদ বোমার ঝঙ্কার ছড়িয়ে পরতে থাকে ওমদুরমান ,দারফুর সহ অন্যান্য শহরেও।সুদানের ডাক্তারদের সংগঠনের বিবৃতি অনুযায়ী এখনও প্রায় ৭০০ জন নিরপরাধ সাধারণ মানুষ প্রাণ হারিয়েছেন যুদ্ধের গ্রাসে। প্রায় ৬০০০ মানুষ মৃত্যুর সাথে পাঞ্জা লড়ছেন ভয়াবহভাবে আক্রান্ত হয়ে।
সোনার দেশ সুদান জুড়ে এখন আর্তের কান্না।হাজারে হাজারে মানুষ প্রাণ বাঁচাতে দেশান্তরী হচ্ছেন। আলো,জল,বিদ্যুৎ,খবর,প্রয়োজনীয় ওষুধের অভাবে বাসিন্দাদের কাটাতে হচ্ছে নরক যন্ত্রণায়। রাস্তা জুড়ে দাপিয়ে বেড়াচ্ছে যুদ্ধের ট্যাংকার, নীল আকাশের দখল নিয়েছে যুদ্ধবিমান। এমনকি আরএসএফের একটি স্কোয়াড দ্বারা হাসপাতাল আক্রান্ত হওয়ার ঘটনাও নজরে এসেছে। দুর্ভিক্ষ ক্লিষ্ট সুদানে মানুষের খাওয়ারের হাহাকার মেটাতে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা নেয় ওয়ার্ল্ড ফুড প্রোগ্রাম। যুদ্ধ চলাকালীন একটি উন্মত্ত বাহিনী ঢুকে পড়ে তাদের অফিসে। ৩ জনকে খুন করে অফিসে ব্যাপক লুঠ চালায়।প্রতিক্রিয়ায় সুদানে সমস্ত খাদ্য সরবরাহ বন্ধ রয়েছে।দুই পক্ষের হিংস্রতার মাঝে গুলিবর্ষণ হয় তুরস্কের দূতাবাসের গাড়িতে। আরএসএফ দেশের প্রধান টিভি চ্যানেল সুদান টিভির অফিসও দখল করে নেয়। গত ৬ ই মে সৌদি আরবের জেদ্দায় মার্কিন সৌদি হস্তক্ষেপে দুপক্ষের মধ্যে প্রাথমিক কথাবার্তা হলেও সমাধান সূত্র এখনও অমিল।
গৃহযুদ্ধের নেপথ্য কারণ
প্রায় এক মাসব্যাপী যে রক্তক্ষয়ী সংঘর্ষ ছড়িয়ে পরেছে সুদান জুড়ে তার প্রধান কারণ দেশের ক্ষমতার দখল নিয়ে দুই সামরিক বাহিনীর বিপদ।২০১৯ সালে ওমর আল বশিরের ৩০ বছরের স্বৈরতন্ত্রের পতনের পর দেশে গনতন্ত্র প্রতিষ্ঠার যে প্রয়াস শুরু হয় তা মিলিটারি জেনারেলদের না পসন্দ।স্বাক্ষরিত চুক্তি অনুযায়ী আরএসএফকে সরাসরি সামরিক বাহিনীতে মিশিয়ে দেওয়ার সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়েছে।বুরহান শিবিরের প্রস্তাব অনুযায়ী আগামী ২ বছরের মধ্যে এই প্রক্রিয়া সম্পন্ন হবে।অন্যদিকে হেমেডটি গোষ্ঠীর দাবি এই প্রক্রিয়ার সম্পন্ন করতে ১০ বছরের সময় দিতে হবে।
তবে প্রকাশ্যে কেবল সময়ক্রমের কথা বললেও সংঘর্ষের প্রধান কারণ ক্ষমতার শ্রেণীবিন্যাস নিয়ে চাপানউতোর।কার্যত স্বায়ত্বশাসিত আরএসএফ সেনাবাহিনীতে মিশে গেলে সেনাবাহিনীর প্রধান কে হবে? আরএসএফ কে নিয়ন্ত্রণ করবে? এই প্রশ্নগুলোই হয়ে উঠেছে সুদানের মানুষের যুদ্ধযন্ত্রণার কারণ।প্রাকৃতিক সম্পদে ভরপুর সুদান।বুরহান এবং হেমেডটি উভয়ই প্রভূত সম্পদের অধিকারী। দেশের সোনার খনির দখল রাখা উভয়েরই আকাঙ্ক্ষা। চাদ সীমান্ত বরাবর উৎকৃষ্ট কৃষিজমির নিয়ন্ত্রণ নিজেদের হাতে রাখতেও তৎপর উভয় গোষ্ঠী।পাশাপাশি দেশে গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠার আশু কর্তব্য বিঘ্নিত করাও যুদ্ধোন্মাদনার প্রধান কারণ।বিগত ১লা এপ্রিল ক্ষমতা হস্তান্তরের জন্য অসামরিক দলগুলোর সাথে চুক্তি স্বাক্ষরের কথা থাকলেও যুদ্ধের অজুহাতে তা স্থগিত রয়েছে। সুদনিজ কমিউনিস্ট পার্টি আশঙ্কা প্রকাশ করেছে অনির্দিষ্টকালের জন্য ক্ষমতা হস্তান্তরের প্রক্রিয়া থামিয়ে রাখার জন্যই এই সামরিক অভিযানের আয়োজন।
আরএসএফ কি?
৮০ এর দশকে চাদ জুড়ে নিজেদের আধিপত্য বজায় রাখতে গদ্দাফির লিবিয়া পূর্ব চাদ অঞ্চলের আরব যাযাবর গোষ্ঠীকে প্রচুর অস্ত্র প্রদান করে ও নিজেদের নিয়ন্ত্রণে আনে। পাশাপাশি দারফুর অঞ্চলে চাদ সীমান্ত অঞ্চলে বসবাসকারী আব্বালা গোষ্ঠীকে অস্ত্র সজ্জিত করে সুদান সরকার। প্রধান উদ্দেশ্য ছিল এই অঞ্চল চাদের প্রভাব মুক্ত রাখা।পরবর্তীকালে সীমান্ত অঞ্চলের এই দুই গোষ্ঠী মিলে স্থাপন করে জানজাউইদ নামক সশস্ত্র দল।দারফুর এবং পূর্ব চাদ অঞ্চলজুড়ে একাধিক গ্রাম লুটপাট,কৃষকের জমি কেড়ে নেওয়া,বর্ণবিদ্বেষী হানাহানির একাধিক ঘটনা ঘটায় এই গোষ্ঠী। ২০০৩ সাল নাগাদ শাসক অমর আল বশিরের বিরুদ্ধে বিদ্রোহী হয়ে ওঠা দারফুরের মানুষজন। প্রধানত এই অঞ্চলের অআরবীয় জনজাতিগুলো দীর্ঘদিনের বঞ্চনার অভিযোগ থেকে সোচ্চার হয়ে ওঠে।আন্দোলনে নেতৃত্ব দেয় সুদানিজ পিপল লিবারেশন আর্মি ও জাস্টিস অ্যান্ড ইকুয়ালিটি মুভমেন্ট।বিপদ বুঝে এই সময় জানজাউইদকে ব্যবহার করে বশিরের সরকার। সরকারি অস্ত্রসজ্জিত হয়ে এই গোষ্ঠী এই সময় দারফুরজুড়ে বর্ণবৈষম্যমূলক গণহত্যা ও গণধর্ষণ চালিয়ে ২০০৩ থেকে ২০০৮ পর্যন্ত ৫ বছরে আনুমানিক ২ লক্ষ থেকে ৪ লক্ষ মানুষকে হত্যা করে।প্রায় ৪০ লক্ষ মানুষ ভিটেমাটি হারায়। পরবর্তীকালে এই ঘটনার জন্য বশির ও জানজাউইদের কমান্ডাররা আন্তর্জাতিক আদালতে দোষী সাব্যস্ত হন। জনজাউইদকে স্বীকৃতি প্রদানের জন্য বশির ২০১৩ সালে আরএসএফ (Rapid support force) নামক আধা সামরিক বাহিনী গঠন করেন ও জানজাউইদকে তার প্রধান অংশ হিসেবে অঙ্গীভূত করেন। প্রধানের পদে বসেন হেমেডটি।
সুদানের রাজনৈতিক ইতিহাস
১৮২০ নাগাদ মিশরের মুহাম্মদ আলি পাশ সুদান দখল করেন। ১৮৮৫ সালে মাহদির নেতৃত্বে সুদান মিশরীয় শাসন থেকে মুক্ত হয় পরবর্তী সময়ে খলিফার নেতৃত্বে ইথিওপিয়ায় সুদানের বিস্তৃতি ঘটে।কিন্তু ১৮৯৮ সালে লর্ড কিচনারের নেতৃত্বে ব্রিটিশ – মিশর সেনাবাহিনী সুদান দখল করে নেয়। এই সময় মিশর ছিল ব্রিটিশ সাম্রাজ্যের অংশ।সরাসরি নিজস্ব নিয়ন্ত্রণ স্থাপন না করে ব্রিটিশ ও মিশরের যৌথ নিয়ন্ত্রণ স্থাপন হয় এই অঞ্চলে। ১৯২২ এ মিশর স্বাধীন হলেও সুদানের শাসন একই ভাবে চলতে থাকে।ব্রিটিশ শাসনের উত্তর ও দক্ষিণ সুদান আলাদা অঞ্চল হিসেবেই পরিচালিত ছিল।উত্তর সুদানে ছিল প্রধানত আরব – ইসলামিকদের আধিপত্য,ভাষা ছিল আরবীয়।অন্যদিকে দক্ষিণ সুদান ছিল খ্রিস্টান সংখ্যাধিক্য ও তাদের ভাসে ছিল স্থানীয় উপজাতির।১৯৫৬ সালে সুদান স্বাধীন হলে উত্তর ও দক্ষিণ সুদান মিশিয়ে একটিই রাষ্ট্র গঠিত হয়।ভৌগোলিক সীমা অনুযায়ী সুদান ছিল আফ্রিকার বৃহত্তম দেশ।স্বাধীনতার পরবর্তী সময়ে সুদানে উত্তর ও দক্ষিণের লড়াই বারবার গৃহযুদ্ধের চেহারা নেয়। স্বাধীন দেশে ৮০০ টি সরকারি পদের মাত্র ৪ টি দেওয়া হয় দক্ষিণের মানুষদের। তার উপর বলপূর্বক দক্ষিণ সুদানে ইসলাম,আরবীয় সংস্কৃতি,ভাষা চাপিয়ে দেওয়ার প্রয়াস চালানো হয়। দক্ষিণ অঞ্চলের উৎকৃষ্ট তৈল খনির দখল নিজেদের কব্জায় রাখার জন্য দমন পীড়ন চালায় খার্তুমের শাসকরা। ১৯৫৫ থেকে ৭২ পর্যন্ত দীর্ঘ ১৭ বছরের গৃহযুদ্ধ জাতিকে অর্থনৈতিক ভাবে স্বনির্ভর হতে দেয়নি কখনও। ৭২ সালে আদ্দিস আবাবা চুক্তির মাধ্যমে দক্ষিণ সুদান স্বশাসন পেলেও ৮৩ থেকে পরিস্থিতি পুনরায় জটিল হয়ে ওঠে। ২২ বছরের দ্বিতীয় গৃহযুদ্ধের পর ২০০৫ সালে উত্তর ও দক্ষিণ সুদানের মধ্যে মার্কিন মধ্যস্থতায় শান্তি চুক্তি স্বাক্ষরিত হয়। ২০১১ সালের জানুয়ারিতে গণভোটের নির্যাস অনুযায়ী ঐ বছরই ৯ ই জুলাই দক্ষিণ সুদান স্বাধীন হয়।
কেবল উত্তর দক্ষিণ বিবাদ নয় স্বৈর শাসকদের ভ্রান্ত নীতির ফলে যুদ্ধ বিধ্বস্ত হয়েছে উত্তর সুদানও।গৃহযুদ্ধ,অনাহার, ক্ষরা,মহামারী সুদানবাসীর নিত্য সঙ্গী। স্থিতিশীল প্রশাসনের অভাব ও সাধারণ জনতার সাথে সরকারের স্বার্থ সংঘাত বিকাশের পথে অন্তরায় হয়েছে বারবার। সেই সুযোগে সুদানের সম্ভ্রান্ত তেল,সোনার ভান্ডারে নাক গলিয়েছে বিদেশী শক্তিরা। স্বাধীনতার পর ন্যাশনাল ইউনিয়নিস্ট পার্টির ইসমাইল আল – আজহারি দেশের প্রধানমন্ত্রী হন।তবে অত্যাচারী শাসকের বিরুদ্ধে বিদ্রোহী হয় সাধারণ মানুষ।বিদ্রোহকে কাজে লাগিয়ে গণতন্ত্রের মিথ্যা প্রতিশ্রুতি দিয়ে ক্ষমতায় আসেন জেনারেল আব্বুদ।আব্বুদের স্বৈরশাসনের বিরুদ্ধে ১৯৬৪ সালে অভ্যুত্থান সংগঠিত হয়।এরপর গণতান্ত্রিক সরকার প্রশাসন চালাতে ব্যর্থ হলে বামপন্থীদের সাহায্য নিয়ে সমাজতন্ত্রের প্রতিশ্রুতি দিয়ে ক্ষমতায় আসেন গাফফার নিইয়েমরি। গোড়ার দিকে কিছু সংস্কারমূলক পদক্ষেপ নিলেও তিনিও পরবর্তী সময়ে ফ্যাসিস্ট শাসকে রূপান্তরিত হন। ১৯৮৪ র বিদ্রোহে নিইয়েমরির পতন হলে দেশে গনতন্ত্র ফিরে আসে।নির্বাচনের মাধ্যমে প্রধানমন্ত্রী হন সাদিক আল মাহদী।১৯৮৯ সালে আবার সামরিক অভ্যুত্থানের মাধ্যমে ক্ষমতা দখল করেন ওমর আল বশির।দীর্ঘ ৩০ বছরের সামরিক শাসনের অবসান ঘটে ২০১৯ সালে গণ অভ্যুত্থানের মাধ্যমে।প্রাথমিক ভাবে সেনা – গণতান্ত্রিক শক্তির সার্বভৌম পরিষদের মাধ্যমে ক্ষমতা পরিচালিত করার পর সম্পূর্ণ গণতান্ত্রিক কাঠামো প্রতিষ্ঠার সিদ্ধান্ত হয়।কিন্তু আবারও ক্ষমতার দম্ভে সামরিক অভ্যুত্থানের মাধ্যমে প্রধানমন্ত্রী আবদাল্লা হামদককে অপসারিত করেন বুরহান ও হেমেডটি। আজ সেই দুই ক্ষমতালোভী শক্তির প্রসারণের পৈশাচিক বাসনাই সুদানের মানুষের জীবনে নিয়ে এসেছে দুর্গতি।
সুদানে কমিউনিস্ট আন্দোলন
একসময় সুদানের কমিউনিস্ট পার্টি মধ্য প্রাচ্য অঞ্চলে ইরাকের কমিউনিস্ট পার্টির পর সর্ববৃহৎ কমিউনিস্ট শক্তি ছিল।১৯৪৬ সালে খার্তুম ও ওমদুরামানের দুটি কমিউনিস্ট গ্রুপের সমন্বয়ের মাধ্যমে সুদানের কমিউনিস্ট পার্টি গঠিত হয়।অন্যান্য গণতান্ত্রিক শক্তিকে নিয়ে কমিউনিস্ট পার্টির নেতৃত্বে গড়ে তোলা ‘HASTU’ নামক জোট দেশের বহু কাঙ্ক্ষিত স্বাধীনতার আন্দোলনে চালকের ভূমিকা পালন করে।স্বাধীনতার পরবর্তী সময়ে দেশে স্বেচ্ছাচারী শাসন শুরু হলে কমিউনিস্টরা সাধারণ মানুষকে নিয়ে বারবার প্রতিরোধ গড়ে তোলে।শাসকরা যখন ধর্ম,ভাষার নামে মানুষে মানুষে বিভেদ ত্বরান্বিত করে দেশের সোনা,তেল,শস্যভাণ্ডার দখলের উল্লাসে মেতেছে তখনই শিক্ষা,কাজ,গণতন্ত্রের দাবি নিয়ে মানুষ বাধার সুর বেঁধেছে কমিউনিস্টরা।১৯৬৪ ও ১৯৬৯ এর বিদ্রোহে বামপন্থীরা গুরত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে।কিন্তু প্রতিবারই শাসকরা প্রতিশ্রুতি ভঙ্গ করলে কমিউনিস্টরা প্রতিবাদ করেছে।১৯৬৫ র নির্বাচনে কমিউনিস্টরা ৮ টি আসনে জয়লাভ করে।১৯৬৯ সালে গাফফার নিইয়েমরি ক্ষমতায় এলে বামপন্থীরা নিজেদের শক্তি বাড়াতে থাকা।কমিউনিস্ট নেতা জোসেফ গারাং দক্ষিণ সুদান উন্নয়ন দফতরের মন্ত্রী হন।মূলত কমিউনিস্টদের উদ্যোগেই দীর্ঘ ১৭ বছরের গৃহযুদ্ধের পরিসমাপ্তির চুক্তির পথ উন্মোচিত হয়।কিন্তু দেশজুড়ে বামপন্থীদের শক্তি ও গ্রহণযোগ্যতা বৃদ্ধি দক্ষিণপন্থী শক্তিকে ভীত করে।সামরিক অভ্যুত্থানের প্রয়াসের সমস্ত দায় কমিউনিস্টদের ঘাড়ে চাপিয়ে ১৯৭১ সালে সুদানে কমিউনিস্ট পার্টিকে নিষিদ্ধ ঘোষণা করা হয়।
নিইয়েমরি সরকারের পতনের পর ১৯৮৫ তে সুদানে আবার দৃশ্যমান পদক্ষেপ শুরু করে কমিউনিস্ট পার্টি।ইব্রাহিম মুহাম্মদ নুগুদের নেতৃত্বে শ্রমিক,কৃষক,প্রান্তিক,বঞ্চিত মানুষকে সংগঠিত করে গণ আন্দোলন গড়ে তোলা হয়। ১৯৮৫ এর নির্বাচনে কমিউনিস্টরা ৩ টি আসনে জয়ী হয়।তবে ১৯৮৯ সালে ওমর আল বশির ক্ষমতায় এলে কমিউনিস্ট পার্টি আবার নিষিদ্ধ হয়।বহু জনযুদ্ধ,গণহত্যা,বর্ণবৈষম্যের খলনায়ক বশিরের বিরুদ্ধে সাধারণ মানুষের বিক্ষোভ মাথাচাড়া দিলে ২০০৭ সালে কমিউনিস্ট পার্টির প্রতি নিষেধাজ্ঞা শিথিল হয়।২০১৯ সালের বশিরকে ক্ষমতাচ্যুত করার গণবিদ্রোহে কমিউনিস্ট পার্টি ছিল অন্যতম কারিগর।এসময় গণতান্ত্রিক শক্তিগুলো নিয়ে গড়ে তোলে ফোর্স ফর ফ্রিডম অ্যান্ড পিসের গুরুত্বপূর্ণ সদস্য ছিল কমিউনিস্ট পার্টি।কিন্তু দক্ষিণপন্থী শক্তিগুলো সেনাবাহিনীর সাথে আপোষ করলে কমিউনিস্ট পার্টি সেই জোট থেকে বেরিয়ে আসে।সেনাদের সাথে সেই আপোষের মাশুল দিতে আজ জ্বলছে সুদান।
২০১৯ পরবর্তী সময়ে সুদান
বশির শাসনের শেষ দিকে সাধারণ মানুষের দুর্ভোগ চরমে পৌঁছায়। ২০১৮ এর ডিসেম্বরে দেশের অর্থনৈতিক বিপর্যয় ও রুটির অভাবের প্রতিবাদে বিক্ষোভ শুরু করে সাধারণ মানুষ। ক্রমেই সেই বিদ্রোহ বশির বিরোধী আন্দোলনে পরিণত হয়। সরকারের টালমাটাল পরিস্থিতির সুযোগ নিয়ে ১১ ই এপ্রিল সেনা আধিকারিক আহমেদ আওয়াদ ইবন আউফ বশিরকে ক্ষমতাচ্যুত করে বন্দী করে দেশে সামরিক শাসন জারি করে। বশিরের পদস্খলনে খুশি হলেও সামরিক শাসন মানতে রাজি ছিলেন না সুদানের নাগরিকরা। বিক্ষোভ চলতে থাকলে আউফ পদত্যাগ করে আল বুরহানকে প্রধান ঘোষণা করেন। বুরহান কিছু সিদ্ধান্ত বদল করলেও মানুষের আন্দোলন চলতে থাকে। ৩ রা জুনে মিলিটারি ক্যাম্পের বাইরে বিদ্রোহী মানুষের শান্তিপূর্ণ অবস্থানে আরএসএফ বাহিনীর নারকীয় আক্রমণে ১২৮ জন প্রাণ হারান ও হাজারের বেশি মানুষ আহত হন।এই সময় গণতান্ত্রিক শক্তির এক অংশ সামরিক বাহিনীর সাথে সমঝোতা করতে রাজি হয়।ফোর্স ফর ফ্রিডম অ্যান্ড পিসের সাথে এসএএফ ও আরএসএফের চুক্তিতে নির্ধারিত হয় তিন বছরের মধ্যে দেশে সাধারণ নির্বাচন ও নতুন সংবিধান রচনার কাজ সম্পন্ন হবে। প্রথম ২১ মাস সার্বভৌম পরিষদের মাথায় থাকবেন সামরিক অফিসাররা।পরের সময়ে থাকবেন গণতান্ত্রিক পক্ষের নেতা। কিন্তু সাধারণ মানুষ এই চুক্তি বিরোধীতা করলে নতুন সরকারের প্রধানমন্ত্রী নিযুক্ত হন ব্যবসায়ী ও কূটনতিক আবদাল্লা হামদক। মন্ত্রীসভা গঠিত হয় ৬ জন গণতান্ত্রিক পক্ষের এবং ৫ জন সেনাবাহিনীর প্রতিনিধি নিয়ে।কিন্তু কেবল ক্ষমতার অভীপ্সায় ২০২১ সালে আবার সামরিক অভ্যুত্থানের মাধ্যমে হামদককে সরিয়ে সামরিক শাসন প্রতিষ্ঠিত হয়। প্রধান হন আল বুরহান। ডেপুটি পদে বসেন হেমেডটি।
২০২২ এর ক্ষমতা হস্তান্তরের চুক্তি
দীর্ঘ লড়াইয়ের মাধ্যমে অর্জিত গণতন্ত্রের অধিকার সুদানের মানুষ পদদলিত হতে দিতে রাজি ছিলেন না। প্রবল দমন পীড়নের মধ্যেও নিরন্তর আন্দোলন,সংগ্রাম চলতে থাকে সেনা শাসনের বিরুদ্ধে। ২০২২ এর ডিসেম্বরে বহির্বিশ্বের হস্তক্ষেপে পুনরায় আল বুরহান, হেমেডটি ও ফোর্স ফর ফ্রিডম অ্যান্ড পিসের মধ্যে ক্ষমতা হস্তান্তর সংক্রান্ত চুক্তি স্বাক্ষরিত হয়।২০২৩ এর ৭ই ফেব্রয়ারি আমেরিকা,সংযুক্ত আমিরশাহী,সৌদি আরব,ইউরোপীয় ইউনিয়ন,আফ্রিকান ইউনিয়নের প্রতিনিধিরা খার্তুমে ত্রিপাক্ষিক বৈঠকে উপস্থিত হন। সিদ্ধান্ত হয় ২০২৩ এর শেষ নাগাদ সাধারণ নির্বাচন অনুষ্ঠিত হবে। সম্পূর্ণভাবে গণতান্ত্রিক শক্তির হতে ক্ষমতা হস্তান্তরিত হবে।দেশের নতুন সংবিধান রচিত হবে। আরএসএফকে সেনাবাহিনীতে মিশিয়ে দেওয়া হবে।সেনাবাহিনীর প্রধান হবেন প্রধানমন্ত্রী।কিন্তু এরপরই সবাইকে অবাক করে ঘোষণা করেন বুরহান ঘোষণা করেন সেনাবাহিনীর প্রধান হলেও কম্যান্ডার জেনারেলকে কোনো নির্দেশ দেওয়ার অধিকার থাকবে না প্রধানমন্ত্রীর। এমনকি সেনাবাহিনীতে নিয়োগেও থাকবে না কোনো সরকারি ভূমিকা।দেশের অর্থনৈতিক ক্ষমতা হস্তান্তরের বিষয়েও স্পষ্ট কোনো কথা নেই এই চুক্তিতে।
বৈদেশিক শক্তির ভূমিকা
গৃহযুদ্ধে জর্জরিত সুদানের অবনমনের দিন লিখন স্থির হয়ে গিয়েছিল ব্রিটিশ শাসনের সময় থেকেই।ব্রিটিশদের ভ্রান্ত নীতির ফলেই মাথাচাড়া দিয়েছিল উত্তর দক্ষিণের বিভাজন।পরবর্তী সময়ে সুদানের নিয়ন্ত্রকের ভূমিকা নেয় মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র।সুদানের বিপুল তৈলভান্ডার,সোনার খনি,শস্য ভান্ডার আকৃষ্ট করেছিল মার্কিনদের।উত্তর,দক্ষিণের বিভাজন নিষ্পত্তি হয়েছিল মার্কিন মধ্যস্থতায়। বর্তমানে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র,গ্রেট ব্রিটেন,সৌদি আরব,সংযুক্ত আরব আমিরশাহী নিয়ে গঠিত ‘ কোয়াড ‘ সুদানের বিভিন্ন বিষয় হস্তক্ষেপ করে থাকে । ক্ষমতা হস্তান্তরের চুক্তিও রচিত হয়েছে তাদের তত্ত্বাবধানেই।বর্তমান সংঘর্ষের সময় মিশর নিজের দেশে স্বৈরশাসন জারি রাখার জন্য সরাসরি বুরহান পক্ষ নিয়েছে।একই অবস্থান নিয়েছে সৌদিও।পক্ষান্তরে ইয়েমেনে আরএসএফকে ব্যবহারের পুরোনো অভিজ্ঞতা থেকে আমিরশাহী দাড়িয়েছে আরএসএফের পক্ষে। রাশিয়ার ওয়াগনার গ্রুপের সাথে আগাগোড়াই সংযোগ রয়েছে আরএসএফের।পাশাপাশি বুরহান পক্ষও রাশিয়ার সাথে কূটনৈতিক সম্পর্ক রেখেছে।লোহিত সাগরের তীরে রাশিয়ার ঘাঁটি গড়ার সম্ভবনা এড়াতে তাই ওয়াশিংটন উভয়পক্ষকেই মদত দিচ্ছে।
বর্তমান হস্তান্তর চুক্তি প্রসঙ্গে কমিউনিস্টদের বক্তব্য
গনতান্ত্রিক অন্দোলনের অতন্দ্র প্রহরী সুদানের কমিউনিস্ট পার্টি বরাবরই সেনাশাসকদের সাথে কোনো আপোষের বিরোধীতা করেছিল। অপোষবিমুখতা থেকেই তারা ফোর্স ফর ফ্রিডম অ্যান্ড পিস থেকে নিজেদের প্রত্যাহার করে নেয়।বর্তমান চুক্তির পরিপ্রেক্ষিতে আফ্রিকান ইউনিয়নের নেতা ফাকির সাথে দেখা করে কমিউনিস্ট পার্টির এক প্রতিনিধি দল।আলোচনার পর তারা জানায় ‘বিপ্লবের প্রতি বিশ্বাসঘাতকতার পর ফোর্স ফর ফ্রিডম অ্যান্ড পিস কোনোভাবেই সাধারণের প্রতিনিধিত্ব করে না। সেনা শাসকদের সাথে যেকোনো আপোষ কখনই দেশে গণতন্ত্রকে সুনিশ্চিত করবে না।’ বৈদেশিক শক্তির প্রধান লক্ষ নিজেদের দেশের বুর্জোয়াদের ব্যবসার জন্য একটি অনুকূল পরিবেশ প্রতিষ্ঠা করা।কিন্তু কোনোভাবেই তারা দেশের গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠা বা মানবাধিকার সুনিশ্চিত করার জন্য উদ্যোগী নয়।পাশাপাশি সুদান কমিউনিস্ট পার্টির বিদেশ বিষয়ক মুখপাত্র সালে মাহমুদ জানিয়েছেন,সেনাদের অধীনে যে কোনো নির্বাচনই পরিণত হবে প্রহসনে। কিছু বুর্জোয়াকে পুতুলের ন্যায় ক্ষমতায় বসিয়ে আসল কর্তৃত্ব তারাই কায়েম করবে। তাই বর্তমান যুদ্ধের পরিস্থিতির অবসান ঘটিয়ে মানুষকে ঐক্যবদ্ধ হয়ে গণতন্ত্র রক্ষার সংগ্রামে নামে আহ্বান জানিয়েছে কমিউনিস্ট পার্টি।
স্বৈরাচারীর দম্ভে পদদলিত হয়ে মানবতা। হিংসোন্মত্ত মানুষ ক্ষমতার লোভে ভুলে যায় হিতাহিত। ক্ষুদ্র কায়েমী স্বার্থে কেড়ে নিতে চায় সাধারণ মানুষের ন্যুনতম বেঁচে থাকার অধিকার।নিজেদের প্রতিপত্তি বজায় রাখতে ধর্ম,বর্ণ,ভাষার নামে বিভাজিত করে জাতিকে।খাদ্য,বস্ত্র,বাসস্থানের সংগ্রাম ভুলিয়ে মানুষকে লেলিয়ে দেয় স্বজাতির বিরুদ্ধে।ধান্দার ধনতন্ত্র বজায় রাখতে মানুষের মধ্যে বিভেদ বিজয় রাখতে কূটকৌশল জারি রাখে পুঁজিবাদীরা।একদিন সুদান গৃহযুদ্ধে মেতেছে ধর্ম,সংস্কৃতির ভিত্তিতে।সেই উত্তেজনা প্রশমিত হলে রক্তে দেশ ভাসিয়েছে জাতিদাঙ্গায়।সেদিনের একজোট স্বৈরাচারীরা আজ যুযুধান রণাঙ্গনে নিজেদের আগ্রাসন বজায় রাখতে। যুদ্ধ বিধ্বস্ত সুদান তাই সারা পৃথিবীর কাছেই একটি শিক্ষা।