Science and Materialism

Science, Philosophy (and Politics?) – Evidence to Ancient India (Part- I)

প্রাককথন

ভারতে বিজ্ঞান চর্চার ঐতিহ্য অবশ্যই প্রাচীন।

দার্শনিক বিশ্বদৃষ্টিভঙ্গীও একইরকম পুরানো।

কিন্তু ইতিহাসের এক নির্দিষ্ট পর্যায়ে পৌঁছে এই উপমহাদেশে বিজ্ঞান চর্চায় যেন কিছুটা ছেদ পড়ে, প্রায় একইসময়ে প্রসারিত হতে থাকে মায়াবাদের দর্শন।

আজকের ভারতে অতীত ভারতবর্ষের ঐতিহ্য পুনরুদ্ধারের নামে যা কিছু চলছে তার শিকড় রয়েছে আধিপত্যকামী রাজনৈতিক কর্মসূচিতে। এ এক এমন ধারণা যা বহুর সাধারণ পরিচিতির জোরে অল্পের উপরে নির্লজ্জ্ব আধিপত্য চাপিয়ে দিতে চায়। শুধু তাই না সেই গাজোয়ারির পক্ষে যুক্তির অজুহাতে বহুবিধ অপবিজ্ঞান, অবিজ্ঞান ও সংকীর্ণ সাম্প্রদায়িক দৃষ্টিভঙ্গীকেই সত্য বলে চালিয়ে দিতে চায়।

এই আবহে বস্তুনিষ্ঠ, প্রকৃত বিজ্ঞান চেতনার প্রসার ঘটানো বিশেষ প্রয়োজন। এই কাজ কেবল সমাজ জীবনের প্রয়োজন তাই নয়, একান্ত জরুরী রাজনৈতিক কর্মসূচি।

সেই রাজনীতির মূল কথা আঁধার চিরে চারপাশে আলো টেনে আনা।

আমরা যেন মনে রাখি, গোটা পৃথিবীর উপরে মানুষের বিজয় সম্ভব হয়েছিল কেবল এই জন্য না যে তারা শ্রেষ্ঠ প্রাণী , বরং এই কারণেই যে মানুষ প্রথমে কৌম, পরে যুথবদ্ধ ও সবশেষে যৌথ জীবন যাপনকে সমাজে রূপান্তরিত করেছিল। সেই সমাজব্যবস্থার গোড়ার কথা একটাই, অনেকে মিলে এক। কেবলমাত্র একের জোরে ব্যাপারটা আদৌ ঘটেনি।

এমনটা কেন ঘটল সেই প্রসঙ্গে ভারতীয় বিজ্ঞান চর্চার ইতিহাসে যাদের আচার্য্য বলা হয় তাদেরই অন্যতম ডক্টর প্রফুল্লচন্দ্র রায়ের নিজস্ব ব্যখ্যা রয়েছে। একসময় বিজ্ঞানী ডক্টর মেঘনাদ সাহাও ভারতীয় দর্শনের ভাববাদী ধারার বস্তুনিষ্ঠ সমালোচনা লেখেন। ভারতের ইতিহাস প্রসঙ্গে বিজ্ঞানসম্মত চর্চায় দামোদর ধর্মানন্দ কোশাম্বি, দার্শনিক উপলব্ধির অনুসন্ধানে রাহুল সাংকৃত্যায়ন প্রমুখেরা বস্তুনিষ্ঠ ও কার্যকরী ভুমিকা পালন করেছেন। প্রাচীন ভারতের দর্শন ও বস্তুবাদের দেশীয় উৎস অনুসন্ধানে ভারতের কমিউনিস্ট আন্দোলনের দুই প্রাজ্ঞ নেতৃত্ব হীরেন্দ্রনাথ মুখোপাধ্যায় ও ই এম এস নাম্বুদিরিপাদ’দের পাশাপাশি দার্শনিক, অধ্যাপক দেবীপ্রসাদ চট্টপাধ্যায়’রাও আজকের প্রজন্মের জন্য অনেক কিছুই রেখে গেছেন।

রাজ্য ওয়েবডেস্কের তরফে আমাদের প্রাথমিক পরিকল্পনা ছিল সেই ইতিহাস, সেই ঐতিহ্যের সাথে আজকের প্রজন্মকে কাছাকাছি নিয়ে আসতে ধারাবাহিক কিছু লেখা প্রকাশ করার।

সেই উদ্দেশ্যেই আমরা যোগাযোগ করি শ্যামাশীষ ঘোষের সাথে। আগে শিবপুর বি ই কলেজ (আজকের আই আই ই এস টি) থেকে মেকানিকাল ইঞ্জিনিয়ারিং’র ছাত্র ছিলেন। মূল পড়াশোনার পাশাপশি এক লম্বা সময় তিনি ভারতে বস্তুবাদ ও বিজ্ঞান চর্চার ইতিহাস প্রসঙ্গে বিভিন্ন বইপত্র ইত্যাদি নাড়াচাড়া করেছেন, এখনও করছেন।

ছোট ও বড়দের জন্য বিজ্ঞান, প্রযুক্তি ও ইতিহাসকে জনপ্রিয় করার কাজেও তার কিছু অভিজ্ঞতা রয়েছে।

সেই অভিজ্ঞতা ও আজকের পরিপ্রেক্ষিতে যা কিছু আমাদের বারংবার মনে রাখার, অন্যদের মনে করিয়ে দেওয়ার দরকার এ দুয়ের ফলাফল এই আলোচনা।

সেই ধারাবাহিকেরই আজ প্রথম পর্ব।

প্রথম পর্ব – শুরুর কথা 

শ্যামাশীষ ঘোষ 

এইরকম একটি বিষয় নিয়ে লেখার উদ্যোগ কেন? হিন্দুত্ববাদী রাজনীতি এখন প্রাচীন ভারতের সবকিছুকে একটা ‘গৌরবময় অতীত’-এর তকমা পরিয়ে রাজনীতির মঞ্চে এনে ফেলেছে – একটি জাতীয়তাবাদ, বিশেষত হিন্দু জাতীয়তাবাদের একটি প্রকল্প। অন্যান্য বিষয়ে আলোচনা বাদ দিয়ে, আমরা যদি কেবল শিক্ষা জগতের কথাই ভাবি, তাহলে দেখবো সেখানে এই ভাবনার অনুপ্রবেশ ঘটা শুরু হয়েছিল বেশ কিছুকাল আগেই। সেই প্রচেষ্টা তাঁরা চালিয়ে যাচ্ছে একনিষ্ঠতার সাথে। সাম্প্রতিক সময়ে প্রকাশিত জাতীয় শিক্ষানীতিতেও আমরা দেখতে পাচ্ছি ‘প্রাচীন এবং শাশ্বত জ্ঞান ও চিন্তার ঐতিহ্য’ ইত্যাদি শিক্ষানীতির লক্ষ্য হিসাবে ঘোষিত হয়েছে। বলা হচ্ছে, ‘ভারতীয় শিক্ষাব্যবস্থা চরক, সুশ্রুত, আর্যভট্ট, বরাহমিহির, ভাস্করাচার্য, ব্রহ্মগুপ্ত, চাণক্য, চক্রপাণি, মাধব, পাণিনি, পতঞ্জলি, নাগার্জুন, গৌতম, পিংলা, শঙ্কর, মৈত্রেয়ী, গার্গী এবং থিরুভাল্লুরস, অন্যান্যদের মতো মহান পণ্ডিতদের জন্ম দিয়েছে, যাঁরা গণিত, জ্যোতির্বিদ্যা, ধাতুবিদ্যা, চিকিৎসাবিজ্ঞান এবং সার্জারি, সিভিল ইঞ্জিনিয়ারিং, স্থাপত্য, জাহাজ নির্মাণ এবং ন্যাভিগেশন, যোগ, চারুকলা, দাবা এবং আরো অনেক কিছুতে বিশ্বজ্ঞানের ক্ষেত্রে গুরুত্বপূর্ণ অবদান রেখেছেন।’ আরো বলা হচ্ছে, ‘ভারতীয় সংস্কৃতি এবং দর্শন বিশ্বের উপর একটি শক্তিশালী প্রভাব ফেলেছে। বিশ্ব ঐতিহ্যের এই সমৃদ্ধ উত্তরাধিকারগুলিকে শুধুমাত্র উত্তরসূরীদের জন্য লালন-পালন ও সংরক্ষণ করা নয় বরং আমাদের শিক্ষাব্যবস্থার মাধ্যমে গবেষণা, প্রসারণ এবং নতুন ব্যবহারে লাগাতে হবে।’ নতুন শিক্ষানীতির নানা প্রসঙ্গে আমাদের তথাকথিত ‘গৌরবময় অতীত’ শোভা পাচ্ছে। অথচ, প্রাচীন ভারতের জ্ঞানচর্চা সম্পর্কে কিছু মানুষ হেলাফেলার মনোভাব দেখান, কেউ উদাসীনতা, আবার কেউ ‘বেদেই সবকিছু আছে’তে বিশ্বাসী। এই হেলাফেলা বা উদাসীনতা বা অন্ধবিশ্বাস, এই সবকিছুর পর্দা সরিয়ে প্রাচীন ভারতে জ্ঞানচর্চার একটা সাধারণ উপলব্ধি, আজকের সময়ে সত্যিই প্রয়োজন। 

যা বোঝা দরকার, প্রাচীন ভারতের – এবং সেই অর্থে, যেকোনও মহান প্রাচীন সভ্যতার – ভিতরে গর্ব করার মতো উপাদান অবশ্যই ছিল এবং সেগুলি উপেক্ষণীয় নয়। সেই প্রাচীন সময়ের মানুষের প্রকৃতিকে জানার প্রচেষ্টা, অনেক সংশয়, অজস্র প্রশ্ন, নানা অনুমান অবশ্যই এক আকর্ষণীয় পাঠ্য। প্রাচীন মানুষ প্রকৃতির মধ্যে থেকে তাঁদের জীবনযাপনের রসদ সংগ্রহ করার তাগিদে নানা কৌশল উদ্ভাবন করেছে, যা থেকে মধ্যযুগ হয়ে আধুনিক যুগের বিজ্ঞান অনেক রসদ সংগ্রহ করেছে, বিকশিত হয়েছে। সেই সময়ের দার্শনিক চিন্তাধারার মধ্যে আমরা বস্তুবাদী দর্শনের অঙ্কুর দেখতে পাই। বিশেষ করে চিকিৎসা বিজ্ঞানে বস্তুবাদী ভাবনা উল্লেখযোগ্য। তবে, আধুনিক বিজ্ঞানের নানা আবিষ্কার সব প্রাচীনকালেই হয়েছিল বলে যে বাদ্য বাজছে, তা সম্ভব ছিল না সমাজের সেই বাস্তবতায়। আমাদের কাছে তা পরিষ্কার হওয়া প্রয়োজন।  

অধ্যাপক মেঘনাদ সাহার একটি বক্তব্য ‘সবই ব্যাদে আছে’ ঘিরে কিছু ভুল বোঝাবুঝি ছিল। উনি এই বক্তব্যের প্রসঙ্গটি নিয়ে বিস্তারে আলোচনা করেছিলেন তাঁর “আধুনিক বিজ্ঞান ও হিন্দুধর্ম” প্রবন্ধে। অনেক পুরনো কাহিনী। মেঘনাদ সাহা সদ্য বিদেশ থেকে ফিরেছেন। ঢাকা শহরনিবাসী জনৈক লব্ধ প্রতিষ্ঠ উকিল তাঁর মৌলিক গবেষণা ‘মৌলের আয়োনাইজেশন-এর তত্ত্ব’ নিয়ে জানতে চেয়েছিলেন। অধ্যাপক সাহা উৎসাহ নিয়ে তাঁকে বলা শুরু করার পর থেকেই সেই উকিল তাঁকে বলতে শুরু করেন: ‘এ আর নূতন কি হইল, এ সমস্তই ব্যাদে আছে।’ বার বার এরকম হতে কিছুটা বিরক্ত হয়ে মেঘনাদ তাঁকে প্রশ্ন করেন, ‘মহাশয়, এসব তত্ত্ব বেদের কোন অংশে আছে, অনুগ্রহপূর্বক দেখাইয়া দিবেন কি?’ তিনি উত্তরে বলেন, ‘আমি ত কখনও ‘ব্যাদ’ পড়ি নাই, কিন্তু আমার বিশ্বাস, তোমরা নূতন বিজ্ঞানে যাহা করিয়াছ বলিয়া দাবী কর সমস্তই ‘ব্যাদে’ আছে।’ ওনার উক্তির প্রসঙ্গ এটিই। অনেকে ধরে নিয়েছেন যে উনি ‘বেদের’ প্রতি অযথা অবজ্ঞা প্রকাশ করেছেন। কিন্তু এই ধারণা ঠিক নয়। “সবই ব্যাদে আছে” এই উক্তিতে তিনি বেদের প্রতি কোনও রূপ অবজ্ঞা প্রকাশ করেননি। 

মেঘনাদ সাহা ব্যাখ্যা করেন, ‘বিগত কুড়ি বৎসরে বেদ, উপনিষদ, পুরাণ ইত্যাদি সমস্ত হিন্দুশাস্ত্র গ্রন্থ এবং হিন্দু জ্যোতিষ ও অপরাপর বিজ্ঞান সম্বন্ধীয় প্রাচীন গ্রন্থাদি তন্ন তন্ন করিয়া খুঁজিয়া আমি কোথাও আবিষ্কার করিতে সক্ষম হই নাই যে, এই সমস্ত প্রাচীন গ্রন্থে বর্তমান বিজ্ঞানের মূলতত্ত্ব নিহিত আছে। সকল প্রাচীন সভ্যদেশের পণ্ডিতগণই বিশ্বজগতে পৃথিবীর স্থান, চন্দ্র, সূর্য, গ্রহাদির গতি, রসায়ন বিদ্যা, প্রাণী বিদ্যা ইত্যাদি সম্বন্ধে নানারূপ কথা বলিয়া গিয়াছেন, কিন্তু তা সত্ত্বেও বাস্তবিক পক্ষে বর্তমান বিজ্ঞান গত তিনশত বৎসরের মধ্যে ইউরোপীয় পণ্ডিতগণের সমবেত গবেষণা, বিচারশক্তি ও অধ্যবসায় প্রসূত। এ দেশে অনেকে মনে করেন, ভাস্করাচার্য একাদশ শতাব্দীতে অতি অস্পষ্টভাবে মাধ্যাকর্ষণ শক্তির উল্লেখ করিয়া গিয়াছেন সুতরাং তিনি নিউটনের সমতুল্য। অর্থাৎ নিউটন আর নূতন কি করিয়াছেন? কিন্তু এই সমস্ত ‘অল্পবিদ্যা ভয়ঙ্করী’ শ্রেণীর তার্কিকগণ ভুলিয়া যান যে, ভাস্করাচার্য কোথাও পৃথিবী অপরাপর গ্রহ, সূর্যের চতুর্দিকে বৃত্তাভাস (elliptical) পথে ভ্রমণ করিতেছে, এ কথা বলেন নাই। তিনি কোথাও প্রমাণ করেন নাই যে, মাধ্যাকর্ষণ শক্তি ও গতিবিদ্যার নিয়ম প্রয়োগ করিলে পৃথিবীর ও অপরাপর গ্রহের ভ্রমণকক্ষ নিরূপণ করা যায়। সুতরাং, ভাস্করাচার্য বা কোন হিন্দু, গ্রীক বা আরবী কেপলার-গ্যালিলিও বা নিউটনের বহুপূর্বেই মাধ্যাকর্ষণতত্ত্ব আবিষ্কার করিয়াছেন, এরূপ উক্তি করা পাগলের প্রলাপ বই আর কিছুই নহে। দুঃখের বিষয় দেশে এইরূপ অপবিজ্ঞান প্রচারকের অভাব নাই, তাঁহারা সত্যের নামে নির্জলা মিথ্যার প্রচার করিতেছেন মাত্র।’ 

মেঘনাদ সাহা একটি উল্লেখযোগ্য বিষয়ের দিকে দৃষ্টি আকর্ষণ করেছেন যে বেদের বিভিন্ন অংশ অতি প্রাচীনকালে বিভিন্ন সময়ে রচিত হয়েছে। এই সমস্ত বিষয়ের জ্ঞানের প্রেক্ষাপট জানা না থাকলে প্রকৃত অর্থ বোঝা দুঃসাধ্য এবং পরবর্তীকালে কষ্টকল্পনার সাহায্য নিতে হয়। তিনি বৈজ্ঞানিকের নিরপেক্ষ দৃষ্টিতে হিন্দুর বেদ ও অপরাপর ধর্মের মূলতত্ত্ব বুঝতে চেষ্টা করেছেন। তাঁর বিশ্বাস যে, প্রাচীন ধর্মগ্রন্থসমূহ যে সমস্ত জাগতিক তথ্য, ঐতিহাসিক জ্ঞান ও মানবচরিত্রের অভিজ্ঞতার উপর প্রতিষ্ঠিত, তার উপর দাঁড়িয়ে বর্তমান যুগের উপযোগী চেতনা প্রতিষ্ঠিত হতে পারে না। বৈজ্ঞানিক মনোবৃত্তির ভিত্তিতে নবযুগের উপযোগী ‘আধ্যাত্মিকতা’র প্রতিষ্ঠা করার প্রচেষ্টা দরকার বলে অধ্যাপক সাহা মন্তব্য করেছেন।  

বিজেপি ২০১৪ সালে ক্ষমতায় আসার পর থেকে এই ‘সব ব্যাদে আছে’ তত্ত্বর খুব রমরমা চোখে পড়ছে। আমাদের প্রাচীন ইতিহাসকে কাটছাঁট করে, একটা গৌরবময় হিন্দু ইতিহাস (বা, এর আড়ালে ব্রাহ্মন্যবাদের ইতিহাস) বানিয়ে তোলার চেষ্টা চলছে। নিউটনের আবিষ্কার, অর্গান ট্রান্সপ্লান্টেশন (প্রমাণ গণেশ) বা এইরকম হরেক আজগুবি কৃতিত্ব সেই প্রাচীন হিন্দু ভারতের কব্জায় চলে যাচ্ছে। খোদ বিশ্ব বিজ্ঞান কংগ্রেসও বাঁচতে পারছেনা এর হাত থেকে। বিজেপি আগেরবার যখন ক্ষমতায় এসেছিল, তখন বিশ্ববিদ্যালয়গুলিতে জ্যোতিষ-‘বিজ্ঞান’-কে আলাদা ডিসিপ্লিন হিসেবে চালু করে দেওয়ার ব্যবস্থা প্রায় পাকা হয়ে গিয়েছিল। অনেক বিজ্ঞানী প্রতিবাদ করেছিলেন। তবুও বিজেপি আবার ক্ষমতায় এসেছে। এই কল্প-ভাবনা কি এখন আমাদের মননের দখল নিচ্ছে? 

প্রশ্নটা শুধু সরকার বা বিজেপি-র আচরণ নিয়ে নয়। বিজেপি ক্ষমতায় না থাকলেও, এই-ভাবনা থেকে কি নিস্তার পাওয়া যাবে, এত সহজে? দেশের এক ব্যাপক অংশের, এমনকী বহু বিজ্ঞানীরও, মনের কথাটা কি ওরই কাছাকাছি নয়? সবই বেদে থাকার ট্র্যাডিশনটা তো আধুনিক হিন্দু-চৈতন্যে অজর, অক্ষর। আর বিজ্ঞান পঠন-পাঠনে যৌক্তিক বিবর্তন শেখার তত্ত্বগুলি (ডারউইন, পর্যায় সারণি ইত্যাদি) যদি পাঠক্রম থেকে সরিয়ে নেওয়া হয়, তাহলে তো অর্ধেক কাজ হাসিল। শিক্ষাব্যবস্থায় একটা ডামাডোল সৃষ্টি করে যদি একটা বড় সংখ্যার মানুষকে শিক্ষার আঙিনা থেকে বার করে দেওয়া যায়, যদি সুকৌশলে আর এস এস পরিচালিত স্কুলগুলিতে ছাত্রছাত্রীদের মগজ ধোলাই করা যায়, তাহলে ভবিষ্যতের নাগরিকেরা তো এই ভাবনাতেই অভ্যস্ত হয়ে পড়বে। শিক্ষকসমাজ-সহ অনেকেই আজ রাস্তায় নেমে জাতীয় শিক্ষানীতি বাতিল করার, ছাত্রছাত্রীদের সরকারি অবৈতনিক বিদ্যালয়ে উচ্চ মানের শিক্ষাদানের দাবি তুলছেন। তাঁরা ভেবে দেখতে পারেন, রাস্তার আন্দোলনের সাথেসাথেই শিশু-কিশোরের মননে শিক্ষার সঙ্গে সমাজের সম্পর্ক ব্যাখ্যা করে ছোট বয়স থেকেই একটা সমাজ সচেতনতা তৈরির কাজ শুরু করার কাজটিও দরকারি কিনা। শিক্ষার বিষয়টি যেহেতু অভিভাবকদেরও স্বার্থের সঙ্গে সম্পৃক্ত, তাঁদেরও সচেতন করার কাজটা বড়ই জরুরী। রাস্তার আন্দোলন অবশ্যই দরকার। পাশাপাশি দরকার ধারাবাহিকভাবে এই সামাজিক চেতনা গড়ার কাজ। সরকারে যে দলই থাকুক, এই কাজটি চালিয়ে নিয়ে যাওয়া ভীষণ দরকারি।     

অধ্যাপক আশীষ লাহিড়ীর কথায়:  

‘খোদ বিদ্যাসাগর মশাই ১৮৫৩ সালেই লক্ষ করেছিলেন যে, ‘ভারতের পণ্ডিত সম্প্রদায়’-এর কাছে বৈজ্ঞানিক সত্যটা গৌণ, এমনকী অদরকারি; দরকারি হল সেই সত্যের সঙ্গে হিন্দুশাস্ত্রের কোনও ধারণার প্রকৃত অথবা কল্পিত মিলটা। অক্ষয় দত্ত তো সারা জীবন এর বিরুদ্ধে লড়াই করতে গিয়ে নিজেকে একঘরে করে তুলেছিলেন। তাতে কারও কিছু এসে যায়নি। নইলে বিবেকানন্দ কেন বলবেন যে, নিউটনের জন্মের এক হাজার বছর আগেই হিন্দুরা মাধ্যাকর্ষণ তত্ত্ব আবিষ্কার করে ফেলেছিল? বিবেকানন্দর প্রায় সমবয়সী মহাবিদ্বান যোগেশচন্দ্র রায় বিদ্যানিধি এর প্রতিবাদ করে বলেছিলেন, ‘কোনো কোনো অল্পজ্ঞ ব্যক্তি ভাস্করাচার্যের উক্তি দর্শাইয়া নিউটনের গুরুত্ব খর্ব করিয়া থাকেন। তাহাদের জানা আবশ্যক, উভয়ের মধ্যে আকাশ পাতাল অন্তর।’ মেঘনাদ সাহা স্বভাবসিদ্ধ তীব্র ভাষায় লিখেছিলেন। এতেও আমাদের নিরেট চৈতন্যে কোনও আঁচড় পড়েনি। নইলে হিগ্স-বোসন কণা ‘আবিষ্কার’-এর পর দেশের উচ্চশিক্ষিত মহল কেন বলবেন যে এতদ্দ্বারা প্রাচীন ভারতের আবিষ্কৃত বৈদান্তিক সত্য প্রমাণিত হইল?’ 

‘১৯৬১ সালে রবীন্দ্রনাথের বিজ্ঞানচেতনা নিয়ে আলোচনা করতে গিয়ে পরিমল গোস্বামী লিখেছিলেন, ‘প্রাচীন ভারতে সবই ছিল এই গ্রাম্য বিশ্বাস, বিজ্ঞানবার্তা এদেশে প্রবেশের পর থেকে অনেক লেখাপড়া-জানা লোকের মধ্যে দেখা দিয়েছিল।… প্রমাণহীন যুক্তির সাহায্যে এ কথা বহু বার বলা হয়েছে যে আধুনিক ইউরোপীয় বিজ্ঞান, আসলে প্রাচীন ভারতীয় বিজ্ঞানের সামান্য একটু অংশের উদ্ধার মাত্র। আমার ধারণা আধুনিক বিজ্ঞানকে পূর্ণ শ্রদ্ধার সঙ্গে বাংলা দেশে প্রথম গ্রহণ করেন সর্বসংস্কারমুক্ত অক্ষয়কুমার দত্ত। কিন্তু তাঁর একক প্রচারের সাধ্য কি নবোদ্গত অহমিকার বিরুদ্ধে যুক্তিসিদ্ধ মতের প্রতিষ্ঠা করে। মিথ্যা অহমিকার আস্ফালন রবীন্দ্রনাথের সময়ে প্রবলতর হয়েছিল’ – এবং তার বিরুদ্ধে রবীন্দ্রনাথ ‘ব্যঙ্গাস্ত্র’ হাতে অবতীর্ণ হয়েছিলেন। হেমন্তবালা দেবীকে লেখা অমর পত্রগুচ্ছে রবীন্দ্রনাথ তীব্র ভাষায় চাবকেছিলেন এই মূঢ়তাকে। সেই তিরস্কারেও আমাদের কিছু এসে যায়নি। কোনও কিছুতেই আমাদের কিছু আসে যায় না।’ 

জোতিরাও ফুলে কত আগে ব্রাহ্মণদের আচারগুলোর আসল রূপ প্রকাশ করে দিয়েছিলেন। তবুও ফুলে-র হুঁশিয়ারির শতাধিক বছর পরে ওই মহারাষ্ট্রেই ব্রাহ্মণ্যবাদী শক্তির হাতে প্রাণ দিলেন যুক্তিবাদী জনসেবী চিকিৎসক নরেন্দ্র দাভোলকর। কিছু প্রান্তবাসী বিজ্ঞানকর্মী ছাড়া তেমন করে আগুন জ্বলেনি আমাদের হৃদয়ে।  

সব ধর্মেই এইরকম অযুক্তিবাদের ছড়াছড়ি। 

কাজেই, বিজেপি-র কাজ দেখে ভীষণ মর্মাহত হওয়ার ভান করবার আগে, আমাদের নিজেদের চোখের ঠুলি খোলা দরকার, বলেই আশীষবাবু তাঁর সংক্ষিপ্ত আলোচনাটি শেষ করেছিলেন। 

আনন্দবাজার পত্রিকা অনলাইনে প্রকাশিত হয়েছে একটি প্রতিবেদন, “কাক বললেন, প্রায় সবই ব্যাদে আছে”। কে এই বিজ্ঞানী? আমেরিকায় ওকলাহোমা স্টেট ইউনিভার্সিটির অধ্যাপক সুভাষ কাক। প্রতিবেদনটি লিখেছেন পথিক গুহ। কলকাতার বসু বিজ্ঞান মন্দিরের অনুষ্ঠানটি ছিল ৮১ তম আচার্য জগদীশচন্দ্র বসু স্মৃতি বক্তৃতা – বুঝুন এই অপবিজ্ঞানের বীজ কতো গভীরে। সেখানেও সেই বস্তুত প্রায় সবই বেদে আছে এই দাবি রাখলেন আমেরিকায় অধ্যাপনারত এই ভারতীয় বংশোদ্ভূত বিজ্ঞানী। ২০১৯ সালে পদ্মশ্রী সম্মানে ভূষিত এই বিশেষজ্ঞ ভারতে প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদীর সায়েন্স, টেকনোলজি অ্যান্ড ইনোভেশন অ্যাডভাইসরি কাউন্সিলের অন্যতম সদস্য। কম্পিউটার চলে যে যুক্তি নির্ভর করে, তার জন্ম নাকি ভারতে; একে তিনি ‘চেতনা’য় এবং তার সাথে বেদান্ত দর্শনে নিয়ে গেছেন; বিনা তারে যোগাযোগও নাকি বেদান্ত দর্শন থেকেই ধার করা! কাক এর মতে নব্য ন্যায় দর্শন-এ বিবৃত যুক্তিশাস্ত্রই নাকি কম্পিউটারের যুক্তির ভিত্তি। নব্য ন্যায় দর্শনে বিধৃত গাণিতিক যুক্তিই কম্পিউটার বিজ্ঞানের ভিত।  

অধ্যাপক কাক ২০১৬ সালে স্বরাজ্য পত্রিকাতে লিখেছেন তাঁর প্রবন্ধ “The Connection Between Vivekananda, Tesla, And The Akashic Field”। তাঁর আনুগত্য কোন দিকে তা স্পষ্ট। প্রযুক্তিবিদ টেসলা বিবেকানন্দকে বলেছিলেন, তিনি পদার্থ এবং শক্তির সমতা প্রমাণ করে ছাড়বেন, যদিও তিনি সেই সমতা প্রমাণ করতে পারেননি। এর কিছুকাল পরে আলবার্ট আইনস্টাইনের E=mc2 সমীকরণ উদ্ভূত হয়। এখানে কাক উল্লেখ করছেন যে টেসলা বেদের ‘প্রাণ’, ‘আকাশ’ এবং ‘কল্প’ প্রসঙ্গে জেনে মুগ্ধ হয়েছিলেন। তিনি ভেবেছিলেন যে তিনি গাণিতিকভাবে শক্তি এবং পদার্থের স্থিতিশক্তিতে রূপান্তরযোগ্যতা দেখাতে সক্ষম। তার ফলে বৈদান্তিক সৃষ্টিতত্ত্ব নাকি একটা নিশ্চিত ভিত্তি পাবে। তিনি এই বৈদান্তিক সৃষ্টিতত্ত্ব এবং আধুনিক বিজ্ঞানের একটি নির্ভুল যোগ দেখতে পাচ্ছিলেন, যেখানে একটির ব্যাখ্যা অন্যটির অনুসরণ করবে। 

বসু বিজ্ঞান মন্দিরে কাক-এর বক্তৃতার শিরোনাম ছিল ‘কম্পিউটেশন, ইন্ডিয়ান সায়েন্টিফিক ট্র্যাডিশন অ্যান্ড আর্টিফিশিয়াল ইন্টেলিজেন্স’। কাক বেদান্ত দর্শনে মন কি বস্তু, সে প্রসঙ্গের আলোচনায় বলেন, কোয়ান্টাম মেকানিক্সের পুরোধা পুরুষ নিলস বোর, হাইজ়েনবার্গ এবং শ্রয়ডিঙ্গারও বিশ্বাস করতেন যে বেদান্ত দর্শন এ সম্পর্কে যা বলেছে, তা ঠিক। কী বলেছে বেদান্ত দর্শন? বলেছে, চেতনা একক এবং স্বয়ংসম্পূর্ণ। তাকে আর কোনও কিছু দিয়ে ব্যাখা করা যায় না। চেতনা কি গাণিতিক? ধাপে ধাপে এগোয়? এই প্রসঙ্গে কাক ভারতীয় গণিতজ্ঞ শ্রীনিবাস রামানুজনের একটি দাবির উল্লেখ করেন যে, ওঁনার আবিষ্কৃত ফর্মুলাগুলো উনি স্বপ্নে তাঁর ইষ্টদেবতার কাছ থেকে পেয়েছেন।’  

এখন আর এস এস যদি একটি বড় সংখ্যায় তাদের প্রভাবিত বিদ্যালয়ে ছাত্রছাত্রী ও তাঁদের অভিভাবকদের মগজে অবিজ্ঞানের বীজ পুঁততে পারে, তাহলে বৈজ্ঞানিক মতবাদে বিশ্বাসী শিক্ষককুল কেন বিজ্ঞানের বীজ রোপন করতে পারবেন না, তাঁদের ছাত্রছাত্রীদের মধ্যে। এই লড়াইটি রাস্তার লড়াইয়ের মতো সোজাসাপটা নয়। অনেক ধৈর্য প্রয়োজন। অনেক গভীরে যাওয়া দরকার। সমাজের সাথে শিক্ষার সম্পর্ক বোঝা দরকার। সমাজ কীভাবে শিক্ষানীতির উপর প্রভাব ফেলে, আবার সেই শিক্ষা সমাজকে কীভাবে প্রভাবিত করে, এটা বোঝা দরকার।  

প্রধানত দেবীপ্রসাদ চট্টোপাধ্যায় এবং সুকুমারী ভট্টাচার্য – এঁদের দুজনের প্রাসঙ্গিক গবেষণামূলক লেখাগুলি ভারতের প্রাচীন সময়ে বেদ এবং অবৈদিক সূত্রগুলি থেকে সেই সময়কার মানুষের বস্তুবাদী এবং ভাববাদী দর্শনের সূত্রপাত, ভাববাদী দর্শনের প্রতি মানুষের সংশয়, বিজ্ঞান চেতনার অঙ্কুরোদ্গমের বিষয়গুলি বিস্তারে আলোচনা করেছে। এগুলি সেই সময়কে কিছুটা বুঝতে সাহায্য করে আমাদের। এই লেখা কোনো মৌলিক গবেষণার ফল নয়। বিভিন্ন রচনা, প্রবন্ধ ও অন্যান্য সুত্র মারফৎ প্রাপ্ত তথ্যের ভিত্তিতে একটি যুক্তিনির্ভর, সহজবোধ্য আলোচনা করাই এই প্রচেষ্টার একমাত্র উদ্দেশ্য। 

ওয়েবডেস্ক এর পক্ষে প্রাককথন : সৌভিক ঘোষ

Spread the word

Leave a Reply