১০ জানুয়ারি , ২০২১ রবিবার
সাঁইবাড়ি হত্যাকাণ্ড : কুৎসার আড়ালে
১৯৭০সালের ১৬মার্চ।ভেঙে দেওয়া হলো দ্বিতীয় যুক্তফ্রন্ট সরকার। দু’টি যুক্তফ্রন্ট সরকারের আমলে ২২মাসে বেনামি জমি দখলমুক্ত করে ভূমিহীন কৃষকদের মধ্যে বিলি করার কাজ দ্রুততার সাথে এগিয়ে ছিল । সারা বাংলায় কৃষকরা লাল ঝান্ডার নীচে শত শত বছরের বঞ্চনার জোয়াল ছুঁড়ে ফেলে নতুন আত্মবিশ্বাস নিয়ে জেগে উঠছিলো। স্বাভাবিকভাবেই যারা বড় বড় জোতের মালিক তাদের চক্ষুশূল হয়ে উঠেছিল যুক্তফ্রন্ট সরকার। গ্রামের বড়লোক, জমিদার-জোতদারদের স্বার্থ রক্ষা করতে,বাংলার বুকে শ্রমিক-কৃষকের অর্জিত অধিকার ছিনিয়ে নিতে তৎকালীন কেন্দ্রীয় সরকার,দ্বিতীয় যুক্তফ্রন্ট সরকারের মুখ্যমন্ত্রী অজয় মুখার্জি ও তার দল বাংলা কংগ্রেস এবং প্রধান বিরোধী দল কংগ্রেসের ষড়যন্ত্রে যুক্তফ্রন্ট সরকারের পতন ঘটানো হয়।সিপিআই(এম), পশ্চিমবঙ্গ রাজ্য কমিটির তৎকালীন সম্পাদক প্রমোদ দাশগুপ্তর পূর্ববর্তী ঘোষণা অনুযায়ী পরের দিন,অর্থাৎ ১৭ মার্চ সারা বাংলা জুড়ে ধর্মঘট পালিত হয়।
ধর্মঘটের দিন বর্ধমান শহরে বিভিন্ন দিক থেকে লাল ঝান্ডা নিয়ে সংগ্রামী কৃষক ও জনসাধারণ মিছিল করে আসতে থাকেন। শান্তিপূর্ণভাবে ধর্মঘট চলাকালীন আদিবাসী জনগণের একটি মিছিল তেলমারি রোডে এলে একটি শববাহী দল এসে পড়ে। স্বাভাবিকভাবেই সৌজন্যে দেখিয়ে মিছিলে অংশগ্রহণকারীরা শব যাত্রীদের যাওয়ার পথ করে দেয়। কিন্তু এরপর যা হয় তা রুপোলি পর্দাকে হার মানাতে পারে। আসলে ঐ শবদেহ কোন মৃত মানুষের ছিলনা,ও ছিল নকল শব, যুক্তফ্রন্টের শব। শববাহী বাঁশের খাটিয়ায় ছিল বোমার মত মারাত্মক অস্ত্রশস্ত্র। মিছিলের মাঝে শববাহী খাটিয়াটি ফেলে দিলে বোমাগুলি ফাটতে শুরু করে আর শবযাত্রী সেজে আসা দুষ্কৃতীরা ঝাঁপিয়ে পড়ে মিছিলের ওপর। চরম বিশৃঙ্খলা সৃষ্টি হয়।তবে দুষ্কৃতীদের তাণ্ডবে এলাকা ছেড়ে পালিয়ে না গিয়ে ওদেরই তাড়া করে মিছিলে আসা জনতা।এবার গুন্ডার দল বর্ধমান শহরের কুখ্যাত কংগ্রেসী গুন্ডা নব সাঁই,প্রণব সাঁই, মলয় সাঁই এর বাড়িতে আশ্রয় নেয়। উত্তেজিত জনতা সাঁইবাড়িতে চড়াও হলে প্রণব সাঁই ও মলয় সাঁই দুই ভাই জনরোষে নিহত হন।
এরপর এই ঘটনাকে কেন্দ্র করে আসরে নেমে পড়ে রাজ্যের তৎকালীন রাজ্যপাল এস.এস ধাওয়ান ও যাবতীয় বাম বিরোধী শক্তি। সিপিআই(এম) এর বর্ধমান জেলা কমিটির সম্পাদক সুবোধ চৌধুরী, পার্টিনেতা বিনয় কোঙার,নিরুপম সেন, মদন ঘোষ প্রমুখদের সরাসরি অভিযুক্ত করে শুরু হয় লাগামহীন কুৎসা যা এখনো চলছে। নির্বিচারে গ্রেফতার ও দমন-পীড়ন নামিয়ে আনা হয় বামপন্থী কর্মী ও সমর্থকদের ওপর,তবে প্রত্যাশিতভাবেই মিছিলে আক্রমনকারী দুষ্কৃতীদের একজনকেও গ্রেপ্তার করা হয়নি। দুস্কৃতির দল পুলিশের গাড়িতে চেপে বামপন্থী কর্মী-সমর্থকদের বাড়ি চিনিয়ে তাদের গ্রেফতার করানোর কাজ করতে থাকে। এফআইআর-এ নতুন নতুন নাম সংযোজন হতে থাকে আর চলতে থাকে নির্বিচার দমন-পীড়ন। স্কুলের প্রধানশিক্ষক থেকে শুরু করে সরকারি কর্মচারী, সাধারণ গৃহস্থ কেউই বাদ পড়েনি ওদের তাণ্ডব থেকে।
সাঁইবাড়ি হত্যাকান্ড নিয়ে প্রাক্তন বিচারপতি তারাপদ রায়ের নেতৃত্বে তদন্ত কমিশন গঠিত হয়। বাম বিরোধী কুৎসার স্বরূপ উন্মোচন হয়ে যায় বর্ধমান টাউন হলে এই কমিশনের শুনানি চলা কালীন। যে ব্যক্তি সাঁইবাড়ি ঘটনায় সিপিআই(এম) নেতাকর্মীদের নামে এফআইআর করেছিলেন তিনি নিজে কমিশনের সামনে এসে বলেন যে কংগ্রেস নেতাদের চাপে তিনি এই কাজ করতে বাধ্য হয়েছেন। যাবতীয় সাক্ষ্য-প্রমাণ গ্রহণের পর এই রিপোর্ট তৎকালীন সরকারের কাছে জমা পড়ে।কিন্তু সেই রিপোর্টে যেহেতু সিপিআই(এম) নেতাদের অভিযুক্ত করা হয়নি তাই সেই রিপোর্ট সিদ্ধার্থশংকর রায়ের সরকার বিধানসভায় পেশও করেনি। অথচ আজও “আপন মনের মাধুরী মিশায়ে” সাঁইবাড়ি কাণ্ড নিয়ে মিথ্যাচার চলছে।
এখনো যারা সাঁইবাড়ি কান্ডে সিপিআইএমকে অভিযুক্ত করেন ও চরম নৃশংসতার অভিযোগ আনেন তাদের কাছে কয়েকটি প্রশ্ন:
১। সাঁইবাড়ি কাণ্ড নিয়ে বিচার বিভাগীয় তদন্ত কমিশনের রিপোর্ট বিধানসভার লাইব্রেরীতে এখনো আছে। যে কেউ পড়ে নিয়ে দেখতে পারেন যে সেখানে সিপিআই(এম) নেতাদের ষড়যন্ত্রকারী ও আক্রমনকারী বলে অভিযুক্ত করা আছে কিনা। সেই সহজ কাজটি না করে খবরের কাগজে,টেলিভিশন চ্যানেলে আর সোস্যাল মিডিয়ায় কুৎসার বেসাতি কেন?
২। ২০১২সালে তৃণমূল কংগ্রেসের সরকার সাঁইবাড়ি নিয়ে আবারএকটি তদন্ত কমিশন বসিয়েছিল। সেই মুখার্জি কমিশনের রিপোর্ট ২০১৭সালে জমা পড়েছে। এখনও তা রাজ্য বিধানসভায় পেশ হয়নি কেন? সেখানেও সিপিআই(এম)কে অভিযুক্ত করা যায়নি বলে?
৩। নিহত প্রণব সাঁই এর পরিচয় নিয়ে “সাঁইবাড়ি বিশেষজ্ঞ”রা নীরব কেন?আসলে এনার পরিচয় দেওয়ার মতো নয় কারণ ইনি কংগ্রেসী আমলেই পি ডি অ্যাক্টে গুণ্ডা বলে চিহ্নিত ছিলেন। জামিন পেলেও প্রণব সাঁই এর বর্ধমান শহরে ঢোকা নিষেধ ছিল। ইতিমধ্যে আউসগ্রাম থানা চোরাচালানের কেসে প্রণব সাঁই এর বিরুদ্ধে গ্রেপ্তারি পরোয়ানা জারি করে। এরকম গুণধর ব্যক্তি পুলিশের নজর এড়িয়ে শহরে ঢুকে দুষ্কৃতীদের মদত দিল কি করে?
৪| আত্মরক্ষার অধিকার গণতান্ত্রিক অধিকার। আক্রান্ত মানুষ নিজের জীবন বাঁচানোর জন্য প্রতিরোধ গড়ে তুললে যদি আক্রমণকারী নিহত হয় তাহলে তার দায় কি আক্রান্তের?
যেকোনো মৃত্যুই অনভিপ্রেত, কিন্তু সাঁইবাড়ি হত্যাকান্ড ঘটবার দায় সম্পূর্ণভাবেই আক্রমনকারী দুষ্কৃতীদের। তারা শান্তিপূর্ণ মিছিলে বোমাবাজি করে পরিস্থিতি উত্তপ্ত না করে তুললে এমন ঘটনা ঘটতো না। আর সিপিআই(এম) নেতৃত্বকে এই হত্যাকাণ্ডের জন্য দায়ী করার যত চেষ্টাই হোক না কেন আদালত ও ইতিহাসের বিচারে তারা নিষ্কলঙ্ক।