১৬ ফেব্রুয়ারী ২০২২ (বৃহস্পতি বার)
অর্থ দপ্তরের রাষ্ট্রমন্ত্রী চন্দ্রিমা ভট্টাচার্য তখন বাজেট পড়ছিলেন। এই নিয়ে দ্বিতীয়বার অর্থ দপ্তরের রাষ্ট্রমন্ত্রী বিধানসভায় বাজেট পড়ছিলেন। শুনছিলেন অর্থমন্ত্রী মমতা ব্যানার্জি। আর মাঝে মাঝে মাথা নাড়ছিলেন।
ঘটনাটি ঘটল বাজেট ভাষণের শেষ দিকে। বিধানসভার ঘড়িতে তখন প্রায় আড়াইটে। মমতা ব্যানার্জি কিছু একটা বললেন। পাশে বাঁহাত মাথার পিছনে দিয়ে এলিয়ে বসেছিলেন ফিরহাদ হাকিম। তিনি বুঝতে পারেননি। তাঁর পাশে অরূপ বিশ্বাস। তিনি মাথা এগোলেন মুখ্যমন্ত্রীর কথা বোঝার জন্য। তার আগেই তৎপর হলেন ব্রাত্য বসু। তিনি মুখ্যমন্ত্রীর সামনের আসনে বসেন। তিনি বুঝেছিলেন, মমতা ব্যানার্জি একটি কাগজ চাইছেন।
ব্রাত্য বসু শিক্ষা মন্ত্রী। তিনি আসন ছেড়ে উঠে গেলেন অধ্যক্ষ বিমান ব্যানার্জির কাছে। অধ্যক্ষর থেকে সাদা কাগজ নিয়ে তিনি দিলেন মুখ্যমন্ত্রীকে। মুখ্যমন্ত্রী খসখস করে কিছু লিখলেন। তারপর চিরকুটের থেকে একটি বড় মাপের কাগজটি মমতা ব্যানার্জি এগিয়ে দিলেন অরূপ বিশ্বাসের দিকে। ব্রাত্য বসু সেটা ঘাড় ঘুরিয়ে দেখলেন — সাদা কাগজ দিলেন তিনি, আর লেখা কাগজ দলনেত্রী দিলেন অরূপকে!
অরূপ বিশ্বাস সেই কাগজ নিয়ে সটান চলে গেলেন ভাষণরত চন্দ্রিমা ভট্টাচার্যর পাশে। তাঁকে দিলেন। অর্থ দপ্তরের রাষ্ট্রমন্ত্রী কয়েক সেকেন্ড পর ভাষণ থামিয়ে সেই কাগজ তুলে নিলেন। পড়লেন। ঘোষনা করলেন — মমতা ব্যানার্জির লেখা অনুসারে — রাজ্যের সরকারি কর্মচারীদের ৩% মহার্ঘ্য ভাতা ঘোষনা হলো এইভাবে।
রাজ্যের ইতিহাসে নজির বিহীন। বাজেটে এর কোনও উল্লেখ নেই। বাজেটে সাধারনত ডিএ-র কথা এই ভাবে লেখাও হয় না। কিন্তু বাজেট ভাষণ চলাকালীন ডিএ ঘোষণা? এক অবিশ্বাস্য বিষয়।
তাই ঘটল। বুধবার। রাজ্য বিধানসভায়। যদিও রাজ্যের কর্মচারীদের বকেয়া প্রায় ৩৮% মহার্ঘ্যভাতা।
অবিশ্বাস্য বাজেটও।
কাজে নয়, মদে জোর!
বাজেটে কোথাও আগামী একবছর রাজ্যে কত কাজের সুযোগ তৈরি করার লক্ষ্যমাত্রা নিচ্ছে রাজ্য সরকার — তার উল্লেখ নেই। গত বাজেটে চন্দ্রিমা ভট্টাচার্য ঘোষনা করেছিলেন,‘‘চার বছরে আমরা ১কোটি ২০লক্ষ কর্মসংস্থান সৃষ্টি করব।’’ তাহলে একবছরে ৩০লক্ষ কর্মসংস্থান হওয়ার কথা। অন্তত গড় ধরলে তাই হয়। গত একবছরে কী রাজ্যে ৩০লক্ষ কর্মসংস্থান হলো? তার জবাব নেই বাজেটে। আগামী একবছর কী ৩০লক্ষ কাজের সুযোগ তৈরিই লক্ষ্য, নাকি বেশি? তারও উত্তর নেই।
যদিও এদিন মুখ্যমন্ত্রী মমতা ব্যানার্জি বাজেট পাঠের পর উঠে দাঁড়িয়েছিলেন। ভাষণও দিয়েছেন। তাঁর দাবি,‘‘এই বাজেট কর্মসংস্থানভিত্তিক(এমপ্লয়মেন্ট ওরিয়েন্টেড) বাজেট। কোটি কোটি মানুষের কর্মসংস্থান হবে।’’
‘কোটি কোটি’ যদি হয়েই যায়, তাহলে চারবছরে ১কোটি ২০লক্ষ কর্মসংস্থানের গতবারের বাজেট ঘোষনাটির কী হবে? কোনও উত্তর নেই।
এবারের বাজেটে আসলে কাজের সুযোগ তৈরির কোনও কথাই বলা নেই। সরকার একটি প্রকল্প ঘোষনা করেছে। তার নাম দেওয়া হয়েছে — ‘ভবিষ্যৎ ক্রেডিট কার্ড।’ মূলত যুবকদের ঋণ দেওয়ার প্রকল্প একটি। ৫লক্ষ টাকা করে ঋণ দেওয়া হবে। বছরে ২লক্ষ যুবক যুবতীকে এই ঋণ দেওয়া হবে বলে সরকারের ঘোষনা। তার মধ্যে ১০% মার্জিন মানি বাবদ, সর্বোচ্চ ২৫,০০০টাকা করে রাজ্য সরকার দেবে বলে ঘোষনা বাজেটে।
এটির হালও কী স্টুডেন্ট ক্রেডিট কার্ডের মত হবে? কারন, ছাত্রদের জন্য এই ঋণের প্রকল্পটি রাজ্যে মুখ থুবড়ে পড়েছে।
মদ বিক্রিতে আরও জোর দিয়েছে সরকার। গত আর্থিক বছরে সরকারের লক্ষ্যমাত্রা ছিল মদ বিক্রী থেকে ১৬,৫০০ কোটি টাকা আয় করার লক্ষ্যমাত্রা নিয়েছিল। এখনও আর্থিক বছর শেষ হয়নি। এখনও পর্যন্ত ১৫,০০১.৩৯ কোটি টাকা মদ বিক্রি করে সরকার আয় করেছে বাজেট নথিতে জানিয়েছে। আগামী বছর, অর্থাৎ ২০২৩-২৪-এ মদ বিক্রী করে ১৭,৯২১.৫৬ কোটি টাকা আয় করার লক্ষ্যমাত্রা নিয়েছে মমতা ব্যানার্জির সরকার। যদিও ২০১১-র বিধানসভা নির্বাচন উপলক্ষ্যে দলের যে নির্বাচনী ইশ্তেহার প্রকাশ করেছিলেন মমতা ব্যানার্জি, সেই ইশ্তেহারের ৯-র পাতায় বামফ্রন্টের তীব্র সমালোচনা করে কী লেখা হয়েছিল? মমতা ব্যানার্জি লিখেছিলেন —‘‘শিল্পের থেকে আজ শুঁড়িখানা অনেক বেশি। শিল্প মানে শুধু মদের বন্যা।’’
প্রশ্ন ঋণ নিয়েও।
ধার — সাড়ে ৬ হাজার কোটি!
২০২২-২৩, অর্থাৎ চলতি বছরে রাজ্য সরকার বাজার থেকে ৭৩,২৮৬ কোটি টাকা বাজার থেকে ধার নেবে গত বাজেটে ঘোষনা করেছিল। এখন, বছর শেষে, সরকার জানাচ্ছে তাদের সংশোধিত(রিভাইজড) বাজেট। সেই হিসাবে গত বাজেটে ঘোষিত বাজার থেকে ধারের পরিমাণ বেড়ে গেছে। সরকার চলতি আর্থিক বছরে এখনও পর্যন্ত ৭৫,১৯৫ কোটি টাকা বাজার থেকে ধার নিয়েছে বলে বাজেট নথিতে জানিয়েছে।
আগামী বছর, ২০২৩-২৪-এ রাজ্য সরকার বাজার থেকে কত ধার নেবে? সরকার জানাচ্ছে, ৭৮,৯৪৬.৪৯ কোটি টাকা। গতবাবের থেকে বেশি — বাজেট ঘোষনাতেই। বছর শেষে আরও বেড়ে কোথায় দাঁড়াবে তা পরে বোঝা যাবে।
আগামী আর্থিক বর্ষ, অর্থাৎ ২০২৩-২৪-এ শুধু বাজার থেকে রাজ্য সরকার ৭৮,৯৪৬.৪৯ কোটি টাকা ধার করবে বলে বাজেট পেশ করে সরকার জানিয়েছে। এই বছরে রাজ্য মোট যা আয় হবে ধরেছে, সেই আয়ের প্রায় ২৫.৪% আসবে এই বাজার ধারের মাধ্যমে।
প্রসঙ্গত, রাজ্য সরকার দাবি করেছে বিভিন্ন ক্ষেত্র থেকে তাদের আয় হবে ৩,১০,৪৯৪.৮৮ কোটি টাকা।
চলতি বাজেট নথিতেও বামফ্রন্ট সরকারের সময়কালের সঙ্গে নিজেদের তুলনা করে ‘সফল’ দেখানোর চেষ্টা করেছে তৃণমূলের সরকার। বামফ্রন্টের সাফল্য এখনও তাদের তাড়া করে বেড়ায়। আর সেই তুলনাতেই এসে পড়ে ঋণের প্রসঙ্গ।
২০১১-তে যখন সরকার পরিবর্তন হচ্ছে, তখন রাজ্যের মোট ঋণের পরিমাণ কত ছিল? ১,৯২,৯১৯.৯ কোটি টাকা। এখন রাজ্যের ঋণ কত? প্রায় ৫লক্ষ ৮৭ হাজার কোটি টাকা! ১১ বছর সরকার চালিয়ে মমতা ব্যানার্জি রাজ্যকে কোথায় পৌঁছে দিয়েছেন, এটি তার হিসাব। আর আগামী বছর? মমতা ব্যানার্জি ১২ বছরে রাজ্যবাসীকে কোথায় পৌঁছে দিচ্ছেন? বাজেট নথিতে রাজ্য সরকার বুধবার জানিয়েছে, চলতি আর্থিক বছর শেষে রাজ্যের মোট ঋণের পরিমাণ দাঁড়াবে ৬,৪৭,৮২৫. ৫২ কোটি টাকা। বাড়ছে প্রায় সাড়ে ৩গুণ!
অর্থাৎ মমতা-শাসনে ধার বাড়ছে ৪,৫৪,৯০৫. ৫২ কোটি টাকা।
‘শ্রী’ এবার রাস্তায়
নতুন একটি প্রকল্প ঘোষনা করেছে রাজ্য সরকার। ‘রাস্তাশ্রী।’ শুধু নতুন রাস্তা তৈরি হবে না এই প্রকল্পে। পুরোন রাস্তা মেরামতির কাজও হবে। ১১,৫০০কিমি রাস্তার কাজ হবে এই প্রকল্পে।
আর কিছু? সরকার ঘোষনা করেছে, লক্ষ্মীর ভান্ডারে যাঁরা ভাতা পাচ্ছেন, ৬০ বছর হলে তাঁদের বার্ধক্য ভাতার আওতায় আনা হবে। তাঁরা ১০০০টাকা করে পাবেন। কিন্তু কী করে? বার্ধক্য ভাতা পাওয়ার কিছু নিয়ম আছে। এর একাংশ টাকা কেন্দ্রীয় সরকার দেয়। তার রাজ্যওয়াড়ি কোটাও থাকে। লক্ষ্মীর ভান্ডার যাঁরা পাচ্ছেন, তাঁরা সবাই কেন্দ্রীয় সরকারের সোসাল অ্যাসিস্ট্যান্স প্রোগ্রামের আওতায় আসতে পারবেন, এই নিশ্চয়তা সরকার দিচ্ছে কী করে?
উত্তর নেই। আবার ভাঁওতা। ধোঁয়াশা।
বাজেট পুরোপুরি এই ভাঁওতা, ধোঁয়াশার বাজেট।