Students will also be present at the fight festival on 7th january -Srijan Bhattacharya



গত কয়েক বছরে লেখাপড়ার ফি বেড়েছে বহুগুণ। কেবল অ্যাডমিশন ফি নয়, কম্পিউটার ফি, ক্যাপিটেশন ফি, লাইব্রেরি ফি, মায় ইউনিয়ন ফি অবধি। ক্যাম্পাসে ছাত্রভোট নেই ৭ বছর হতে চলল। খাতায় কলমে ইউনিয়ন নেই, কিন্তু ইউনিয়ন ফি আছে।

স্কলারশিপ, ফেলোশিপের পরিমাণ কমছে। সরকার বলে দিচ্ছে, একটা পেলে আরেকটা পাবে না। আর সে ফেলোশিপ যদি মৌলানা আবুল কালাম আজাদের নামে হয়? নৈব নৈব চ! ফেলোশিপ বন্ধ। নিজের গাঁটের কড়ি খরচা করে তেল মাখো। গরিবের লেখাপড়ার কোনো দায়িত্ব সরকার নেবে না।

হ্যাঁ, তেনারা একটা সাইকেল দিয়েছেন বটে। সে তো বুদ্ধবাবুও দিতেন। সাইকেল চড়ে একজন ছাত্রী যাবে কোথায়? স্কুলটাই তো বন্ধ হয়ে যাচ্ছে! বেঞ্চ নেই, ব্ল্যাকবোর্ড নেই, ক্লাসরুম নেই। এখন পার্থ-মানিক-ভাইপোদের কল্যাণে শিক্ষকও নেই। শিক্ষকরা সব ধর্মতলায় আর সল্টলেকে বসে। স্কুল চালাবে কে? এখন তো বলছে অঙ্গনওয়াড়িটাও তুলে দেবে। দু’দিন পর এসএসকে-এমএসকে’গুলোও তুলে দেবে।

একটা জামা দিয়েছে যদিও, পকেটের কাছে একটা ‘ব’ মার্কা ছাপ দিয়ে। একবার কাচলেই সে জামা অর্ধেক হয়ে যাচ্ছে। ফ্রি সাইজ। এডুকেশনটা ফ্রি’তে দেওয়ার কথা ছিল। দিদিমোদী জামার সাইজটা ফ্রি করে দিলেন। বাঁটুল দ্য গ্রেটের গায়েও যে জামা, নন্টে ফন্টের গায়েও সেই জামা’ই।

কেউ পরতে পারছে না। কেউ পড়তে পারছে না। পড়াশোনা অসম্ভব। মিড ডে মিলে চুরি। টেক্সটবুকে চুরি। স্কুলের পরিকাঠামো নির্মাণে চুরি। শিক্ষক নিয়োগে চুরি। স্টাফ নিয়োগে চুরি। লাইব্রেরির হতশ্রী দশা। ফ্যান লাইট জ্বলে না ক্লাসের। জিজ্ঞাসা করলে হেডমাস্টার ফ্যালফ্যাল করে চেয়ে বলেন, কী করব ভাই, বেশি বললে পানিশমেন্ট পোস্টিং’এ বাড়ি থেকে দূরে পাঠিয়ে দেবে। গভর্নিং বডিতে বসে পেটমোটা হয় স্থানীয় তৃণমূলী কচি নেতার। কাজের বরাত আসে, বরাত যায়। কিন্তু বরাত ফেরে না হতভাগ্য সরকারি স্কুলের।

এরপর উচ্চশিক্ষা। উচ্চমানের চিটিংবাজি। এমন কলকাঠি করেছে, সারা বছর পরীক্ষা। ছেলেমেয়েরা পড়বে কখন? পারলে প্রতি সপ্তাহে বিভিন্ন ধরনের অ্যাসেসমেন্ট। সাবজেক্টের বোঝা হাজারো ধরনের। অমুক কারিকুলাম, তমুক মডিউল, তুশুক পার্সেন্টাইল করতে করতে ওষ্ঠাগত প্রাণ। ছাত্রদের খেলাধূলা করার সময় থাকছে না। গান শোনার, সিনেমা দেখতে যাওয়ার সময় থাকছে না।

অবশ্য এ দুঃখ বেশিরভাগ ছাত্রেরই কপালে জোটার কোনো চান্সই নেই। অধিকাংশই তো স্কুলে পড়াকালীনই ড্রপ আউট হয়ে যাচ্ছে। পিসিমণি কন্যাশ্রী নিয়ে চিল চিৎকার করেন৷ এদিকে নাবালিকা বিবাহে পশ্চিমবঙ্গ ওয়ান অফ দ্য টপমোস্ট। বিপুল পরিমাণ ছেলে, বিশেষত তফশিলী জাতি-উপজাতি ও সংখ্যালঘু পরিবারের সন্তান, লেখাপড়া থেকে ছিটকে যাচ্ছে মাঝপথেই। বাইরের রাজ্যে কাজ করতে চলে যাচ্ছে কত সতেরো, আঠারো, উনিশের ছাত্র-যুব। তাতে অবশ্য ওনাদের আর কী যায় আসে! সালমান খান তো পিসির বাড়ির সাইজ নিয়ে সার্টিফিকেট দিয়ে গেছে! সবাইকে দেয়? হুঁহুঁ।

কলেজের পরিকাঠামোর হাল ভয়ানক। ১৫-২০টা কাউন্সেলিং’এর পরেও হাজারে হাজারে প্রাইভেট ইঞ্জিনিয়ারিংয়ের সিট ফাঁকা। কী হবে লেখাপড়া করে, ভাবছে যৌবন। লেখাপড়া করে চাকরি পাবই, এই গ্যারান্টি তো নেই। ফলতঃ, শহরের রাস্তায় বেড়ে চলছে কাবাবের দোকান। আগুনের আঁচের সামনে বসে কারা? সেই সতেরো, আঠারো, উনিশ।

এর মধ্যে কোভিড-লকডাউনকে ব্যবহার করে নতুন ঢপবাজি। অনলাইন ক্লাস। ‘বাইজু’বাবুদের পোয়াবারো। অনলাইন ক্লাস করল কারা? যাদের বাড়িতে ল্যাপটপ, স্মার্টফোন, ওয়াইফাই’এর অভাব নেই। যাদের কাছে বেঁচে থাকার ন্যূনতম শর্তটুকু মেটানোই দায়, তাদের কাছে শিক্ষা পৌঁছে দেওয়ার জন্য ব্যবহার হলো না প্রযুক্তি। কোনো পরিযায়ী শ্রমিক হয়ে যাওয়া ছাত্র অনলাইনে ক্লাস করতে পারল না। পিসি ট্যাব দিলেন না, ট্যাবের টাকা দিলেন। সে টাকা দিয়ে কতজন ট্যাব কিনলো, তার খোঁজ রাখল না কেউ।

অনলাইন ক্লাস বাড়িয়ে দিল ডিজিটাল ডিভাইড। ড্রপ আউট বাড়ল চড়চড়িয়ে। তারা আর ফিরল না। হাজার হাজার স্কুল বন্ধ হয়ে গেল। লাখ লাখ ছেলেমেয়ে মাধ্যমিক উচ্চমাধ্যমিক না দিয়ে মাঝপথে হারিয়ে গেল। সরকার বলল, আজকাল তো ইংরিজি মিডিয়ামে পড়ার ঝোঁক বেশি। তাই হয়ত গ্রাম শহরে সরকারি স্কুল চলছে না। একদিন বাংলা মিডিয়াম উঠে যাবে, এই আশাতেই হয়ত পিসি রবীন্দ্রনাথের গানের লাইন পালটে দিলেন।

কলেজও উঠে যাবে। বিশ্ববিদ্যালয়গুলোকে দিল্লির বাবুরা অটোনমাস বানাবেন। অটোনমাস মানে স্বায়ত্তশাসিত নয়, আর্থিকভাবে স্বনির্ভর। অর্থাৎ তুমি ইউনিভার্সিটি, তুমি আর সরকারের পিছন পিছন টাকাপয়সার জন্য ঘুরঘুর কোরো না। পুরোটাই সেল্ফ-ফিন্যান্সড কোর্সের মুখাপেক্ষী হয়ে যাও। ছাত্রদের বলে দাও, ইউনিভার্সিটিই যদি গ্রান্ট না পায়, তোমাদের আর কম পয়সায় পড়াবে কী করে! লোন নিতে উৎসাহিত কত ছাত্রদের। এডুকেশন লোন, স্টুডেন্ট ক্রেডিট। ইউনির্ভাসিটির গ্রান্ট না পাওয়ার ব্যবস্থা করবে সরকার খোদ। কী করে? প্রথম ধাপ, ইউনিভার্সিটি গ্রান্টস কমিশন তুলে দিয়ে। জাতীয় শিক্ষানীতিতে ঠিক যেমনটি প্ল্যান করা আছে!

তফশিলী জাতি-উপজাতির সংরক্ষণ, হিন্দু-মুসলমানের স্বাভাবিক মিলেমিশে বড় হওয়া, ধর্মনিরপেক্ষতার পাঠ, লিঙ্গসাম্যের পাঠ – এসবই অস্তাচলে। সিলেবাস কমিটি বীরদর্পে জানাবে, পরের বছর থেকে রামায়ণ মহাভারত বাধ্যতামূলক। ডারউইন বাদ। মার্কস তো বাদই। রবীন্দ্রনাথও বাদ। ছেলেমেয়েরা পড়বে কী? কেন, বাল নরেন্দ্র!

নাগপুরের সিলেবাস বলছে, পদ্মফুলকে বাংলায় ঘাসফুল বলা হয়। এখানে ইতিহাসের বই থেকে তেভাগার কথা বাদ, কিন্তু বেচারাম মান্নার ঝিন্চ্যাক্ উপস্থিতি। সর্বনাশা জাতীয় শিক্ষানীতি অক্ষরে অক্ষরে মেনে নিয়েছেন ব্রাত্যবাবুরা। ৩ বছরের অনার্স সারতেই নাজেহাল হচ্ছে ছাত্ররা, ওনারা ৪ বছরের অনার্স কোর্স চালু করছেন। এত্তো হনার্ড হবার পর কাজ কে দেবে ছাত্রদের, সে ব্যাপারে অবশ্য স্পিকটি নট সরকার। দিল্লি তো বলেই রেখেছে, চাইলে ফার্স্ট ইয়ার বা সেকেন্ড ইয়ারের শেষে ডিপ্লোমা-সার্টিফিকেট নিয়ে বাজারে চড়তে বেরিয়ে পরো, কে বলেছে তোমাদের গ্র‍্যাজুয়েশন কমপ্লিট করতে??

এই তো দুরবস্থা। ভাজপা-ভাইপো সরকারদ্বয়ের তাণ্ডবে নাভিশ্বাস শিক্ষাক্ষেত্রের। লেখাপড়ার জগৎ আগে খবরে আসত অমর্ত্য সেন নোবেল পেলে, এখন খবরে আসে কুন্তল শান্তনু হৈমন্তীর দৌলতে। এডুকেশন বিট করা সাংবাদিক কাজ হয়ে দাঁড়িয়েছে গোয়েন্দাদের মতো, চোর খুঁজে বেড়ানো। শুধু কি চাকরি চুরি? বিএড কলেজে দুর্নীতি, কলেজ অ্যাডমিশনে দুর্নীতি, এমনকি পাশ করানো বা ফেল করানোতেও দুর্নীতি! প্রশ্ন করলে, রুখে দাঁড়ালেই ইউনিয়ন রুমে তালাবন্ধ করে মার। কলার ধরে দেওয়ালে চেপে হুমকি, কিরে এসএফআই করিস নাকি তুই?

বাঁচতে হবে। বাঁচাতে হবে লেখাপড়ার দুনিয়াটাকে। আমাদের জন্য, আমাদের পরের প্রজন্মের জন্য। বছরের পর বছর আমরা সম্মিলিতভাবে ধুঁকেই চলব, তা হতে পারে না।

শিক্ষকরা মুখ খুলতে শুরু করেছেন। অভিভাবকরা জুতো ছুঁড়তে শুরু করেছেন পার্থ-মানিকদের উদ্দেশে। বড়লোকের খবরের কাগজগুলোও পোস্ট এডিট ছাপাতে শুরু করেছে। শিক্ষা বাঁচাও – লুঠেরাদের হাত থেকে, তোলাবাজদের হাত থেকে, দাঙ্গাবাজদের হাত থেকে। সুবিচার চাই আমাদের।

যে মেয়েটি টিএমসিপি নেতার কুপ্রস্তাবে অপমানিত হয়ে আত্মহত্যা করল, তার বিচার চাই। যে মেয়েটি স্টুডেন্ট ক্রেডিট কার্ডের লোন না পেয়ে আত্মহত্যা করল, তার বিচার চাই। যে ছেলেটি ছাত্র ভোট চেয়ে পুলিশি হেফাজতে খুন হয়ে গিয়েছিল ১১ বছর আগে, তার বিচার চাই। যে ছেলেটির এলাকায় প্রতিবাদী ভাবমূর্তিকে ভয় পেয়ে মাঝরাতে ছাদ থেকে ঠেলে ফেলে দিল রাষ্ট্রীয় গুণ্ডারা, তার বিচার চাই। র‍্যাগিংয়ের আস্ফালন সহ্য করতে না পেরে অকালে ঝরে গেল যে প্রথম বর্ষ, তার বিচার চাই। সুদূর হায়দ্রাবাদ বা হরিয়ানাতে দলিত হওয়ার জন্য অপমান সয়ে সয়ে নীরবে হারিয়ে গেল যে যৌবন, তার বিচার চাই। ছায়া হয়ে থাকার থেকে, তারা হয়ে থাকা শ্রেয় মনে হলো যার, তার বিচার চাই।

বিচার চাইতে, সুবিচার চাইতে ছাত্ররা যাবে। ইনসাফ চাইতে ছাত্ররা যাবে। ইনসাফের দাবিতে ৫০ দিনের যাত্রায় যুবদের কাঁধে কাঁধ মিলিয়ে ছাত্ররা পথ হেঁটেছে সর্বত্র। ইনসাফের দাবিতে রাস্তা ভরিয়ে মিছিল করেছে ছাত্ররা। আজ, কাল, পরশু, ছাত্ররা রাস্তাতেই ছিল, লড়াইতেই ছিল। ক্যাম্পাসে ক্যাম্পাসে দেওয়াল ভরেছে স্লোগানে। সতেরো আঠারো উনিশকে ইনসাফ দিতে পারেনি সরকার, রাষ্ট্র, মিডিয়ার ফোলানো বেলুনরা।

ছাত্ররা তাই যাবে। আগামী ১২ই জানুয়ারি পার্লামেন্ট অভিযান। স্লোগান উঠেছে, শিক্ষানীতি বাতিল করো, রক্ষা করো শিক্ষা। পরের লাইনে সারা দেশের প্রেক্ষিত মাথায় রেখে লেখা হয়েছে, বিজেপি’কে রুখে দাও, রক্ষা করো ভারতকে। আমাদের রাজ্যে, আমরা বলেছি, বিজেপি-তৃণমূল দু’য়ের বিরুদ্ধেই লড়াই জানকবুল। সেই বার্তা নিয়েই ২২-২৪শে জানুয়ারি মালদায় সংগঠিত হবে এসএফআই’এর ৩৮তম রাজ্য সম্মেলন। আহ্বান জানানো হবে – স্কুল কলেজে শপথ করো, বিভেদ রুখে স্বদেশ গড়ো।

বহমান লড়াইয়ের নতুন অধ্যায়। ৭ই জানুয়ারি। ডাক যৌবনের। সংহতিতে কলকাতা ভাসিয়ে দেবে বাংলার খেটে খাওয়া মানুষ। শীতের দুপুরের কলকাতা, উত্তাপ ছড়িয়ে দেবে সমস্ত আহতের মহল্লায়। আহতের শুশ্রূষায় যাবে ছাত্ররা। সঞ্জীবনীসুধা নিয়ে ক্যাম্পাসে ফিরবে ছাত্ররা। শিক্ষাক্ষেত্রে মড়ক লেগেছে। বাঁচতে হবে। বাঁচাতে হবে।

৭ই জানুয়ারি। আপাতত, ওয়ান পয়েন্ট ডেস্টিনেশন। ছাত্রদের বিরুদ্ধে ঘটা সব না-ইনসাফির জবাব চাইতে, সারা বাংলার ছাত্ররা জড়ো হবে ব্রিগেডের মাঠে। প্রস্তুত হচ্ছে ক্লাসরুম, ক্যান্টিন, কমনরুম। প্রথম বর্ষকে তৃতীয় বর্ষ ইস্তেহার বিলি করতে করতে ফিসফিস করে বলছে, বাড়িতে বলে দিস, ওইদিন ফেস্ট আছে।

প্রতিস্পর্ধীদের ফেস্ট আছে ৭ই জানুয়ারি ব্রিগেডে। ছাত্ররা যাবে।

Spread the word

Leave a Reply