প্রভাত পট্টনায়েক
নয়া উদারবাদ স্বনির্ভরতার প্রতিটি ক্ষেত্রকেই আক্রমণ করেছে। যে তিনটি ক্ষেত্র ইতিপূর্বে আলোচিত হল তার সবকটির উপরেই নয়া উদারবাদী অর্থনীতির সার্বিক প্রভাব রয়েছে। আমরা এবার আলোচনা করব ঐ তিন ক্ষেত্রে নয়া উদারবাদী অর্থনীতির পরিসরে থেকেই আজকের বাস্তবতায় বিকল্প কোনও বন্দোবস্ত আদৌ সম্ভব কি না।
নয়ের দশকে আমাদের দেশে নয়া উদারবাদকে সার্বিক নীতি হিসাবে মেনে চলার শুরু। তার আগে আমরা আমদানিকৃত পণ্য সামগ্রীর ক্ষেত্রে কড়া বিধি-নিষেধ মেনে চলতাম। উদ্দেশ্য ছিল বৈদেশিক মুদ্রার ভান্ডারে যেন চাপ না পড়ে, আরেকদিকে দেশীয় উৎপাদনেরও বিকাশ ঘটে। ভারতে আমদানি-রপ্তানি সংক্রান্ত হিসাবের ঘাটতি মেটানো হত সাধারণভাবে তিনটি উপায়ে। রপ্তানি বাবদ আয়, কম সুদের অর্থ সাহায্য (কনসেশনাল এইডস) যাতে দীর্ঘমেয়াদী পরিকল্পনা রুপায়নে সহায়তা পাওয়া যায় এবং ঝুঁকি অপেক্ষাকৃত কম এমন ধরণের লগ্নী পুঁজির ব্যবহার। নয়া উদারবাদ এমন বন্দোবস্তের সুযোগ আর রাখেনি। যত সময় গেছে তত বেশি আমরা বৈদেশিক মুদ্রার উপরে নির্ভরশীল হতে থেকেছি, একইসাথে বেড়েছে লগ্নী পুঁজির উপরে ভরসা করে বাজেট ঘাটতি মেটানোর বাধ্যবাধকতা। আজকের দিনে আমাদের দেশে রিজার্ভ ব্যাংকের হাতে এক বিরাট পরিমানে বৈদেশিক মুদ্রা রয়েছে (প্রায় ৬০০ বিলিয়ন ডলার), এক দীর্ঘমেয়াদী নীতির কারণেই সেই ভান্ডার নির্মিত হতে পেরেছে। তবু এই সত্য মনে রাখতে হয় যে এহেন ভান্ডারের অনেকটাই শর্তসাপেক্ষ ঋণ ও লগ্নী পুঁজির জোরে গড়ে তোলা হয়েছে। এমন লগ্নী বাজারের তেজিভাবের সাথে সমানুপাতিক মানসিকতায় কার্যকরী থাকে। তিলমাত্র বিপদের আশংকায় সেই ভান্ডারের এক উল্লেখযোগ্য অংশই যে কোনও মুহূর্তে দেশের বাজার থেকে অদৃশ্য হয়ে যাওয়ার সম্ভাবনা থাকে। চীনও তাদের বৈদেশিক মুদ্রাভান্ডারে বিরাট পরিমাণ সঞ্চয় রেখেছে। কিন্তু চীনের ফরেন এক্সচেঞ্জ রিজার্ভ মূলত রপ্তানির মাধ্যমে আদায়কৃত উদ্বৃত্ত আয়ের (এক্সপোর্ট সারপ্লাস) ভিত্তিতে গড়ে তোলা, এই কারণেই তারা মন্দার অবস্থাকে মোকাবিলা করতে সক্ষম হয়েছে। আমাদের দেশে রিজার্ভে বৈদেশিক মুদ্রার পরিমাণের অনেকটাই ঋণ ভিত্তিতে পাওয়া বলে তা বাজারের ঝুঁকির সাথে যুক্ত। বাজারে মন্দার বিপদকে আঁচ করে লগ্নী মুখ ফেরালে আমাদের সমস্যার মুখে পড়তে হবে। বর্তমানে বিশ্বায়িত লগ্নী পুঁজি সংকটে রয়েছে, অর্থনৈতিক উন্নয়ন আটকে পড়া অবস্থার মুখোমুখি হয়েছে। পরিস্থিতির পর্যালোচনায় আমেরিকার রক্ষণশীল অর্থনীতিবিদেরা অবধি বলতে বাধ্য হচ্ছেন- ‘সমসাময়িক পুঁজিবাদ অভ্যন্তরীণ স্থবিরতার পর্যায়ে প্রবেশ করেছে’, সামনে এগোনোর রাস্তা খুঁজে পাওয়া যাচ্ছে না। আমাদের রপ্তানি কমতে শুরু করেছে। ডলারের তুলনায় ভারতীয় মুদ্রার দাম ক্রমশ কমছে, এখন আমরা এক ডলারের বিনিময়ে ৮৩ টাকা খরচ করতে বাধ্য হচ্ছি। এমন অবস্থাতেই দেশীয় বাজার থেকে লগ্নী হওয়া পুঁজি বেরিয়ে যেতে শুরু করে। লগ্নী পুঁজির চরিত্র বরাবরই অস্থির, বাজারে মন্দার অবস্থা আশঙ্কা করে একবার যদি বিনিয়োগ কমতে শুরু করলে আমাদের মতো দেশ লগ্নী পুঁজির উপরে মাত্রাতিরিক্ত নির্ভরতার মূল্য চোকাতে বাধ্য হবে। নয়া উদারবাদী বন্দোবস্তে পণ্য ও পুঁজির বাধাহীন চলাচল এমন মাত্রায় পৌঁছে গেছে যেখানে মালিকানার মর্জিমাফিক এক দেশের বাজার থেকে আরেক দেশের বাজারে পুঁজির যাতায়াত অবাধ, এমন অবস্থায় বিদেশী লগ্নীর জোরে দীর্ঘমেয়াদী কোনও পরিকল্পনাই কার্যকরী হয়ে ওঠে না। তাই নয়া উদারবাদী অর্থনীতির আওতাধীন থেকে স্বনির্ভরতার লক্ষ্যে বৈদেশিক মুদ্রাভান্ডারের উপর ভরসা করা চলে না।
খাদ্যসামগ্রীতে স্বনির্ভরতা অর্জনের বিষয়ে ইতিপূর্বে আমরা আলোচনা করেছি। এই বিষয়টি যেকোনো দেশের জন্যই এমন গুরুত্বপূর্ণ যা বারে বারে উল্লিখিত হওয়ার দরকার। খাদ্যে স্বনির্ভর না হলে কি হয় সেই প্রসঙ্গে আমাদের চোখের সামনেই এক বিরাট উদাহরণ রয়েছে। লগ্নী পুঁজির দাপটের সামনে মাথা ঝুঁকিয়ে আফ্রিকা নিজেদের খাদ্য স্বনির্ভরতা খুইয়েছে। উন্নত পুঁজিবাদী দেশগুলি সদা সর্বদা নিজেদের দেশে উৎপন্ন হওয়া খাদ্যশস্যকে অন্যান্য দেশের বাজারে বিক্রি করতে চায়। এই জন্য তারা আফ্রিকা, এশিয়াতে বিভিন্ন দেশের কৃষিজমির চরিত্র বদল করতে চাইছে। তাদের প্রস্তাব বা বলা উচিত তাদের নিদান হল বিভিন্ন দেশে বিরাট কৃষিজমিকে খাদ্যশস্য উৎপন্ন করার কাজে না লাগিয়ে অর্থকরী ফসল (ফুল এবং অন্যান্য শস্য যা কিছুতে বিদেশের বাজারে ভালো চাহিদা রয়েছে) উৎপাদনে ব্যবহার করা হোক। আফ্রিকা এই প্রস্তাবে সাড়া দিয়ে নিজেদের খাদ্য উৎপাদন ব্যবস্থাকে বদলে ফেলে, কৃষিজমিতে জরুরী খাদ্যশস্য চাষ না করে বৈদেশিক বাজারের জন্য অর্থকরী চাষের কাজে ব্যবহার করতে শুরু করে। দেশের কৃষিজমিকে খাদ্যশস্য উৎপাদনের কাজে ব্যবহার না করে রপ্তানির উদ্দেশ্যে ফসল ফলানর কাজে ব্যাহার করতে দেওয়া হলে তার ফলাফল সম্পর্কে বুঝতে আফ্রিকার সাহারা অঞ্চলের উদাহরণটিই সর্বোৎকৃষ্ট। খাদ্যপণ্যের আমদানি উপর নির্ভরশীল হয়ে পড়ার পরে একের পর এক দুর্ভিক্ষ ঐ জায়গাকে সম্পূর্ণ বিধ্বস্ত করে দিয়েছে। এ অবস্থায় বিদেশের বাজার থেকে প্রয়োজনীয় খাদ্য সামগ্রী খরিদ করে সমস্যা মোকাবিলার উপায়টি একেবারেই কাজে আসেনি। ভারতে কৃষিজমির ব্যবহার সম্পর্কে কোন নিয়ন্ত্রক আইন না থাকলেও কৃষিকার্যের পুরানো চেহারা, ন্যূনতম সহায়ক মূল্যের বন্দোবস্ত এবং গনবন্টন ব্যাবস্থা ঘুরপথে দেশের অভ্যন্তরে খাদ্যশস্য উৎপাদনের নিশ্চয়তা দেয়। উন্নত দেশগুলি বহুবছর ধরেই ভারতকে খাদ্যশস্য আমদানি করতে প্রথম থেকেই চাপ দিয়ে আসছে। বিশেষ করে সেইসব খাদ্যশস্য যেগুলি তারা উদ্বৃত্ত উৎপাদন করে, আবার যেসব খাদ্যশস্য উৎপাদনে তারা অভাবী সেক্ষেত্রে রপ্তানি বাড়ানোর জন্য তাদের উপরে চাপ থাকে। ভারত পঞ্চাশের দশকের শেষার্ধে এবং ষাটের দশকের শুরুর দিকে পাবলিক ল ৪৮০ ধারার ভিত্তিতে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র থেকে খাদ্যশস্য আমদানি করত। ষাটের দশকের মাঝামাঝি সময়ে দুবার ফসল উৎপাদনে বিপর্যয় ঘটে যার ফলে বিহারে দুর্ভিক্ষ দেখা দেয়। এই অবস্থায় মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র বলা চলে ভারতের হাত মুচড়ে ধরে খাদ্যশস্যের রপ্তানি চালায় এবং কার্যত আমাদের অবস্থা হয় জাহাজ থেকে মানুষের মুখে খাদ্য পৌঁছানোর। ঐ অবস্থাকে খাদ্য সাম্রাজ্যবাদের একটি প্রকৃষ্ট উদাহরন বলা চলে। অবস্থা এতটাই সংকটের ছিল যে দেশের তৎকালীন খাদ্য এবং কৃষিমন্ত্রী জগজীবন রামকে প্রধানমন্ত্রী ইন্দিরা গান্ধী ‘সবুজ বিপ্লব’ আয়োজন করার নির্দেশ দেন।
খাদ্যশস্য উৎপাদনের খরচ এবং তার বিনিময় মূল্যের মাঝের ব্যাবধান মেটাতে খাদ্যে ভর্তুকি, গনবন্টন ব্যাবস্থা, খাদ্যশস্য সংগ্রহের পদ্ধতি-প্রকরন এবং ন্যূনতম সহায়ক মুল্যের বন্দোবস্ত করা হয় সেই সময় থেকেই। যদিও নয়া উদারবাদী জমানায় এই সবকিছুরই ব্যাপ্তির ক্রমাবনমন ঘটেছে তবু এখনও এই বন্দোবস্তের এক বিরাট বাস্তব প্রেক্ষিত রয়ে গেছে কারন এর আগে কোনো কেন্দ্রীয় সরকার বন্দোবস্তগুলিকে বাতিল করার মতো পাগলামির পরিচয় দেয় নি। সবুজ বিপ্লব নিয়ে কারোর ব্যাক্তিগত মূল্যায়ন যাই হোক না কেন, একথা মানতেই হবে যে বিবিধ পরিবেশগত প্রভাব সত্ত্বেও সবুজ বিপ্লবের কারনেই আমাদের দেশ খাদ্য সাম্রাজ্যবাদের জোয়াল থেকে বেরিয়ে আসতে পেরেছে এবং খাদ্যে আত্মনির্ভরতা অর্জন করেছে যদিও এর ফলে জনগণের এক বড় অংশের মধ্যেই খাদ্যের পরিমান ও আয়ের অস্বাভাবিকতা তৈরি হয়েছে।
অতীতের শিক্ষা এই যে আর কোনভাবেই আমাদের যেন খাদ্য সাম্রাজ্যবাদের খপ্পরে না পড়তে হয়। যদিও কেউ প্রশ্ন তুলতেই পারেন আন্তর্জাতিক বাজার থেকে অন্যান্য বহুবিধ পণ্যের আমদানি করার মতো ভারতে খাদ্যই বা কেন আমদানি করা হবে না? এই একটি প্রশ্নের অনেকগুলি জবাব হয়। প্রথম কথা, বহির্বিশ্বের কথামতো তাদের প্রয়োজনের খাদ্যশস্য (যা দেশীয় ফসলের বদলী হিসাবে উৎপন্ন করা হবে আমাদের জমিতে) উৎপাদন এবং রপ্তানির যে পন্থা তাতে উৎপাদিত পণ্যের মূল্যমানের ওঠানামার এক বিরাট ঝুঁকি থেকে যায় যেমনটি বৈদেশিক মুদ্রাভান্ডারের ক্ষেত্রেও থাকে। আর তাই, কিছু বছর বাদে আমাদের দেশের হাতে আন্তর্জাতিক বাজার থেকে খাদ্যপন্য আমদানি করার মতো যথেষ্ট বৈদেশিক মুদ্রার যোগান না থাকার সম্ভাবনা প্রবল।
দুই, বিনিয়োগের বহির্গমন বেড়ে গেলেও একই অবস্থা হবে। একথা ঠিক, এই মুহূর্তে আমাদের দেশে বৈদেশিক মুদ্রা ভান্ডারে মজুত যথেষ্টই, কিন্তু সেই মজুতের উপরে চিরকালের জন্য ভরসা করা চলে না। বিনিয়োগের বহির্গমন হবে না এবং আমরা এক দীর্ঘ সময় ধরে আন্তর্জাতিক বাজার থেকে খাদ্য আমদানি করতে পারব এমন প্রকল্পনার অর্থ কোটি কোটি মানুষের ভবিষ্যৎ নির্ভর করবে একগোছা বিনিয়োগ সংক্রান্ত ফাটকাবাজের খেয়ালখুশির উপরে।
তিন, ভারতের মতো এত বড় একটি দেশ যদি আচমকাই আন্তর্জাতিক বাজার থেকে খাদ্য আমদানির পরিমান বাড়িয়ে দেয় তবে সেই বাজারে খাদ্যের দামও হঠাৎ করেই অনেকটা বেড়ে যাবে। কিছু বছর বাদে যখন আমাদের দেশে আভ্যন্তরীণ খাদ্য উৎপাদন কমবে নিশ্চিতভাবেই আমাদের অনেক অনেক বেশী দাম দিয়ে আমদানি খরচ ব্যায় করে খাদ্যের চাহিদা মেটাতে বাধ্য হতে হবে।
চার, যদি আমাদের হাতে বিশ্ববাজার থেকে খাদ্য আমদানি করার উপযুক্ত বৈদেশিক মুদ্রাভান্ডার মজুতও থাকে তা সত্বেও যখন আমাদের রপ্তানি করা ফসলের দাম পড়ে যাবে তখন দেশের উৎপাদনকারী জনগণের আয় কমবে ফলে তাদের ক্রয়ক্ষমতাও কমবে এবং তারা আমদানি করা খাদ্যশস্য কিনতে পারবেন না। সেই অবস্থায় দেশে যথেষ্ট পরিমান আমদানিকৃত খাদ্যের মুজুত সত্বেও মানুষ অনাহারে দিন কাটাতে বাধ্য হবেন।
সবশেষে, খাদ্যভান্ডারে জরুরী অবস্থা জারি হবার সম্ভাবনার কথা বাদ দিলেও যে সম্ভাবনা থেকেই যায় তা হল, দেশের জমিতে নিজেদের প্রয়োজনে খাদ্যশস্য উৎপাদন না করে যদি বহির্বিশ্বের সাথে চুক্তিমত তাদের প্রয়োজনের ফসল ফলানো হয় তবে সেই ব্যবস্থায় নিশ্চিতভাবেই প্রতি একরে কর্মসংস্থানের সূচক নিচে নামবে। একরের পরে একর জমিতে যদি খাদ্যশস্যের বদলী হিসাবে খাদ্য নয় এমন ফসল ফলানো চলতে থাকে তবে কৃষিকার্যের শ্রমে নিযুক্ত হয়ে রোজগারের এবং সামগ্রিকভাবে কৃষিতে কর্মসংস্থানের সুযোগ কম হতে বাধ্য। আরেকদিকে খাদ্য নয় এমন ফসল উৎপাদনের কাজে খাদ্যশস্য উৎপাদনের কাজের তুলনায় প্রতি একর জমিতে অনেক কম মজুরি দিতে হবে বলে এই কাজে পাওনা মুনাফা অর্থনীতির অন্য কোন ক্ষেত্রেও কাজের সুযোগ তৈরি করবে না। উল্টে সেই মুনাফা কার্যত বাইরের দেশে কর্মসংস্থান তৈরি করবে। খাদ্যশস্য উৎপাদনের বদলী হিসাবে ফুল, ফলের উৎপাদন বৃদ্ধি করা হলে সার্বিক কর্মসংস্থানের চিত্রে কেবলই অধোগতিপ্রাপ্তি জুটবে। এর সাথে আরও বেশী অংশের জনসাধারণকে দারিদ্রের কবলে চলে যেতে হবে। সর্বশেষ ফলাফল হিসাবে চাহিদার বাজারে সার্বিক ক্রয়ক্ষমতা হ্রাসের ফলে অনাহারে দিন কাটানোর পরিস্থিতি তৈরি হবে। আর তাই অর্থকরী ফসল চাষ কোনোভাবেই কার্যকরী সমাধান না।
আজকের ভারতে রাবার বোর্ড, টি বোর্ডের মতো সংস্থাগুলি এখনও টিকে থাকলেও বাজারে নিয়ন্ত্রণ জারী করার জায়গায় তারা আর নেই। তাই কেরালার মতো রাজ্যে রাবারের দামে মন্দা তৈরি হলেও রাবার বোর্ড তার মোকাবিলায় কিছুই করতে পারেনি। নয়া উদারবাদী বন্দোবস্তই সেই বাধার মূল কারণ। ভারতে উৎপন্ন খাদ্য সামগ্রীর ক্ষেত্রেও কিছুদুর এমনটা ঘটছে, উৎপাদিত পরিমানে বিশেষ ঘাটতি না হলেও ন্যায্য ও উপযুক্ত দাম না মেলায় চাষিদের অবস্থা সঙ্গিন হয়েছে। তারা হয় ব্যাপক ঋণের জালে আটকে পড়ছে নাহলে চাষের কাজ ছেড়ে দিয়ে অন্য মজুরিতে দিন গুজরান করতে বাধ্য হচ্ছে। এখানেই সরকারের ভূমিকা জরুরী ছিল, কিন্তু নয়া উদারবাদ তা চায় না, তা চায় পুঁজির স্বার্থে ব্যাপক ও বিস্তৃততর মুনাফার নিশ্চয়তা- তাই সরকারী সুরক্ষার যাবতীয় বন্দোবস্তই ধ্বংসের মুখে পড়েছে বা বলা ভালো ঠেলে দেওয়া হয়েছে।
এইসমস্ত কারনে কোনো বড় দেশ যদি মনে করে তারা খাদ্যের প্রশ্নে সুরক্ষিত থাকবে তবে সেই দেশকে নিজের জমিতে খাদ্যশস্য উৎপাদনের ব্যবস্থা করতে হবে। কৃষিজমিতে কি উৎপাদন করা হবে সেই সিদ্ধান্ত খোলা বাজারের হাতে ছেড়ে দেওয়া যাবে না। দেশের মাটিতে কি ফসল উৎপন্ন হবে সেব্যাপারে সিদ্ধান্ত নিতে সরকারকে হস্তক্ষেপের ব্যবস্থা হতেই হবে – এটাই অতি প্রয়োজনীয় সামাজিক বাস্তবতা। এই লক্ষ্যে একটি গুরুত্বপূর্ণ পদক্ষেপই হল বাজারে ফসল বিক্রি হবে সরকার নির্ধারিত দামে। বাজারের ইচ্ছামতো দামে খাদ্যপণ্য বেচাকেনার বিরুদ্ধে গিয়েই সরকার বাজারকে নিয়ন্ত্রন করবে।
আগেই উল্লেখ করা হয়েছে প্রয়োজনীয় খাদ্য সামগ্রীর পরিমাণে অভ্যন্তরীণ উৎপাদনে ঘাটতি হলে বিদেশের বাজার থেকে খরিদ মারফত তা মিটিয়ে নেওয়ার উপায় খুব একটা কার্যকরী হয় না। এমনটা আরও ঘটে কারণ আপদকালিন চাহিদার মোকাবিলায় বৈদেশিক মুদ্রাভান্ডার থেকে পরিস্থিতি মোকাবিলার চেষ্টা করা হলেও ঐ একই সময়ে আন্তর্জাতিক বাজারে আচমকা চাহিদা বৃদ্ধির খবর পাওয়া মাত্রই যাবতীয় দাম চড়া হয়ে ওঠে। তখন যে অর্থভাণ্ডার যথেষ্ট বলে মনে করা হচ্ছিল তাকেই অপ্রতুল বলে মেনে নেওয়া ছাড়া উপায় হয় না। এর সুত্রপাত ঘটে আন্তর্জাতিক বাজারে অর্থকরী ফসলের দাম পড়ে যাওয়ায়। একদিকে আমরা নিজেদের খাদ্যভান্ডারে স্বনির্ভরতা খুইয়ে বসি, আরেকদিকে উৎপাদিত ফসলের উপযুক্ত (যেমনটা ধারণা করা হয়েছিল) দাম না মেলায় এক বিরাট পরিমাণ জনসাধারণের ক্রয়ক্ষমতাও কমে যায়। তাই বাইরে থেকে খাদ্য কিনে আনলেই সমস্যার সমাধান হবে এমনটা ভাবা একেবারেই ভুল, কেননা বাড়তি দাম দিয়ে খরিদ করা সামগ্রী কেনার মত চাহিদা বাজারে না থাকলে সেই পরিকল্পনা মুখ থুবড়ে পড়তে বাধ্য। আফ্রিকায় এমনটাই ঘটেছে। ভারতে নয়া কৃষি আইন জারী করে সেই পথেই চলার চেষ্টা হয়েছিল। আপাতত দেশের কৃষকসমাজ সেই বিপদ প্রতিহত করেছেন। গোটা দেশেরই কৃষকদের প্রতি কৃতজ্ঞ থাকা উচিত। অবশ্য মুখে সেইসব আইন বাতিলের ঘোষণা হলেও ঘুরপথে সেগুলিকে কার্যকরী করার ব্যবস্থা জারী রয়েছে। এধরণের অপচেস্টার বিরুদ্ধে জনসাধারণকে প্রকৃত অর্থে অবহিত করতে যারা বিশেষভাবে সক্রিয় থেকেছেন, কৃষকদের লড়াইতে পাশে থেকেছেন যেমন প্রবীর পুরকায়স্থ- তাকে এবং আরও অনেককেই এখন সন্ত্রাসবাদী কাজে মদত যোগানোর অভিযোগে গ্রেফতার হতে হচ্ছে। তাই একথা বলাই চলে নয়া উদারবাদ কোনোভাবেই খাদ্য স্বনির্ভরতা অর্জন করতে দেয় না, সে পথে বারংবার বাধা সৃষ্টি করে।
এবার আসে প্রযুক্তির প্রসঙ্গ। স্বনির্ভরতা অর্জনের পথে যে কোনও দেশকেই নিজেদের প্রযুক্তিগত উন্নতিসাধনের কাজকে এগিয়ে নিয়ে যেতে হয়। কেউ কেউ ভাবেন মহাকাশ গবেষণার মতো বিষয়ই বোধহয় প্রযুক্তিগত উন্নতিসাধনের একমাত্র বিবেচ্য। বিষয়টি তেমন না, এর পরিসর আরও বিস্তৃত। খাদ্যের মতো আরও কিছু অতীব জরুরী সামগ্রীর ক্ষেত্রেও একইধরনের সতর্কতা অবলম্বন করতে হয়, আর সে জন্যই মহাকাশ গবেষণার পাশাপ্সহি সংশ্লিষ্ট অন্যান্য ক্ষেত্রগুলিতে ব্যবহৃত বিজ্ঞান ও প্রযুক্তিগত উপায়সমূহের ক্ষেত্রে সার্বভৌম অবস্থান বজায় রাখা একান্তই জরুরী হয়ে পড়ে। এমন সার্বভৌম অবস্থান অর্জনে অনেক কিছুই জড়িয়ে থাকে। আমি কয়েকটি গুরুত্বপূর্ণ অংশের কথাই আলোচনা করব। বিজ্ঞান-প্রযুক্তির জরুরী উদ্ভাবন, উন্নতিসাধনের জন্যই প্রয়োজন নিজেদের জন্য উপযোগী শিক্ষানীতির। মোদী সরকারের আমলে দেশের সরকারী এমনকি বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়গুলিকেও আক্রমণের মুখোমুখি দাঁড়াতে হচ্ছে। একদিকে জওহরলাল নেহরু বিশ্ববিদ্যালয়ের উদাহরণ যেমন রয়েছে, তেমনই আমরা অশোকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ঘটনাও জেনেছি। শিক্ষাক্ষেত্রে বহুদিন যাবত একটি ভুল ধারণার প্রচলন রয়েছে। বিদেশের নামি-দামি বিশ্ববিদ্যালয়গুলিকে (অক্সফোর্ড, কেমব্রিজ এবং ঐরকম আরও যত বিশ্ববিদ্যালয় আকাদেমিক পরিসরে প্রিমিয়ার ইন্সটিটিউট হিসাবে পরিচিত) এদেশে ক্যাম্পাস খুলতে দিলেই যেন আমাদের দেশে শিক্ষার মানে ব্যাপক অগ্রগতি ঘটবে- এ হল তেমনই একটি ভ্রান্ত ধারণা। এই প্রসঙ্গেই সরকারী শিক্ষানীতির বিষয়টি আলোচনা করতে হবে। একটা বিশ্ববিদ্যালয় তো শুধু কতগুলি বাড়ির সমাবেশ নয় যেখানে পড়ানো হয়, এই কাজ তো কোচিং সেন্টারেও হয়। বিশ্ববিদ্যালয় এমন একটা প্রতিষ্ঠান, একটা পরিসর যেখানে ভাবনাকে মূল্য দেওয়া হয়, ভাবনার বিকাশ হয়,মূল্যবোধ গড়ে ওঠে। বিশেষত তৃতীয় বিশ্বের সমাজে এরকম স্থান তৈরী করা খুবই কঠিন। ভারতের কৃতিত্ব যে ভারতে এমন অনেকগুলি প্রতিষ্ঠান রয়েছে, এবং এই কৃতিত্বের একটা বড় কারণ এদেশের বিশাল ভৌগলিক আকার। আমাদের প্রতিবেশী দেশের শিক্ষাবিদরা সর্বদা আক্ষেপ করেন যে তাদের দেশে এইপ্রকার শিক্ষার পরিবেশ তৈরী করার পরিকাঠামো নেই। ভারতের ক্ষেত্রে আরো একটি গুরুত্বপূর্ণ বিষয় ছিল যে, সকলে একই ধারার চিন্তার অধিকারী হোন বা না হোন, তারা প্রত্যেকেই অন্যান্য ধারার চিন্তার প্রতি শ্রদ্ধাশীল ছিলেন।
যারা ফ্যাসিস্টিক বা স্বৈরাচারী তারা নিজেরা গুরুত্বপূর্ণ কোনো ভাবনাকে পোষণ করতে পারে না, এমনকী এইধরণের কোনো ভাবনাকে তারা শ্রদ্ধাও করতে পারে না, সুতরাং এতে অবাক হওয়ার কিছু নেই যে বিজেপি এই মুক্ত চিন্তার শিক্ষাঙ্গনগুলিকে পরিকল্পিতভাবে ধ্বংস করছে, এবং আগামী দিনে আমাদের দেশের জন্য তা এক অপূরণীয় ক্ষতিতে রূপান্তরিত হতে চলেছে।