নাৎসি জার্মানি সোভিয়েত ইউনিয়নকে আক্রমন করার দিন থেকেই বিশ্বযুদ্ধের চরিত্র বদলে হয়ে উঠেছিল জনযুদ্ধ। একদিকে মানব সভ্যতা রক্ষাকারী সোভিয়েত ইউনিয়ন, আর একদিকে মানব সভ্যতার শত্রু ফ্যাসিবাদ।
সোভিয়েত ইউনিয়নের কাছেই পরাজিত হয়েছিলেন হিটলার।
সভ্যতার এযাবতকালের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ সেই ঘটনায় নারীদের ভূমিকা ছিল অত্যন্ত তাৎপর্যপূর্ণ। নানা তথ্যে আমরা জানি হিটলারের সমর্থকদের মধ্যে মহিলারা যথেষ্ট ছিলেন। যদিও হিটলারের গলায় তাঁরা শুনেছিলেন,‘‘সন্তান পালনে, রান্নাঘরে ও গীর্জায় উপাসনায় নারীর ভূমিকাকে সীমাবদ্ধ রাখতে হবে।’’ তবু নাৎসিবাদের সমর্থক, প্রচারক ছিলেন মহিলাদের একাংশ।
অথচ প্রথম বিশ্বযুদ্ধে বিধ্বস্ত জার্মানিতে কাজের হাহাকার মহিলাদেরও গুরুত্বপূর্ণ সঙ্কটে ফেলেছিল। তীব্র আর্থিক মন্দা, বেকারিতে মহিলাদেরও এক বড় অংশ বিপন্ন। তবু সেই মহিলাদেরই একাংশ ইহুদি বিতারণ, ‘আর্য রক্তের বিশুদ্ধতা’ রক্ষায় হিটলারের প্রবল সমর্থক, প্রচারক হয়ে উঠেছিলেন।
দেশে দেশে পিছিয়ে থাকা সমাজের, দর্শনের ধারক বেশিরভাগ ক্ষেত্রে নারীরা হয়ে থাকেন। প্রতিক্রিয়ার অত্যন্ত বিপজ্জনক মজুতশক্তি হিসাবেও মহিলাদের শাসকরা ব্যবহার করে যুগে যুগে।
কিন্তু সোভিয়েত ইউনিয়নে কী দেখা গেছিল? দেশরক্ষার লড়াই এবং ফ্যাসিবাদ, নাৎসিবাদের বিরুদ্ধে আন্তর্জাতিকবাদের আদর্শে উদ্বুদ্ধ লড়াই মিলে গেল। এবং সেই সংগ্রামে সৈনিকের ভূমিকায় অবতীর্ণ হলেন শ্রমজীবী, কৃষিজীবী মহিলারা। কারখানায় কাজ করা মহিলা, খেতে কাজ করা নারী — প্রত্যেকে হয়ে উঠলেন যোদ্ধা।
১৯১৭ পরবর্তী সমাজতন্ত্র-নির্মাণের সময়কালে সোভিয়েত ইউনিয়নে নারীর বিকাশে বিশেষ গুরুত্ব দেওয়া হয়েছিল। আর বিকাশের জন্য অর্থনৈতিক স্বনির্ভরতা অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। জমি এবং কারখানায় ব্যক্তিগত মালিকানা বিলুপ্ত হয়েছিল। ফলে ভূস্বামী ও পুঁজির মালিকদের ক্ষমতারও উচ্ছেদ হয়ে গেছিল। ১৯১৯-এ ‘নারী-শ্রমিকদের অদলীয় সম্মেলন’-এ লেনিন বললেন,‘‘ভূস্বামী ও পুঁজির মালিকদের ক্ষমতাও উচ্ছেদ করা হয়েছে, সেই মুহূর্ত থেকেই রাজনীতির কাজ সহজ, সুস্পষ্ট এবং মেহনতকারী মানুষ এবং মেহনতকারী মেয়েদেরও নাগালের মধ্যে এসে পড়েছে।’’
অর্থাৎ অর্থনৈতিক স্বনির্ভরতা নারীর উপর চেপে বসে থাকা দীর্ঘকালের প্রতিক্রিয়াশীল সামাজিক জগদ্দল পাথরকে ধাক্কা মেরে সরিয়ে দিয়েছিল। নারীর গণতন্ত্রকে নিশ্চিত করেছিল। তখন নারী হয়ে উঠেছেন নির্মাতা এবং নতুন ব্যবস্থার অন্যতম পরিচালক। এই বিপুল শক্তি, যা দীর্ঘ দাসত্বের শৃঙ্খল থেকে মুক্তির পথ পেয়েছে সমাজতন্ত্রে।
নারীসমাজ সেই আপন হয়ে ওঠা ব্যবস্থাকে রক্ষার জন্য তার সর্বশক্তি প্রয়োগ করবে। নাৎসি জার্মানির আগ্রাসনের বিরুদ্ধে তাই নারী শক্তিকে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকায় দেখা গিয়েছিল।
কিন্তু এই কাজ কী খুব সহজ না। লেনিন কী বলছেন? সেই ১৯১৯, ২৮শে জুন। লেনিনের কন্ঠে শোনা গেল,‘‘মুক্তিদানের জন্য সব রকমের আইন বিধিবদ্ধ হওয়া সত্বেও নারী পারিবারিক দাসীই রয়ে গিয়েছে। কারণ তুচ্ছ ঘরকন্নার কাজ তাকে নিষ্পেষিত করেছে, তার টুঁটি চেপে ধরেছে; তাকে হতবুদ্ধি ও অবনত করে তাকে রান্নাঘরের কাজে ও শিশুপালনেই আটকে রেখেছে।…মেয়েদের প্রকৃত মুক্তি, প্রকৃত কমিউনিজম তখনই আরম্ভ হবে, যখন এই হীন পারিবারিক অর্থনীতির বিরুদ্ধে (ক্ষমতাসীন শ্রেণির দ্বারা পরিচালিত) ব্যাপক সংগ্রাম শুরু হবে, অর্থাৎ এই অর্থনীতি যখন ব্যাপকভাবে সমাজতান্ত্রিক অর্থনীতিতে রূপান্তরিত হবে।’’
অর্থাৎ ‘ক্ষমতাসীন শ্রেণি’র অর্থনীতি বনাম সমাজতন্ত্রের দিকে অগ্রসরমান অর্থনীতিই প্রাথমিক এবং গুরুত্বপূর্ণ মাপকাঠি নারীর অবস্থানের ক্ষেত্রে।
একদিকে জমিদার এবং বুর্জোয়াদের অর্থনীতি। অন্যদিকে সমাজতন্ত্র নির্মাণের অর্থনীতি। নারীর ভবিষ্যৎ এই ভাবেই দেশের ভবিষ্যতের সঙ্গে জড়িয়ে।
আমাদের দেশ আধা সামন্ততান্ত্রিক, আধা পুঁজিবাদী শাসনে আবদ্ধ। বিজেপি এই ব্যবস্থার প্রধান রক্ষক। আরএসএস সহ সঙ্ঘ পরিবারের দর্শন সেই ব্যবস্থার ভিত্তি। বিশেষত সারা পৃথিবী যখন অতি দক্ষিণপন্থার দিকে এগিয়েছে, ভারত যখন সেই উগ্র দক্ষিণপন্থার অন্যতম প্রধান মদতদাতা, তখন নারীর ভবিষ্যৎ আগের যে কোনও সময়ের থেকে বেশি বিপন্ন।
আবার সেই নারীদেরই একাংশ হয়ে উঠেছে ফ্যাসিবাদী ধাঁচের শাসকের অন্যতম হাতিয়ার।
২০১৯-র সেপ্টেম্বরে ‘নারীদের অবস্থান’ সম্পর্কে একটি রিপোর্ট প্রকাশ করতে গিয়ে রাষ্ট্রীয় স্বয়ংসেবক সঙ্ঘ (আরএসএস)-র সরসঙ্ঘচালক মোহন ভাগবৎ বলেন,‘‘নারীরা সব বিরোধগুলিকে খেয়াল রেখে ঘরের যত্ন নেয়, ঘরকে মসৃণ ও শান্তিপূর্ণভাবে চালায়। এই ক্ষেত্রে নারীদের বিপুল ভূমিকা আছে। পুরুষরা তা পারে না।…প্রকৃতি পুরুষকে যে গুণাবলী দিয়েছে তার মাধ্যমে সে শিকার করে, শ্রম করে, কিন্তু তাদের ঘরের বিষয়গুলি যত্ন করার সামর্থ্য দেয়নি।’’
অর্থাৎ — পুরুষরা ‘শ্রম’ করে। নারীরা ‘ঘরের যত্ন নেয়।’ তা শ্রম হিসাবে গণ্য নয়। পুরুষ বাইরে কাজ করবে। নারী ঘরে ঢুকে ‘ঘরকে মসৃণ’ করবে।
মানে — নারীকে উৎপাদন, উপার্জনের ক্ষেত্র থেকে দূরে সরিয়ে রাখো।
লক্ষ্য দুটি — নারীর অর্থনৈতিক স্বাধীনতার সুযোগ রুদ্ধ করা। নারীকে আপন লক্ষ্যে, স্বার্থে সংগঠিত হওয়ার সুযোগ থেকে দূরে সরিয়ে দেওয়া।
১৯২৫-এ আরএসএস তৈরি। প্রথম থেকেই এটি উচ্চবর্ণের পুরুষদের সংগঠন। ১৯৩৬-এ এক স্বয়ংসেবকের মা লক্ষ্মীবাঈ কেলকার সঙ্ঘে নারীদের সদস্যপদ চেয়ে আবেদন করেন তৎকালীন সঙ্ঘপ্রধান হেডগেওয়ারের কাছে। তাঁর আবেদন নাকচ করা হয়। তাঁকে ‘রাষ্ট্র সেবিকা সমিতি’ তৈরির অনুমতিটুকু দেওয়া হয়। সঙ্ঘের বিচারে পুরুষরা হতে পারেন ‘স্বয়ংসেবক।’ নারীরা — শুধুই সেবিকা। আর প্রীতিলতা ওয়াদ্দেদারের মরদেহের পাশে পাওয়া তাঁর শেষ বিবৃতিতে মিলেছিল সংগ্রামে, দেশের জন্য লড়াইয়ে নারীর সমানাধিকারের দাবি!
সঙ্ঘের দর্শন ভারতের স্বাধীনতা সংগ্রামের আদর্শ, ফলগুলিরও বিরোধী।
মনুস্মৃতি সঙ্ঘের আদর্শের ভিত্তি। যে মনুস্মৃতির ভিত্তিতে দেশের আইন-কানুনগুলি পালটানোর উদ্যোগ নিয়েছেন নরেন্দ্র মোদী। সেই মনুস্মৃতিতে নারীদের সম্পর্কে বেশ কিছু বিধান আছে। তার দুটি এখানে উল্লেখ্য। ‘কণ্যা হল ভূমি, পশু ও বস্তুর ন্যায়। তাই তাকে সম্প্রদান করতে হয়।’ আর? ‘গৃহস্থালীর সব কাজ নারীকেই সম্পন্ন করতে হবে সুচারুভাবে। তার পৃথিবীতে পতি হল প্রভু। তার কাজ সন্তান উৎপাদন, আত্মীয় পরিজনের সেবা এবং গৃহস্থালীর কাজ। এই কাজ পুরুষ করলে হয় সে দাস অথবা শূদ্র।’
সমাজতন্ত্র নির্মাণে অথবা কমিউনিস্টদের দর্শন এই ধারনার পুরোপুরি বিপরীত। সঙ্ঘের দর্শন, ব্রাহ্মণ্যবাদী সামন্ততান্ত্রিক শাসনের হাতিয়ার।
তবে শুধু হিন্দুত্ববাদেই নয়, পৃথিবীর অধিকাংশ ধর্মেই নারীদের অবস্থান কিছুটা এমনই। এর বিরুদ্ধে সোভিয়ত ইউনিয়নেও সমাজতন্ত্র নির্মাণে বলশেভিকদের লড়াই করতে হয়েছিল। লেনিনের কথাই উল্লেখ করা যায়।
বিপ্লবের এক বছর পরে বিভিন্ন আইন চালু করার পরেও লেনিন এবং সোভিয়েত নেতৃত্ব দেখেছিলেন যে, শহরে এবং কারখানা অঞ্চলে বিবাহের পূর্ণ স্বাধীনতা সংক্রান্ত আইন অনেকটাই মেনে চলা হচ্ছে। সচেতনতাও বেড়েছে। কিন্ত গ্রাম এবং মফস্বল এলাকায় সে সব প্রায় কাগজপত্রেই সীমাবদ্ধ হয়ে আছে। সেখানে তখনও পাদ্রিদের প্রাধান্য। গির্জাতেই বিয়ে হচ্ছে।
১৯১৮-র ১৯শে নভেম্বর। নিখিল রাশিয়া নারী-শ্রমিক কংগ্রেসে লেনিন বললেন,‘‘আমরা জানি যে, সেকেলে অপ্রচলিত নিয়ম-কানুনের সব বোঝা শ্রমজীবী মেয়েদেরই বইতে হয়।’’ পল্লী অঞ্চলে পাদ্রিদের প্রভাব, গির্জার সক্রিয়তা সম্পর্কে তিনি বললেন,‘‘প্রাচীন আইন-কানুনের তুলনায় এই দুর্নীতির (পাদ্রিদের সামাজিক প্রভাব) উচ্ছেদ করা কঠিনতর কাজ।’’
সেই কাজ করতেই হবে নারী এবং সামগ্রিকভাবে সমাজের বিকাশের জন্য। কিন্তু সতর্ক থাকতে হবে। সেই প্রসঙ্গে লেনিনের পরামর্শ, ‘‘ধর্মীয় কুসংস্কারের বিরুদ্ধে খুব সতর্কতার সঙ্গে লড়াই করতে হবে। ধর্মভাবে আঘাত দিয়ে যারা এই লড়াই চালায় তারা অনিষ্টই করে বেশি। প্রচারের ও শিক্ষার মাধ্যমেই এই লড়াই চালাতে হবে। উগ্র স্বভাব দেখালে জনগণের বিরুদ্ধাচারণই করা হবে। এই জাতীয় লড়াইয়ের ফলে ধর্মের ভিত্তিতে তারা বিভক্ত হয়ে পড়বে অথচ আমাদের শক্তি একতায়। দারিদ্র এবং অজ্ঞতাই ধর্মীয় কুসংস্কারের গভীর উৎসস্থল। তাই এই সবের বিরুদ্ধেও আমাদের লড়াই করতে হবে।’’
শ্রমজীবীদের ঐক্য অক্ষুন্ন রাখার সংগ্রাম ফ্যাসিবাদের বিরুদ্ধে সংগ্রামের গুরুত্বপূর্ণ শর্ত। নারী সমাজের ভূমিকা এবং তাঁদের মধ্যে সেই লক্ষ্যে কাজের পথ নভেম্বর বিপ্লবও দেখিয়েছে। তাই নভেম্বরের বিপ্লবের চর্চা প্রতি মুহূর্তে প্রাসঙ্গিক।